দানিয়াল ওয়েবেস্টর (Daniel Webster) সাহিত্যালোচনার সঙ্গে সঙ্গে নিজ হস্তে জমি চাষ করতেন। কিছুকাল আগে দেশের কতগুলি লোককে নিজ হাতে জমি চাষ করবার জন্য ভারি উৎসাহান্বিত দেখেছিলাম। এখন সে ফুর্তি আর নেই। যে জাতি মনে করে, শারীরিক পরিশ্রম মানুষকে ছোট করে, তারা নিকৃষ্ট, তারা পতিত। পাপ ও অন্যায় কর্মে মানুষ ছোট হয়, পরমুখাপেক্ষী হয়ে এবং মনের স্বাধীনতা হারালে মানুষের অসম্মান হয়। সত্য ও পবিত্র জীবন ত্যাগ করে যে সব দুবৃত্তের দল অন্যায়ের সেবা করে পয়সা উপায় করে, ধিক তাদের জীবনে, মন তাদের কত ছোট, এই শ্রেণীর লোক নিজেদের ভদ্রলোক বলে যদি পরিচয় দেয়, তাহলে মানুষ যেন তা শুনে হাসে।
শেলী পানির মধ্যে কাগজের নৌকা ভাসাতেন। এইভাবে সাহিত্যলোচনার শ্রান্তি হতে তিনি শান্তি সংগ্রহ করতেন। প্রতিদিন চার মাইল হাঁটার কমে ডিকেন্সের পেটে ভাত হজম হতো না, নিত্য ঝড়-ঝাঁপটা, বৃষ্টি-বাদলা কিছু না মেনে মুক্ত আকাশতলে একটু ঘোরা ফেরা তার চাই। সাদি (Southey), ওয়ার্ডসওয়ার্থ খুব হাঁটতেন। ওয়ার্ডসওয়ার্থ যে রাজ্যসুদ্ধ ঘুরে বেড়াতেন তা তাঁর লেখা হতেই বোঝা যায়। ফুলে ভরা মুক্ত প্রান্তর, নিঝরের সঙ্গীত, মেঘে-ভরা আকাশ, ছবি, এসবের মাঝে তিনি ভাষা খুঁজে বেড়াতেন। মৌন প্রকৃতির অন্তরের মাঝে মিশে তিনি আত্মার বাণী শুনতেন–বিশ্বব্যাপী বিরাট অনন্ত পুরুষের বাঁশি তার শিরায় ধ্বনিত হয়ে উঠত।
শেলী অনেকবার ঘোড়া হতে আছাড় খেতেন, কিন্তু তবু তাঁর শিক্ষা হতো না। যেমন পড়তেন তেমনি চড়তেন, শেষকালে একেবারে পাকা ঘোড়সোয়ার হয়েছিলেন।
শিক্ষিত ভদ্রলোক যিনি, তিনি নড়ে বসবেন না, একটা না একটা ব্যাধি লেগে আছে–কোনো পরিশ্রমের কাজ করতে তার নিতান্ত অনিচ্ছা, ঘোড়ার চড়া তো একেবারেই অসম্ভব। এসব হচ্ছে অভিশপ্ত জীবনের দুরবস্থা। উচ্চ জীবনের সঙ্গে কী শক্তি, স্বাস্থ্য ও পরিশ্রমের কোনো যোগ নেই? জগতের অনেক মহৎ ব্যক্তি দুর্বল হয়ে তারা সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাদের শিক্ষা ও সত্য যাঁরা প্রতিষ্ঠিত করছেন, তাঁদের কিন্তু কৃশ ও দুর্বল হয়ে কাজ চলে নি।
দরিদ্র, অশিক্ষিত পরিচিত আত্মীয় বন্ধুকে আপন বলে পরিচয় দিতে সঙ্কোচবোধ করা ভাল, কিন্তু দরিদ্র পূত চরিত্র, সরল, বর্বর, পরিশ্রমী মানুষকে আত্মীয় বলে পরিচয় দিতে মনে যেন কোনো সঙ্কোচ না আসে। জীবনের পক্ষে এ একটা বড় কলঙ্ক। মানুষের নাম নিয়ে তুমি বড় হতে যেয়ো না, তোমার নামেই মানুষের সম্মান হোক।
বেলজিয়ামের মন্ত্রী মেলাম, বিলেতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পুরুষ গ্লাডস্টোন কুড়োল দিয়ে প্রকাণ্ড গাছ কেটে নামাতেন। এজন্য তাদেরকে কেউ ছোটলোক বলে নি। এগুলি হচ্ছে পৌরুষ।
ইংরেজ জাতি হাজার লক্ষ পথে নিজেদের জীবনকে সার্থক করে তুলতে চেষ্টা করে। ইংরেজকে ঘৃণা করলে চলবে না। উপযুক্ত গুণ স্বীকার না করলে আমাদেরই ক্ষতি হবে। আফ্রিকার বনজঙ্গলে, মেরুপ্রদেশের তুষার তরঙ্গে, অনন্ত সমুদ্রের বুকে, অতলের তলে, ভূগর্ভে, আকাশে, পর্বতে–সর্বত্র সে তার শক্তি নিয়ে ছুটাছুটি করছে। তাদের মধ্যে শক্তি ও গুণ আছে বলে যে তাদের, কোনো জাতিকে অসম্মান করবার ক্ষমতা আছে, এ আমি বলছি না।
কত ইংরেজ সামান্য সামান্য বিষয় নিয়ে সারা জীবনটা কাটিয়ে দিয়েছেন। এইসব কলকারখানা ও নৈমিত্তিক সুখ উপকরণের অন্তরালে কত মানুষের চিন্তা ও সাধনা রয়েছে তা কি কেউ ভেবে দেখবে না? শুধু চাকরি-দাসত্ব মানব জীবনের গৌরবের জিনিস নয়। নানা রকমে আমাদের জীবনের শক্তিকে সার্থক করতে হবে। যে জাতি এক সময় জগতে কত উচ্চ স্থান অধিকার করেছিল, সে আজ সামান্য দু-একশো টাকার জন্যে কত দীনতা স্বীকার করে। নিজেদের গৌরবময় অতীত ইতিহাস হয়তো কেউ জানে না। ভিতরে যাদের বড় বলে অনুভূতি রয়েছে সে কি কখনও অস্থিতে সন্তুষ্ট থাকতে পারে।
অজ্ঞান ও মূর্খতা হচ্ছে সকল দুঃখের মূল। আবার একথাও ঠিক, যারা অত্যন্ত মূর্খ তাদের বিশেষ কোনো দুঃখ-কষ্ট নেই। গরু-ঘোড়া বা কুকুর-শৃগালের কোনো বেদনা নেই। তার মানে এদের আত্মসম্মান জ্ঞান নেই। তার মানে এদের ভিতর কোনো বোধ বা চিন্তা করবার ক্ষমতা নেই। মানব জীবনের দুঃখ-কষ্টের হাত এড়াবার জন্যে কেউ কি খোদার কাছে প্রার্থনা করে–হে খোদা, তুমি যদি আমায় কুকুর করে সৃষ্টি করতে, তা হলে জীবন কত সুখেরই না হতো। হীন জীবনের অসম্মান ও নিগ্রহ কুকুরে না বুঝলেও মানুষ তা দেখে অশ্রু ফেলে, পশুর অনুভূতি নেই বলেই সে তার দীনতা ও বেদনা বুঝতে পারে না, সত্য করে কী তার জীবন মানুষের ঈর্ষা আনে? মূর্খর জীবনে পশুর সুখ থাকতে পারে, কিন্তু চিন্তাশীল মহানুভব ব্যক্তি তার পতিত জীবন দেখে অশ্রু বিসর্জন করেন। মানুষের জীবন এমনভাবে ব্যর্থ হয়ে যাবে এ তার সহ্য হয় না। তিনি মানুষ মানুষ বলে পাগল হয়ে সব ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন। মহানবী মুহম্মদ (সঃ) এর জীবন-কথা আবৃত্তি করতে যেয়ে অনেকে বলেন, “আমাদের মহানবী তাঁর উম্মতের (শিষ্যমণ্ডলী, মুসলমান জাতি) জন্যে অসীম প্রেম পোষণ করতেন। এদের মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত তিনি শান্ত হবেন না। তিনি খোদার কাছে দাবি করে বলবেন–হে দয়াময়, তুমি আমার শিষ্যমণ্ডলীর মুক্তি দাও।”