-‘এ কোথায় আনলেন আমাকে, অন্ধকারে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে ওরা কারা? ও ও রা কারা? ওদের ওরকম পাথরের মতন চাউনি কেনো? উঃ, এখানে এত শীত, শরীরের প্রতিটি রক্তবিন্দু যেন জমে যাচ্ছে, ওদের দৃষ্টি সহ্য করতে পারছি না, বর্শার মতন এসে বিঁধছে আমাকে, সরাও ওদের, উঃ, আমার লাগছে , ভয় লাগছে খুব.. ওরে কে কোথায় আছিস? এক্ষুনি সরিয়ে নিয়ে যা এদের…’
-‘শ শ শ…আস্তে কত্তা। বেয়াদপি মাপ করবেন, কিন্তুক এখানে আমরা কেউ তেমন চিল্লামিল্লি করি না। আর ওদের কথা জিগ্যেস করচেন? চিনতে পারলেন না? সে কি? ওরা ওই তারা কত্তা, যাদের আপনি ইস্কুলে ঢুকে বন্দুক বোম দিয়ে এক্কেরে সাবাড় করে এয়েচেন,এরা তারাই।’
-‘এ এ এ রা এখানে কেন?’
-‘একটা ছোট্ট পরীক্ষা বাকি রয়ে গ্যাচে যে। এইটা পাস করলেই, বুইলেন কিনা, ডাঁয়ে বাঁয়ে হেব্বি সুন্দরি সুন্দরি অপ্সরা, রাত দিন খাঁটি দিব্য শরাব, আরও কত্ত কি সুবিধা বিনা ট্যাক্সো তে, ইশশ আমার ই তো ইচ্ছে করে কত্তা পরমপিতাকে বলে ওইদিকে একটা ডেপুটেশন বাগিয়ে নি, আর টিএ ডিএও হেবি ভালো। শুধু যাতায়াতটাই একটু মুশকিল, তবে কিনা…. ‘
-‘আহ, বাচালতা রাখুন। কি করতে হবে ঝটপট বলুন। আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে।’
-‘তেমন কিচুই না কত্তা, এই একশো সত্তরজন আপনাকে জিজ্ঞেস করবে ঠিক কি অপরাধে আপনি এদের ওপর গুলি চালালেন। মানে এরা ঠিক আপনার কি কি ক্ষতি করেছিল। সব্বাইকে ইন ডিটেইলস এক্সপ্লেইন করতে হবে, বুইলেনএইটাই আপনার শেষ পরীক্ষা, তেমন শক্ত কিচু নয়, না? আমি তো আগেই কয়েচিলুম আপনাকে’
-‘মা…মা…মানে?’
-‘মানে আবার কি স্যার? এই ধরুন ওই যে বাঁ দিকে মাঝের সারিতে ছ’বছরের ছেলেটা দাঁড়িয়ে, ওর নাম ইমরান। ওর তিন বছরের চুন্নুমুন্নু বোনটা রোজ রাতে খাবার সময়ে কাঁদে, ভাইয়াকে ছাড়া খাওয়ার অব্যেসটা তেমন রপ্ত হয়নি কি না। একদম পেচুনে এগারো বছরের ছোঁড়াটা? ওর নাম হলো তারিক। বাপ ফৌত হয়েচে বহুদিন, বেধবা মায়ের এক লওতা আর কি, সে মাগি একনো, কি আস্পদ্দা দেকুন, একনো রোজ রাতে ছেলের জন্যে খাবার সাজিয়ে বসে থাকে, সুনলে কার না রাগ হয় বলুন দিকি? আর ডানদিকে মাঝের সারিতে মিষ্টি গোলগাল ছেলেটা? ওর নাম সুলতান। এর কতা সুনলে তো আপনি হেসেই খুন হবেন। এর আবার এক বুড়ি দাদি ছাড়া তিনকূলে কেউ নেই, এর জানাজার ওপর আছাড়িপিছাড়ি করে বুড়ির কান্নাটা যদি দেকতেন কত্তা, হি হি হি, আমারই ত ভসভসিয়ে পেটের ভেতর থেকে হাসি উটে আসচে। সে বুড়ি অবিশ্যি পরে গলায় দড়ি দেয়, কি অন্যায় বলুন দিকিন। তারপর একদম সামনে বছর পাঁচেকের মেয়েটা, নার্গিস। বাপ আবার শখ করে ডাকতো প্রিন্সেস নার্গিস বলে, হুঁ, যত্তসব নেকপুষু, ঢং দেকে বাঁচি নে বাপু, সে মিনসে নাকি রোজ রাত্তিরে ছাতে উটে আকাশে তাকিয়ে এই এক আকাশ তারার মদ্যি মেয়েকে খোঁজে। গা জ্বলে যায় না এই সব আদিখ্যেতা দেকলে অ্যাঁ? নিজেই বলুন?’
-‘আ আ মি পারবো না, পারবো না, কিছুতেই পারবো না। ওদের যেতে বলুন, ওরা এগিয়ে আসছে কেন আমার দিকে। বারণ করুন, ওদের বারণ করুন। এই কে কোথায় আছিস, এদের সরিয়ে নিয়ে যা, আমার দম আটকে আসছে, দূর হ, দূর হ তোরা আ আ আ আ……’
-‘কত্তা, বলি ও কত্তা, মুচ্ছো গেলেন নাকি? সাড়াশব্দ নেই যে।
নাহ, এও দেখছি সেই একই ব্যাপার। ওরে কে কোথায় আছিস, এক্ষুণি দৌড়ে আয়। এই বরাহনন্দকেও হাত পা বেঁধে অনন্ত নরকে নিক্ষেপ কর। জিনা হারাম করে দিলো শয়তানের বাচ্চাগুলো।’
হাত ঝাড়তে ঝাড়তে বেরিয়ে এলেন বিরক্ত পরমপিতা। তারপর এগিয়ে গেলেন স্বর্গদ্বারের দিকে, কাজ শেষ হয়নি তারঁ।