যতগুলি ইংরেজ সেখানে ছিলেন-নারী, পুরুষ, শিশু বুড়ো সবাই সেই ঘেরার মাঝে জমা হয়েছিলেন।
বাইরে একটু দূরে একটা ঘরে এক পিপে বারুদ ছিল, কিন্তু কে যাবে সেটাকে আনতে? অসভ্য দস্যুগুলি তীর তুলৈ বসে আছে। সেই ক্ষুদ্র দলটির মুরুব্বী সবাইকে বিপদের কথা বুঝিয়ে বললেন। কয়েকজন যুবক বলল–আমরা বারুদ আনতে যাবো। সংখ্যায় সেখানে মাত্র ষোলজন পুরুষ ছিল!
একটা সতেরো বছরের মেয়ে উঠে বললেন–তোমাদের কারো যাওয়া হবে না। এই ক্ষুদ্র দলের পক্ষে একটা মানুষের জীবনও খুব মূল্যবান। আমি নারী এবং অবিবাহিতা আমার জীবনের মূল্য খুব কম। তোমাদের জন্যে জীবন দিতে চাই আমি। আশ্চর্যের বিষয় কেউ তাকে তার সংকল্প ত্যাগ করাতে পারলেন না। সাহসী বালিকা বেড়ার দরজা খুলে বাইরে বের হলেন। বিপদসংকুল পথ অতিক্রম করে তিনি যখন বারুদের ঘরের দিকে অগ্রসর হতে লাগলেন তখন সকলে দারুণ শঙ্কায় তার দিকে চেয়ে রইল। সকলেই মনে করছিল এখনই দস্যুদের তীর এসে তার বুকে পড়বে। খোদা বালিকার মহত্ত্ব ও উচ্চতায়। মুগ্ধ হয়েছিলেন। বালিকা বারুদ কাঁখে করে নির্বিঘ্নে কয়েক মিনিটের মধ্যে ফিরে এলেন। সতের বছরের এই বালিকার মনুষ্যত্বের সাহস সেই ছোট দলকে বাঁচিয়েছিল।
যে মানুষের মাঝে মনুষ্যত্বের গৌরব আসন নিয়েছে, তার মধ্যে যে সৌন্দর্যের প্রকাশ হয়, তার সঙ্গে দেহের সৌন্দর্যের কোনো তুলনা হয় না। মানব-মঙ্গলের জন্যে মানুষ যে ত্যাগ স্বীকার করে, তা শুনলে কান পবিত্র হয়, লেখনী ধন্য হয়। তাদের স্পর্শে এসে জগৎ ধন্য হয়েছে। তাদেরই জয়গান শোনাবার জন্যে আকাশে চাঁদ ওঠে। বিশ্বের সৌন্দর্য। তাদেরই সংবর্ধনার জন্যে নত মাথায় দাঁড়িয়ে আছে। ঊষার বাতাস তাদেরই পুণ্যমাধুরী বুকে নিয়ে দিকে দিকে ছোটে।
যে জীবন মহত্ত্বের মঙ্গল–আলোকে উজ্জ্বল হয়ে উঠল না, যেখানে জ্ঞানে মনুষ্যত্বের দীপ্তি শোভা পেলো না–সে জীবনে কাজ কী?
জীবনকে সুন্দর ও পবিত্র করে যদি না তোলা গেল তবে তাকে সুখী করবার জন্যে এত উৎসব আয়োজন কেন? এই ছার নিকৃষ্ট মাংসের স্তূপটাকে বাঁচিয়ে রেখে কোনো লাভ নেই। ওতে মূল্যবান পোশাক জড়াবারও কারো কোনো অধিকার নেই।
জীবনে কাজ করতে হবে। কাজহীন জীবন শত পাপের আবাস। কি বাল্যে, কি যুবক বয়সে সকল সময়ে কাজ চাই। যদি পিতার অগাধ অর্থ-সম্পত্তি পেয়ে থাক, যদি হাতখানি মুখে তুলতেও দশজন দাসদাসী হাজির হয়, তা হলেও তোমাকে কাজ করতে হবে, দুঃখ বেদনার অভিশাপ দিয়ে খোদা এ জগতে অন্তহীন কাজের পথ করে দিয়েছেন।
তুমি অর্থশালী, তোমার কোনো কাজ নেই। কত মানুষ নত হয়ে তোমাকে সালাম করে। কত খাবার সামগ্রী তোমার সামনে আসে, কত ভেট-ডালি তোমার মনকে তুষ্ট করে। তোলে, কিন্তু তবুও বলি কাজ নেই এ কথা তুমি কখনও ভেবো না। তোমার মনের দিকে তাকিয়ে দেখ, সে কত অন্ধকারে পড়ে আছে। তুমি মানুষ, তোমাকে জ্ঞান-সাধনা করতে হবে। যে পয়সার জন্যে পুস্তক পাঠ করে, সে অধমের অধম!
শিক্ষিত লোককে এবং উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদেরকে বই ও জ্ঞানালোচনার সঙ্গে কোনো সম্বন্ধ না রেখে হেসে-খেলে জীবন কাটাতে দেখেছি। এরা ঘি-মাংস খেয়ে থাকে, মানুষ। এদের সম্মান করে থাকে। কী মর্মবেদনা!
তুমি অর্থে বড়? তুমি উচ্চ রাজকর্মচারী? নবাবের কন্যাকে বিয়ে করেছ? পরিপূর্ণ তৃপ্তিতে মন তোমার ভরে আছে, এতটুকু দুঃখ তোমার নেই। তোমার ঐ হাসি ঐ রহস্য, আলাপের অন্তরালে দেখতে পাচ্ছি তোমার দীনতা, তোমার দারিদ্র্য, তোমার পাতিত্য। তুমি তো বড় নও। যে হৃদয় জ্ঞানের সঙ্গে কোনো যোগ রাখে না, যে মানুষ মনকে মহৎ ও উচ্চ করে তোলার জন্যে কিছুমাত্র ব্যগ্র নয়, সে তো ছোট। সে তার সিংহাসন ছেড়ে নিচে এসে দাঁড়াক।
জীবনকে বড় করবার জন্যে তুমি কঠিন পরিশ্রমের সঙ্গে নানা শাস্ত্রের আলোচনা করতে পার। এ জগতের কিছুই তো তুমি জান না? এ হেন মানব-জীবন ব্যর্থ হয়ে যাবে। এটা কী সহজ কথা! লক্ষ কোটি বছর পরেও তো এই সাধের জীবনকে ফিরে পাবে না। অতএব কেমন করে তুমি এর অপব্যবহার করতে সাহস পাচ্ছ? আকাশে, তারায়, আলোকে, উদ্ভিদে কত রহস্য গোপন হয়ে রয়েছে–সে রহস্যের সন্ধানে কত জীবন কাটিয়েছেন। তুমি কাজ খুঁজে পাও না–এর অর্থ কী?
যেভাবে ধর্ম পালন করে তুমি আত্মপ্রসাদ লাভ করছো, এটা ধর্ম নয়। মানুষের ব্যথা বেদনা-তার পতিত জীবন দেখে যদি তুমি তোমার মনে কোনো ব্যথা না জাগে, তাহলে তুমি ধর্ম উৎসব কর, আরব দেশে যাও, তোমার বেতন এক সহস্র টাকা হোক–তুমি আসলে ছোট। ধর্মজীবনের সত্য তোমার কাছে ধরা পড়ে নি। অন্তহীন নরনারীকে আত্মা দিয়ে, শরীর দিয়ে সেবা করতে হবে–কেমন করে ভাবো তোমার কাজ নেই।
দেশের লোকের মধ্যে দেখেছি মানুষ জীবনে যতই হীন ও নীচ থাকুক না কেন, মৃত্যুর পর কাউকে দিয়ে কিছু কোরান পড়িয়ে অথবা কিছু দান করে তার মুক্তির পথ পরিষ্কার করে দেওয়ার আয়োজন হয়। বেশি কিছু করলে অর্থ ব্যয় করে মসজিদ তোলা হয়। মানুষগুলি বোঝে না মসজিদে যাবার আগে মানুষকে মাদ্রাসায় কুরানের কালামগুলি মুখস্থ করে নিতে হবে। সবাই মসজিদ তুলতে ব্যস্ত। তারা বোঝে না জগতে যদি বিদ্যালোচনা না থাকে তা হলে আপনা-আপনি মসজিদগুলি ভেঙ্গে পড়বে। পতিত জাতি কখনও তার ধর্মমন্দির খাড়া করে রাখতে পারবে না। আপনা-আপনি খোদার ঘরগুলি ভেঙ্গে মাটিতে মিশে যাবে।