সেই একই উত্তর, সারাদিনমানে দৈনিক গড় ব্যবসার তিরিশ চল্লিশ পার্সেন্ট হবে কি না সন্দেহ। যারা ক্রেডিট কার্ডে কেনে, তারাই এসেছে শুধু।
পাশে ইলেক্ট্রনিকসের দোকান, তিনি অবশ্য বেশি বিচলিত নন, তেনার দোকানে প্রায় সব কেনাকাটাই কার্ডে হয়। তবে ‘আজ কাস্টমার কম হ্যায়, ছুট্টা দেকে অটো ইয়া টাঙ্গা চঢ়না পড়েগা, ইসি লিয়ে লোগ জ্যাদা নিকলে নেহি হ্যাঁয়।’
এরপর জেল রোড, ইন্দোরের চাঁদনি আর কি। ঢুকেই দেখি এক চানা মসালা ওয়ালা,কম্বুর্ন্টে অর্ডার দিলুম ‘ভাই, চার জাগাহ পে দস দস রুপেয়াকা বানাও, নিম্বু জ্যায়াদা। পাঁসসও কা নোট লোগে না?’
ছোকরা প্রথম ঠোঙাটা তুলে ফিক করে হেসে ফেলে, ‘কাহে মজাক কর রহে হো বাবুজি?’
এরপরে এক বাদামওয়ালার সঙ্গেও ঠিক একই কথোপকথন হয়েছিল। একই বক্তব্য, লিখতে আমিও বোর হবো, পড়তে আপনিও বেহুদ্দ বোর হবেন। তাই দুটো কেস একটাতেই সালটে নিই।
‘বলি ব্যবসাপাতি ক্যামন’
‘খুবই কম কত্তা, নোকজন কম বেরিয়েছে কি না’
‘তা এই পাঁচশো হাজার টাকা ব্যান হলো, তোমার অসুবিধা হচ্ছে না?’
‘হাসালেন কত্তা, পাঁচ দশ টাকার মাল বেচি, লোকে খুব বেশি হলে পঞ্চাশ টাকার নোট দেয়। পাঁচশো টাকার নোট ইয়ে হলে আমার কি?’
টিকেট সাইজ, পারচেজ টিকেট সাইজ। এতক্ষণে জ্ঞানচক্ষুরুন্মীলিত হলো। এদের রোজকার ব্যবসায় পাঁচশো টাকার ভূমিকা সীমিত। লোকাভাবহেতু ব্যবসায় মন্দাটাই আসল অসুবিধার কারণ।
‘ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট আছে?’
‘না বাবু’
‘জমানো টাকাকড়ি নিশ্চয়ই পাঁচশো হাজারে আছে, সেটা কি করবে?’
‘কেন? মহাজনকে দেবো, মানে যার কাছ থেকে এই চানা /বাদাম আনি, তাকে দেবো, সেই বদলে দেবে।’
‘তা সে কত টাকা কাটমানি নেবে?’
ভারি অবাক হয়ে সে চোখ তুলে তাকায় সেই টিকিধারী বিহারি ব্রাহ্মণবালক, ‘সে কি? চাচা আমার মহাজন, আমার মালিক। তার সঙ্গে আমার রোজকার কারোবার চলে, তার বেটির নিকাহতে আমাদের ফুল ফ্যামিলির চার পাঁচদিন রান্না বন্ধের হুকুম হয়, সে থোড়াই আমার সঙ্গে এই রকম চিন্দিগিরি করবে? কি বলছেন কি বাবুজী? এখন যদি আপনি যান তো চাচা টোটালকে উপর তিস প্রতিশত তো পাক্কা লেগা। লেকিন মেরে পিতাজী ভি উনকে সাথ কাম করতে থে, ম্যায় ভি কাম করতা হুঁ দস সাল হো গ্যায়া। হাম লোগোঁকে সাথ ইয়ে সব… শোচ ভি নেহি সকতে।’
বুঝলাম, ভারত, দ্যট ইজ ইণ্ডিয়া নামের দেশটির মানুষী সম্পর্কের সবকটি পেহ্লুঁ দেখতে ও শিখতে আমার এখনো বাকি আছে।
পরের শিকার এক ডিমসিদ্ধওয়ালা। ছ”টাকা পার ডিমসিদ্ধ। একই গল্প, লোক কম বাজারে তাই রোজগার কম। আর দিনে হাজার টাকার মতন ডিমসিদ্ধ বিক্রি হয়। হাজার পাঁচশো নোটের গল্পই নেই। জমানো টাকা কিছু পাঁচশো হাজারের নোট আছে বটে, তবে এঁয়ার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টও আছে। অতয়েব ইনি নিশ্চিন্ত আছেন, ‘নেক্সট উইক মে তো ফির সে ওহি কাস্টমার আয়েঙ্গে না, এক হপ্তে কি বাত হ্যায় জি। পিছলে সাল বারিষমে কেয়া কিয়ে থে লোগোঁ নে? ইয়ে ভি ওয়সেহি সমঝ লোঁ।’
সবারই একই বক্তব্য, দুদিনের কেস, মিটে গেলে আর ঝামেলা নেই।
কিন্তু এসব তো এক্কেবারে নিম্নবর্গের ব্যবসায়ীকুল। মধ্যবিত্ত দোকানদার, অর্থাৎ রিটেইলারদের কি হাল হকিকত বাবু? যাদের আমদানি আর খরচা দুটোই পাঁচশো হাজারের নোটে হয়? তাঁদের কি গপ্প, অ্যাঁ?
এইটে বোঝাতে গেলে আপনাদের একটা টেকনিক্যাল জিনিস সামান্য বুঝতে হচ্চে যে কত্তা!
যে কোন কম্পানির উৎপাদিত প্রডাক্ট আপনার হাতে যে আসে, তা অন্তত কমপক্ষে দুজন মধ্যবর্তীর হাত ঘুরে পৌঁছয়, কম্পানি টু ডিস্ট্রিবিউটর, ডিস্ট্রিবিউটর টু রিটেইলার অ্যান্ড ফাইনালি রিটেইলার টু কনজিউমার। অর্থাৎ,
কম্পানি-গ্গ ডিস্ট্রিবিউটর-গ্গ রিটেইলার -গ্গ কনজিউমার।
(হোলসেলারদের এই আলোচনায় আনলাম না, মালটা সামান্য জটিল হয়ে যাবে বলে। আপাতত ধরে নিন হোলসেলার ইকোয়ালটু বড় সাইজের রিটেলার, যদিও কিছু তফাত আছে)।
এখন এই চেনে একটা সাপ্লায়ার -কাস্টমার ব্যাপার আছে। কম্পানি ডিস্ট্রিবিউটরের সাপ্লায়ার, ডিস্ট্রিবিউটর রিটেইলারের সাপ্লায়ার, আবার রিটেইলার হলো কনজিউমারের সাপ্লায়ার।
উল্টোদিক ধরে, কনজিউমার হলো রিটেইলারের কাস্টমার, এবং এইভাবে এগোতে এগোতে ডিস্ট্রিবিউটর হলো কম্পানির কাস্টমার।
ব্যবসার নিয়ম হচ্ছে সাপ্লায়ারের কাছ থেকে যত বেশি সম্ভব ক্রেডিট বা ধার আদায় করা, এবং কাস্টমারকে যত সম্ভব ক্যাশে বিক্রি করা। তাতে ব্যবসায় অপারেটিং ক্যাশ বৃদ্ধি পায়। ওটা ব্যবসার সুস্বাস্থ্যের চিহ্ন, ওতে ট্টঞ্জজ্জ অর্থাৎ রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট বাড়ে, লেভারেজ বাড়ে, অপুত্রের পুত্র হয় নির্ধনের ধন, ইহলোকে সুখী অন্তে বৈকুণ্ঠে গমন, ইত্যাদি প্রভৃতি।
পরের দিন সক্কাল সক্কাল ছানটান করে, চাট্টি ইডলি ধোসা খেয়ে মার্কেটে নেমে যা দেখলাম, তা জন্মজন্মান্তরেও ভুলিব না। আমার সমস্ত ন্যাখাপড়া, দশ বারো বছরের এক্সপিরিয়েন্স ধূলিস্যাৎ করে দেখি গঙ্গা উলটো বইছে!
তাবৎ দোকানদার তাঁদের সাপ্লায়ার,অর্থাৎ ডিস্ট্রিবিউটদের পেমেন্ট দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। সে কি দৃশ্য রে ভাই, প্পুরো ‘কে বা আগে প্রাণ করিবেক দান’ কেস, দেখলে সারা শরীরে রোমাঞ্চ জাগে, জেগে আছি না বৈকুণ্ঠধামগতি হয়েছে বোঝা দায়। দোকানদার ঝাঁপিয়ে পড়ে কারেন্ট বিল তো বটেই, আগামী দুমাসের স্টকের জন্যে অগ্রিম পেমেন্ট অবধি ডিস্ট্রিবিউটরের পকেটে গুঁজে দিচ্ছে, মুখে স্পষ্ট ‘তুই কি আমার পর?’ ভঙ্গি।