একটা মানুষ মরে গেলে পল্লীর সকল মানুষের চোখ দিয়ে পানি পড়ে। শহরে কী তাই? কে কার খবর রাখে? কারো ব্যাধি হলে তাকে দূর করে দিতে পারলেই শহরের লোক নিশ্চিত হয়।
পল্লী বালকের স্নেহপ্রবণ ভাব কোনোকালে যায় না। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সে ভাবটি আরও উদার ও ব্যাপক হয়ে পড়ে। পক্ষান্তরে শহুরে লোক যতই বড় হতে থাকে জীবন সংগ্রামের কঠিন ভাবনা ভাবতে হয়, ততই তার মনের সঙ্কীর্ণতা ও স্বার্থপরতী বেড়ে ওঠে।
শ্যামল প্রকৃতি-ছায়ার সঙ্গে পরিচিত হবার সুযোগ শহরবাসীর নাই। দেশের এত খবর, এত রক্তারক্তি, এত ওলট-পালট এসবের কোনোটির সঙ্গে তার সহানুভূতি নাই। সে কেবল নিজের ভাবে মশগুল।
নিরালা নির্জন স্থান জীবনের বা মনের উন্নতির পক্ষে খুবই অনুকূল। মনে উন্নতি না। হয়ে শুধু পয়সায় যদি মানুষ বড় হয় তবে সে বড় হওয়ার কোনো মূল্য নাই। শহরে লোকের পক্ষে একাকী হয়ে থাকা একেবারেই অসম্ভব। সহস্র নতুন মুখ সহস্র নতুন চিত্র তার মনকে সর্বদা উত্তেজিত করে রাখে। কোনো জিনিসের ভেতরের দিকে তাকাবার তার কোনো অবসর নেই।
গ্রামের মাঠে ধানের ক্ষেতের শ্যামল শোভা শহরে নেই। ফসল তৈরি করবার জন্যে পল্লীর মানুষেরা মাঠে যে পরিশ্রম করেন তাতে আনন্দ। কৃষকেরা অশিক্ষিত বলে লোকে তাদের ঘৃণা করে থাকেন। শিক্ষিত লোক এই সমস্ত কাজ করলে কেউ তাদের ঘৃণা করতে পারে না।
কী করে ধান তৈরি হয়, দেশের মানুষ কেমন করে ফসল তৈরি করে, পল্লীবাসীরা কেমনভাবে জীবন-যাত্রা নির্বাহ করে, এ বিষয়ে শহরে লোকের কোনোই ধারণা নেই। সুতরাং দেশ সম্বন্ধে তাদের জ্ঞান খুব অসম্ভবপূর্ণ।
বিলেতের অধিকাংশ ইঞ্জিনিয়ার গ্রামের মায়ের ছেলে। নদীর নিচে রেলের রাস্তা তৈরি, বড় বড় সেতু নির্মাণ এ সব শহরের লোকের দ্বারা হয় না।
নিউটন, জর্জ স্টিফেনসন বাল্যকালে অজ্ঞাত পল্লীতে মানুষ হয়েছিলেন। পল্লীতে অজ্ঞাত হয়ে অনেক বড় মানুষ জাতির সেবা করে থাকেন। নাম যখন তাদের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে, পল্লীবাসী যখন সাধনা পথে বিঘ্ন হয়ে দাঁড়ায় তখন তারা বাধ্য হয়ে শহরে আসেন। সাহিত্যিক বাফুন (Buffon) কিন্তু চিরকালই পল্লীমায়ের আঁচলে বসে জাতির সেবা করেছিলেন। তিনি শহরে জীবন পছন্দ করতেন না।
শত শত মানুষের শ্রদ্ধা ভক্তি যিনি পাচ্ছেন, যাঁর চারিদিকে কত মানুষ ভীত ব্যাকুল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে–তিনি যে কোনোকালে খোকা ছিলেন, মায়ের বুকে কেঁদেছেন, তা বিশ্বাস করতে মনে যেন চায় না। অধ্যাপক আলেকজাণ্ডার মারে (Alexander Murray) এরা এক সময়ে মাঠে মাঠে মেষ চরাতেন। গ্রামের সুখ-দুঃখের এক সময় বিমলিন করেছিল। মধ্যাহ্ন নিঝন মাঠের মাঝ দিয়ে অথবা নদী পথে যাবার সময় প্রাণের মাঝে যে ভাবের উন্মেষ হয় তা শহরে তা অনুভব করতে পারি নে। প্রান্তরের বুক কাপিয়ে দিগন্তের বাতাস পথিকের মনে স্পন্দন আনে, তা শহরে কই? জ্যোৎস্নাপ্লাবিত প্রকৃতির পুলক উৎসব, বর্ষাকালে মেঘের মাতামাতি ঝিল্লিমুখর নিশীথরাত্রি; গ্রামান্তরে নারী দুঃখের করুণ প্রতিধ্বনি শহরে নাই। কতদিন নির্জন মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে কত কথা ভেবেছি, কোনো দূর জগতের অব্যক্ত আহ্বান এসে প্রাণকে ব্যাকুল করে তুলেছে; শহরে তা কই।
পল্লী মাঠ-প্রান্তরগুলি মানুষকে চিন্তাশীল করে তোলাবার পক্ষে খুব অনুকূল। চিন্তার সঙ্গে যে হৃদয়ের যোগ নেই, সে হৃদয় বড় দরিদ্র। বেঞ্জামিন ব্রডি (Benjamin Brodie) মাঠে মাঠে ঘুরে চিন্তা করতে শিখেছিলেন। নতুন নতুন সত্যের সঙ্গে তিনি পরিচিত হয়েছিলেন, যখন তিনি একাকী পল্লীর পথ ধরে ঘুরে বেড়াতেন।
দেশের গ্রামগুলির অবস্থা বড়ই শোচনীয়। সেখানে না আছে রাস্তা, না আছে কোনো পাঠাগার। বিদ্যালোচনা ব্যতীত সাধারণ লোকের উন্নতি হবে কীসে? বই না পড়ে কী মানুষ আত্মার দারিদ্রে লজ্জিত হয়? সকলেই মুখে বলে, সদা সত্য কথা বলা উচিত; কিন্তু মনের উপর কথার দাগ ফেলান কি সহজ কথা? মানুষকে এত বিচিত্র পন্থার ভিতর দিয়ে সত্যে দীক্ষিত করতে হবে, তার কী ঠিকানা আছে? লেখক ও সাহিত্যিকরা কবিতা, গল্প, ইতিহাস ও কাব্যের ভিতর দিয়ে মানুষকে সত্য পথে অহ্বান করছেন। জীবনকে বড় করে তোলাবার জন্যে সর্বদা বই পুস্তক পড়তে হবে। সাধারণ মানুষকে উচ্চ প্রেরণা দেবার জন্যে তাকে জ্ঞান সাধনায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে; অথচ এ কাজের জন্যে কোনো চেষ্টা নেই। জ্ঞানের সেবা না করলে কোনো মানুষের বা কোনো জাতির দুঃখ ঘোচে না। কলেজ ও স্কুলে ক’টি লোক যেতে পারে? পল্লীতে যারা অজ্ঞাত জীবন-যাপন করছে তাদের দুয়ারে যেয়ে জ্ঞান ও সাহিত্যের উপহার নিয়ে দাঁড়াতে হবে।
মানুষের সহিত মানুষের যোগ হবার, সুবিধা গ্রামে খুব কম। মানুষগুলি কুপমণ্ডুক হয়ে বসে থাকে, এর কারণ রাস্তাঘাটের গ্রামের লোক জানতে পারে না। একে সেখানে মোটেই ভাব নেই; তার উপরে যেটুকু আছে, তারও আদান-প্রদানের সুবিধা সেখানে খুব কম। জাতিকে বড় করতে হলে পল্লীর মানুষকে প্রথম জাগাতে হবে। গ্রামে গ্রামে পাঠাগার খুলতে হবে; চলাচলের সুবিধা করে দিতে হবে। যারা শিক্ষিত তাদের ঘৃণা অহঙ্কার পরিহার করে পতিত মানুষের জন্যে বহু ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। মানুষের জন্যে মানুষের মাথাব্যথা হওয়াই প্রয়োজন। মানুষকে ভুলে যারা ধর্মজীবনের আদেশগুলি পালন করতে যান, তাদের ধর্ম-পালন কিছুই হয় না। মানুষের জন্যে মানুষকে কাঁদতে হবে।