শহরের রাস্তার ধারে দেখা যায়–কোনো আশি বছরের বুড়ো শীর্ণ দেহখানি প্রখর রৌদ্রের মধ্যে এলিয়ে দিয়ে একটা পয়সার জন্যে কাঁদছে। কারো হাত-পা খসে পড়েছে, অতি কষ্টে ব্যথিত দেহখানি টেনে নিয়ে সামনে অগ্রসর হচ্ছে। কত মানুষ অদেখা অপোছা হয়ে রাস্তায় মরে কে তার খবর রাখে? স্মরণ রাখবেন–এরা মানুষ, পশু নয়, আমাদের দেশের মানুষ আমাদের ভাই। কত যে ভিখারিনী দলে দলে দুটি চালের জন্য দুয়ারে দুয়ারে ঘোরে, তাদের কোলে ছোট ছোট শিশু। কোনো নারীর পুরুষের মতোই হাত পা খসে পড়েছে। কোথায় এরা রাত্রি কাটায় তাও জানি না। মুক্ত আকাশতলে বৃষ্টি-বাদলায় গাছের তলায় হয়তো এরা বিশ্রাম করে। এদের মধ্যে অনেক যুবতীও আছে যারা দুদিন আগে রূপের ঝলকে পথিককে মাতিয়েছিল।
অনেক দিন আগে, একদিন কলকাতার এক রাস্তায় দেখলাম একটা বালিকা তার শিশুপুত্রকে কোলে করে শীতে কাঁপছে। কাছে যেয়ে জিজ্ঞেস করলাম–তোমার বাড়ি কোথায়? সে বললো, নদীয়া জেলায়। অনেকক্ষণ কথা বলার পর বুঝতে পারলাম, দু বছর আগে সে কোনো যুবকের প্ররোচনায় বাড়ির বের হয়! যুবকটি তাকে নিরাশ্রয় করে পালায় নি, সম্প্রতি কী একটা অন্যায় করে জেলে গিয়েছে। এখন নিরাশ্রয় হয়ে পথে বেরিয়েছে। যেখানে বাস করছিল, বাড়ির খাজনা না দিতে পারায় তারা তাকে বের করে দিয়েছে। শিশুটির বয়স মাত্র তিন মাস। তার বাপই হচ্ছে সেই লোকটি। কোথায় এর বাড়ি? যখন সে ছোট ছিল কত লোক তাকে সোহাগ করেছে আর আজ সে কোথায়? স্নেহ নাই, মায়া নেই, আপন বলতে তার এ সংসারে কেউ নাই। তার ঘর-দুয়ার, তার পরিচিত খেলার সাথীরা আজ কোথায়? একটুখানি ভুল করায় জীবন ভর তাকে এক নির্বাসনদণ্ড ভোগ করতে হবে। সে যে নারী–তার হৃদয়-বেদনা বোঝবার মতো কেউ নাই। এই শ্রেণীর বহু মেয়ে শহরে বাস করে। শয়তান প্রকৃতির লোক যুবতী মেয়েদের চুরি করে এনে শহরে পাপ কাজের জন্যে বিক্রি করে–যারা এককালে ছিল পল্লী পরিবারের শুভ্র ফুলের মালা। আর একটা মেয়ের কথা জানি। এই মেয়েটির বাড়ি হচ্ছে এক পল্লীতে। একটা বুড়ি গঙ্গা স্নানের কথা বলে তাকে কালীঘাটে নিয়ে আসে। বালিকাটি সরল মনেই স্নান করে পুণ্য অর্জন করবার জন্যে রেলে চড়ে শহরে এসেছিল। স্নান করে যখন সে উপরে উঠলো তখন বহু অন্বেষণ করে সে বুড়িকে খোঁজ করতে পারলো না। তারপর তার জীবনে বহু ঘটনা ঘঠেছে। শেষকালে উদরের জ্বালায় ও লজ্জা নিবারণের জন্যে লজ্জা বিক্রয়ের ব্যবসা শুরু করেছে। একে ভদ্রঘরের মেয়ে বলেই বুঝছি। খোদার উপর তার খুব বিশ্বাস। পাপ জীবনের কথা স্মরণ করে সে বলল–কপালে লেখা ছিল; কী উপায় আমার, তাই বলুন। কষ্টে আমার মন ভেঙ্গে গিয়েছিল। ইচ্ছা করেছিলাম একটা সেলাই-এর কল কিনে দিয়ে তাকে স্বাধীন ও পবিত্র-জীবন যাপনের পথ করে দেবো; কিন্তু সাহিত্যিকের তো পয়সা। নাই। কেবল বেদনা আছে। মানব-জীবনের এই কঠিন দুরবস্থার কথা যখন মনে হয় তখন খোদাকে বলি, হে খোদা, আমাকে হত্যা করে এদের বাঁচাও অথবা এদের পথ করে দাও। অত্যাচারী সমাজের বিধানে এতভাবে কত মানুষের জীবন ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে।
আরও একটা পতিতা স্ত্রীলোক আমাকে যা বলেছিল, তা শুনলে আপনারা স্তম্ভিত হবেন। রাস্তার ধার থেকে সে আমাকে এ কথাগুলি বলে আহ্বান করছিল–আপনি আমার মা-বাপ, আমার ঘরে আসুন, আমাকে কিছু দিয়ে যান, নারী জীবনের শ্রেষ্ঠ ধন আপনাকে। দেব, তার পরিবর্তে আপনি কী কিছু দিবেন না? হারে হতভাগিনী, যদি পয়সাই থাকতো তা হলে সর্বস্ব দিয়ে তোমাদের এ পাপজীবন হতে উদ্ধার করতাম।
নদীয়া জেলা হতে মেহের আফজানকে শয়তানেরা কেমন করে চুরি করে এনেছিল, সে খবর সকলেই জানেন। সে ছিল কুলবধূ। শেষকালে তাকে হতে হয়েছিল এসেন্সমাখা সাধারণ নারী। কী বিস্ময় কী বেদনা–যা ভাবতে চোখে পানি আসে। এরূপ বহু ঘটনা নিত্যই ঘটছে। সেদিনও চব্বিশ পরগণার একটা মেয়েকে তার খালা মুখ বেঁধে চুরি করে এনে বালিগঞ্জে কুব্যবসার জন্যে বিক্রয় করে। শহরে যেসব পতিতারা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে, তাদের অনেকের জীবনের প্রথম পৃষ্ঠা যারপর নাই শোকাবহ, এদের কথা কে ভাবে? চরিত্র হারাবার ভয়ে কলঙ্কে লজ্জায় ভদ্রলোকেরা এদের কাছ থেকে দূরে সরে যান; কিন্তু শিক্ষিত মহিলারা কি এদের জন্যে কিছু করতে পারেন না?
সকল দেশেই কুস্বভাবা নারী পাপ ব্যবসা করে। কিন্তু আমাদের দেশের মতো অন্নের জন্যে কিংবা সমাজের অত্যাচারে তাদের এই কদর্য জীবন অবলম্বন করতে হয় না। যে শয়তানী সে ধ্বংস হয়ে যাক তার জন্যে কিছু হয়তো করবার নাই।
অন্যান্য দেশে রাস্তায় আর্ত-পীড়িতের জন্যে আশ্রম আছে কিনা ঠিক জানি না। রাস্তায় মানুষ মরতে দেখে কি ঘরের দুয়ার দিয়ে কি শুয়ে থাকা সম্ভব? এদের আঁখিজল, এদের ব্যথা কী চিরকালই ব্যর্থ হয়ে যাবে?
শহরে যে সব বড় বড় মান্যস্পদ ব্যক্তিকে দেখা যায় তাদের বাড়ি প্রায়ই শহরে নয়। পল্লীর অজ্ঞাত কুটিরে যিনি একসময় খেলা করেছিলেন আজ তিনি নগরে উচ্চ বেদীর উপর দাঁড়িয়ে জাতির কর্তব্য-কথা শোনাচ্ছেন। ভবঘুরে শহরবাসীরা চিরকালই ভবঘুরে। নিজেদের অত্যন্ত বুদ্ধিমান ভেবে অল্প বয়সে অত্যধিক চালাক হয়ে শহরে বালকেরা জীবনকে মাটি করে দেয়। পল্লীর শান্ত শীতল নির্জন মাঠ, গোধূলিলগ্নে পশ্চিমাকাশে সোনালি রাগ, নদী-তীরে পল্লীবালাদের কলহাসি, পালতোলা নৌকাগুলির অন্তহীন পথে যাত্রা শহরে কারো মনকে ভাবময় করে তোলে না। এখানে কেবল মুহূর্তে মুহূর্তে চিত্রপটের মতো দৃশ্য বদলাতে থাকে; মনে কোনো চিন্তা করবার সুযোগ পায় না। যে হৃদয় নিরালায় বসে মানব-সমাজ তথা বিশ্বের শত লীলা-রঙ্গ সম্বন্ধে চিন্তা করবার কিছুমাত্র অবসর পায় না, তার কী মনুষ্যত্ব থাকে? কল-কারখানার মতো শহরের লোকগুলি সুশৃঙ্খল জীবন কাটায়। কল-কারখানার সঙ্গে যেসব ভাব ও প্রাণের কোনো যোগ নাই–শহরের লোকগুলির জীবনও ঠিক তেমনি। নিত্য সকালবেলা উঠা, কাজের মতো করেই কিছুক্ষণ। খবরের কাগজে পাঠ করা, তারপর বাধা কাজে জীবন শেষ করে দেওয়া। চিন্তা করে বা ভেবে তারা জীবনের সময় নষ্ট করবার সুযোগ পায় না। ভাবপ্রবণ হয়ে শহরে লোক কাউকে আপন মনে করতে পারে না। স্বার্থ ও টাকার গন্ধ যেখানে পায় সেখানে যেয়েই। তারা হাজির হয়। তারা আপন মনে করে কেবল হয়তো পত্নীকে। জগতে আর কারো সঙ্গে তাদের সম্বন্ধ নাই।