ধর্মমন্দিরের কথা ভাববার আগে আমাদের জ্ঞান-প্রচারের কথা ভাবতে হবে। মানুষকে উন্নত, জ্ঞানী ও সৎস্বভাব করবার জন্যে যিনি যে প্রচেষ্টা করুন না, তিনি মহৎ, তাঁরই ধর্মজীবন সার্থক হয়, তিনি পুণ্যবান ও বরেণ্য।
চারিদিকে লক্ষ নরনারী পাপে, মূর্খতার অত্যাচারে, মানুষের উপেক্ষায় তিলে তিলে মরে যাচ্ছে, তাদের জন্যে কি তোমার করবার কিছু নেই? বিশ্বকে উদ্ধার না করতে পার, তোমার গ্রামটিকে কি তুমি উচ্চজীবনের ধারণা দিতে পার না? তাদের মধ্যে ধর্ম ও মনুষ্যত্বের বীজ উপ্ত করতে পার না? কত বালক-বালিকা, কত যুবকের জীবন নিরাশায় ব্যর্থ হয়ে যাবে। তাদের মধ্যে শক্তি ও বিশ্বাসের আগুন জ্বালাতে পার না? তুমি মানুষ, তুমি ভাব ও ভাষার প্রাণপূর্ণ প্রতিচ্ছবি–ঘরের কোণায় বসে থাকবার জন্য তুমি নও। আজ হাটের মাঝে তোমাকে এসে দাঁড়াতে হবে। কাজ তোমার অফুরন্ত। বৃথা জীবন নষ্ট করে দিচ্ছ কী বলে? মানুষের পাপ ও ব্যথা দেখে তোমার মনে জ্বালা উপস্থিত থোক। শয়তানকে হত্যা করবার জন্যে তোমার মাঝে আল্লাহর মহিমা প্রকাশ হোক।
জ্ঞানালোচনা করার পক্ষে আমাদের দেশের একটা ভয়ানক বাধা আছে। বিদেশী ভাষায় কোনো উত্তম পুস্তকও মনকে আনন্দ দান করতে অসমর্থ। নিরানন্দের ভিতর দিয়ে কি জগতে কোনো কাজ সিদ্ধ হয়? নিজের ভাষায় সহস্র বই হওয়া চাই। মানুষের ভিতর জ্ঞানস্পৃহার জন্যে একটা পিপাসা হলে বিদেশী ভাষায় তা মিটাবার কোনো সুবিধা হয় না। জ্ঞান অর্জন পথের এই বাধা জাতির পক্ষে কত বড় ক্ষতির কথা তা আমি বলতে পারি না।
হচ্ছে হবে–এই বলে সময়কে যেতে দিলে কোনো কালে কোনো কাজ হবে না। জীবনে হাসি খেলার যে আবশ্যকতা নেই তা বলছি নে। কিন্তু শুধু হাসি খেলা দিয়ে এ সোনার জীবনকে ব্যর্থ করে দিয়ে লাভ কী? লেখাপড়া শিখে চাকরি করছ। আশা করেছ–জীবন অর্থ উপায়, পান ভোজন আমোদ-উৎসব করেই কাটিয়ে দেবো। জমিদারিতে যথেষ্ট টাকা পাওয়া যায়, সুতরাং সময়কে উড়িয়ে দেওয়ার অধিকার তোমার রয়েছে। অনেক টাকা আছে বলে কি কতগুলি সাগর-জলে ফেলে দেওয়া যায়? সময়ের আর এক নাম অর্থ–তা কী জান? শত রকমে সময়ের কাছ থেকে লাভ আদায় করে নিতে পার। সময়ের সদ্ব্যবহার করলে তোমার আরও উন্নতি হবে; তখন-তখন ফল পেতে না পার কিন্তু ধীরভাবে বিশেষ কোনো সাধনা ধরে থাকলে পাঁচ অথবা দশ বছর পর তুমি তোমার সাধনার ফল দেখে বিস্মিত হবে। নিজের কোনো লাভের জন্যে যদি পরিশ্রম না করতে চাও, তবে মানুষ–তোমার প্রতিবেশীর জন্য তুমি তোমার জীবনকে সার্থক করো।
এ জগতে জ্ঞান-সাধনা ব্যতীত কোনো জাতির সম্মান হয় না। যদি জাতির সম্মান বাড়াতে চাও তা হলে জ্ঞানের সাধনা করতে হবে। জাতিকে বড় করবার জন্যে তোমাকে পরিশ্রম করতে হবে। কারো দ্বারা অপমানিত হয়ে তোমার মর্মবেদনা উপস্থিত হয়েছে, শুধু মানুষকে গালি দিয়ে তুমি নিজের বা জাতির সম্মান বাড়াতে পার না। যার মধ্যে মানুষ জ্ঞান ও চরিত্রশক্তি দেখে তাকেই লোকে সম্মান করে। তুমি নিজে জ্ঞানী ও চরিত্রবান হও, মানুষকে জ্ঞানী ও চরিত্রবান করতে চেষ্টা কর।
বিপুল অর্থ জমিয়েছ, কিন্তু বিশ্বাস কর যাদের জন্যে তুমি এই অর্থ রেখে যেতে চাও তারা যদি জ্ঞানী ও চরিত্রবান না হয়, তাহলে তোমার অর্থ তাদের কল্যাণ না করে শুধু অকল্যাণই করবে। তোমার অর্থ হবে তাদের পাপ অন্যায়ের সহায়। যদি পুত্ররা স্কুল কলেজে লেখাপড়া না শেখে তা হলেও ইচ্ছা করলে তাদের তুমি মানুষ করে তুলতে পার। এজন্যে তোমার সাধনা চাই। বাইরের শিক্ষকদের সাহায্য না নিয়ে তুমি নিজেই তোমার পুত্রগণকে নৈতিক বল দেবার জন্য পরিশ্রম কর কুড়েমি করে অথবা ক্রোধে তাদের জীবনকে ব্যর্থ করে দিও না।
এ জগতে তুমি মানুষকে যা কিছু দাও না, জ্ঞান দান অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ দান আর নেই। পতিতকে পথ দেখান, জ্ঞানান্ধকে জ্ঞান দান করাই শ্রেষ্ঠ ধর্ম। জ্ঞানী হতে হলে স্কুল কলেজের সাহায্য ব্যতীত তা হবে না। এরূপ মনে করা নিতান্ত ভুল। মানুষ যে কোনো অবস্থায় চেষ্টা করলে বড় হতে পারে।
মানুষের ভিতরে এমন কোনো জিনিস আছে, যাকে তৈরি করলে সে অসাধ্য সাধন করতে পারে। এমন রহের মালিক হয়ে যদি তুমি তোমার জীবনকে ব্যর্থ করে দাও, তাহলে তুমি পাগল। কত লক্ষ কোটি মানুষ মানবাত্মার অধিকারী হয়ে জীবনকে কেমন মূল্যহীন করে দিচ্ছে।
তোমার ভিতরে অফুরন্ত ক্ষমতা রয়েছে, তুমি অজেয় শক্তির রাজা। কেন তুমি তোমার শক্তি, এত সম্পদ হেলায় মাটি করে দিচ্ছ? তুমি মানুষ, তোমাকে জাগতে হবে, তোমাকে দাঁড়াতে হবে, তোমাকে গান গাইতে হবে, তোমাকে বিশ্বের সাথে যোগ স্থাপন করতে হবে। তোমার লুকিয়ে থাকবার অবসর নেই।
জীবনে যদি কিছু করতে চাও, তাহলে অসীম ধৈর্য চাই। মানুষের সাফল্যের অন্যতম কারণ ধৈর্য। আচার্য বসু বলেছেন, বিফলতা দেখে যে দমে যায় না, সেই জয়ী।
কুরানে বহুস্থানে খোদা মানুষকে ধৈর্য ধারণ করতে বলেছেন।
কত প্রতিভাশালী যুবকের জীবন আলস্যে ও মূল্যহীন আমোদ-উৎসবে নিরর্থক হয়ে গিয়েছে। সাধনা ও পরিশ্রমের দ্বারা কত সাধারণ মানুষ জীবনকে বড় করে তুলতে পেরেছেন।
ইয়াগো (lago) বলেছেন, আমাদের জীবনটা কতকটা বাগান বাড়ির মতো। এ বাগানে যেমন ফুলের গাছ লাগাবে, তেমন ফুলই ফুটবে।