‘আহা হা হা হা। মুচ্ছো যাই আর কি। নকশা দেকে বাঁচিনে। নেহাৎ আমার সহজ সরল বাপ ডিগ্রী দেকে…’
‘হ্যা হ্যা হ্যা। হেইডাই তো হইল কথা। বোযলা মা, ডিগ্রী। হ্যান্ডসাম তো সিলামই, হে হে হে (‘মরণ, বুড়োর আদিক্যেতা দ্যাকো’) তারপর বোযলা কিনা, এয়াগো ফ্যামিলিতে তো ল্যাখাপড়ার তেমুন চল নাই (‘মাজে মাজে ইচ্চে করে বুড়োর মুকে নুড়ো জ্বেলে দিই’), তা শ্বশুরমশয় আমার হাত ধইর্যা কইলেন, ”দ্যাহো প্রশান্ত, আমার মাইয়াডা তে মানুষ হয় নাই”…
‘দ্যাকো, অনেক্কন ধরে সুনচি এসব। এরপর কিন্তু টিটি ডেকে টেরেন থেকে নামিয়ে দেবো, সত্যি বলচি’।
এতক্ষণে স্নিগ্ধা এদের খুনসুটি উপভোগ করতে শুরু করেছিল। ওর মনের গভীরে জমে থাকা মালিন্য কেটে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে। এই বুড়োবুড়ির কথাকাটাকাটির গভীরে কোথাও অন্তঃসলিলা ফল্গুর মত একটা ভালোবাসার চোরাটানও আছে। হয়তো বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু কিছুতেই উপেক্ষা করা যায় না।
সুজন জিজ্ঞেস করে ‘আপনারা কি কোনও কাজে যাচ্ছেন ? নাকি এমনি, আমাদেরই মতন ছুটি কাটাতে?’
ছুটি কাটানোর কথা শুনে স্নিগ্ধা একবার ওর দিকে অপাঙ্গে তাকিয়ে নেয়। কিছু বলে না।
‘সে আমরা বচ্ছরে দুইবার শ্রীক্ষেত্রে আসি বাপু। বাবা জগন্নাথের পেসাদ নিয়ে ঘরে ফিরি’
-‘এইগুলা এক একখান হোক্স, বোযলা। এইসব পূযাফুযা সব ফালতু। লোক ঠকানের কায়দা আর কি। ছুডবেলা থেইক্যা দেখতাসি….’
-‘দেখো, ঠাকুর দেবতা নিয়ে বাজে কতা একদম বলবে না। বামুনের ছেলে, সান্ধ্যাহ্নিক টুকু করো না, বাসি কাপড়ে খেতে বস, পইতে দিয়ে মশারির দড়ি করেচ। কি ভাবচো, এসব উনি দেকেন না?’
-‘তা আমারডা ছাড়ান দাও। তোমারটা তো দ্যাহেন। তা হেইডা দিয়া রুপুর ভালো কিছু হইলো নাকি?’
হঠাৎ দুজনেই চুপ করে যান। ভদ্রমহিলা মাথা নিচু করে বসে থাকেন। ট্রেন তখন খড়গপুর পৌঁছেছে। ভদ্রলোক শশব্যস্ত হয়ে ‘খাওনের লগে কিসু পাওয়া যায় কি না দেহি’ বলে দরজার দিকে এগিয়ে যান।
স্নিগ্ধা এসে সুজনের পাশে এসে বসে, কেন জানি না গা’টা একটু শিরশির করছিলো ওর। ইচ্ছে করছিলো এদিকে এসে বসতে।
ট্রেন খড়গপুর ছাড়ালে প্রশান্তবাবু এক চাঙারি কচুরি আলুরদম আর চারটে ডিমসিদ্ধ নিয়ে ফিরে আসেন। প্রসন্ন মুখে বলে ‘খাইয়া দ্যাহ। হে হে হে। অম্রেতো, বোযলা, অম্রেতো। লিপিড প্রোফাইলের কথাডা ভুইল্যা যাও।’
সুজন মৃদু আপত্তি করে। ‘আহা আপনি আবার কেন এত কষ্ট করে….’
ভদ্রলোক দাবড়ে দেন, ‘আরে খাইয়া দ্যাহো। বড় বড় শেফেদের এয়াদের কাস থেইক্যা কসুরি বানানো শেখন লাগে।’
সবাই সেই মুহূর্তে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে চাঙারির ওপর।
স্নিগ্ধা আর সুজন একই চাঙারি থেকে কচুরি খেতে থাকে। হাতে হাত ঠেকে যায়, কাঁধে কাঁধ, আঙুলে আঙুল।
ওদিকে খেতে খেতে প্রৌঢ়া ভদ্রমহিলা একবার আড়চোখে কর্তাটির দিকে তাকিয়ে নেন,
-‘তেলেভাজা আর ডিম খাচ্চ খাও। কিন্তু বেসি বাড়াবাড়ি যদি দেকিচি, তক্ষুনি কিন্তু সরিৎ ডাকতারকে ডেকে সুদু গলা ভাত খাওয়াবো, বলে রাকলুম’।
-‘হেইডাই দিও, সংগে যদি এক চামচ মরিচ বাটা, কসুর লতির তরকারি আর গিমা শাগের বড়া ভাইজ্যা দাও গিন্নি, দুইখান চুমা এহনই দিতে পারি হে হে হে’।
বৃদ্ধা মুহূর্তে রাঙিয়ে ওঠেন, ‘নোলা দ্যাকো বুড়োর। আর কতাবাত্রার কি ছিরি। মুকের কোন আড় নেই ‘।
সুজন হেসে ফ্যালে। স্নিগ্ধা সামান্য অপ্রস্তুত হয়। তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করে ওঠে ‘ওঁর বুঝি ওসব খাওয়া বারণ?’
খানিকক্ষণ চুপ থেকে মুখ খোলেন বৃদ্ধা, ‘তিন তিন বার হার্ট অ্যাটাক হয়ে গ্যাচে ওনার। শেষ বার তো যমের মুক থেকে সরিৎ ডাক্তার একাই টেনে এনেচিল। টানা একমাস হাসপাতালেই সংসার গুচিয়ে বসেছিলুম,’ বলেই হাত জোড় করে প্রণাম ঠোকেন উনি, ভগবান না ডাক্তারবাবু, কার উদ্দেশ্যে সেটা বোঝা যায় না অবশ্য।
তবে তার পরেই তাঁর গলায় আগুন ঝরে পড়ে,’তাও কি বুড়োর হুঁস বলে আচে কিচু? ছাইপাঁশ গেলা কি কিচু কমতি আচে? আবার অমন দেবতুল্য ডাক্তারকে বলে কি না, ”রেগুলার কাস্টমারদের কিছু ডিস্কাউন দেবেন না?” কী বলবো বাছা, কিচুই না পেয়ে শেষে একমুঠো নজেন আর ডাক্তারবাবুর একটা নতুন পেস্কিপশন লেকার খাতা তুলে এনেচেন উনি, বচ্ছরকার বাজারের হিসেব রাকার জন্যে। কি বেয়াক্কেলে লোক ভাই কি বলবো, হাড় মাস কালি করে দিলে এক্কেবারে’
-‘হ, নিযের কথাডা কও। হাডু দুইখান তো পুরাই ইন্ডিয়ার ইকনমি, খালি ন্যাতাইয়া ন্যাতাইয়া পড়ে। ডাইন চক্ষুখান তো গ্যাসেই। আমি কই কি একখান কালো কাপড় বাইন্ধা রাখো, পুরাই পাইরেট লাগবো’অনে, পাইরেট অব ক্যারিবিয়ার মত পাইরেট অফ বাগবাজারিয়া। পার্ফেক্ট অ্যাটায়ার ফর ইউ। হে হে হে হে। বোযলা মা, আমারে ভালোমানুষ দেইখ্যা একখান ডিফেক্টিভ বউ হ্যান্ডওভার কইর্যা। দিসিল..’
ভদ্রমহিলা তেড়েফুঁড়ে ওঠেন। ‘এই নিয়েই তো চল্লিশটা বচ্ছর তোমাদের বাঙাল ফ্যামিলির সেবাযত্ন করে গেলুম। বলি তোমার ননদ দ্যাওরদের মানুষ করলো কে? কোন খেয়ালটা রাকতে শুনি? নিজের বোনের বিয়ের দিন বরের ছোটমামাকে বলনি ‘বিয়া ত দিতাসেন, পোলায় গবর্মেন্টের অফিসার, চুরিচামারির অভ্যেস নাই তো?’, বলি এসব ঝামেলা কে সামলায়? আমার দ্যাওরের আশি বছরের বিধবা শাশুড়ি ঠাকুমাকে তুমি সর্দি হয়েচে সুনে গরম জলে রাম না হুইস্কি গুলে খাওয়াওনি? ছি ছি ছি, কি কেলেঙ্কারি’।