মানুষের ব্যথা-বেদনা যার মনকে দুর্বল না করে, সে বড় দরিদ্র। মানুষের সাথে মানুষের পার্থক্য কী?–একরত্তিও না–অনুভূতি সবারই সমান। ব্যথিত মানুষকে সম্মুখে দেখে কোন প্রাণে আনন্দ কর? এ জগতে দেখি বহু মহাপুরুষ জন্মগ্রহণ করেছেন, তাঁরা দুস্থ মানুষের জন্যে সর্বস্ব দান করেছেন, কিন্তু তবুও তাদের অভাব হয় নি। খোদার উপর যাদের গভীর বিশ্বাস আছে, তারাই এমন মহাপ্রাণের পরিচয় দিতে পারেন। খোদার উপর বিশ্বাসের অর্থ এ নয় যে, তিনি সোজাসুজি আকাশ থেকে নেমে এসে তোমার বালিশের নিচে ধনরত্ন রেখে দেবেন। খোদা পরিশ্রম ও সাধনার মূল্য দিয়ে থাকেন। মানুষের দুঃখে যদি সত্যি তোমার দয়া হয়, তা হলে তাদের কথা স্মরণ করেই তোমাকে চতুগুণ পরিশ্রম করতে হবে। ঘরে বসে তুমি মানুষকে সাহায্য করতে পারবে না। মানুষকে সাহায্য করবার জন্যে যদি তুমি জীবন ভরে সুযোগের আশায় বসে থাক তাহলে সুযোগ হয়তো জীবনে আসবে না। দরিদ্রকে সাহায্য কর এবং সঙ্গে সঙ্গে পরিশ্রম কর, খোদা তোমাকে অর্থ দেবেন। তুমি যে মানুষের সেবক–তোমার হাতে অর্থ যদি না আসে তা হলে খোদার মহিমা, তার সব কথাই যে মিথ্যা হয়ে যাবে।
মানুষকে ভুলে দরিদ্রকে ব্যথা দিয়ে যদি তুমি অর্থ আহরণ করতে থাক, তা হলে খোদার অভিশাপের জন্য তোমার মাথা ঠিক করে রেখো। কে সেই নরপিশাচ, যে দরিদ্রের বুকের রক্ত নিংড়ে গৃহিণীর গয়না প্রস্তুত করে? ঈদের দিনে ছেলেদের জামা-কাপড় কিনে দেয়? তোমরা কে কে তার সঙ্গে কথা বলছ?
অনেক মানুষ আছে, যারা নিজের আত্মীয়-স্বজন ও পরিচিত বন্ধু-বান্ধব ছাড়া বাকি সকল মানুষের প্রতিই নিষ্ঠুর, বলেছি তো মানুষে মানুষে পার্থক্য কী? মানুষের যে ভাই, সে তো তোমারই ভাই, অতএব তাকে আঘাত দাও কোনো সাহসে? মানুষকে তুমি কেমন করে কঠিন কথা বল? তোমার লজ্জা হয় না? তুমি কার পয়সা নিজের ঘরে নিয়ে যাচ্ছ? কাকে ক্ষুধিত রেখে তুমি নিজের উদরপূর্তি করবার আয়োজন করছ?
ছোটদের প্রতি নিষ্ঠুর ব্যবহার করা মোটেই ভদ্রতা নয়। যে মানুষ দরিদ্র ভৃত্যের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করতে পারে না, সে যেন মানব দুঃখে বেদনা প্রকাশ না করে। এই অসহনীয় ভণ্ডামির শেষ হোক। একসময় রাজা পিটার তার ভৃত্যকে প্রহার করেন, সেই প্রহারেই ভূতত্যর মৃত্যু হয়। সম্রাট কেঁদে বলেছিলেন আমি মানুষকে শাসন করবার ব্রত গ্রহণ করেছি কিন্তু হায় নিজকে শাসন করতে পারি নি।
বড় লোকরা জানে না, তাদের দরিদ্র পিতা-পিতামহেরা মানুষের কাছে কত ছোট হয়ে যশ ও সম্মান অর্জন করেছিলেন। সুখের কোলে পালিত বড় লোকদের দরিদ্র, অত্যাচারিত মানুষের বেদনা বোঝবার কোনো ক্ষমতা নেই। তারা অজ্ঞাতসারে অত্যাচারী হয়ে পড়েন। জগৎ ও মানব সমাজ সম্বন্ধে তাদের ধারণা খুবই অসম্পূর্ণ।
জীবনকে উন্নত করবার জন্যে তোমাকে পরিশ্রম করতে হবে। উত্তরাধিকারসূত্রে অতি অল্প লোকেই পূর্ব পুরুষের অর্থ সম্পদ লাভ করে থাকে। পিতার বা শ্বশুরের সম্পত্তির লোভ তুমি করো না। শক্তি সাধনা করে তোমাকেই বড় হতে হবে। কে বলে পুরুষের সম্মুখে বাধা রয়েছে? চাই শুধু তোমার উন্নত জীবনের ইচ্ছা। চাই তোমার জীবনের প্রতি মুহূর্তের সদ্ব্যবহার। হাসি-গল্পের আবশ্যকতা আছে, কিন্তু হাসি-গল্প করবার জন্যে তো তোমার স্ত্রী ও বন্ধু-বান্ধব রয়েছেন। রহস্যালাপ করা জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গুণ, কিন্তু তাই বলে রহস্য করে জীবনের অধিকাংশ সময় নষ্ট করে ফেলো না–কাজ কর, কাজ করতে অভ্যাস কর। এমন দিন আসবে যখন অবসর তোমার কাছে মোটেই ভালো লাগবে না। জীবনে যে কাজ কর না, যে অবস্থাতেই থাক না, ‘তোমার সকল উন্নতির মূল তোমার বুদ্ধি ও জ্ঞান। জীবনের সকল অবস্থায়, সকল সময়ে তোমাকে ভাবতে হবে, পড়তে হবে। জ্ঞানের আলোক-রথ নিয়ে তুমি যেদিকেই যাও না কেন–সিদ্ধি তোমার ধরা রয়েছে। জ্ঞানকে বাদ দিয়ে যিনি জীবনকে উন্নত করতে চান, তিনি সফলতা লাভ করতে পারবেন না। এ জগতে মূখের কোথাও স্থান নেই।
অনবরত কাজ করে করে চিত্ত যেন নীরস-কঠিন না হয়ে উঠে। পত্নী-ভাই-বন্ধুদের সঙ্গে স্নেহ-মমতার আদান-প্রদান হওয়া মানুষের সঙ্গে লৌকিকতা করা জীবনে এ সবেরই প্রয়োজন আছেনইলে মানবজীবন একটা অভিশাপ বিশেষ হয়ে উঠবে। জীবন শুধু কাজ নয়, এর একটা রসের দিকও আছে। প্রীতি-ভালবাসা প্রেম-প্রণয়হীন কাজের যন্ত্র হয়ে যদি সংসারে বাঁচতে চাও, তা হলে তুমি হতভাগ্য। দারিদ্রের কষাঘাত অসহ্য। অভাবের তাড়না লজ্জাজনক, পাওনাদারদের তাগাদা জীবনের সুখ-শার্ট : নষ্ট করে, তা ঠিক; কিন্তু তাই বলে অনবরত কাজ নিয়ে হৈ হৈ করে বেড়ানোও ঠিক নয়। অত্যধিক পরিশ্রমে মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে, কোনো কঠিন ব্যাধি হওয়াও অসম্ভব নয়। জীবনের যাদের সঙ্গে যোগ রয়েছে তাদের কাছেও অপ্রীতিকর হয়ে উঠতে হয়।
যারা অত্যাধিক মানসিক পরিশ্রম করতে অভ্যস্ত তারা যেন নিয়মিতভাবে শারীরিক আমোদ ক্রীড়ায় যোগ দেয়। আজকাল বন্দুক জিনিসটি সংগ্রহ করা বড় কঠিন, নইলে বন্ধুক নিয়ে শিকার সন্ধানে বের হওয়া খুব চমৎকার। এতে যেমন আনন্দ তেমনি পরিশ্রমও হয়।
যারা মানসিক পরিশ্রম করেন তারা সংসারের কাজও খুব করতে পারেন। উচ্চশ্রেণীর চিন্তাশীল লেখক ও পণ্ডিতেরা হাতে কোনো কাজ করতে লজ্জাবোধ করেন, তা বলছি না। আলস্যবশত অথবা শরীরের প্রতি অবহেলা করে তারা সাধারণত কোনো পরিশ্রমের কাজই করতে চান না। মানসিক পরিশ্রমের সঙ্গে ভালো আহার ও শারীরিক পরিশ্রম যদি না হয়, তা হলে নানা ব্যাধি এসে দেখা দেবে। মাটি কোপান, কাঠ ফাড়া এবং সংসারের কাজে কোনো লজ্জা তো নেই বরং এতে স্বাস্থ্য ভালো থাকে। যারা শারীরিক পরিশ্রম করবার সুযোগ পায় তাদের শরীর খুব শিগগির ভাঙ্গে না। এজন্য গৃহস্থ ঘরের শরীর ও মন কুড়ে –বিলাসী ঘরের মেয়েদের চেয়ে অধিক সুস্থ ও প্রফুল্ল।