তারপর? তারপর আর কি? আমি লোভাতুর নয়নে মাছের দিকে চেয়ে রইলাম, আর মাছউলি মউশি সতৃষ্ণনয়নে আমার দিকে।
আমার হাতে শুধু একটা দু হাজার টাকার নোট, মউশির কাছে দুটো একশো টাকার নোট, আর কয়েকটা খুচরো!
ফলে বুঝতেই পারছেন, পরিমাণটা তত বেশি না হলেও লাগে। আর চট করে বাড়ির কাজের মেয়েটিকে দুহাজারের নোট দিতে গায়ে লাগে, তাকে খুচরোতে দিতে হয়। আমার চালিয়ে নেওয়ার বিবিধ উপায় আছে, সে বেচারি অত উপায় পাবে কোত্থেকে?
তা গত মাসে নিজের পানবিড়ি ইত্যাদি খরচার জন্যে চেনা পানের দোকানীকে ধরেছিলাম। সিগারেট আর পানের ব্যবসা হাণ্ড্রেড পার্সেন্ট ক্যাশের ব্যবসা, আর এলইউপিঅর্থাৎ লো ইউনিট প্রাইস বিজনেস, এদের কাছে খুচরো থাকতে বাধ্য। তা চেনা দোকানী, আমাকে নিরাশ করেনি, দু হাজার নোটের বদলে আঠেরোশো দিয়েছে, বাকি দুশো টাকা দু হপ্তায় পান সিগারেট কিনলে কেটে নেবে এই কড়ারে। প্রিপেইড নেশা আর কি!
তা গতকাল বাড়িতে ফিরে ছানটান করে লুঙ্গিটা পরে মুড়ি বাদামের বাটিটা টেনে নিয়েছি কি নিই নি, ও মা, গিন্নি দেখি খপাৎ করে ওয়ালেটটা হাতে নিয়ে চিল চিৎকার, ‘তোমার কাছে এত্ত খুচরো, আমাকে বলোনি তো? জানো আমার কি অসুবিধা হচ্ছে? বলি এত বয়েস হলো, আক্কেলহুঁশ কবে হবে শুনি?’ আমিও কাষ্ঠহাসি হেসে কিছু বলতে গেলুম বটে, কিন্তু খেয়াল করে দেখলুম প্র্যাকটিক্যালি গলা দিয়ে ঘোঁ ঘুঁ ঘপাৎ ছাড়া আওয়াজই বেরোচ্ছে না!!
তা তিনি সতেরশো টাকা হাতিয়ে খুব কড়া চোখে তাকিয়ে বললেন, ‘একশোটা টাকা রইলো, পুরুষ মানুষের হাতে বেশি ক্যাশ থাকা ভালো নয়। আর হ্যাঁ, দুটো দুহাজার টাকার নোট দিয়ে দিয়েছি, কাল সন্ধ্যেবেলায় যেন ভালোয় ভালোয় চল্লিশটা একশোটাকার নোট পাই। কথাটা যেন মনে থাকে। ‘
বাপ মার কথা অমান্য করা যায় মশাই, স্ত্রীর কথা অমান্য করলে যে ঝড়ঝঞ্ঝাবজ্রপাত আছড়ে পরে তার প্রতিকার মনু সংহিতা থেকে হ্যারি পটার কোত্থাও লেখা নেই। ফলে আজ খুবই চিন্তিত মুখে মার্কেট এসেছি, সেলসম্যান ছোকরা দেখি আরও চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে।
‘কি রে, মুখটা ভেঁদড়ের মতন করে রেখেছিস কেন?’
‘ধান্দা বিলকুল ঠপ পড়া হ্যায় স্যার। ইস মাহিনেকা টার্গেট নেহি হোগা।’
‘সে কি রে পাগলা? চাকরি থাকবে যে রে! না তোর চাকরি থাকবে, আর আমার তো নেইই ধরে নে। বলি ওরে পচমপকাই, আমরা তো সেলসের লোক। দুর্গমগিরিকান্তারমরু পার হয়ে ব্যবসা আনাই তো আমাদের কাজ রে পাগলা। ওরে তুই কি সামান্য লোক? বলি কবি ”মহারাষ্ট্র জীবনপ্রভাত’ এ কাদের কথা বলেছেন? স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধ কাদের জন্যে হয়েছিল? মহাকবি শ্রীজাত যে বলেছেন ‘এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে’, সে কার জন্যে, অ্যাঁ? ওরে তুই কি রাজা ভটচায্যির ভারতবর্ষ পড়িসনি? ছত্রে ছত্রে যে তোর বীরগাথাই লেখা আছে ‘ ইত্যাদি বলেটলে, ‘কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন ‘, ‘ঊর্ধগগনে বাজে মাদল’ টাইপের পেপটক দিতেই সে ছোঁড়া বেশ চাঙ্গা হয়ে গা ঝাড়া দিয়ে বললো, ‘তাহলে চলুন স্যার’।
ঘন্টাপাঁচেক বাদে ফের সে দুজন একই জায়গায়। পঁচিশটা দোকানে কল করা হয়েছে, মাত্তর তিনটে প্রোডাক্টিভ। দোকানদাররা কম্পানির সেলসম্যান দেখলেই মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে তাড়িয়ে দিচ্ছে।
যাই হোক, এর পর অফিসে যেতে হয়, রিপোর্ট ফাইল করতে হবে। সে হতোদ্যম ছোঁড়াকে ‘সেলসের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ’ ইত্যাদি বুঝিয়েটুঝিয়ে চোখের জল মুছিয়ে দিচ্ছি, ছোকরা ডিস্ট্রিবিউটর পয়েন্টে যাবে বলে অ্যাবাউট টার্ন করেছি কি করেনি, খপ করে ওর হাত ধরেছি।
‘ক্যায়া হুয়া স্যার?’
‘ হ্যাঁ রে বুদ্ধুভুতুম দহিবড়া খাবি? ‘
ছোকরা ভারি অবাক হলো, ‘কিউঁ স্যার?’
‘ নইলে মিসল পাও খাবি নাকি? বেশ ঝাল ঝাল? নাকি ভড়াপাও বলে দিই দুটো?’
সে ভারি সন্দিগ্ধ স্বরে জিজ্ঞেস করে, ‘কিঁউ বস? কেয়া হো গ্যায়া?’
এইবার খাপ খুলতেই হয়। ‘বলি কম করে তো কুড়িটা দোকান থেকে ক্যাশে ডিউ বিলের পেমেন্ট নিলি। ব্যাগটা খোল দিকিন সন্টিমন্টি’।
এইবার সে ছেলে হেসে ফেলে আমার মতলব বুঝে, ‘আপকো ছুট্টা চাহিয়ে ক্যায়া?’
আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। পকেটে চল্লিশটা একশো টাকার গরমাগরম পাত্তি। ডানদিকের হিপ পকেটটা যেভাবে ফুলে আছে, তাতে দক্ষিণ নিতম্বে টিউমার হয়েছে বলে কারো সন্দেহ বলার কিছু নাই। তবে ওসব তেমন কিছু না। মোদ্দা কথা এই যে আমার কাছে এখন, চল্লিশটা ইয়ে, তার মানে,
১. রাত্তিরে মাটন, আর
২. হে হে জানেনই তো , কাল লাঞ্চে গলদা!
কালকে কি বেহুদ্দ বেইজ্জত হয়েছি রে ভাই, মানে সে কি বিচ্ছিরি রকমের ইন্সাল্ট, সে আর কহতব্য নয়! ভালো বাংলায় যাকে বলে সুতীব্র অপমান, প্রায় সেটাই আর কি। গা”টা যা রাগে রি রি করছে না, মনে হচ্ছে সে ছোকরাকে ধরে কেলিয়ে পাটপাট করে দিই, তারপর থেঁতো করে, আগুনে পুড়িয়ে, হামানদিস্তায় ফেলে গুঁড়ো গুঁড়ো করে..
ব্যাস, শুনেই দাঁতফাঁত বার করে চলে এলেন না? কি ইল্লি মাইরি, আবদার শোনো একবার! আমার এত বড় অপমানের কথাটা নাকি ব্যাখ্যান করে শোনাতে হবে। যত্তসব করেকটেঘ্যাচাং টাইপের বন্ধু হয়েছে কতগুলো দেখছি, হুঁঃ
আচ্ছা আচ্ছা, আর রাগ করতে হবে নি, বলছি।
তা ঘটনা খুবই সামান্য। কয়েকদিন বাদে কলকাতায় যাবার একটা প্ল্যান আছেই। ফলে গত পরশু গেছি অফিসের পাশেই যে ইয়েস ব্যাঙ্কটা আছে, সেখানে, কিছু ক্যাশ তুলবো বলে। লাইনটাইন দেখলুম একটু কম। দুজনের পরেই আমার ডাক পড়লো। আমিও গিয়ে ভারি আহ্লাদী মুখ করে চেকটা গছিয়ে দিলুম কাউন্টারে।