এইখানে একটা কথা বলা দরকার। জাতিকে যত কথাই বল না, নৈতিক যত বিধিই প্রণয়ন কর না, যত ধর্ম ব্যবস্থাই থাক না–যাবৎ না তার ভিতরের মানুষটি চোখ খুলে প্রত্যেক কথা বুঝতে চেষ্টা না করে, তাবৎ তার কল্যাণ নেই। কোনো বিধি ব্যবস্থা, কোনো মহাপুরুষের বাণী তাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে না। তার অধঃপতন হবেই। প্রত্যেক মানুষের ভিতর এমন একটা জিনিস আছে যে সুবিধা ও সুযোগ পেলে জগতের প্রত্যেক কথা বাজিয়ে গ্রহণ করতে চায়। ইংরেজ পণ্ডিতেরা এই জিনিস বা শক্তিটাকে যে কথায় প্রকাশ করেন, তার বাংলা অনুবাদ ‘বিবেক’। ভালো মন্দ বুঝিয়ে দেবার জন্যে মানব জাতির পক্ষে এর মতো মহাগুরু আর নেই। ইনিই আমাদের ভিতরের অন্তর মানুষ। আঘাত করে যদি একে অন্ধ করে ফেলা হয়, তবে তুমি যত বড় মহাপুরুষই হও না, তুমি বড় দুর্ভাগা। তোমার পতন হবেই। মহাপুরুষেরা যেসব কথা বলেছেন তা শুধু মেনে নিতে হবে। তার সত্য ভালোমন্দ বিচার করাটা দোষের এইরূপ চিন্তা নিয়ে যারা জীবন চালায়, তাদের ভবিষ্যৎ ভয়াবহ। বিনা কারণে নিজের বাহাদুরি ফলাতে গিয়ে কোনো মহানবী বা কোনো মহাপুরুষকে উড়িয়ে দিতে হবে, এ আমি বলছি নে–আমি বলছি বিনয় ভাবে সত্য অনুসন্ধানের মন নিয়ে তোমাকে প্রত্যেক কথায় সমালোচনা করতে হবে। তবেই তোমার মুক্তি।
যা বলছিলাম–হযরত মুহম্মদ (সঃ) পতিত পাপান্ধ অনুভূতিহীন মানুষের জীবন দেখে। অশ্রু বিসর্জন করেছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন–সোনার মানব জীবন কেন এত পাপে কলঙ্কিত হবে? মানুষের পাপ তার কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছিল।
তিনি তাঁর শিষ্যমণ্ডলীকে ভালবাসেন, শেষ দিন তিনি ‘মানব’ নাম উচ্চারণ করবেন বলে এই কথা বলেই আমরা যদি তৃপ্তি লাভ করি, তা হলে আমরা অপদার্থ। তিনি আমাদের পাপ ও অন্ধতা দেখে কেঁদে দিয়েছিলেন সে কথা আমাদের স্মরণ নেই, আমরা কেবল তাঁর দয়ার মহিমা প্রচার করি। কী বিড়ম্বনা, বিবেক ও চিন্তাহীন জাতির পতন কী আশ্চর্যভাবে সংঘটিত হয়।
জীবনকে শুদ্ধ ও পবিত্র করে তুলতে হবে। কারণ এটাই ধর্ম। শুধু উপাসনা ও মহাপুরুষের ভক্তিপূর্ণ নামোচ্চারণে আমাদেরকে মুক্তি দেবে না।
জীবনের পাপ ও কলঙ্ক মুছতে চেষ্টা না করে আল্লাহ্ দয়াময় একথা বলো না। উহা নিকৃষ্ট শ্রেণীর লোকের কথা। জীবনকে শুদ্ধ ও পবিত্র করবার জন্যে তোমার ভিতরে একটা আন্তরিক চেষ্টা হোক। সাধুরাই জীবনকে পবিত্র করবে, এরূপ কল্পনা করা নিতান্তই অন্যায়। প্রত্যেক মানুষকে বড় হতে হবে। প্রত্যেককে ব্রাহ্মণ দরবেশ হতে হবে। মানুষের পক্ষে ছোট ও শুদ্র হয়ে থাকা অধর্ম ও পাপ। সাধু-সন্ন্যাসী বলে কী স্বতন্ত্র একটা মানবসমাজ আছে।
নিষ্ঠুর কথা বলতে, একটা কঠিন বাক্য ব্যবহার করতে তোমার যেন লজ্জা হয়। নিষ্ঠুর কথা প্রয়োজন হলে বলতে হবে, কিন্তু এই রূঢ় কথা ব্যবহার করবার আগে ভেবে দেখ, তোমার কার্যটি ন্যায়ানুমোদিত কিনা।
মানুষের সঙ্গে নিষ্টুর ব্যবহার করে যে, খোদার সঙ্গে প্রেম করতে যায় তার বুদ্ধি খুব কম। মানুষের একটা বিশ্বাস এসেছে–অন্যায় ও পাপে জীবনকে কলঙ্কিত করে, কোনো ক্ষতি নেই–আল্লাহকে ডাকলেই সকল পাপ ধুয়ে যাবে এটা যে মিথ্যা কথা–এ সকলে বিশ্বাস করো।
আমি দ্বিতীয়বার বলছি, জীবনের পাপকে দূর করবার চেষ্টা না করে শুধু আল্লাহর কাছে প্রেম জানালে চলবে না। তার দয়া ভিক্ষা করলেও কাজ হবে না, তিনি দয়াময় একথা বলাও কিছু নয়। প্রাণান্ত সাধনা করেও যদি ভুল হয়ে যায় তবে সে জ• খোদার স্নেহ রয়েছে, এ সত্যি–তিনি দয়ালু এটা ঠিক, তাই বলে পাপ ও অন্যায় করবার অধিকার নেই।
পাপ ও অন্যায় বুঝতে হলে আত্মার অনেকখানি জ্ঞান লাভ করতে হবে। মূর্খ যে কাজ বা যে ঘটনাকে নির্দোষ বলে মনে করে, জ্ঞানী সেখানে হীনতা ও অসম্মান ভেবে সরে পড়েন। জীবনের পাপ ও কলঙ্ক বোঝবার মতো মন হওয়া চাই। আমি একটা মানুষকে জানি তিনি জীবনে বহু পাপ করেছেন অথচ অসঙ্কোচে আল্লাহূকে লক্ষ্য করে বলে থাকেন–হে খোদা! আমি তো জীবনে কোনো অন্যায় করি নি!
মানুষের সঙ্গে অন্যায় ব্যবহার করে যে বড় গলায় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে সে মূর্খ। যার কাছে যে অপরাধ করেছ ক্ষমা চেয়ে নাও–তারপর ঊষার মহিমার মাঝে আল্লাহর প্রেমে নিজেকে হারিয়ে ফেলো। ব্যথিতের দীর্ঘশ্বাসকে সংবর্ধনা জানাবার জন্য খোদার দূতেরা আকাশ পথে এগিয়ে আসেন এ কি কেউ জান না?
দুবৃত্ত নরপিশাচের মনে ব্যথা দিতে হবে না তা বলছি নে। দুবৃত্তকে তো শাস্তি দিতে হবেই। সাধু ও উচ্চ জীবন দুবৃত্তকে দমন করেই তো সার্থক হয়।
অন্যায়ের অভিশাপ বড় ভয়ানক, পীড়িত মানুষ যত ছোটই হোক তার ব্যথাকে ভয় করতে হবে। তোমার অর্থ, তোমার পোষাক, তোমার দাস-দাসী, তোমার গায়ের শক্তি তোমাকে পীড়িতের নিক্ষিপ্ত অদৃশ্য বাণ হতে রক্ষা করবে না।
মানুষকে সম্মান করা জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গুণ। ছোটলোককে সম্মান করতে তার ক্ষতি হয় একথাও ঠিক। দুর্বল ও পাপীকে সম্মান করলে অনেক সময় তার মাঝে মনুষ্যত্বের কিরণ যেয়ে পড়ে, তার ফলে তার কল্যাণ হওয়া সম্ভব। যে মানুষ মূর্খ ও দুবৃত্ত তাকে শ্রদ্ধা করলে সে নিজেকে বড় মনে করে, মহৎ জীবনকে অবজ্ঞা করলে লজ্জাবোধ করে এও ঠিক। জীবন কীভাবে চালাতে হবে, মানুষের সঙ্গে ঠিক কিরূপ ব্যবহার করতে হবে, জীবন পথের শত শত রহস্যের কীভাবে মীমাংসা করতে হবে–এ সম্বন্ধে ঠিক করে কিছু বলে ওঠা কঠিন। তোমার ভিতর যে অন্তর মানুষ রয়েছে, তাকে অপমান করো না। অপমানে তার মরণ হয়। ওগো, তাকে মেরে ফেলো না। জীবনের সকল সময়, অবস্থায়, আলোকে, অন্ধকারে, সকল পাহাড়ে, মাঠে, মরুভূমে, সাগরে সর্বত্র তোমার শুভ সে বলে দেবে।