তা প্রথম দিন, আট তারিখ, ছিল কনজিউমার ভিজিট। যে কোনও একটি আম আদমি পরিবারে হানা দিয়ে তাঁরা কি করেন, কি দেখেন, কি ভাবেন, কি খান, কি পড়েন, বাড়িতে কে কে আছেন, কি কি আছে ইত্যাদির তত্ত্বতালাশ নেওয়া, যদি কোনও নতুন কনজিউমার ইনসাইট পাওয়া যায়। ধর্মশাস্ত্রে বলেছে আত্মানং বিদ্ধি, ম্যানেজমেন্টশাস্ত্র বলে কনজ্যুমারাৎ সমৃদ্ধি, অর্থাৎ তিনিই সেই বেদাহমেতং পুরুষং মহান্তম…তাঁকে জানলেই মার্কেটিং এর পরমব্রহ্মলাভ হয়, নান্যঃ পন্থা বিদ্যতেহনায়!
তা ইত্যাদির পর সন্ধ্যেবেলা বন্ধুবান্ধব অ্যাজ ইউজুয়াল একত্তর হয়ে যে যার বসের নামে গুচ্ছের গালমন্দ করছি, এমন সময় সবারই মোবাইলে টুংটাং আওয়াজ করে দুয়েকটা মেসেজ ঢুকলো। সবাই একসঙ্গে মেসেজ চেক করতে স্ক্রিনে চোখ রাখলাম….
তারপর কি হইলো জানে শ্যামলাল!!
যে ঝড়ঝঞ্ঝাবজ্রপাতজলোচ্ছ্বাসবন্যামহামারীভূমিকম্প ভেঙে পড়লো তার আর তুলনা নেই। আমরা হতচকিত, টিভির চ্যানেলে চ্যানেলে ফেটে পড়লো উচ্চকিত তরজা আর আলোচনা, বাড়ি থেকে ঘনঘন ফোন, হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজে আর জোক্সের বন্যা, সর্বোপরি ফেসবুকে ফের ফাটাফাটি!
সেই রাত্তিরেই বাইরে বেরিয়ে দেখি এটিএমের সামনে লম্বা লাইন। পান দোকান থেকে খানদানি আংগ্রেজি শরাব কি দুকান অবধি পাঁচশো কি হাজার টাকার নোট দেখালেই এমনভাবে আঁতকে উঠছে যে কহতব্য নয়। চারদিকে ‘যাহ সসালা, এ সব কি হচ্চে বাওয়া’ ভাব।
পরের দিন ৯ তারিখ আমাদের কনজ্যুমার ভিজিটের অ্যানালিসিস অ্যান্ড আইডিয়েশন পার্ট ছিল। ততক্ষণে ফেসবুকে যে যুদ্ধ লেগেছে তার কাছে কুরুক্ষেত্র, ওয়াটার্লু, স্তালিনগ্রাদ সব তুচ্ছ। ফেসবুক না হয়ে এ যদি সামনাসামনি হতো, কলকাতার জনসংখ্যা সেইদিনই হাফ হয়ে যেত, নীরদবাবু গোঁফে তা দিয়ে বলতেন, ‘আত্মঘাতী বাঙালি কি সাধে বলেছিলুম রে বাওয়া?’
সকালে গিন্নি ফোন করে জানালেন যে বাড়ির হাউসমেডটি এসেই হাউহাউ করছে, এই সপ্তাহেই সে মাইনে পেয়েছে, সবই পাঁচশো আর হাজারের নোটে। এখন সে কি করবে? দয়াপরবশ হয়ে গিন্নিকে বললাম, ‘ওকে বলো হাজার দুয়েক ক্যাশ পরে দিয়ে যেতে, আপাতত তুমি ওকে পাশের বিগ বাজার থেকে তোমার ক্রেডিট কার্ডে ওর যা লাগে তেমন হাজার দুয়েকের জিনিসপাতি কিনে দাও।’
দুমিনিট পরে গিন্নি জানালেন যে তিনি সলজ্জমুখে এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। ওদের চওলের যে লোক্যাল মুদিশ্রেষ্ঠ, তিনিই আপাতত ধারবাকিতে জিনিসপত্র দিচ্ছেন, দু সপ্তাহের মধ্যে দিতে হবে এই কড়ারে।
তা সেই আইডিয়েশন সেশনে অশ্বডিম্বরূপ একটি আইডিয়া প্রসব করে সন্ধ্যেবেলা স্থির করলুম সদলবলে একটু বেরোব, ইন্দোর শহরটাও দেখা হবে আর তত প্রিভিলেজড নন এমন কয়েকজনের সঙ্গে দেখা করে হালহকিকত বুঝে নিই।
কপালগুণে একটা ভাড়ার গাড়ি পেয়ে গেলাম, চারঘন্টার জন্যে আটশো টাকা নেবে, এবং কিমাশ্চর্যম, পাঁচশো টাকার নোটেই নেবে?
কেন বাওয়া, সারা দুনিয়া পাঁচশো হাজারের নোট দেখলে কুষ্ঠরোগীর মতন এড়িয়ে যাচ্ছে, তোমার অসুবিধা হবে না?
স্মিত হেসে ছোকরা জানালো কাল পরশু তাকে ব্যাঙ্কে যেতেই হবে ডিপোজিট করতে। আরো চারটে নোট না হয় এক্সট্রা হবে। ডিপোজিট করতে তো আর লিমিট নেই, ‘কাস্টমার কিঁউ ছোড়ে?’
তা তেনার গাড়ি চড়ে চারজন জ্ঞানপিপাসু বৈরাগী গিয়ে যে জায়গায় প্রথমে বডি ফেললাম, তার নাম রাজওয়াড়া। ইন্দোরের পুরোনো রাজপ্রাসাদ আর কি। তবে রাজওয়াড়া তখন বন্ধ। আশেপাশের বাজারহাট অবশ্য খোলা।
রাজওয়াড়ার ঠিক সামনে উদাস চোখে দুই অটোওয়ালা দাঁড়িয়ে, তাদের প্রথমজনকে পাকড়াও করি, ‘কি চাচা, কাজকম্মের হাল কি?’
দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে ক্লান্ত উত্তর ভেসে আসে, ‘বহোত খারাব হালত বাবু।’
আমার আবার নাম্বার নিয়ে খুঁতখুঁতুনি আছে, খারাপ মানে কত খারাপ? ভালো মানে কত ভালো? কোয়ান্টিফাই প্লিজ।
বুঝলুম, তেনার দিনমানে হাজার টাকার মতন ব্যবসা হয়। শতিনেক টাকার পেট্রোল পোড়ে, আর পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দোবস্ত’ বাবদ আরও একশো, কুল্লে ছ”শো টাকা দিয়ে ঘরসংসার চলে।
আজ, এই সন্ধ্যেবেলা অবধি মোট ব্যবসার পরিমাণ চল্লিশ টাকা!
হুম। তা তোমার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট আছে?
না বাবু, এখনো খাতা খুলিনি।
তা জমানো টাকাকড়ি রাখো কোথায়?
চোরাচাউনির সঙ্গে, ‘ঘরেই থাকে বাবু’।
নিশ্চয়ই পাঁচশো হাজারের নোটেই রাখো। সেটা এখন কি করবে?
উত্তর শুনে টং করে রক্ত মাথায় উঠে গেলো, ‘বস্তিমে এক হ্যায় অটোওয়ালা, দো ঠো অটো হ্যায় উসকে পাস, বোলা হ্যায় সারে কে সারে পাঁসসও না নোট লে লেগা, অওর হর পাঁসসও কে লিয়ে চারশো দেগা’।
ভারতবর্ষের সব কাকই বোধহয় কাকের মাংস খায়, না? সে কাক বুর্জোয়া হোক বা প্রলেতারিয়েত?
পরের অটোওয়ালে ভাইয়ার সঙ্গে কথাবার্তাও প্রায় একই লাইনে। তফাত দুটো জায়গায়, এক, অটো এই ভাইটির নয়, মালিকের। মালিককে দিনান্তে তিনশো টাকা তুলে দিয়ে বাকি যা বাঁচবে সব এঁয়ার। আর জমানো টাকা নিয়ে তিনি চিন্তিত নন, ‘ মালিক বোলে হ্যাঁয়, উনহোনে বন্দোবস্ত কর দেঙ্গে’, না, কোনও কাটমানির প্রশ্নই নেই, ‘হামারে মালিক হ্যাঁয়, ইয়ে সব টাইম পর তো হামলোগোঁ কো দেখনা পড়ে গা না।’
এগোতে এগোতে দেখি ওষুধের দোকান। ইন্দোরের শুকনো আবহাওয়াতে ঠেঁট ফেটে চৌষট্টি হয়ে গেছিলো। গিয়ে বোরোলীন (হ্যাঁ, এই বাঙালি ব্র্যাণ্ডটি ভারতের সর্বত্র পাওয়া যায়) কেনার ছলে প্রৌঢ় মালিকটিকে সেই একই প্রশ্ন, ‘ধান্দাপানি ক্যায়সা হ্যায় বাউজী?’