নারী বহুভাবে নিজেদের জীবন সার্থক করতে পারেন। তাই বলে বিয়ে না করে অন্য পথে নারী জীবনকে সফল করতে চেষ্টা করুক, এ আমি বলছি নে। আমার কথা নারী ইচ্ছা করলে পুরুষদের ন্যায় নিজেদের জীবনকে মূল্যবান ও শ্রদ্ধেয় করে তুলতে পারেন। নীরবে অজানা অচেনা হয়ে, অসীম ধৈর্যে মঙ্গলময়ী নারী মানব জাতিকে যে সুখ ও আনন্দ দান করেন, তার তুলনা কোথায়?
বিদেশে কিরূপ হয় জানি নে, এদেশে কিন্তু নারীর সেবা ও স্নেহের কোনো মূল্য নেই। সমাজের অত্যাচার তাদের কর্মশক্তিকে একেবারে চূর্ণ করে ফেলেছে পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীদের হাসপাতালটি দুটি সামান্য দরিদ্র মেয়ে কর্তৃক স্থাপিত হয়েছিল। মানুষের দ্বারে দ্বারে যেয়ে তারা ভিক্ষা করেছিলেন।
অসম্মান ও অভাবের চাপে পিষ্ট হওয়ার চেয়ে বিয়ে না করাই ভালো। বিয়ে করে যদি কতকগুলি লোকের কষ্ট বাড়ান হয় তা হলেও নারী-পুরুষের মিলনের প্রয়োজন নেই। বিয়ে করে দাস জীবনের অগৌরব বাড়িয়ে আর লাভ কী?–এই কথা বলতে খুব ইচ্ছা হয়, কিন্তু কঠিনভাবে আদেশ করতে ভয় পাই। সতী স্ত্রী ও চরিত্রবান ব্যক্তির প্রণয় মিলন জগতের মর্যাদা ও শোভা বর্ধন করেছে।
নারীর যদি কর্মশক্তি থাকতো, সে যদি এত সরলা, এত ভীতা, চকিতা, এত কৃপার পাত্রী না হতো তাহলে তার সঙ্গ লাভ মানুষের পক্ষে বিপজ্জনক হতো না। নারী যে মানুষের অসম্মানের তার সহানুভূতি চাই, অতএব কোনো অবস্থায় তাকে বাদ দেওয়া চলে না। আমার কাঁদবার সময় আমি নারীর চোখেও অশ্রু দেখতে চাই নইলে যে আমি মরে যাব।
যে দেশে নারীর কিছুমাত্র সম্মান নাই, যেখানে সে হাসল মানুষ তাকে চরিত্রহীন বলে সন্দেহ করে, সেখানে তার কর্মশক্তি, তার মনুষ্যত্ব তার বিবেক ও ব্যক্তিত্ব জাগ্রত হবে কেমন করে? সেখানে নারী পুরুষ জীবনে কর্মপথের একটা বাধা ছাড়া আর কি? নারীর চোখ-মুখের সম্মোহন বিভার পাশে শক্তির শিখা জ্বালাও। সে শুধু ফুলের মতো মানুষের আরাম বর্ধন করবে না। হাতের যষ্টি হয়ে পুরুষ-সমাজের কল্যাণ বর্ধন করবে।
আল্লাহর নামে নারী-পুরুষের মিলন পার্থিব সকল কিছু অপেক্ষা মূল্যবান ও শ্রদ্ধার জিনিস। নারী-পুরুষের যথার্থ মিলন অতীব দুর্লভ। সত্যিকার প্রণয় যারা করতে পেরেছে তারা সামান্য নয়।
ইসলাম কঠিন কর্তব্যের জন্যে প্রেম-প্রণয়কে প্রশ্রয় না দিলেও ইউসুফ-জোলেখার সুমহান আত্মদানকে অতীব উচ্চ স্থান দিয়েছে। মানুষের আত্মা প্রেম ও স্বাধীনতা ছাড়া আর কিছু নয়।
প্রেম-স্বাধীনতা বাদ দিলে মানুষের কিছুই থাকে না। বহির্জগৎ হতে ধরে এনে ঘরে আবদ্ধ রেখে নারীর জীবনকে বর্তমানকালে ব্যর্থ করে দেওয়া হয়েছে। তাকে মানুষের প্রেমহীন কামুকতার উপকরণ করে তোলা হয়েছে। ইসলাম এটা সমর্থন করে না। নারীর জীবন এত ছোট নয়।
কেউ কেউ শুধু রূপ দেখে বিয়ে করেন। নারী-জীবনে রূপ একটা শ্রেষ্ঠ সম্পদ তা স্বীকার করি, কোনো এক বিখ্যাত ইংরেজ মহিলা বলেছেন–আমি আমার জ্ঞান বিসর্জন দিতে রাজি আছি, যদি বিনিময়ে রূপ মেলে। এই মহিলা দেখতে তত ভালো ছিলেন না।
রূপ মানুষকে অভিভূত করে ফেলে সত্য, কিন্তু রূপের পাশে যদি গুণ না থাকে, নারীর রূপ যদি পুরুষের মনকে অধঃপতিত করে, তার রুচি ও মনুষ্যত্বকে খর্ব করে দেয়, তবে সে রূপকে বাদ দিতে হবে। নারী বলতেই সে রূপসী–তাকে ভালবাসার মতো মন ও মহত্ত্ব চাই। ভালবাসা না থাকলে শ্রেষ্ঠ রূপসীও মানুষকে আনন্দ দান করতে পারে না। নারী-পুরুষের মিলনের শুধু উদ্দেশ্য হচ্ছে–জীবনের দানকে সার্থক করে তোলা। শুধু ভোগের জন্যে রূপকে যে আদর করে সে খুব ছোট।
নারীর মনে যদি রূপ না ফোটে তবে মুখের রূপে কেউ সত্যিকারের সুখ পায় না, স্থায়ী করে তাকে ভালবাসে না। বিরক্ত হয়ে দূরে সরে যায়–যে পারে সে নিতান্তই অপদার্থ ও হীন। নারীর রূপ কয়দিন থাকে? তার মনের লাবণ্যই স্থায়ী। সে বিভা বয়সের সঙ্গে সঙ্গে কেবলই বাড়ে।
বস্তুত যাকে ঠিক বন্ধু বলে বরণ করে নিতে মন আপত্তি তোলে না, সেই নারীকেই বিয়ে করা যায়। শুধু ভোগের জন্যে নারী-পুরুষের মিলন নিরর্থক; কিন্তু আসলে কী দেখতে পাওয়া যায়? যে যুবক তাকে বিয়ে করতেই হবে। মেয়ে হলেই স্বামী গ্রহণ করতে হবে। নারী-পুরুষের মিলনের যে একটা উচ্চ রকমের সার্থকতা আছে, তা সমাজের কেউ মানে না। দেখতে পাই স্বামী পত্নী কেউ কারো হৃদয় বোঝে না। কেউ কারো সাধনার খবর রাখে, নারীরা পুরুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও ব্যথা-বেদনা বোঝেন না, জীবনকে সার্থক করার জন্যে এ কী প্রকার আয়োজন? এমনভাবে নারী-পুরুষের মিলন অবৈধ।
ভোগ জিনিসটা দোষের এ আমি বলি না। বলি শুধু শরীরের ভোগেই যেন জীবন শেষ না হয়। মানব জীবন এত ছোট নয় যে ভোগের মাঝে কর্তব্য সম্পাদনের তৃপ্তি রয়েছে সে ভোগ অতি সুন্দর ও কাম্য। এ ভোগকে আনন্দের সঙ্গে বরণ করে নিতে হবে, না নেয়াটাই দোষের। পতির পাপে যদি পতির মনে দুঃখ না আসে, দুরাচার স্বামীর উপহারে যদি নারীর প্রাণ উৎফুল্ল হয়ে ওঠে তবে বুঝবো হে নারী নিজের জীবনকে তুমি ব্যর্থ করে দিয়েছে। পাপ নীচতার বিরুদ্ধে দাঁড়াবার জন্যই নারী-পুরুষের মিলন। অতএব দাম্পত্য জীবনের কোনো অংশে যদি পাপ আদর পায় তবে সে দাম্পত্য বন্ধন নিরর্থক।