তা কি বলছিলাম যেন?
হ্যাঁ, আমার সেই বন্ধু। হাইট পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি, রোগা প্যাংলা আর বিচ্ছিরি রকমের কালো। মানে উজ্জ্বল ঘনশ্যাম নয়, নোংরা কালো। একে শুধু চাকরি করতে গিয়ে নয়, তার আগেও চিনতাম, কারণ ছোকরা আমার কলেজের সহপাঠী ছিল।
আগেই স্বীকার করে নিই, বেরহামপুরের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে আসা এই ঔড্র সন্তানের মাথা ছিল অতি সরেস। বাবা মা নিরক্ষর, আদ্যন্ত ভাগচাষীদের ফ্যামিলি। ছেলে যে শুধু আই আই টি ক্র্যাক করেছিল তা নয়, আমাদের ব্যাচে সিভিলের টপার ছিল।
যাই হোক, এহেন প্রতিভার দুর্বলতা ছিল শুধ দুটি, পানুদর্শন ও মহিলা অবলোকন। তবে ছেলে ছিল ভারি সভ্যভব্য, হাঁ করে আদেখলের মতন তাকিয়ে দেখা ছাড়া আর বেশি কিছু করার হিম্মত ছিল না। তার ওপর সে ছোঁড়া নিজেও এ নিয়ে বেশ সচেতন ছিল। একবার মদ্যপাবস্থায় বলেই ফেলেছিল, ও যদি নারীসঙ্গহীন জীবন কাটিয়ে মারা যায়, ওর অতৃপ্ত আত্মার পিণ্ডদান যেন সোনাগাছিতে করা হয়!! আর মিস্টার ইন্ডিয়ার ঘড়ি বা হ্যারি পটারের ইনভিজিবিলিটি ক্লোক হাতে পেলে ওর কি কি করার ইচ্ছে সে আখ্যান বিস্তারিত ভাবে প্রকাশ পেলে হিউ হেফনার ওর কাছে নাকখত দিয়ে নাড়া বাঁধতেন, মস্তরাম আর বিচিত্রবীর্য খেদমতের কাজে নিযুক্ত হতেন!
তা আমাদের চারজনের গ্যাং ছিল, আমি, এই মহাপুরুষ, জগদীশ কুম্ভারে আর গণেশ পাওয়ার, ওরফে ভাউ। মারাঠিতে ভাউ কথাটা সসম্ভ্রমে প্রতিপত্তিশালী লোকেদের বলা বলা হয়। কিন্তু গণেশ পাওয়ারকে ভাউ বলা আর তুষার কাপুরকে অ্যাল প্যাচিনো বলা একই কথা। কিন্তু সেটা আমাদের বক্তব্য না। আমাদের গল্প এখন অন্য।
সুধী পানুবিদদের আশা করি মনে আছে, ২০০৩ সালে মল্লিকা শেরাওয়াতের একটি মুভি রিলিজ করে, ”খোয়াইশ” বলে। ভদ্রমহিলা তাতে সতেরোটা চুমু খেতে জনমানসে অশেষ হর্ষোৎপাদন করেছিলেন। তা সেই চুম্বনসমুদ্রের ঢেউ আমাদের হায়দ্রাবাদের উপকূলীয় জনপদ রামচন্দ্রপুরমেও এসে লাগলো। সেই ঔড্রনন্দন তো সাতিশয় উত্তেজিত। অফিসে মন দিয়ে পিএলসির সার্কিট ডিজাইন করছি, তার প্রায়-অর্গ্যজমিক গলায় ফোন, ‘উসকি **** দেখা হ্যায় বে? মন করতা হ্যায় কাটকে ঘর লে আঁয়ু’। তাকে এইসব হিংস্র স্যাডিস্ট চিন্তাভাবনা থেকে নিবৃত্ত করে ফোন রেখেছি কি রাখিনি, ফের ফোন, ‘ইসিকো **** স্টাইলমে লাগানে সে য্যাদা মজা আয়েগা, নেহি? তুঝে কেয়া লাগতা হ্যায়? উয়োম্যান অন টপ?’
শেষে একদিন বিরক্ত হয়ে বল্লুম ধুর মূর্খসঙ্গমী, চল, তোকে সিনেমাটা দেখিয়েই আনি। নইলে আমার এই ইয়ে জ্বালানো তোর বন্ধ হবে না।
আমার একটা সেকেণ্ড হ্যাণ্ডে কেনা বাজাজ ফোর এস ছিল। টুকটুক করতে করতে সবচেয়ে কাছের যে সিনেমা হল, যেখানে ছুঁচোর ভয়ে পা তুলে রাখতে হয়, সেখানে এক শনিবারের সন্ধ্যায় দুজনে গিয়ে হাজির।
জানি না কতজন এই জঘন্য সিনেমাটি দেখেছেন, এবং তার মধ্যে কতজনের মনে আছে। শুধু রসিকজনা জেনে রাখুন, এই মুভিতে এক জায়গায় দেখানো হয়েছে যে হিরো হিরোইন সঙ্গমপূর্ব কালের প্রিকশন হিসেবে কণ্ডোম কেনা মনস্থ করেন, হিরোটি সেই লজ্জাজনক বস্তুটি কিনতে গিয়ে অ্যাজ ইউজুয়াল বেহুদ্দ ছড়ান, অবশেষে মল্লিকা গিয়ে স্মার্টনেসের হদ্দমুদ্দ করে সেই রাবারখণ্ড কিনে বিজয়তিলকস্বরূপ ধারণ করে ‘উড়িয়ে ধ্বজা অভ্রভেদী রথে’ করে ফিরে আসেন।
যাহাই হউক। সিনেমা দেখে টুকটুক করে ফিরে আসছি। সেই মক্কেল দুহাতে আমার কোমর জড়িয়ে বাঁ কাঁধে থুতনি রেখে জিজ্ঞেস করলো, ‘হ্যাঁ রে, তুই পারবি?’
‘কি পারবো?’
‘দোকানে গিয়ে সবার সামনে কণ্ডোম। কিনতে?’
‘ধুর বাঁ*, না কেনার কি আছে?’
‘বা* পারবি বাঁ*। আমি বলছি তুই পারবি না, তোর গাঁ* দম নেই’।
বাঙালকে চ্যালেঞ্জ দেখানোটা ভারতের ইতিহাসে চিরকালই ঐতিহাসিক ভুল বলে চিহ্নিত হয়ে এসেছে। মনে হলো এ কথাটা এই ওড়িয়াছানাকেও বুঝিয়ে দেওয়াটা আশু কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে।
ফল, হাজার টাকার বেট!
তা বাইক এনে থামালুম টাউনশিপের মধ্যেকার বাজারের সবচেয়ে বড় মেডিক্যাল শপটির সামনে। বাইক স্ট্যাণ্ড করলাম। তিনি আমাকে সদর্পে বললেন, ‘চল বে চুতিয়ে, লে কর আ।’
ভাগ্যক্রমে দোকানে এক সমবয়সী ছেলে দাঁড়িয়ে কাফ লজেঞ্জ কিনছিলো। আমি গিয়ে শুকনো গলা ঘেঁ ঘুঁ ঘিঁ করে বল্লুম ‘ক ক ক কণ্ডোম আছে?’
ঠক করে একটা ছোট প্যাকেট, ছোট্ট ব্রাউন এনভেলাপে বন্দী হয়ে এলো। আমিও অন্যদিকে তাকিয়ে দশটাকা দিলুম, দোকানদারও নৈর্ব্যক্তিকভাবে অন্যদিকে তাকিয়ে টাকাটা নিয়ে ড্রয়ারে রাখলেন।
বীরদর্পে ফিরে এলুম, ছোকরার সামনে প্যাকেটটা নাচিয়ে বল্লুম, ‘ওহে ভগিনীসঙ্গমী, আব তু যা, করকে দিখা।’
দৈব। দৈব সর্বত্র প্রবল। এ কথা অস্বীকার করে কার সাধ্য? নইলে এতক্ষণ খালি থাকা কাউন্টারে সে ছোকরা এগোনো মাত্র দুটি সুন্দরী কিশোরীর আবির্ভাব ঘটবে কেন?
রসের নাগর হিসেবে আমার খ্যাতি সর্বজনস্বীকৃত। রগড় দেখার জন্যে একদম সাইড ঘেঁষে এলাম। সে ছোঁড়া তো যে ভাবে দোকানের সামনে এগোলে, দেখে মনে হলো সত্তরের ওয়েস্ট ইণ্ডিজের পেস ব্যাটারির সামনে ব্যাট হাতে জাভাগাল শ্রীনাথ!!
সেই নিস্তব্ধ সশঙ্ক মুহূর্তটি এখনো মনে আছে। বন্ধুবর সেই সদ্যযৌবনবতী কিশোরীদুটির প্রতি অপাঙ্গে কিছু অহৈতুকী প্রেমার্তি বিলিয়ে দোকানদারকে বললেন, ‘কন্ডোম হ্যায়?’