সঙ্গী ষাটোর্ধ ভদ্রলোকটি গাত্রবর্ণে ঘোরকৃষ্ণ। দোহারা চেহারার মানুষটি উচ্চতায় ছফুটের সামান্য বেশীই হবেন। তিনি রুমাল বের করে ঘাম মুছতে মুছতে কাঁচাপাকা গোঁফের ডগা নাচিয়ে বললেন, ‘মনে করনের ত কিসুই দেহি না। আমরা হইলাম গিয়া বোনাফায়েড প্যাসেনযার। আমাগো সীট পাইয়া বইয়া পরসি। মনে করনের আসেডা কি হেতে?’
মহিলা একবার শ্যেনদৃষ্টিতে ভদ্রলোককে মেপে নেন। তারপরে মধুমাখা স্বরে কিঞ্চিৎ লঙ্কার ঝাঁজ মিশিয়ে বলে ওঠেন ‘ওইভাবে হুড়যুদ্দ করতে করতে কারও গায়ের ওপর এসে পড়লে সরি বলতে হয়। তোমাকে ছোটবেলায় তোমার মা বাবা শেকায় নি?’
‘হে হে, ওইরকম ফুডবল মার্কা বডি হইলে ত গরাইয়া যাইবই। উনি সবই বোযসেন। তোমারে আর কওন লাগবো না’।
বলেই ভদ্রলোক গিন্নির দিকে দৃকপাত না করে সুজনের পাশে বসে চোখ টিপে জিজ্ঞাসা করেন ‘কি খাইতাসেন? বাকার্ডি না স্মারনফ? হে হে। আমিও লইয়া আইসি, পেপসি দিয়া ওল্ড মঙ্ক , বোযলেন নি?’
ভদ্রমহিলা অত্যন্ত স্থির গলায় বলেন ‘নিজের গুনপনার পরিচয় দেবার আগে লোকে অন্তত নিজের নামটুকুন বলে। ওনার নাম জিগ্যেস করেচ? নাকি উটেই আগে ছোঁকছোঁক, ককন খুলে বসবে। আর পারিনা বাপু’।
ভদ্রলোক হঠাত খুব গম্ভীর হয়ে রুমাল পকেটে ঢুকিয়ে হাত বাড়িয়ে বলেন’ মীট মিস্টার প্রশান ভট্টারিয়া। এক্স চিফ প্রোডাকশন ম্যানেযার অফ ভারত মেশিনারি। ইঞ্জিনিয়ার ফ্রম শিবপুর বি ই কলেয। থার্টি ফাইভ ইয়ার্স অফ আনপ্রিসিডেন্টেড এক্সাম্পল অফ…..’
‘ওফফ, এই সুরু হল বুড়োর। এই ছিলুম, ওই ছিলুম। অমুক সায়েব আমার ইঞ্জিরি দেকে এই বলেচিলো, ওমুক কনফারেনে ওই পেয়েচিলুম। বাঙাল বিয়ে করে যে কি গোকখুরি করেচি মা যে কি বলি। একটা সাট্টিপিকেটের জন্যে এমন হাবাতে মার্কা হা পিত্যেশ কাউকে করতে দেকিনি বাপু’
‘বলি বোঝবা কি কইর্যাব? তোমাগো ফেমিলিতে ল্যাখাপড়ার চল আসে নাকি কিসু? বউবাযারে দুইখান সোনার দোকান দুইডা বাদ দিয়া কি আসে কও দেহি? ভাইগুলা ত এক একডা খাডাশ। পয়সার গরমে ত্যাল ম্যাকম্যাক করে।’
‘আহাহা…. ঢং দেকে বাঁচিনে বাপু। কি দেমাক কি দেমাক। বলি আমাদের ত নাকি কিচুই ছিলো না। তা কি দেকে নেংচে নেংচে এলে হ্যাংলার মতন?’
‘দ্যাহ রমা, দ্যাট হ্যাপেনড বিকজ অফ আওয়ার প্যারেন্টস। বুল্টির বিয়ার গয়না গড়াইবার লগে আমার ছুডকাকা আমারে লইয়া তোমাগো দোকানে গেসিল। তা আমার রূপ (হালকা হাসি) দেইখ্যা আর ডিগ্রীখান শুইন্যা তোমার বাবার হ্যাসরপ্যাসর দেইখ্যাই তো হ্যা হ্যা হ্যা…..’
‘ইসস ম্যাগো, আবার সেই বিচ্চিরি হাসিটা হাসচে দ্যাকো’
এই পর্যায়ে সুজন প্রায় হামলে পড়ে। হাত বাড়িয়ে বলে ‘সুজন বসু, বাড়ি লেকটাউন। এরিয়া সেলস ম্যানেজার অফ হাইজিন অ্যান্ড কেয়ার কম্পানি। মীট মাই ওয়াইফ স্নিগ্ধা, ফ্রম যাদভপুর, মাস্টার্স ইন কম্প্যারেটিভ লিটারেচার। আর আমাদের প্লিজ তুমি করে বলুন। আপনারা বয়সে অনেক বড়’।
বৃদ্ধ উল্লসিত হয়ে ওঠেন ‘বাহ বাহ, যাদবপুরের মাইয়া, মাস্টার্স করস, হ্যা হ্যা,… দেখলা গিন্নি, বাঙালগুলা কেমুন আউগাইয়া যাইতাসে’।
‘তুমি থামো বাপু। তা বাছা, তোমাদের দেশগাঁ কোতায়? লেকটাউনতো হালে হয়েচে, জত্ত মেড়োগুলো আসর বসিয়েচে ওখানে। তা বাপু বাপ পিতেমোর ভিটেটি কোতায়?’
সুজন খুব কুণ্ঠিত স্বরে বলে ‘বাঁকুড়া,’ শুনেই প্রৌঢ়া একগাল হাসি হেসে বলেন ‘সে তো আমাদেরও গাঁ তো ওদিকেই। বলি গাঁয়ের নামখানি কিচু জানা আচে?’
সুজনের গলা শুকিয়ে যায়। ওরা বাঁকুড়ার বাসিন্দা নামেই, গত পঞ্চাশ বছর ধরে ওরা কলকাতার লোক। গ্রামের নামটা মুখস্থই ছিলো, কিন্তু এঁদের দেখে মাথাটা পুরো ঘেঁটে গেছে, নামটা কিছুতেই মনে আসছে না।
ওদিকে ভদ্রলোক দিব্যি স্নিগ্ধার সংগে আলাপ জমিয়ে নিয়েছে ‘দ্যাশ যানি কোথায় কইলা ? বিক্রমপুর? হ্যা হ্যা, আমাগো ইয়ে ত কাসেই, সাভার। আহা হা হা। কত্ত যমি নদি পুহইর আসিল আমাগো। সে যদি একবার যাইতাম…..’
এতক্ষনে অরিন্দম কহিলা বিষাদে….
ভদ্রমহিলা বীরদর্পে এদিকে ফেরেন, মিষ্টিস্বরে হুল ফুটিয়ে বলেন ‘বলি এইসপ গুল ঝেড়ে আর কদ্দিন চলবে বল দিকিন? জমি পুকুর ওবদি না হয় বুঝলুম, বলি নদী কি করে কারও সম্পত্তি হয় নাকি বাপু? আর সব্বারই তো শুনি ওদিকে নাকি গাদা গাদা জমিদারি ছিল। বলি বাংলাদেশে এত জমি আচে? নাকি ওদিকে এক ডেড় কাঠাতেই জমিদারি পাওয়া জেত? কি জানি বাপু, ইদিকে তো দু দশ খান গাঁ না হলে আমরা জমিদার বলে মানতেই চাইতুমনি। বলে সুজনের দিকে তাকিয়ে চোখ মটকে নিঃশব্দে হাসতে থাকেন।
বৃদ্ধ ঈষৎ গরম হয়ে বলেন, ‘দ্যাখো, দ্যাশ তুইল্যা কথা কইবা না। জানো আমরা কত কষ্ট কইর্যাঈ…’
কথা শেষ হতে দেন না বৃদ্ধা, কলকল করে ওঠেন ‘ওনার কতা একবর্ণ বিশ্বেস কোরনি বাপু। বুড়ো জন্মেচে এদিকে, সাতচল্লিশের পরেই। ওপার থেকে এদেসে এসেচিলেন আমার শ্বশুরমসাই, ছিলেন ইসকুল মাসটার। আহা, অমন লোক আর হবে না বাবা, সাক্ষাৎ ঈশ্বরতুল্য মানুষ। আর আমার ছিলেন আমার শাশুড়ি, সাক্ষাৎ মা অন্নপূর্ণা। যা কষ্ট ওনারা করেচেন। এনারা তো ওই যা হোক করে ডিগ্রী বাগিয়ে এক একজন হনু হয়েচেন, সে উনি, আমার দ্যাওর, ননদ সব একেকজন সেয়ানা নাম্বার ওয়ান….’
-‘দ্যাহো রমা, এইসব ইন্টারনাল কথা এদিক ওদিক কওন ঠিক না।’