মানুষকে যত পার ঘৃণা বা অবজ্ঞার চোখে দেখে না। যতটা সম্ভব মানুষকে আদর ও শ্রদ্ধা করতে হবে। অনেক মানুষ আছেন যারা বলে থাকেন–তাদের মতো ভদ্রলোক আর দেশে নেই। যথার্থ ভদ্রলোকদের পক্ষে ঐরূপ কথা বলা কঠিন, একথা বলে তিনি আদর পান না। মানুষ ছোট হয়ে থাকাতে প্রকৃত ভদ্রলোকের মনে আনন্দ হয় না–তিনি চান মানুষের কল্যাণ, পতিতের উন্নতি। গৌরব-অহঙ্কার করে নিজের বংশমর্যাদা প্রচার করবার সময় তার নেই। হায়, যারা বংশ মর্যাদার অহঙ্কার করবার জন্যেই বেঁচে আছে, তারা কত দরিদ্র!
তোমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সাধনা–আল্লাহর কাজ করা। শুধু অর্থের জন্যে বেঁচে থাকা নয়। জীবন সংগ্রাম খুব কঠিন হয়েছে,তা স্বীকার করি, কিন্তু এরই মধ্যে তো বেশি করে আল্লাহর কাজ করতে হবে।
আল্লাহর কাজের অর্থ শুধু মসজিদ তোলা, কোরান পড়ান এবং কাবা শরীফে যাওয়া নয়। এ তুমি বিশ্বাস কর, মসজিদ তোলা, কোরান পাঠ, কাবা শরীফে যাওয়া আমি অবজ্ঞা করছি এ যেন কেউ মনে না করে। অন্ধের মতো সঙ্কীর্ণ নিষ্ঠুর প্রাণ নিয়ে এই তিনটি কাজ করলেই আল্লাহর কাছে তোমার মঙ্গল হবে না।
আল্লাহর কাজের অর্থ–মানুষকে কল্যাণ ও মহত্ত্বের পথে টেনে নেওয়া। শত মূর্খকে মসজিদে ভর্তি করে আল্লাহ্ আল্লাহ্ করলে মসজিদের কোনো গৌরব বাড়বে না। আল্লাহর ধর্মও তাতে পালন হবে না। আল্লাহ্ চান খাঁটি মানুষ, সত্যের সৈনিক, তাঁর জীবনের সেবক, পরদুঃখকাতর মহাপ্রাণ বান্দা। দুঃখীকে রক্ষা করে আল্লাহর কাজ কর, পতিত ও পাপীর জন্য অশ্রু বিসর্জন কর, ক্ষুধার্ত দেশবাসীর জন্য তোমার প্রাণ অস্থির হয়ে উঠুক, অত্যাচার ও অবিচার দেখে তোমার কঠিন শোক উপস্থিত হোক।
আত্মসর্বস্ব হয়ে যদি কোরান পাঠ কর–তুমি আল্লাহর কাজ করছ এ কথা বলা হবে। ওরে অন্ধ! কোরানের মাঝে কী লেখা আছে তা কি তুমি দেখ না? শুধু অক্ষর আবৃতি করেই জীবন শেষ করলে!
নারী পাঠিকার জন্যে বিশেষ করে গুটিকয়েক কথা বলবার আছে। নারী সব সময় নিজেকে নিঃসহায় মনে করে, তার কারণ সে তার হাত-পায়ের ব্যবহার জানে না। শুধু সাজ পরে পুরুষের মনোরঞ্জন করেই নারীর বেঁচে থাকা কঠিন। আজ স্বামী বেঁচে আছেন, কাল যদি হঠাৎ তিনি মারা যান তা হলে তুমি কোথায় যাবে? যদি বাপের বাড়ি চলে যাও, তাহলে তোমার ছেলেমেয়েদের ভার কি ভাই-বৌরা নেবেন? যে এতদিন সমাদরে রাজ রানীর হাতে স্বামীর ঘর করেছে তার পক্ষে পরের মুখের দিকে চেয়ে দাসীর অসম্মানে বেঁচে থাকা কী সম্ভব? তুমি তোমার জীবনকে ইচ্ছা করলে পুরুষের মতোই সার্থক করে তুলতে পার। তোমার চারিদিককার পুরুষগুলি তোমাকে ঠাট্টা করুক, কিন্তু তুমি আমার কথা বিশ্বাস কর। তোমার ভিতর মানুষের আত্মা আছে, তোমার জীবন পথে ভেসে যাবার নয়।
যখন ইংল্যাণ্ডে রানী বোর্ডেসিয়া রাজত্ব করছিলেন তখন বিদেশী এসে তাঁর রাজত্ব আক্রমণ করে। রাণী দুই মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে বেরিয়েছিলেন। তাঁর তখনকার সেই মূর্তি দেখলে আমাদের মনেও ভয় হয়। শ্রদ্ধা ও সম্ভমে অবনত হয়।
মানুষকে যদি ছোট করে রাখা হয়, সে তার শক্তির কথা বুঝবে না। তুমি নারী বলে তোমাকে দেশের মানুষ ছোট করে রেখেছে। তোমাকে বিয়ে দিয়েই পুরুষ তার কর্তব্য শেষ করেছে। উচ্চ জীবনের কথা ভাববার আগে নারীকে আত্মনির্ভরশীল হতে হবে, স্বাধীনভাবে তাকে হাত ও মস্তিষ্কের ব্যবহার শিখতে হবে। তার অর্থ নেই, জীবনের স্বাধীনতা নেই, তার আবার উচ্চ জীবন কী? বেটা ছেলের মতই নারী, তুমি বেড়ে ওঠ। পুরুষের সাহায্য না নিয়েই তুমি বেঁচে থাকতে পার, তার জন্যে প্রস্তুত হও।
তোমাকে পুরুষ হাত-পা বেঁধে খাঁচার মধ্যে পুরে রেখেছে, এর ফলে তোমার মনুষ্যত্ব নষ্ট হয়েছে। মানবসমাজের সঙ্গে মিশলে তুমি বিশ্বে পাপ সৃষ্টি করবে, এর মতো অন্যায় কল্পনা আর নেই। তোমার কী নিজের বিবেক নেই? তোমার কি শুদ্ধ জীবনের মর্যাদা বুঝবার ক্ষমতা নেই।
বিশ্বের কেউ যদি তোমাকে সাহায্য না করে, তুমি সেজন্যে কেঁদো না। তোমার ভিতর যে শক্তি রয়েছে, তাকে আজ জাগিয়ে তোল। তুমি লেখাপড়া শেখ। তুমি এত পরাধীন থেকো না। স্বামী তোমাকে ভাত না দিলেও তুমি নিজের ভাত যাতে সংগ্রহ করতে পার, তার ব্যবস্থা কর। পুরুষ তোমার উপর বহু অত্যাচার করেছে, এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে তোমাকে আজ দাঁড়াতে হবে। প্রতিশোধ ঘৃণা নিয়ে নয়, ক্ষমার বিনয় নিয়ে। নিজের জীবন যদি নিরর্থক হয়ে থাকে, তবে তোমার সন্তানের জীবন যেন নিরর্থক না হয়। ছেলের মঙ্গলের জন্যে টাকা ব্যয় করছ, তোমার অনাথিনী ভিখারিনী মেয়ের কথা তুমি ভাববে না? সে কেমন করে এ সংসারে বেঁচে থাকবে? যদি সে স্বামীর ভালবাসা না পায়–পরের বাড়িতে যদি স্থান না হয়–যদি তার স্বামী মারা যায়, তা হলে তার কি হবে? এই সহজ কথা তুমি বোঝ না? মেয়েকে সম্পত্তি লিখে দিলেও মূর্খ মেয়ে তা কি রাখতে পারবে? কত নারী আত্মশক্তির অভাবে দারিদ্ভারে জন্মভূমি ত্যাগ করে শহরে অভাগিনীদের জীবন গ্রহণ করে, সে শোকের কথা কি জান?
ফরাশি দেশের এক কৃষকের মেয়ে লক্ষ লক্ষ পুরুষ সৈনিকের অধিনায়িকা হয়ে ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন, তা শুনলে তুমি দুর্বলা অন্তঃপুরচারিকা ভয়ে মূৰ্ছা যাবে।