বাদ্দিন, তা সেই শবরীর প্রতীক্ষার শেষে যখন হোটেলে পৌঁছলুম, সুনয়নী রিসেপশনিস্টটি…
যাদের বাজে ইতরগন্ধী ছ্যাঁচড়াপনা অপছন্দ, তেনারা এখানেই ক্ষান্ত দিলে খুবই ভালো করবেন। এমনিতেই আমার লেখা কেউ বিশেষ পড়েটড়ে না। যেসব রুচিশীল শ্রদ্ধেয় লোকজন তাও ক্ষমাঘেন্না করে মাঝেমধ্যে উঁকি দিয়ে দেখেন, এই লেখা পড়ে যদি তেনাদের ব্লাডপ্রেশার অকস্মাৎ গগনচুম্বী হয়ে পড়ে, রাতবিরেতে সরবিট্রেট হাতে ছুটতে পারবো না, আগেই কয়ে রাখলুম বাপু, হ্যাঁ।
যাগগে যাক, তা সেই সুনয়নী রিসেপশনিস্টটি পাসপোর্ট, বুকিং পেপার্স ইত্যাদি চেক করে রাগী ডলপুতুল টাইপের টোনে প্রথমে বললেন ‘অল রুমস আর নন স্মোকিং, ইফ ইউ স্মোক, ওয়ান তাউজেন্দ বাত ফাইন’, এতটা শুনেই ভাবছি কলকাতায় ফিরে ট্রাভেল এজেন্ট অভিষেককে তিনমাসের জেলই দেবো, না সাতদিনের ফাঁসি, এবং সময় তিনি কাংস্যনিন্দিত ন্ট্রে ফের বলে উঠলেন ‘অ্যান্ড ইফ ইউ স্তিল আওয়ার তাওয়েল, দু তাউজেন্দ বাত ফাইন’!!
অয়ি সুন্দরী, আমাদের দেখে কি তোর তোয়ালেচোর মনে হচ্ছে, অ্যাঁ?
পরে বুঝলুম এঁয়াদের দোষ নেইকো। আমাদের দেশোয়ালি ভাইরাই নিশ্চয়ই কেউ এমত নিদর্শন রেখে গেছে আগে, নইলে এরাই বা অমন করে বলবে কেন?
এ বিষয়ে আমার এক পুরোন কলীগের কথা মনে পড়ে গেলো। ভদ্রলোক সমস্ত হোটেলের যাবতীয় জিনিসপত্র নিজের মতো করেই দেখতেন, একদম নিজের মনে করে। রুমে ঢুকেই চটপট সাবান, শ্যাম্পু, ময়েশ্চারাইজার, টুথপেস্ট, টুথব্রাশ, চিরুনি, টি ব্যাগ, সুগার স্যাশে ইত্যাদি যা হাতের কাছে পেতেন সে সওওব দ্রুত নিজের ব্যাগে ঢুকিয়ে, তারপর হাউস কিপিং এ ফোন করে ‘এইও, তুম লোগ কা সার্ভিস তো একদম বেকার দেখতা হ্যায় রে, ঘরমে সামানপাতি রাখনেসে কি তোমলোগোকো খুব কষ্ট হোতা হ্যায় রে ব্যাটা’ বলে সেইসব জিনিস আরেকদফা আনাতেন। আমরা বলাবলি করতাম দাদার বাড়িতে বিভিন্ন হোটেলের ছাপমারা চাদর, বালিশের ওয়াড়, তোয়ালে থেকে শুরু করে আদ্ধেক কনজিউমেবল ইত্যাদি যা আছে, উনি স্বচ্ছন্দে একটা মিক্স অ্যান্ড ম্যাচ হোটেল খুলে বসতে পারেন।
তবে যেদিন দেখলাম দাদা হায়াত রিজেন্সির বাথরুমের মধ্যেকার জুতো পালিশের মেশিনটাকে খুব মনে দিয়ে দেখছেন, আর আমি হালকাচ্ছলে ‘ কি গো দাদা, এবার কি এটাও নিয়ে যাবার প্ল্যান কষছো নাকি’ প্রশ্ন করাতে আক্ষেপের সুরে বলেন ‘নারে, অত বড় ব্যাগ আনিনি’, সেদিন ওনার প্রতি আমার সম্মান যাবতীয় ওয়ার্ল রেকর্ড ব্রেক করে ফেলে!
যাগগে, কি বলছিলাম যেন? হ্যাঁ। তা রুমে ঢুকে চটপট ফ্রেশ হয়ে পাটায়ার সী বিচে দৌড়ে গেলুম।
এবং অত্যন্ত নিরাশ হলুম। সরু একটা বিচ, নোংরা, কিছুই তেমন দেখার নেই, চাট্টি বিকিনিপরিহিতা সুন্দরী বাদে। এর থেকে মন্দারমণি কি তাজপুরও অনেক ভালো।
তবে সমুদ্রের ধার ঘেঁষে রাস্তাটি, অর্থাৎ মেরিন ড্রাইভটি ভারি বাহারি। সুন্দর সাজানো গোছানো ঝকঝকে রাস্তা। তাতে নানা দেশীবিদেশী ট্যুরিস্ট ঘুরে বেড়াচ্ছে। রাস্তার পাশে মাঝেমাঝে ছোট ছোট কফি বা বিয়ারের ঠেক। মাথা তুললেই নীল আকাশ, তাতে উঁকি দিচ্ছে রাস্তার পাশে লাগানো পাম গাছগুলোর উঁচু মাথা। রাস্তার অন্যফুটে ছোট ছোট দোকান, সেখান থেকে দরদাম করে একটা চপ্পল কিনলুম। সে জিনিস আমি এখনও ব্যবহার করি, যেমন আরাম, তেমন টেঁকসই।
তারপর হোটেলে ঢুকে দেখি সাত ভাই চম্পা গোল হয়ে বসে, মধ্যমণি এক মহিলা, বয়েস আঠাশ থেকে আটচল্লিশের মধ্যেই কিছু একটা হবে। বুঝলাম ইনিই আমাদের ট্যুরিস্ট গাইড। আমি ঢুকতেই সবাই সসম্ভ্রমে জায়গা ছেড়ে দিলো, হাজার হোক আর এস এম বলে কথা, বয়সে, সম্মানে, পদমর্যাদায়….
ভদ্রমহিলা প্রথম প্রশ্ন করলেন, ‘হোয়েন আর ইউ গোয়িং তু বুমবুম?’
বুমবুম? সেটা আবার কি? ধূপগুড়ির আরতিপিসির নাতির নাম তো বোধহয় শুনেছিলাম বোধহয় এরকম কিছু একটা, নাকি বোমাটোমা নিয়ে কিছু বলছে? কেষ্টদা তাহলে আজকাল এদিকেই নাকি?
সাউথ বেঙ্গলের এ এস এম সুজন অত্যন্ত ভারি গলায় জিজ্ঞেস করলো, (আমি টার্গেটের কথা বললেই ও গলাটা যেমন ভারি করে ফেলে) ‘হোয়াত ইস বুমবুম? ‘
‘ইউ দোন্ত নো হোয়াত ইজ বুমবুম? সাকিং ফাকিং ম্যাসাজ? গুদ প্লেস, বেরি গুদ গার্লস….’
ইজ্জত একেবারে ধুলোমে পড়কে বিলকুল গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে হাওয়ার সঙ্গে উড় গ্যায়া!!!
সেলস অফিসাররা সঙ্গে সঙ্গে খুবই গম্ভীর ভাবে বাঙালি জীবনে বাজার অর্থনীতির ক্রমবিকাশ ও টাকার অবমূল্যায়নের পরিপ্রেক্ষিতে আধুনিক ব্যাঙ্কিং ব্যবসার ওপর তার প্রভাব, এই টাইপের একটা সিরিয়াস আলোচনা করার মতো মুখ করে বাইরে বেরিয়ে গেলো। সুজন, আর বিহারের এ এস এম আশিস ঝা আমার বজ্রাহত মুখের দিকে একঝলক তাকিয়েই গলা খাঁকারি দিয়ে বল্লো ‘নো বুমবুম’, বলেই স্পষ্ট শুনলুম, আশিস চাপা গলায় যোগ করলো, ”নট নাউ”!
তারপর বেলা দশটা নাগাদ যখন গাড়ি চেপে নং নুচ ভিলেজে পৌঁছলুম, তখনও আমার বুমবুমের ঘোর কাটেনি।
নং নুচ ভিলেজ একটি কৃত্রিম গ্রাম, দুরন্ত সাজানো গোছানো, পর্যটকদের মনোরঞ্জনের যাবতীয় ব্যবস্থা মজুত। কিছু স্থানীয় কালচারাল শো দেখলাম, এদিকওদিক প্রচুর ফটো তোলা হলো। হাতিদের নিয়ে একটা দুর্দান্ত ভালো শো হয়, যে কোন সার্কাসের থেকে শতগুণে ভালো। হাতিতে ছবি আঁকে, আর্চারি করে, ট্যাঙ্গো ট্যাঙ্গো জিঙ্গো জিঙ্গো নাচে, ফুটবল খেলে, পেনাল্টি মিস করলে হতাশার ভঙ্গিতে মাথায় হাত, সরি শুঁড় দিয়ে বসে পড়ে, আবার গোল হলে হাইফাইভের ঢঙে হাইশুঁড় করে। মাঝেমধ্যে দর্শকদের মধ্যে কোনও ক্ষীণকটি মধ্যেক্ষামা স্কার্টপরিহিতা বিদেশিনীকে একবার শূণ্যে ঘুরিয়ে মাথায় তোলে, তাতে আবার বিপুল সিটি!!