ভদ্রমহিলা আমার মুখ দেখে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন, তারপর বিশুদ্ধ কলকাত্তাই বাংলায়…
‘আগেই বুঝেছি, তুই এদিককার নোস। নেহাত ভেঁদড় না হলে কেউ মিষ্টি দিয়ে ভাত খাওয়া শুরু করে না। ওটা চপ নয় স্টুপিড, ওটা নারকেল আর গুড়ের মিষ্টি, ওটাকে বলে ওবাট্টু। আরে আরে আরে, ওটা কি দিয়ে ভাত মাখছিস? আরে ওটা ডাল নয় রে বোকা, স্যুপ, ওটাকে বলে উলাভা চারু…..’ বাক্যস্রোত চলতেই থাকলো।
আর আমি বেহুদ্দ বেকুবের মতন হাঁ করে চেয়ে রইলাম। রাজামুন্দ্রিতে বাংলা? ইনি??
তবে খিদের সামনে বেশিক্ষণ বেকুব হয়ে থাকা শাস্ত্রে নিষিদ্ধ। ঠাকুমা ছোটবেলায় ছড়া কাটতেন, ‘অন্ন এমুন চিজ, খোদার থিইক্যা উনিশ বিশ’, ফলে ডাল দিয়ে ( এরা ডালকে বলে পাপ্পু) ভাত ভেঙে খেতে খেতে তেনার বক্তিমে শুনতে লাগলুম।
ভদ্রমহিলার জন্ম কর্ম বিবাহ কলকাতাতেই, সাউথ কলকাতায়, লেকের ধারে (‘হ্যাঁ রে, মেনকা সিনেমা আছে? ওর পাশেই তো আমাদের বাড়ি ছিল। আহা, ম্যাটিনি শোতে বাবা মায়ের হাত ধরে উত্তম কুমারের ছবি দেখতে যেতুম’), পড়াশোনা ওখানেই (‘ তখন তো স্কুলে মজা হতো কতো, রবীন্দ্রজয়ন্তীতে নাটক করেছি, শ্যামাতে নেচেছি, চিত্রাঙ্গদায় গান গেয়েছি, সরস্বতীপূজো করেছি। এখনও হয় রে? অবশ্য গার্লস স্কুল, তুইই বা জানবি কি করে বল’), কলেজও (‘ এখনও আশুতোষ কলেজে ডিবেট ক্লাবটা আছে? চমৎকার ডিবেট হতো আমাদের সময়ে , কি ভালো ক্যুইজ হতো, প্রেসিডেন্সি থেকে শার্প ছেলেমেয়েরা আসতো, আহহা, এখনও হয় রে?’)।
সারাক্ষণ ধরে এই চললো, মাঝেমধ্যে মৃদু ধমক, কার পরে কি খেতে হয় তার নির্দেশ দিয়ে। তারপর সেই অবিশ্রান্ত বকবক। তখনকার অশান্ত কলকাতা ( ভদ্রমহিলার কলেজ লাইফটা সত্তর দশকে বুঝতে দেরি হয়নি বেশি), ধরপাকড়, মিটিং মিছিল, শহর জুড়ে নিরন্ন উদ্বাস্তুদের ভিড়, কালীঘাট, চেতলা, গড়িয়াহাট, জবরদখল কলোনি, মনে হচ্ছিল একটুকরো ইতিহাস যেন চোখের সামনে সোনার রিমলেস চশমা পড়ে হাসিমুখে বসে। একবার পার্ক স্ট্রিটের কথা জিজ্ঞেস করলেন, আরেকবার গোলবাড়ির কথা। কলেজ স্কোয়ারের ফুচকার কথা জিজ্ঞেস করার সময় তো চোখদুটো চকচক করছিল, স্পষ্ট দেখলুম।
পুলিহারা বলে একটা আইটেম ছিল, একটু টক মতন ফ্রায়েড রাইস আর কি, দিব্যি খেতে। আমি খেতে খেতে এখানে এলেন কি করে জিজ্ঞেস করাতে সামান্য বিষন্নতার ছায়া পড়লো ভদ্রমহিলার চেহারায়, ‘তোর আঙ্কেল চাকরি করতো অডিটে, বুঝলি? সেও আমার মতই কলকাতায় বড় হয়েছে। এইট্টি ফাইভে এদিকে চলে আসি। তারপর ছেলেমেয়ে বড় হতে লাগলো, আমারও আর কলকাতা ফেরা হোল না। ‘
ততক্ষণে খাওয়া শেষ হয়ে গেছিলো, বিল মিটিয়ে একটু মৌরি চিবোতে চিবোতে বেরোবার সময় বল্লুম ‘এখনও চমৎকার বাংলা বলেন তো’।
রীতিমতো ক্ষুন্ন হলে তিনি, ‘ সে কি রে? ছোটবেলা থেকে শিখেছি, স্কুল কলেজ বন্ধুবান্ধব আড্ডা সবই বাংলাতে দিয়েছি, ভুলে যাব কি রে? তাছাড়া…. কি বলতো? ‘
নিচু হয়ে জুতো পরছিলুম, উঠে দাঁড়িয়ে বল্লুম ‘কি?’
ভদ্রমহিলা চোখ টিপে বললেন, ‘ইউ ক্যান টেক সামওয়ান আউট অফ ক্যালকাটা, বাট ইউ ক্যান নট টেক ক্যালকাটা আউট অফ হার ‘।
গাড়ি করে ফিরে আসার সময় এসি বন্ধ করে জানলার কাঁচটা নামিয়ে দিলাম। ঠাণ্ডা হাওয়া, বিকেল হয়ে নেমে আসছে নরম রোদ। সেই দিকে তাকিয়ে ভাবলাম আমার মতন যারা কলকাতা ছেড়ে এসেছি কাজের সূত্রে, আমরাও কি সব সময় বুকের মধ্যে একটুকরো কলকাতা বয়ে নিয়ে চলি না? সব সময় কি স্বপ্ন দেখি না, কোন এক অলৌকিক ভোরে এসে যাবে সেই রাজার চিঠি, সেই মায়ার ভূখণ্ডে ফিরে যাবার সনদ। আমার মতনই পৃথিবীজোড়া হাজার হাজার কলকাতা ছাড়া মানুষদের কি অমোঘ বাঁধনেই না বেঁধে রেখেছে সেই বুড়ি শহর..কি অনায়াসেই….
ডিমনিকাহিনী
বহু পূর্বকৃত পুণ্যবলে লোকে সেলসে চাগরি পায় মহাই, আজই হাতেনাতে প্রমাণ পেলুম।
হয়েছেটা কি, এই ডিমনি নামের মামণি এসে তো কয়েকদিনের জন্যে নাহক অসুবিধা সৃষ্টি করেইছেন, এ কথা শীতের ন্যাতাকাঁথা দিয়েও আর চেপে রাখা যাচ্ছে না। আমার ব্যক্তিগত ভাবে যে খুব অসুবিধা হচ্ছিল তা নয়। এক অটোতে যাতায়াত, কাঁচা সবজি বাজার আর বাড়িতে গিন্নির সহকারিণীটিকে মাইনে, এ ছাড়া ক্যাশ আমার লাগেই না। তদুপরি পাওয়াই মার্কেটে জয়ন্তর দোকান থেকে মাছ কিনি, আর সেখানে বহুকাল থেকেই ক্রেডিট কার্ডে পেমেন্ট নেয়, গত দুবছর যাবৎ তাই কিনছি।
কিন্তু সবাই জয়ন্ত নয়। সবার কাছে অনলাইন পেমেন্টের ব্যবস্থা নেই। এই যেমন সেদিন। পাওয়াই মার্কেটে মাছ কিনতে গিয়ে থমকে গেলাম! ইয়াব্বড়বড় গলদা মশাই, একেকটার ওজন দেড়শো গ্রামের কম হবে না, হলফ করে বলতে পারি। শুঁড় বাদ দিয়েও এক বিঘৎ লম্বা, আর তেমনই পুরুষ্টু, প্রায় মর্তমান কলার সাইজেরই। বাড়িতে কোকোনাট মিল্ক আছে দেখে এসেছি, নারকেলও এক পিস আছে বলেই মনে পড়ছে। দাম, হে হে, বলছি বলছি, মুচ্ছো যাবেন না কিন্তু, শক্ত করে কিছুমিছু একটা ধরে বসুন।
সাড়ে চারশো। না না, পার পিস না, কিলো সাড়ে চারশো। ফলে যদি ভাবিইই যে এই রোব্বারের দুপুরে লাঞ্চটা দেরাদুন রাইসের ভাত আর গলদার মালাইকারি দিয়েই সারবো, তাতে কি খুব ভুল হবে অ্যাঁ?
ভাবতে ভাবতেই আলতো করে হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে লালাটা মুছে নিলাম। আরে না না স্বপ্ন নয়। অ্যাগদম সত্যি, আজই সকালে, আই আই টি পাওয়াই মার্কেটে।