প্রশ্নটা শুনেই সেলস অফিসারটি দেখলাম তড়িৎগতিতে বললো, ‘আছে তো স্যার, বারুইপুর মার্কেটে আজ কাজ হচ্ছে তো’, কিন্তু তৎক্ষণাৎ ম্যানেজারের চোখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে গেলো।
ব্যাস…ক্যাচ কট কট…ম্যানেজার বারণ করছে কেন? নিশ্চয়ই কিছু গোলমেলে কেস হ্যাজ। হুঁ হুঁ বাওয়া, বারো বচ্ছর হয়ে গেলো এই লাইনে রগড়াচ্ছি, হাঁ করলেই হনুলুলু বুঝে যাই, চ্যাঁ করলেই চাইকোভস্কি, আমার সঙ্গে চালাকি পায়া হ্যায়? কম্বুর্ন্টে বল্লুম, ‘ ঠিক হ্যায়, লেটস গো টু বারুইপুর’।
এইবার দেখলাম বর্ষীয়ান এরিয়া ম্যানেজারটি এগিয়ে এলেন, ‘বলছিলাম কি স্যার, গত মাসে ওখানেএকটা মিসহ্যাপ হয়ে গেছে, না গেলেই নয়?’
ব্যস, আমার সন্দেহ একদম যাকে বলে শিবপুরের বোটানিক্যাল গার্ডেনের বটগাছ। লোচাটা গত মাসেই করেছে, তাই আমাকে যেতে দিতে এতো অনীহা। দৃঢ় গলায় বল্লুম যে ‘না হে, আমি বারুইপুরেই যাবো, এক্ষুণি যাবো।’।
যেখানে ছিলাম যেখান থেকে বারুইপুর যেতে আধঘণ্টাটাক লাগে। আদর্শ মফস্বল বলতে যা বোঝায়, বারুইপুর ঠিক তাই। তবে শহর কলকাতার আগ্রাসী থাবা এতদূর এসে পৌঁছতেও ছাড়েনি। বিস্তীর্ণ পেয়ারাবাগান কেটে আস্তে আস্তে উঠছে দামী হাইরাইজ। মার্কেটের রাস্তায় সাইকেল আর ভ্যানগাড়িকে সচকিত করে বেরিয়ে যায় দামি মোটরসাইকেল আর চারচাকা।
মার্কেটে এসে গাড়ি থেকে নামতেই যে ভদ্রলোক সহাস্যে অভ্যর্থনা করলেন, বুঝলাম যে তিনিই এই এলাকার স্টকিস্ট। মাঝারি উচ্চতার দোহারা ছিপছিপে চেহারা, উজ্জ্বল মেটে তামার রঙে গায়ের রঙ, বগলে একটা ছোট হাতলওয়ালা চামড়ার ব্যাগ, মুখে জর্দাপান চিবোনো এক অতি অমায়িক হাসি! নামতেই আস্তাজ্ঞে হোক, বস্তাজ্ঞে হোক ইত্যাদির পর্ব পেরিয়ে বল্লুম, ‘মার্কেট দেখান দাদা’।
তা ঘন্টাদুয়েক ঘুরে দেখলাম এ মার্কেটও বেশ ভালোই। খুচখাচ যা ইস্যু আছে সে সসাগরা জম্বুদ্বীপে সর্বত্র ঘটে থাকে, আমরা বলি ইনফিল্ট্রেশন। মানে অন্য এলাকার স্টক (আমাদেরই) এই এলাকায় ঢোকা। সেসব আটকানোরও উপায় আছে। কিন্তু তাহলে আমাকে আসতে বারণ করছিলো কেন এরা? এমন কি ঘোটালা বা মিসহ্যাপ হয়েছিলো এখানে? হুমম, কেস জটিল লাগতা হ্যায়!
সে যাই হোক, মার্কেট দর্শানান্তে, ভদ্রলোকের সঙ্গে সদুপায়ে অশেষ ভব্যিযুক্ত আলোচনার পর মনে হলো এবার কিছু পারিবারিক আলাপ পরিচয় করে ( যা আমি করেই থাকি) কেটে পড়বো। ফলে আমি হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ বাড়িতে কে কে আছেন? ছেলে মেয়ে কয়জন আপনার?’
অপাঙ্গে খেয়াল করলাম, এই প্রশ্ন শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমার ম্যানেজার আর সেলস অফিসার, দুইজনেও যেন শিউড়ে উঠে স্থির হয়ে গেল। কেসটা বোঝার আগেই ডিস্ট্রিবিউটর ভদ্রলোক নির্বিকার মুখে একটা পান মুখগহ্বরে দিয়ে, একটু জর্দা চিমটি দিয়ে ফেলে বললেন, ‘ আমি আর আমার বউ আছি।’
আমার মশাই অনুসন্ধিৎসা প্রায় পাড়ার খবরচালানি মাসিদের পর্যায়ে পড়ে, মুখে হাসিটা রেখেই জিজ্ঞেস করলাম, ‘ছেলে? মেয়ে?’
নির্বিকার উত্তর এলো, ‘একটা মেয়ে ছিলো স্যার। গত মাসে গলায় দড়ি দিয়ে সুইসাইড করেছে।’
আমি প্রস্তরবৎ স্থাণু! মানে? সুইসাইড করেছে ওঁর মেয়ে? আর সেই কথাটা এতো ক্যাজুয়ালি বলছেন? আড়চোখে তাকিয়ে দেখি বাকি দুইজনও ভাবলেশহীন মুখে স্থির দাঁড়িয়ে আছে।
এইটাই তাহলে সেই মিসহ্যাপ?
অনিচ্ছা সত্ত্বেও মুখ থেকে বেরিয়ে গেলো, ‘ ক্কি, ক্কি করে? মানে হোয়াই?’
ভদ্রলোক আরেকটু জর্দা মুখে ফেলে বললেন, ‘ কি আর বলবো স্যার, অ্যান্ড্রুজে পড়তো, পলিটিকাল সায়েন্স। পড়াশোনায় ভালো ছিলো স্যার, মাধ্যমিকে এলাকার মধ্যে হায়েস্ট মার্ক পেয়েছিলো।’
চিত্রার্পিতবৎ আমার মুখ থেকে উচ্চারিত হলো, ‘তাহলে?’
‘একটা ছেলের সঙ্গে ওর অ্যাফেয়ার্স ছিলো স্যার, সে প্রায় অনেক দিনের। কয়েকদিন আগে জানা যায় যে ছেলেটি ভালো না, দশ জায়গায় বাইক নিয়ে ঘোরে আর মেয়েবাজি করে। আগে একবার বিয়েও করেছিলো, ডিভোর্স হয়ে যায়, সেটা আমার মেয়েকে বলেনি। মেয়েটা আমার খুব সোজা সরল ছিলো স্যার। শুনে খুব মুষড়ে পড়েছিলো। আমরা অনেক বুঝিয়েছি। আমি, ওর মা, ওর কাজিন বোনেরা। বলেছি এরকম তো হতেই পারে। ভাগ্যিস বিয়ের আগে জানা গেলো। নইলে কি কেলেঙ্কারি হতো বলতো?’
‘তারপর?’ নিজের গলা থেকে বেরোনো আওয়াজটাকে নিজেই চিনতে পারছিলাম না।
‘মেয়েটা আমার হেব্বি বোকা ছিলো, বুঝলেন স্যার ‘, সেই একই নৈর্ব্যক্তিক সুরে বলে যেতে লাগলেন ভদ্রলোক, ‘দুদিন কান্নাকাটি করলো, কিছু খেলো না। ব্যাপারটা ওকে হেভি ডিস্টার্ব করেছিলো বুঝলেন। তারপর তিনদিনের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে রয়েছে।’
এরপরে আর কথা চলে না। একহাতে ভদ্রলোককে কাছে টেনে নিলাম, বুকে জড়িয়ে বললাম, ‘সরি টু হিয়ার দ্যাট সাহেব। আগে জানলে আপনাকে বিরক্ত করতাম না। আমিও একজন সাতবছরর কন্যাসন্তানের বাবা। আপনার দুঃখটা কিছু হলেও…’
মূর্খ আমি, গেছি সদ্য সন্তানহারা পিতাকে সান্ত্বনা দিতে। ভদ্রলোক আমাকে জড়িয়ে হাউহাউ করে কেঁদে উঠলেন সেই ভরা বাজারের মধ্যে, যেন মুহূর্তের মধ্যে পাথর ফাটিয়ে বেরিয়ে এলো শত ঝর্ণার জল, ‘আপনার তো সাত বছরের মেয়ে স্যার, আমার একুশ বছরের মেয়ে, একটি মাত্র সন্তান। কত কষ্ট করে, কত ভালোবেসে, কত আদর করে মানুষ করেছি ওকে। সামান্য জ্বরজারি হলেও রাত জেগে থেকেছি স্যার, জানেন? আজ অবধি গায়ে হাত তোলা দূরে থাক, বকাবকি অবধি করিনি। নিজে না খেয়ে মেয়ের জন্যে ভালো কলেজে ভর্তি করেছি স্যার, সবচেয়ে ভালো যা যা পারি তাই এনে দিয়েছি, শুধু ওর জন্যে। গলায় দড়ি দেওয়ার আগে একবার আমাদের কথাটা ভাবলি না মা?’