যার নিজের মেয়ের বয়েস আট, সে পঞ্চমবর্ষীয়া একটি বালিকার অসীম অত্যাচারে ঠিক কতটা বিচলিত হতে পারে সে আপনারা জানেনই! আমি সজোরে ঘাড় নেড়ে বল্লুম, ‘কৈ, না তো!’
কিন্তু তিনি কোথায়?
খেয়াল হলো যে এরপর তিনি নেমে পরে একবার তাঁর বর্তমান সাম্রাজ্য, মানে সমস্ত কামরাটি সরেজমিনে তদন্ত করতে বেরিয়েছেন। শুধু কি তদন্ত? প্রত্যেককে ডেকে ডেকে ‘হ্যাল্লো আঙ্কেল, হোয়াটস ইওর নেম? হ্যলো আন্টি হোয়াটস ইওর নেম? হোয়ের ডু ইউ স্টে, হুইচ স্কুল ইউ রিড ইন’ ইত্যাদি বলে সবাকার তত্ত্বতালাশ নিয়ে সে প্রায় সি আই ডি ডিপার্টমেন্ট খুলে ফেলেন আর কি। তার ওপর আরও অন্য এক রগড়। ঠিক আমাদের পাশে কম্পার্টমেন্টে যাচ্ছিলেন এক ”এম্লেসাহিব”, মানে জনৈক বিধায়ক মহোদয়। তা পৃথিবীর এই অংশে সমস্ত সরকারি বাবুলোগ, মানে আর্দালি ও চাপরাশি অবধি যা সমাদর পেয়ে থাকেন, তা সভ্য দুনিয়াতে বড় বড় ”অফসর”দের কপালে তা মুশকিলহি নেহি, একদম না মুমকিনভি হ্যায়। এই অম্লসাহিবটিও তিন চারজন পুলিশ প্রহরাবেষ্টিত হয়ে, খানচারেক মোসাহেব ও চামচা সমভিব্যাহারে রাজপাট জাঁকিয়ে বসেছিলেন প্রায়। অকস্মাৎ সেই রাজ্যপাটে ভদ্রমহোদয়ার ব্লিৎজক্রিগ! তিনি সপাট গিয়ে এম্লেসাহিবের প্রায় কোলে উঠে প্রশ্ন করলেন, ‘হোয়াটস ইওর নেম?’
ভদ্রলোকের চোখ প্রায় গোলগোল হয়ে কপালে উঠে যাচ্ছিল আর কি! ওঁরই এলাকায় ওঁকে নামধাম জিজ্ঞেস করে, হ্যার ঘাড়ে কয়ডা মাথা! কিন্তু প্রশ্নকর্তীর হাইট দেখে বুঝলেন কেসটা কি! তারপর দুজনে মিলে অনেকানেক ভব্য আলোচনান্তে, দুজনেই দুজনকে মাঝেমধ্যে কল করবেন এমন প্রতিশ্রুতি আদায় করে ইনি ফের নিজের রাজপাটে ফিরে এলেন।
কিন্তু চলে এলেই তো আর হলো না মশাই। সামান্য এন্টারটেইনমেন্ট না হলে রাজারাজড়াদের মনই বা উঠবে কি করে বলুন? এখন ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো সেই আমি। দুর্ভাগ্যক্রমে সেই সময় আমি একটি রহস্যোপন্যাসে ডুবে ছিলুম। তিনি খানিকক্ষণ আমাকে অভিনিবেশ সহকারে পর্যবেক্ষণ করে প্রশ্নবাণ ছুঁড়লেন, ‘তোমাকে সামার হলিডেতে খুব হোমটাস্ক দিয়েছে, তাই না?’
দ্রুত একমত হয়ে পড়ি, তদুপরি মুখখানা খুবই কাঁদোকাঁদো করে রাখতে হয়, ‘সে তো বটেই, একগাদা হোমটাস্ক, তার ওপরে প্রোজেক্ট ওয়ার্ক, তারও ওপরে একগাদা সামেশন আর সাবস্ট্রাকশন, আর আমাদের স্কুল টীচার কি স্ট্রিক্ট কি বলবো কি বলবো, ইয়া ম্মোটা ম্মোটা স্কেল দিয়ে….’আমার গলা থেকে হাহাকার ঝরে পড়ে। সেই আগত দুর্ভোগের চিন্তায় ব্যাকুল কান্নার শুনে পাথরও গলে যেতে বাধ্য, আর ভক্তের কান্নায় ভগবান দ্রবীভূত না হলে শাস্ত্র টাস্ত্র সব মিথ্যে , মুনি ঋষিরা সেইরকমই বলে গেছেন শুনেছি না? তেনারও চোখটা ছলছল করে এলো বোধহয়, আমার পাশে বসে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে সান্ত্বনা দেন, ‘আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে, ঠিক আছে, ম্যাথসটা না হয় আমি হেল্প করে দেবো, কেমন? আমাদের তো সামেশন শেখাচ্ছে এখন!’
এত বড় আশ্বাসের পরেও যে খুশিতে মাতোয়ারা হয়ে যে না ওঠে স্বীকার করতেই হয় যে সে ব্যাটা এক্কেরে ঘোর পাষণ্ড বিভীষণ! ফলে বইটই বন্ধ করে হাঁটু মুড়ে সিটের ওপর গুছিয়ে বসতেই হলো, আলাপ পরিচয়টা সেরে ফেলি, এই ছিলো মতলব!
‘তোমার নাম কি শুনি?
‘মৌটুসি। তোমার নাম কিইইইই?’
‘উমমম আমার নাম কুমড়োপটাশ বকবকম’।
‘ইশশশশ, মিথ্যেবাদী। কুমড়োপটাশ কারও নাম হয় নাকি?’
‘হয় হয় যানতি পারো না। আচ্ছা তুমি কোথায় থাকো মৌটুসি?’
‘আমি তো খিদিরপুরে থাকি। তুমি?’
দিব্য মজা লাগছিলো, বানিয়ে বানিয়ে বললাম, ‘আমিও খিদিরপুরে থাকি, হুমহুম, তাই তো তোমাকে চেনা চেনা লাগছে। তোমাদের বাড়িতে একটা বুদ্ধুভুতুম থাকে না?’
‘ইসশশ, তুমি কি মিথ্যুক, কি মিথ্যুক গো! আমাদের ক্লাসের বিভানও এত মিথ্যে বলে না। তুমি তো হাওড়ায় থাকো’।
চমৎকৃত হই, সামনে স্বয়ং হারমাইওনি গ্র্যা ঞ্জার সশরীরে নাকি?, ‘কি করে বুঝলে?’
‘হি হি হি হি, তোমাকে কেমন হাওড়া হাওড়া দেখতে!’
স্তম্ভিত হওয়ার কিছু বাকি থাকে না আর, সত্যি বলেছে বলে খুশি হবো, নাকি রেসিস্ট কমেন্ট বলে ক্ষোভে ফেটে পড়ে ফেসবুকে স্টেটাস দেবো বুঝে উঠতে পারি না। ওদিক থেকে মহোদয়ার মাতৃদেবীর কাংস্যনিন্দিত কণ্ঠস্বর শোনা যায়, ‘ছি মামমাম, ওসব কি বাজে কথা? বারণ করেছি না ওরকম বলতে?’
আমি কাষ্ঠহাসি হেসে বলি, ‘না না ঠিক আছে, বাচ্চা তো, হেঁ হেঁ ‘, এই বলে ফের অটল ধৈর্যের সঙ্গে আলাপ জমাতে ব্রতী হই, ‘আচ্ছা, তোমাদের স্কুলে কী কী পড়ায়?’
তিনি ভাবুক ও স্বপ্নালু চোখে অনেক্ষণ উর্ধনেত্র হয়ে থাকেন, তারপর ক্ষীণ স্বরে শুরু করেন, ‘ম্যাথস, ইংলিশ, বেঙ্গলি, সায়েন্স…’ এরপরে ভাণ্ডার ফুরিয়ে যায়, তিনি গভীর চিন্তার সঙ্গে কর গুনতে থাকেন। আমারও মায়া হয়, আহা, এই বয়সে আর কত কিই বা শিখবে বলুন তো? সময় তো পড়ে আছেই সামনে,অত্ত তাড়াহুড়ো কিসের অ্যাঁ? অতএব অন্য প্রশ্নে যেতে হয়, ‘তোমার বেস্ট ফ্রেণ্ড কে?’
‘স্কুলে না বাড়িতে?’
তাই তো! এই বয়সে এসে যখন চারিদিকে তাকিয়ে দেখি শুধু ঈর্ষাকাতর সহকর্মী আর কাঠিচালনায় বীরোত্তমকেশরী প্রতিবেশীদের, তখন ভুলেই যাই শিশু বয়সে আমারও কিছু বন্ধু ছিলো, তাদেরও আমরা স্কুলের বন্ধু আর পাড়ার বন্ধুতে ভাগ করতাম। তখন ছোট শরীরে বড় মন ছিলো, সর্বত্র বন্ধু খুঁজে পেতাম, আর এখন?