সাধনার কোনো কোনো ব্যাপারে যদি প্রথম বারে ব্যর্থ মনোরথ হও, পরাঙ্মুখ হয়ো না–বারে বারে আঘাত করো, দুয়ার ভেঙ্গে যাবে। তাড়াতাড়ি না করে ধীরে ধীরে অগ্রসর হও। ধরে থাক, ক্রমশ তোমার শক্তি ও সুবিধা বাড়তে থাকবে। গিরি-শির হতে যখন পাথরখণ্ড নামতে থাকে, তখন তাকে প্রথমটায় দেখে মনে হয় এই নগণ্য পাথরের টুকরাটা কিছু নয়। ক্রমে যখন সে নিচে নেমে আসে, তখন তার শক্তি হয় কত ভয়ানক। সম্মুখে যা কিছু পায় ভেঙ্গে চূর্ণ করে নিয়ে যায়।
ব্যর্থতা, দুর্ভাগ্য ও বিপদ তোমার সকল উদ্যম ব্যর্থ করে দিচ্ছে। তোমার মনে যে উৎসাহ, যে কর্মশক্তি ছিল, তা যেন নিবে যাচ্ছে। এটা ঠিক জেনো কোনো সাফল্যই সহজে লাভ হয় না। রাস্তার পার্শ্বে যে বড় বড় বাড়ি দেখতে পাও, তার পেছনে একটা মানুষের কত সাধনা, কত বেদনা রয়েছে, তা কি কল্পনা করেছ? এ জগতে শক্তি সাধনার জয় হয়ে থাকে। বাপ-দাদার সম্পত্তি ও টাকা যারা পায়, তাদের পক্ষে সংসারের কঠোরতা অনুভব করা খুব কঠিন, কিন্তু সাধারণের পক্ষে সুখ ঐশ্বর্য সহজে লাভ হয় না। ধৈর্য ধরে দুঃখজ্বালা বাধা-ব্যর্থতাকে উপহাস করে ধরণীর ঐশ্বর্য লাভ করতে হবে।
দুঃখ-বেদনার ভিতর দিয়েই তো মানুষের মনুষ্যত্ব জাগে। সুতরাং দুঃখ দেখে ভয় পেলে চলবে না। দারিদ্র্য ও কষ্টের আঘাত খেয়ে যে জগতে আসন রচনা করেছেন তার মনুষ্যত্ব, জ্ঞান ও সুখ পালিত মানুষের চেয়ে অনেক বেশি।
অনেক বড় লোক তাই নিজেদের ছেলেদেরকে বাল্যে সাধারণ কাজ করতে দেন। এটি উত্তম প্রথা। যতই বড় হও না কেন, বড় আসন ধরে রাখবার জন্যে জীবনের বহু অবস্থার সঙ্গে আমাদের পরিচিত হতে হবে। যে সমস্ত বড়লোকের ছেলে কোনো কালে দুঃখের পরশ পায় নি, তাদেরও কালে চরিত্রহীন, যথেচ্ছাচারী ও মূর্খ হবার খুবই সম্ভাবনা। ভবিষ্যৎ জীবনে সম্পূর্ণ মানুষ হবার জন্যে আমাদের বাল্যকালের যাবতীয় সাধারণ কাজ করতে হবে, তা আমার অবস্থা যতই ভালো হোক।
অবস্থা যেমন হোক না, যত বিপত্তিই আসুক না, ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়ে যাবেই। বিশ্বাসই আমাদের মুক্তি অব্যর্থ করে দেয়-সঙ্কোচ অবিশ্বাস মানুষকে নিতান্ত দরিদ্র করে রাখে। বিশ্বাসের শক্তি কতখানি, মানবজীবনের কাছে এ যে কত বড় দান তা আমি ভালো করে পরে বলবো। ইচ্ছা ও বিশ্বাসের সঙ্গে তোমার কর্মশক্তি তোমার জাগ্রত হবে, তোমার সম্মুখের কুয়াশার ভিতর দিয়ে জয়ের পথ পরিষ্কার হয়ে উঠবে।
জীবনকে যদি উন্নত করতে না চাও, তবে ধীরে ধীরে তোমার পতন হতে থাকবে। মানুষ একই অবস্থায় থাকতে পারে না–তাকে সামনে এগোতে হবে, নইলে পেছনে হঠতে হবে, এইটে হচ্ছে স্বাভাবিক নিয়ম। এক জায়গায় সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। অহঙ্কারে যদি মন ভর্তি হয়ে থাকে অথবা চুল পেকেছে বলে নিজেকে জ্ঞানী মনে করে চুপ করে বসে থাক, তবে প্রতিদিন তোমার অধঃপতন হতে থাকবে। জীবনের কোনো অবস্থায় নিজেকে সম্পূর্ণ মনে করো না। এ করলে তোমার মনের অবনতি অবশ্যম্ভাবী–সে অবনতি তুমি কিছুই বুঝতে পারবে না।
অর্থ, ক্ষমতা ও মর্যাদার অহঙ্কারে যদি ভিতর ও বাইরের দিকে না তাকিয়ে চোখ বুজে বসে থাক, তা হলে বুঝব তুমি দরিদ্র, একটা অনাবশ্যক মাংসস্তূপ–সে জগতে এসেছিল একেবারেই বিনা কারণে–তার গুণহীন দেহটাকে শুধু বাঁচাতে।
অসত্য জীবন যাপন করে মানব সেবায় কোনো আবশ্যকতা নেই। যে হৃদয় পাপ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠে না, তার মানুষের কল্যাণ কামনা করবার কোনো অধিকার নেই। এক ডাক্তার ভায়াকে আমি দেখেছি, তিনি দিবারাত্রি জাতির কল্যাণ কামনা করেন, অথচ তিনি মানুষের নিকট হতে অম্লানভাবে ঘুষ গ্রহণ করেন।
ইসলামের মুক্তির অর্থ সত্য ও ন্যায় জীবনের প্রতিষ্ঠা–মানব প্রেম অসত্যের বিনাশ। যে মানুষ প্রতিবেশীর অর্থ অপহরণ করে, যে নিজের চরিত্রকে পবিত্র ও নির্মল করতে সচেষ্ট
হয়, যে মূর্খ ও নীচ, যে মানুষকে কঠিন কথা বলতে লজ্জা বোধ করে না–সে যেন সমাজের কল্যাণ চিন্তা না করে। সেই দুর্বত্ত ভণ্ড যেন ইসলামের স্বাধীনতা না চায়। দূর হোক সে আমাদের ভিতর হতে।
ফিলিপ সিডনী (Philip Sydney) বলেছেন, কোনো পথ যদি না থাকে তবে আমি একটা তৈরি করে নিতে পারি। সত্যি তো–জীবনকে উন্নত করবার পথ কোনো। অবস্থাতেই রুদ্ধ হয় না, চাই তোমার আগ্রহ। যে কাজে পাপ ও অন্যায়ের ছায়া নেই তা করতে এত লজ্জা কেন? মানুষের পদলেহন করতে লজ্জা হয় না? খোদার আদেশকে অমান্য করে পয়সা উপায় করতে তোমার মনে ভয় হয় না? অন্ধ সমাজ যে কাজকে হীন বলছে–বিশ্বাস কর সে কাজ হীন নয়। তোমার উপর যারা নির্ভর করে আছে, তাদের দারিদ্র্য ঘুচাবার জন্য মানুষের কাছে দুর্বলতা জানিও না বা অর্থ ভিক্ষা করো না। আল্লাহর দেওয়া দুই বাহু আছে; তাই পরিচালনা করে তুমি জীবনের পথ কেটে নাও। যদি সমাজ ও পরিচিত লোক দেখে লজ্জা হয়, তবে কোনো অপরিচিত দূর দেশে চলে যাও। আমেরিকা, বিলেত ও জাপানের বহু উদ্যমশীল মানুষ কত সাধারণ কাজ করে জীবনকে উন্নত করেছেন, সে খবর হয়তো তোমরা রাখ না।
মহৎ মানুষের একটা স্বভাব হচ্ছে এই যে, তারা মানুষের ব্যথা দেখে চুপ করে থাকতে পারে না। ডাক্তার জনসনের বাড়ি ছিল দীন-দরিদ্রের আখড়া। অপরিচিত দুঃখী মেয়ে পুরুষ সবাই তাঁর পরম আত্মীয় ছিল। একবার একটা খোকা পথের মাঝে কেঁদে তাদের দুরাবস্থার কথা জানায়। সেই ছেলেটিই তার বুড়ো মায়ের একমাত্র অবলম্বন। কোনো লোকের দরকার ছিল না, তবুও জনসন ছেলেটিকে তখন-তখন চাকরি দিলেন।