কিছু থাক আর না থাক শহরের মানুষগুলি খুব বাবু ধরনের হয়ে থাকে। নিতান্ত আত্মীয় অন্তরঙ্গ বন্ধুকেও তারা সালাম করে বাড়ির বের করে দেয়। পরিষ্কার বাবু হয়ে চলাটা দোষের তা বলছি না। যারা টানাটানি করে জীবন কাটাতে অভ্যস্ত তাদের টানাটানি বোধ হয় কোনো কালে শেষ হবে না।খরচ করতে পার, বাবু হয়ে চলাতেও বিশেষ বাধা নাই, কিন্তু চাই তোমার ভিতরে একটা ভীষণ উদ্যম। তোমার শক্তিতে একটা কঠিন বিশ্বাস। সাবধান, জীবনকে উন্নত করবার উদ্যমে যেন কোনো প্রকার কলংক এসে না জোটে। অন্যকে হত্যা করে নিজেকে বাঁচাতে তো কোনোই আনন্দ নাই। মানুষের সুখ দুঃখের অনুভূতি সকলেরই এক। অন্যকে বেদনা দিয়ে নিজে কী সুখী হতে পারা যায়?
শহরে বহু বড় বড় ব্যবসায়ী রয়েছেন। এরা ইচ্ছা করলে, জাতি ও সমাজের কত কল্যাণ করতে পারে তা হয়তো এরা জানেন না। আমেরিকার এক ধনী ব্যবসায়ী গ্রাম্য লোকদের মধ্যে পাঠাগার স্থাপনের জন্যে, কোটি কোটি টাকা দান করে গিয়েছেন। কেউ ধর্ম প্রচারের জন্য–কেউ কুষ্ঠ ব্যধির চিকিৎসার জন্যে অজস্র টাকা দিয়েছেন। টাকা পয়সা উপায়ের সার্থকতা কীসে হয় এই কথা যখন বড়লোকেরা বোঝেন, তখনই তাদের টাকা উপায় সার্থক হয়। দীন-দুঃখীর অশ্রু মুছাতে, জাতির কল্যাণ ও জ্ঞান বর্ধন করতে যদি রিক্ত হস্ত হতে হয় সেও ভালো। টাকা এক জায়গায় জমা করে কোনো লাভ নাই। সেবা কার্যে যে টাকা ব্যয় না হয়ে মানুষের পাপের ইন্ধন যোগায়, সে টাকা সাগরজলে। ফেলে দেওয়াই ঠিক। জঘন্য সে টাকা, তাতে মানব-সংসারের কোনোই প্রয়োজন নাই।
শহরের একটা বড় রকমের বেদনা হচ্ছে প্রাণহীনতা, এ জন্যে পল্লীবাসীরা শহরের লোককে অত্যন্ত ঘৃণা করেন। মিথ্যা সম্মান-জ্ঞান বজায় রাখবার জন্যে অনেক শহুরে মানুষ অত্যন্ত হীনতার পরিচয় দিয়ে থাকেন। একবার বাড়ি ভাড়া নেবার জন্যে এক যুবকের কাছে গিয়েছিলাম। তিনি তার এক আত্মীয়কে আমাদের কাছে চাকর বলে পরিচয় দিতে লজ্জা বোধ করেন নি, পরে তার এই অপকর্মের কথা বুঝতে পেরেছিলাম এবং লজ্জায় আমাদের। মাথা হেঁট হয়েছিল। শহরের লোকই এমন রুচির পরিচয় দিতে সাহস পান।
পুণ্যবান ও জ্ঞানী ব্যক্তিদের পাশে শহরে একশ্রেণীর লোক তৈরি হয় যারা অত্যন্ত দুর্মতি। কোনো ভদ্রঘরের ছেলে তাদের সংস্পর্শে এলে সর্বনাশ হতো। অষ্টাদশ বছরের কম বয়সী কোনো যুবককে স্বাধীনভাবে শহরে আসতে দেওয়া ঠিক নয়। এখানে মানুষকে কুপথে নেবার এত প্রলোভন রয়েছে যার হাত থেকে বেঁচে থাকবার মতো মনের বল। অনেকেরই নাই। সঙ্গে অভিভাবক থাকলে যুবকদের থিয়েটার ও অন্যান্য বিপজ্জনক স্থান হতে দূরে রাখতে পারেন। অন্য দেশে কি হয় জানি নে, কিন্তু আমাদের দেশে থিয়েটারগুলি। মানুষকে পাপের পথে নেবার জন্য সর্বদা আহ্বান করছে। থিয়েটার দেখলে মনের উন্নতি হতে পারে এ আমি বিশ্বাস করি না। যদি হয়ই তাহলে সে এদেশে নয়; যেখানে নায়িকারা ভদ্রঘরের মেয়ে নয়। যারা পথের নারী। চোখে মুখে যাদের একটা উদ্দাম কামুকতার আকর্ষণ লেগে রয়েছে। এখানে রঙ্গালয় মানুষকে কোনো উচ্চ শিক্ষা দিতে পারে না। রঙ্গালয়ের অপবিত্র হাওয়া হতে সর্বদা ছেলেমেয়েদের দূরে রাখতে হবে। অন্তত হিন্দু ভদ্রঘরের বউঝিরা যদি অভিনয় করেন তা দেখে উপকৃত হওয়া যায়। এইসব চরিত্রহীন স্ত্রীলোকদের কাছ থেকে মন কোনো উপদেশই নিতে চায় না।
প্রাণহীনতা সম্বন্ধে যে বলছিলাম এটা শহরে বড় বেশি। এখানে ভদ্র ব্যবহারগুলি সাধারণত প্রাণের সঙ্গে যোগ না রেখে হাতমুখ থেকে বেরিয়ে পড়ে। কাজ আর ব্যস্ততায় এখানকার মানুষের উন্নত চিন্তা, হৃদয়ের কোমল ভাবগুলি চূর্ণ হয়ে যায়। সে জন্যে মনে হয় শহর-বাজারে মানুষের স্থায়ী বাসভবন হওয়া ঠিক নয়। এটা হচ্ছে কেবল কাজের জায়গা; এখানে ভাবের প্রণয় মোটেই নাই। অপরিচিত ও অনাত্মীয় যারা তাদের সংগে পরের মতো ব্যবহার করা যায়; কিন্তু অবস্থায় যদি কুলায় তাহলে আপন লোকের সঙ্গে খুব প্রীতিভরা ব্যবহার করা উচিত। শহর বলেই কি সবাইকে এখানে অমানুষ হতে হবে? অবস্থায় না কুলায় আলাদা কথা; তাই বলে মিষ্টি মিষ্টি কথাও কি দুর্মূল্য?
বহু পণ্ডিত, জ্ঞানী ও উচ্চশ্রেণীর লোক শহরে এসে জমা হয়। এদের সংগে মিশলে প্রাণে তৃপ্তি থাকে; মনেরও যথেষ্ট উন্নতি হয়। পণ্ডিত ও উচ্চ শ্রেণীর লোকের পক্ষে শহরে বাস করা সুবিধাজনক হলেও পল্লীকে তারা ভুলতে পারে না। ব্যবসা, জ্ঞান বিজ্ঞান ও স্বাধীন জীবনের অনেক সুবিধা শহরে আছে। এখানে সমস্ত দেশের সুখ-দুঃখ, ন্যায়-অন্যায় ও অভাব-অভিযোগের শেষ মীমাংসা হয়। সারা দেশের অন্যায় ও অবিচারকে ধ্বংস করবার জন্যে এখানে রয়েছে শাসনের মেরুদণ্ড। বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন মানুষের মিলন হচ্ছে এখানে। শহরের উচ্চ শ্রেণীর লোকদের রুচি, সভ্যতা পল্লীবাসীরা গ্রহণ করেন। শহর। দেশের মস্তিষ্ক বলে পল্লীরূপিনী হাত-পাগুলিকে আমরা ঘৃণা করতে পারি না।
শহরে আর একটা মর্মপীড়ক দৃশ্য সাধারণত দেখতে পাওয়া যায়। সেটি হচ্ছে : রাস্তার ধারে দুঃখী নর-নারীর আর্তনাদ। কোথা হতে আসে তা জানি নে। সবারই বাড়ি যে শহরে তা নয়। পল্লীতে এদের হয়তো স্থান হয় না, তাই শহরের পাষাণ বুক বিদীর্ণ করে কিছু রস সংগ্রহ করবার জন্যে তারা এখানে আসে। মানুষ থাকতে মানুষের সন্তান ভাত পায় না। এ ভাবতেও আমার মন দুঃখে বিস্ময়ে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। গ্রামের দুঃখী আতুরের জন্যে গ্রামবাসীরা কী অবস্থা করিতে পারেন, তা পরে বলবো।