জাতিকে বড় করবার জন্য তোমার নিজের জীবনকে বাঁচাবার জন্যে তোমাকে আজ ঘরের বের হতে হবে। ইসলাম তোমাকে ঘরের মধ্যে থাকতে বলে নি–তবে তোমার এই বন্দিনী অবস্থা! কে তোমাকে হাতকড়া দিয়ে রেখেছে? সমাজে লজ্জা–দুবৃত্ত সমাজকে উপহাস করে, হাতের কড়াকে চূর্ণ করে আজ জীবন-সন্ধানে বেরিয়ে পড়। তোমার গতি সর্বত্র হোক। পাপী লম্পট পুরুষসমাজ তোমাকে বন্দিনী করে সতী করে রাখতে চায়। তোমার সতিত্বের মর্যাদা কি তুমি নিজে বোঝ না? একি তোমার অপমান নয়?
পারস্যে আরবে, মিশরে হাট-বাজারে বিপণীতে সর্বত্র নারীদের অবাধ গতি ছিল। তারা স্বাধীনভাবে প্রয়োজন হলে এমনকি নির্জনে পর-পুরুষের সঙ্গে কথা বলতেন। পৃথিবীর অতীত কালে কী বর্তমান সময়ের কোনো জাতির মধ্যে নারীদের এই বন্দিনী অবস্থা ছিলো না ও নেই, অভদ্রভাবে এক কাপড়ে বাইরে বের হওয়া নারী-পুরুষ উভয়ের পক্ষে নিষিদ্ধ।
আরব মহিলা যুদ্ধক্ষেত্রে যে শক্তি ও বীরত্বের পরিচয় দিয়েছেন, তা শুনলে তোমার মুখ হয়তো কালো হয়ে যাবে কিন্তু জানো তোমার ঐ রাঙ্গা মুখ তোমাকে বাঁচিয়ে রাখবে না, এ জগতে রাঙ্গা মুখের কোনোই মূল্য নেই। রূপকে ভ্রমরের মতো মানুষ কিছুক্ষণের জন্য বাহবা দিতে পারে; কিন্তু শক্তি ও গুণ ব্যতীত এ জগতে কোনো স্থান পাওয়া যায় না। গুণের অর্থ শুধু স্বামী ও শ্বশুর-শাশুড়ীর ভক্তি নয়।
তুমি সেলাই-এর কাজ শিখতে পার। বই বাঁধাইয়ের কাজ, কাঠের কাজ, কামারের কাজ, সোনারুপার কাজ যে পুরুষ মানুষই করবে এর তো কোনো কারণ নেই। দেশের সর্বত্র মেয়ে চিকিৎসকের বহু অভাব রয়েছে। জ্ঞানার্জন লেখাপড়া শেখার কথা যেন সব সময়ই মনে থাকে। নইলে তোমার কল্যাণ হবে না।
গ্রেজ দালিং বলে এক খ্রিষ্টান বালিকার কথা শুনলে তোমার হৃৎপিণ্ডের রক্ত নেচে উঠবে। তোমার নিজের জীবনের সঙ্গে তার জীবন তুলনা করে দেখ, তাকে তুমি বুঝবে, নারী এমন কী অপরাধ করেছে, যাতে সে ছোট হয়ে থাকবে। কী এমন পাপ সে করেছে, যাতে আঁখিজলে জীবন শেষ করতে হবে।
গ্রেজ সমুদ্রের ভিতর ডুবো জাহাজের যাত্রীদিগকে উদ্ধার করেছিলেন। ভীষণ ঝড়ে সমুদ্রের ঢেউগুলি কী ভয়ানক আকার ধারণ করেছিল, তার মধ্যে নৌকা ভাসান কি সহজ কথা? বিপন্ন হৃদয়ের আশাহীন মৌন কঠিন আর্তনাদে তার নারী-হৃদয়ের কী গভীর অনুভূতি জাগিয়েছিল। সমুদ্রের গর্জনকে উপহাস করে, প্রতিমুহূর্তে মরণকে আলিঙ্গন করে এমন অসীম সাহসের কাজ করা কি সহজ কথা? নুরজাহান, রানী এলিজাবেথ, কবি জেবুন্নিসা, রিজিয়া, চাঁদ সুলতানা, খনা, জোন এরা সবাই নারী ছিলেন। কুমুদিনী মিত্র, কাজী সোফিয়া খাতুন, গুহ, সরোজিনী নাইডু, সরলা দেবী, শান্তা ও সীতা দেবী, শৈলবালা, ঘোষজায়া, ইয়াজদানী-পত্নী, সারা তৈফুর, সাখাওয়াত হোসেন-পত্নী এরা সবাই নারী।
তোমাকে শুধু নিজের কথা ভাবলেও চলবে না। নারীকে আজ নারীর ভিতর প্রাণ সঞ্চার করতে হবে। শত বোন অন্ধকারে, দারিদ্রে ব্যথায় চূর্ণ হচ্ছে, তাদের জন্যে পাগলিনী হয়ে আজ তোমাকে পথে বের হতে হবে। তাদের মধ্যে তোমাকে কথা বলতে হবে, তাদের মধ্যে তোমাকে জীবনের গান গাইতে হবে। পরদা আজ ছিঁড়ে দূর করে ফেলে দাও, ভগ্নির ব্যথায় আজ তোমার সকল কাজে ভুল হয়ে যাক। কাজ শেষে তুমি আবার ঘরের মধ্যে প্রবেশ কর, তাতে আপত্তি নেই। আজ নারীর আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে–আজ নিঃসহায় হয়ে সবার কাছে আঘাত পেয়ে–সে ‘বোন, বোন’ বলে ডাকছে। তবু কি ঘরের মাঝে বসে থাকবে?
৪. পিতৃ-মাতৃভক্তি
হযরত মুহম্মদ বলেছেন–মায়ের পায়ের তলে স্বর্গ। তিনি আবার বলেছেন–মা-বাপের চেয়ে খোদাই তোমার বেশি আপন।
পিতামাতা যদি অন্যায় কাজ করতে বলেন, তবে সেখানে না করাই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ পিতৃ মাতৃভক্তি। মায়ের ভিতর যে সত্য মা রয়েছেন তাকেই মেনে নিতে হবে।
উড়িষ্যায় একবার দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। মানুষ না খেতে পেরে মরছিল। প্রথমে টাকা খরচ করে চাল পাওয়া যেতো, শেষে চালেরও অভাব হল। মানুষ পথে বের হল কিন্তু সবারই যে বিশ্বগ্রাসী ক্ষুধা। কে কাকে অন্ন দেবে? এরপর মানুষ গাছের পাতা খাওয়া আরম্ভ করল। শেষে তাও ফুরিয়ে গেল। সে দেশে একটা উড়িয়া পরিবার ছিল। দুটি ছেলে আর পত্নী। বাপ তাদের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে একদিন কোন দিকে বেরিয়ে গেল, আর ফিরে এলো না। যা কিছু ছিল সব বিক্রয় করে ফেলা হল, তবুও ক্ষুধা নিবৃত্তি হল না। মানুষ যা-তা খেয়ে জ্বর, কলেরায় মরে যেতে লাগল। শেষে দেশে কিছুই রইল না, কেবল রইল উত্তপ্ত বালি আর রৌদ্র। একদিন ছোট ছেলেটি ভিক্ষার জন্য বের হয়ে সেও আর ফিরে এলো না। মা ক্ষুধা ও ব্যাধির যন্ত্রণায় বিছানায় পড়লেন। তিনি প্রথমে দুই-তিন দিনে সামান্য কিছু মুখে দিতেন, এখন তাও দেন না। দুর্বল অস্থিসার শরীরে কাঁদবার শক্তিও ছিল না। বড় ছেলে ভিক্ষা করে যে দুই মুঠা পায় তাই এনে মাকে খাওয়ায়। সে নিজে কোনো দিন খায়, কোনো দিন খায় না। মায়ের জন্যে অশ্রুতে তার চোখ ভেসে যায়। মা না খেতে চাইলে সে অনুনয় করে তাকে খাওয়ায়। মা না খেলে কাঁদতে থাকে। ছেলেটির নাম সনাতন।
এইভাবে দুই-চার দিন গেল। একদিন সনাতন ভিক্ষায় বের হল। মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরছিল আর মায়ের কথা ভাবছিল। সে ভাবছিল এতদিন মাকে বাঁচাতে পেরেছি। আজ আর পারবো না, মা নিশ্চয়ই মরে যাবে, খোদা একমুঠা চালের যোগাড় তুমি করে দাও। মা আমার পথ চেয়ে আছে। পিতা কোথায় চলে গেছেন, ভাইও ভিক্ষায় বের হয়ে আর ফিরে এলো না।