সেদিন সনাতনের চরণ জড়িয়ে আসছে। তবুও হাঁটছিল। এক ব্রাহ্মণের বাড়ির দুয়ারে এসে সে ভিক্ষা চাইল। ব্রাহ্মণ বড় দয়ালু, কিন্তু তা হলে কী হয়? তার ঘরেও বেশি কিছু ছিল না। বালকের শীর্ণ চেহারা দেখে বললেন, বাবা আমরা যা বেঁধেছি তারই এক মুঠো তোমায় দিচ্ছি, কিন্তু এত অল্প অন্নতে তোমার কী হবে? সনাতন বলল–আমায় তাই দিন, তাই আমি নিয়ে যাব। ব্রাহ্মণ সনাতনকে বসতে বলে বাড়ির ভেতর থেকে কিছু ভাত এনে জিজ্ঞাসা করলেন–কোথায় বসে খাবে?
সনাতন বলে–আমি খাব না, সঙ্গে নিয়ে যাবো। ব্রাহ্মণ বললেন–সে কি? এত অল্প ভাত কোথায় নিয়ে যাবে? এখানে বসেই খাও। সনাতন বিনীতভাবে বলল না–মহাশয়, একমুঠো ভাত হলেও আমাকে বাড়ি নিয়ে যেতে হবে।
ব্রাহ্মণ বিস্মিত হয়ে কারণ জিজ্ঞাসা করলেন, বালক বলল–মা আমার তিন দিন না খেয়ে ঘরে পড়ে আছে। মায়ের কথা বলতে যেয়ে সনাতন কেঁদে ফেলো। ব্রাহ্মণ বালকের কথা শুনে নিতান্ত ব্যথিত হলেন। এবার তিনি কিছু বেশি করে ভাত আনতে গেলেন; কিন্তু ফিরে এসে দেখলেন দুর্বল শরীরে হঠাৎ মানসিক উত্তেজনায় সনাতন মাটিতে মূৰ্ছিত হয়ে পড়ে আছে। শরীরে তার প্রাণ নেই।
সনাতনের অতুলনীয় মাতৃভক্তি চিরকালই মানুষের ভক্তি-অশ্রু আকর্ষণ করবে।
পিতামাতা অনেক সময় ছেলেদের অবাধ্য বলে গালি দিয়ে থাকেন–ছেলে যদি অবাধ্য হয় তবে তার কারণ পিতামাতার জ্ঞানের অভাব। বুদ্ধিহীন সেনাধ্যক্ষ যেমন সৈন্যদেরকে চালনা না করতে পেরে নিজেদেরই অযোগ্যতার পরিচয় দিয়ে থাকেন, পিতামাতাও তেমনি অবাধ্য ছেলের নিন্দা করে নিজেদের হালকামির পরিচয় দেন। মানুষ সব জায়গাতেই মানুষ; অন্যায় রকমে আঘাত পেলেই সে ক্ষেপে উঠবে। কীরূপ ব্যবহার করলে ছেলেরা চরিত্রবান, বিনয়ী ও ভক্তিমান হয়ে উঠে, তা এখানে বলা কঠিন। একদিক হতে কোনো কালে ভক্তির উৎস বয় না। স্নেহ বিচক্ষণ ব্যবহার ও নিরন্তর সন্তানের মঙ্গল কামনা ছেলেমেয়েকে তাদের প্রতি বাধ্য করতে সক্ষম। শিশু ও ছেলে মেয়েরা বিচক্ষণ ঋষি নয়, মুরুব্বীদের সঙ্গে কিরূপ ব্যবহার করতে হবে, তা তারা জানে না। পিতার জন্যে যদি প্রাণ দিতে হয়, তা তারা চিন্তা ও যুক্তিতর্ক না করে দেবে। শিশু ও যুবকের মনকে যুক্তি দিয়ে বশ করতে যাওয়া বড়ই ভুল। ক্রুদ্ধ হলে ছেলেরা আল্লাহকে অপমান করতে ইতস্তত করে না, সে যে অবোধ।
অতিরিক্ত স্নেহে অনেক সময় পুত্র-কন্যাদের নৈতিক অধঃপতন হয়। লোকে বলে–চোরের পুত্র চোরই হয়ে থাকে। পিতামাতার স্নেহের শক্তি এত বেশি যে, তা ভেবে দেখলে অবাক হয়ে যেতে হয়। মানুষকে কঠিনভাবে আঘাত করলেও সে তার পিতা-মাতার সংসার ত্যাগ করতে পারে না। তাই অনেক সময় পিতা ও মাতার রূঢ় ও কঠিন ব্যবহার আশীর্বাদস্বরূপ মানব জীবনের সমূহ কল্যাণ করে থাকে।
পিতা কঠিন আঘাত করেছেন সন্তানকে তা কিন্তু নীরবে মেনে নিতে হবে। অসহ্য হলে দূরে সরে যেতে পার, তার সঙ্গে কলহ বিবাদ করা কাপুরুষতা। বিয়ে হলে পুত্রবধূর সঙ্গে কোনো কোনো স্থলে পিতার মিল হয় না, ফলে পুত্রের সঙ্গেও অনেকটা অপ্রীতিকর সম্বন্ধ এসে জোটে। বহু অপদার্থ মানুষ পিতৃভক্তির ভুল অর্থ বুঝে পিতার মনোরঞ্জনের জন্যে পত্নী ত্যাগ করে। এদের মতো পিতৃদ্রোহী আর নেই। পিতার ভিতর যে সত্য পিতা রয়েছে; তাকেই মানতে হবে। পিতার অসত্যকে বরণ করে অনেক পিতৃভক্ত সন্তান পিতার আদর লাভ করে, এরা সুখে জীবনযাত্রা নির্বাহ করলেও এদের মূল্য খুব কম। পুরুষের নিঃসহায় পত্নীর প্রতিও একটা কর্তব্য রয়েছে।
পিতামাতার অবস্থা যদি শোচনীয় হয়, অন্নাভাবে তারা যদি উপবাসী থাকেন, তা হলে তাদের জন্য সম্পদশালী ব্যক্তির অর্থ প্রয়োজনমত না বলে নিলে কোনো দোষ হয় না। কিন্তু তা যদি না হয় তবে পিতার অর্থ লালসা বা তার অসুখের জীবনযাপনের জন্যে তুমি অধর্ম করে পয়সা উপায় করতে পার কিনা। তাতে তোমার পিতা যদি তোমায় অভিশাপ দেন কোনো ক্ষতি নেই।
মেবারের রাজা মাড়বার রাজকন্যার সঙ্গে ছেলের বিয়ের সম্বন্ধ করেছিলেন। যখন কথা হচ্ছিল তখন রাজা রহস্য করে বলেছিলেন–আমার মতো বুড়োর হাতে কেউ মেয়ে দেবে না। এ রহস্যের মাঝে এতটুকু দুর্বলতা ছিল না। পুত্র সে কথা শুনে বললেন–”আমার বাপের সঙ্গেই রাজকন্যার বিয়ে হবে।
পুত্রের কথা শুনে রাজা ছেলেকে ডেকে বললেন–আমি বুড়ো হয়েছি, তোমাকেই এখন সংসারী হয়ে সব ভার নিতে হবে। পাগলের মতো এ কী কথা বলছ?
পুত্র বললেন–আমি এ মেয়েকে বিয়ে করতে পারবো না।
রাজা কিছু বিরক্ত হয়ে পুনরায় বললেন–দিন ঠিক হয়ে গিয়েছে। বিয়ে না করলে কী হবে, তা কি তুমি বুঝতে পারছ না।
পুত্র পুনরায় বললেন–আমার দ্বারা এ কাজ অসম্ভব। ক্রমে রাজা ভারি চিন্তিত হয়ে পড়লেন। এদিকে দিনও ঘনিয়ে আসছিল। রাজকন্যার নির্দিষ্ট দিনে বিয়ে হওয়া চাই, নইলে সর্বনাশ হবে। রাজা আর একবার পুত্রকে ডেকে তাকে বিয়ের জন্য প্রস্তুত হতে বললেন। এবার রাজা কঠিনভাবে বললেন–পুত্র তবুও অসঙ্কোচে বিবাহে অসম্মতি প্রকাশ করলেন। এবার রাজা আরও কঠিনভাবে বললেন–বেশ আমিই এই বালিকাকে বিয়ে করছি কিন্তু ঠিক জেনো এর গর্ভে যদি কোনো সন্তান হয় তবে সেই সিংহাসনে বসবে। পুত্রকে ভয় দেখিয়ে পথে আনবার জন্যেই রাজা একথা বলেছিলেন। কিন্তু তবুও পুত্র পিতার মতোই কঠিন ভাষায় বললেন–ভগবানের নামে শপথ করে বলছি, আমি আপনার সিংহাসনের মায়া ত্যাগ করলাম।