এক রাজা, বেড়াতে বের হয়ে প্রজাদের অবস্থা দেখতেন। প্রজারা নানা উপহার দিয়ে রাজা-রানীকে সম্মান জানাচ্ছিলেন। এক বৃদ্ধ তার সাতটি পুত্র এনে রাজাকে বললেন-হে সত্যের প্রতিনিধি, আমার আর কিছু নেই–দেশ কল্যাণের জন্যে আমার এই সাত পুত্র উপহার দিচ্ছি।
রাজা বৃদ্ধকে বললেন–আপনার এই দানের চেয়ে আর কোনো দান শ্রেষ্ঠ হয় নি। আপনার এই শ্রেষ্ঠ উপহার আমি মাথা পেতে নিচ্ছি। সত্যের সেবকের কাছে সত্যের সৈনিকই শ্রেষ্ঠ উপহার।
যে পিতা দেশ কল্যাণের জন্য পুত্রগণকে দান করতে পারেন তিনিই শ্রেষ্ঠ পিতা। যাদের এমন পিতা পাবার ভাগ্য হয়েছে জীবন তাদের সার্থক। পিতার মঙ্গল উদ্দেশ্যের মুখে যদি জীবন বলি দেওয়া যায় তবে তার মতো পিতৃভক্তি আর নেই। হযরত ইব্রাহিম যখন বললেন, পুত্র, সত্য তোমাকে আহ্বান করছে। তোমার হৃদয় রক্ত দিয়ে সত্যের মর্যাদা রাখতে হবে। শিশু তখনই বললেন-বাপ, এতেই তো জীবনের সার্থক।
সত্যের জন্যে তোমার যা কিছু আছে সব উৎসর্গ করতে হবে। কারবালার মরুমাঠে তৃষ্ণায় এক এক করে মরতে হবে তথাপি অসত্যকে নমস্কার করতে পার না।
যে পিতা জীবনকে এমন করে সার্থক করে দেবার জন্যে আহ্বান করেন তিনি ধন্য। এস বিশ্বের সকল সন্তান তাঁকে সালাম করি।
পিতাকে ভক্তি করি কেন? তিনি আমার শরীরটাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন সেই জন্যে? মনুষ্যত্বকে অবমাননা করে, তার প্রাণপন চেষ্টায় জীবনকে সুখী করতে পেরেছি, এই জন্যে? আমি তার উপার্জিত অর্থে আরামের পথ নিরাপদ করতে পেরেছি এ জন্যে? না, না, না–সে জন্যে নয়। আমি চাই মনুষ্যত্বের প্রতিষ্ঠা, আমি চাই মানুষের সত্য জীবনের উদ্ধার, আমি চাই অবিচারের অবসান, আমি চাই দুঃখের অবসান। আমার সাধনাকে আমার পিতা তার স্বরে মনে করিয়ে দিয়েছেন। এ জীবন ব্যর্থ হবার নয়। আঁধার রাতে আমার পিতা আমার পাশে জীবনের মহাসঙ্গীত শুনিয়েছেন; আমি স্পন্দিত প্রাণে তার মুখের দিকে চেয়েছিলাম, তিনি আমার বুকে হাত দিয়ে বলেছিলেন, ভয় নেই। তুমি শক্তি,–এই আঁধার সাগর পাড়ি দিয়ে তোমাকে আলোকের রাজ্যে দাঁড়াতে হবে–তুমি অনন্ত, বিনাশ তোমার নেই; তুমি বিরাট–তুমি ছিলে তুমি আছ–তুমি থাকবে। আমার দেহ, মন, প্রাণ, রক্ত, সবগুলি তরল হয়ে পিতার চরণ সিক্ত করেছিল।
এমন পিতার বিদ্রোহী সন্তান হয়ে কি আমি নিজেকে হত্যা করতে পারি? তা হলে বিশ্বের সকল গান যে আজ থেমে যাবে আজ আকাশে বাতাসে কেবল ক্রন্দন জেগে উঠবে।
তুমি পিতাকে সন্দেশ রসগোল্লা খাওয়াও, মাতাকে বহুমূল্য পোশাক দাও, আজ্ঞা পালনের জন্যে নত মাথায় তাদের সামনে দাঁড়িয়ে থাক, এই দেখেই আমি তোমাকে পিতৃ মাতৃভক্ত বলতে পারবো না। আমি জিজ্ঞাসা করবো–তোমার স্বভাবে কলঙ্ক আছে কিনা? তুমি চরিত্রবান কিনা? মানুষ তোমার সৎগুণের কথা বলে কিনা? তোমার স্পর্শে এসে নরনারীকে বিপন্ন হতে হয় কিনা? মানব শিশুকে তুমি স্নেহ কর কিনা? যদি কোথাও উত্তর না পাই–আমি বলবো তুমি পিতৃ-মাতৃভক্ত নও–তুমি বিদ্রোহী অভাগা।
দৈনন্দিন জীবনে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাজে পিতামাতার স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি নজর রাখতে হবে–ভুল করে তা যেন কেউ মনে না করে।
এক ভদ্রলোক সবার মাঝে বলেছিলেন, আমি আমার সন্তানকে দেশের কাজে দান করলাম। সন্তানরা বন্ধু বান্ধবের কাছে বলেছিলেন–পিতার ইচ্ছায় আমরা আমাদের জীবন নষ্ট করতে পারি নে। এরা বৃদ্ধ পিতাকে যথেষ্ট সম্মান করতেন, তারা পিতার সর্বপ্রকার সুখের ব্যবস্থা করে দিতেন, তবু এদের পিতৃভক্ত বলতে আমার সংকোচ হয়। যে পুত্র পিতার জড়দেহের সেবা করেই তৃপ্তি লাভ করে তার ভক্তি নিকৃষ্ট। পিতার সত্য ও আত্মার বাণীতে যে সাড়া দেয়, ভক্তি পথে তার স্থান অনেক উচ্চে। পিতার আত্মার আদর্শকে অবমাননা করে যে তার দেহের সুখ দান করে সে কাপুরুষ; পিতার আশীর্বাদ পাবার উপযুক্ত সে নয়। লোকমুখে অনেক সময় শুনেছি, দরিদ্র পিতা পুত্রের সঙ্গে দেখা করতে গেলে পুত্র লজ্জা করে বন্ধুবান্ধবদের কাছে তার পরিচয় দিতে লজ্জা বোধ করেছেন। পিতা যদি দরিদ্র হন সে জন্য তো লজ্জার কিছু নেই। কার্লাইল সব সময়ই নিজেকে চাষার ছেলে বলে পরিচয় দিতে গৌরব বোধ করেছেন। এ জগতে বহু মহাপুরুষ জন্মেছেন, তাঁরা খুব দরিদ্রের ছেলে। আত্মশক্তিতে নিজের সাধনায় মানুষ বড় হয়। বাপের দারিদ্র্য তোমাকে ছোট করে না।
তুমি যদি ছোট লোকের ছেলে হতে তাতেও তোমার লজ্জার কোনো কারণ নেই। হীন চরিত্র পিতামাতার স্নেহ অনেক সময় মানুষকে নীচ ও ছোট করে রাখে। কিন্তু তোমার মধ্যে যে তোমার পূর্ব-পুরুষের নীচতা রয়েছে–সেকথা বলবার আগে আমাকে অনেকখানি ভেবে দেখতে হবে। হীন বংশে জন্মেছ বলেই যদি কেউ তোমাকে ছোট মনে করে, আমি তাকে ঘৃণা করি। ছোট লোকের ছেলে ছোট হয় কোনো সময়ে? যখন তার মধ্যে আত্মশুদ্ধির কোনো প্রচেষ্টা না থাকে, বিবেক যেখানে স্নেহের দানে দুর্বল হয়ে পড়ে, যেখানে একটা নিরর্থক দাম্ভিকতা বিদ্যমান থাকে, সেখানে অহঙ্কার নিজের ভুল বোঝবার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। যেখানে আত্মা নির্মল, শুদ্ধি সাধনায় সদাই সজাগ; মনুষ্যত্বের আহ্বান চঞ্চল, সেখানে কি আমি তোমায় ঘৃণা করতে পারি? যে সত্য সাধকের কুৎসা রচনা করে, তাকে দুর্বল করে ফেলতে চায়, তার নামায রোযা বৃথা। খোদার সঙ্গে যে আত্মীয়তা করেছে, হউক সে দাসীর ছেলে, তাকেই শ্রদ্ধা করতে হবে। খবরদার তাকে অসম্মান করো না।