ভদ্রলোক একটু অপ্রতিভ হয়ে পড়েন, ‘আহা, অর লগেদুইখান তুলসিপাতাও ত দিসিলাম গ্লাসের উপর’।
-‘দ্যাকো, একদম মাতা গরম করাবে না।’
-‘হে হে গিন্নি, রাগ কর ক্যান। তুমি ছিলা বইল্যাই ত বাইচ্যা আসি। কই কি তিরিশ বচ্ছর তো হইয়াই গ্যালো। ন্যাক্সট সাত জনমের লাইগ্যা তো উপরওয়ালার কাসে তোমার নামখান লেইখ্যা ডিমান্ড ইন্ডেন্ট যমা দিয়াই রাখসি। এহন দ্যাখার কে আগে উপরে গিয়া ইন্ডেন্টখান ফাইল করে। হ্যা হ্যা হ্যা। মনে হয় আমার চান্সডাই বেশি। কি কও?’
-‘যত্তসব অলুক্ষুনে কতা’
স্নিগ্ধা সুজনের পাশে ঘনিয়ে আসে। ‘আপনাদের ছেলে মেয়ে?’
-‘তার কথা কইও না মা। কুলাঙ্গার। একখান শিক্ষিত হামবাগ’
-‘দ্যাকো, যেকানে সেকানে নিন্দে করবে না রুপুর। হিরের টুকরো ছেলে আমার’।
-‘করুম, হাযার বার করুম। হিরা নয়, কয়লা।’
সুজন খুব ইতস্তত ভাবে জিজ্ঞেস করে ‘কি করেন উনি’।
বৃদ্ধার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে’ ও তো খুউপ ভালো ছেলে বাবা। খড়গপুর আই আই টি থেকে খুব ভালো পাসটাস করে এখন অ্যামেরিকা তে আচে। বুজলে, ওকানেই মাস্টার করে, ডাক্তার হয়ে রিসাচ করে’।
-‘ট্রেইটর। কুইসলিং। লাস্ট টেন ইয়ার্স দ্যাশে আয় নাই। মায়-বাপেরে দ্যাহনের কুনো ইসস্যাই নাই। হি ইস টু বিযি টু টক টু হিস পেরেন্টস ইভেন ওয়ান্স ইন আ মান্থ। এক বোচা নাক জাপানিরে বিয়া কইর্যা বাসসা কাসসা লইয়া ভালই আসে। আমাগো কথা মনেই পড়ে না।’
-‘আহা। ওদের কত কাজ বল দিকিন। রাতদিন খাটাখাটনি…’
-‘তাহইলে কালও ”অরে কতদিন দেহিনা ”বইল্যা কান্দতাসিলা ক্যান?’
বৃদ্ধা চুপ করে যান।
বয়স্ক লোকটি উঠে ট্রাভেল ব্যাগ থেকে একটা চাদর বার করে স্ত্রীর গায়ে জড়িয়ে দেন। ‘ঠান্ডা লাগাইয়ো না’।
স্নিগ্ধা কোন কথা খুঁজে না পেয়ে জিজ্ঞেস করে ‘ওনার বুঝি ঠান্ডার ধাত?’
‘হ, তবে কিনা আমার অ্যাকশনটা হইল গিয়া পুরাই সেল্ফিশ, বোঝলা না? বুড়ি কাল মইর্যাধ গ্যালে এই বুড়াডারে দেখবো কেডা? হ্যা হ্যা হ্যা’
বৃদ্ধা কপট রাগত দৃষ্টিতে তাকান। তারপর কঠিন স্বরে জিজ্ঞেস করেন ‘ওসুদের ব্যাগটা কই? এখন তোমার দুটো ট্যাবলেট খাওয়ার কতা না?’
-‘রাখসিলা কই?’
-‘কেন? তোমার ওই নীল হাতব্যাগটার মদ্দ্যে। সেটা কোতায়?’
বৃদ্ধ উদাস মুখে বসে থাকেন।
-‘কতা কানে জাচ্চে না?’
-‘যাইব কই? হোটেলে গিয়া খুইজ্যা দেখুম’অনে’।
-‘পথে এসো। ব্যাগটাতো পাসের বারির বান্টিকে ফুটবল খেলার জন্যে দিয়ে এসচিলে। ভাগ্যিস ওর মা এসে নিয়ে গেসলো। এই নাও। এখন মুখটা খোল দিকিন। এই যে, হ্যাঁ……’
পরম মমতায় উনি চল্লিশ বছরের সুখ দুঃখের সাথী ভদ্রলোকটির মুখে ট্যাবলেট দিয়ে জল ঢেলে দিতে থাকেন।
সেইদিন রাতে, সুজনের বুকে আঙুল বোলাতে বোলাতে স্নিগ্ধা জিজ্ঞেস করে ‘বিয়ে করলেই খুব ঝগড়া হয়, না?’
সুজন আধো ঘুমে বলে ‘হুঁ’।
-‘ঝগড়া করাটা কি খুব ইম্পর্ট্যান্ট?’
-‘হ্যাঁ’
-‘হ্যাঁ?’
-‘হ্যাঁ। তবে কি না আরও ইম্পর্ট্যান্ট হল ঝগড়া করতে করতে এক সঙ্গে বুড়ো হওয়াটা।’
স্নিগ্ধা হয়ত আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু হঠাত করে সুজনের ঠোঁট ওর ঠোঁটের ওপর নেমে আসায় আর কিছুই বলে উঠতে পারে না ও।
তখন অবশ্য বেশি কিছু বলার কথা ওর মনেও ছিলো না।
আর মনে থাকলেও তখন তাতে কিছু এসে যায় না।
পাটায়াতে পটলকুমার
ইজ্জত একেবারে ধুলোমে পড়কে বিলকুল গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে হাওয়ার সঙ্গে উড় গ্যায়া!!!
ইণ্ডিগোর ফ্লাইটে রাত আড়াইটেয় ব্যাঙ্কক এসে পৌঁছে শুনি ভোর চারটের আগে ট্রান্সফার দেবে না। এদিকে এয়ারপোর্টের দোকানপাটও দেখি সব ঝাঁপতোলা। অতএব ক-এ কমললোচনে শ্রীহরি আবৃত্তি করা ছাড়া কিছুই করার থাকে কি? লোকজন ইতিউতি ঘুরতে লাগলো, আর আমিও কমলকুমার মজুমদারের ওপর অনিরুদ্ধ লাহিড়ীর লেখা একটা বই নিয়ে একটা বেঞ্চে লম্বা হবো হবো করছি, ছফুট চার ইঞ্চি হাইট আর একশো কিলো ওজনের তিনসুকিয়ার সেলস অফিসার কার্তিক শুক্লা, আমাকে একবার হাল্কা করে জিজ্ঞেস করে গেলো লাগেজ খুলে একটা ওল্ড মঙ্কের লার্জ বানিয়ে দেবে কিনা। মাতাল আর কাকে বলে?
সাউথ কলকাতার সেলস অফিসার হরিকমল দেখলাম খুব হাসিমুখে আমার দিকেই আসছে। কি রে, ব্যাঙ্ককে নেমেই রাতবিরেতে এত আনন্দ কিসের তোর? লক্ষণ তো ভালো না, অ্যাঁ? সে ছোঁড়া অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে জানালো একটা বেশ ফাঁকা রুম ও খুঁজে পেয়েছে, একদম খালি, কয়েকটা মাদুর টাইপের কি সব পড়ে আছে, আমি কি গিয়ে একটু গড়িয়ে নেবো?
শুনে তো আমি খুবই ইম্প্রেসড, বলে কি ছেলে? এয়ারপোর্টে আজকাল শিয়ালদা”র ডর্মিটরি খুলেছে নাকি? হাজার হোক সেলসের লোক…. জিজ্ঞেস করলুম, কি রুম রে? ছোকরা সেম হাসিমুখে জানালো, বাইরে লেখা আছে ‘প্রেয়ার রুম’ !!!
অর্থাৎ, নামাজ আদায়ের রুম! ছোকরার দোষ নেই, পেরথম বার বিদেশে এয়েচে!
সেলসের লোকেদের লাইফে স্কিম আর ইন্সেনটিভ, এই বস্তুদুটি লেগেই থাকে, যাগযজ্ঞে ওম এবং স্বাহা ধ্বনিদুটির মতই। তেমনই এক ইনসেন্টিভের পার্ট হিসেবে এই ব্যাঙ্কক যাত্রা। সর্বসাকুল্যে আটজনের টিম, পাঁচটি ফুলের মতই পবিত্র ও নিষ্পাপ সেলস অফিসার আর দুটো মুশকো টাইপের ষণ্ডা চেহারার অত্যাচারী এ এস এম, সবমিলিয়ে সাতভাই চম্পা বললেই চলে, আর পারুল বোন হিসেবে আমি, ইস্ট রিজিওনের আর এস এম, শ্রীলশ্রীযুক্ত….