‘বেকার সময় নষ্ট করছেন স্যর। চটি পরেই যাবেন বলছেন? চলুন তাহলে, দুগগা দুগগা।’
‘একটা মিনিট প্রভু, প্লিজ প্লিজ’।
‘উফফ, বড্ড জ্বালান মশাই। নিন উঠুন’, এই বলে যমরাজ একটা হাত দিয়ে ওনার ঘাড়ে ধরতেই জ্ঞান হারালেন প্রিয়নাথ বাবু।
***************
ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসলেন প্রিয়নাথ। সকালে তীব্র আলোয় চোখটা কুঁচকে গেলো। সারা গা ঘামে ভিজে জবজব করছে।
স্থির হয়ে বসে রইলেন খানিকক্ষণ।
স্বপ্নটা যদি সত্যিই হত? সত্যিকারের সত্যি হত? সত্যিই যদি কোনমুহুর্তে ডাক এসে যায় বিনা নোটিশে একদিন, তখন কি করবেন প্রিয়নাথ এই ঐশ্বর্য নিয়ে?
আর যার নোটিশ এসে গেছে আগে থেকে? ঢাক ঢোল বাজিয়ে? এবং যে নোটিশ ফিরিয়ে দেওয়ার পূর্ণ ক্ষমতা প্রিয়নাথ রাখেন, তার বেলা?
মনে হল কেউ যেন জীবনের দাবাখেলায় একটা কিস্তিমাতের চাল চেলে দিয়ে কৌতুকের সঙ্গে লক্ষ্য করছে প্রিয়নাথের হাবভাব, ঠেঁটের কোণে একটা বিদ্রূপের হাসি ঝুলিয়ে, যেন জিজ্ঞাসা করছে, ”এবার কি করবে প্রিয়নাথ, এবার?”
উঠে দ্রুত নিজের আলমারি হাঁটকাতে থাকেন উনি,আহ চেকবইটা কোথায় গেলো?
কোথায় যেন ভর্তি আছে সুবর্নার ছেলে? আহ,নামটা কিছুতেই মনে পড়ছে না। এখানেই কাগজের টুকরোটা রেখেছিলেন না?
পাগলের মতন সবকিছু ওলটপালট করে খুঁজতে থাকেন প্রিয়নাথ। দাবার চালটাকে পালটা ফিরিয়ে দেওয়া খুব জরুরি।
এক্ষুণি।।
ডিলেমা
বিপিন হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারলো না!
অথচ অফার লেটারটা হাতে পেয়ে কিন্তু বিপিন ভারি খুশিই হয়েছিল। সে কথা বিপিনের স্পষ্ট মনে আছে।
নাহ, গল্পটা প্রথম থেকেই খুলে বলি।
বিপিন, বিপিনচন্দ্র শাসমল আমাদের কলেজে পড়তো। ছেলে হিসেবে চমৎকার, দিলদার বন্ধুঅন্তপ্রাণ। শুধু মা সরস্বতীর সঙ্গে পার্মানেন্ট ফৌজদারি মামলা এই আর কি! তা মা শেষতক সামান্য আড়চোখে কৃপাদৃষ্টিপাত করাতে ছোকরা পাশটাশ করে ভারি খুশি হয়ে আমাদের একদিন খাইয়ে দিল। উঃ, সে কথা মনে পড়লে এখনো জলে জিভ আর কৃতজ্ঞতায় হৃদয় আর্দ হয়ে ওঠে!
যাগগে। বিপিন কলেজ পাশ করে ঢুকলো সেলসের চাকরিতে। তারপর যা হয়, একদিন বিয়েও করে ফেলল বাড়ির কথামত।
টুকটাক করে মন্দ কাটছিল না। শুধু তখনো ছেলেপিলে না হওয়াতে একটু মরমে মরে থাকতো এই আর কি। আমরা বন্ধুরা অবিশ্যি উৎসাহ দিতাম, ‘ এমনি এমনি কি এসব হয় রে পাগলা, এর জন্যে কঠোর পরিশ্রম লাগে, দিনরাত মেহনত করতে হয়’। মুশকিল এই যে আমাদের কথামত দিনরাত মেহনত করতে গেলে বিপিনকে খাবারদাবার ছেড়ে শুধু ইয়াকুতি হালুয়ার ওপরেই থাকতে হয়, খুব স্বাভাবিক কারণেই সেটা শোভনও না সম্ভবও না।
যাই হোক, এদিকওদিক টুকটাক ইন্টার্ভিউ দিতে দিতে একদিন বিপিন দেখলো, ইয়া আল্লা, মার দিয়া কেল্লা!! খোদ হিন্দুস্থান লিভারে চাকরির অফার! ভালো মাইনে, প্রচুর পার্কস ইত্যাদি ইত্যাদি। নাচতে নাচতে বিপিন পুরোন কম্পানিতে রেজিগনেশন দিয়ে অ্যাক্সেপ্টেন্স লেটার পাঠিয়ে আমাদের অলিপাবে বেধড়ক মাল খাওয়ালো। আমরাও যাবতীয় ঈর্ষা বুকে চেপে ‘হেঁ হেঁ, ইউনিলিভার খুউপ ভালো কম্পানি। তেরা তো লাইফ বন গ্যায়া ইয়ার’ ইত্যাদি বলে চোখ, এমন কি কপাল অবধি মাল খেয়ে টলতে টলতে বাড়ি ফিরলুম।
সব গল্প প্রায় শেষ, শুধু মেডিকেল টেস্টটাই বাকি, এমন সময়ে বিপনে পুরো ঘেঁটে গেলো!
মেডিকেল টেস্টের জন্যে অ্যাপোলো থেকে বাড়ি এসে ব্লাড, ইউরিন সব নিয়ে গেছিল। তার পরদিন বাকি টেস্টগুলোর জন্যে হাসপাতালে গেছে, ডাক্তারবাবু নাম শুনেই বিপিনকে বগলদাবা করে সোওওজা নিজের কেবিনে!
‘ক্কি ব্যাপার স্যার?’, বিপিন ভারি আকুল হয়ে শুধোলে।
ডাক্তারবাবু টেস্টের রিপোর্ট পড়তে পড়তে আধখানা রিডিং গ্লাসের ওপর দিয়ে তাকিয়ে বললেন ‘দিনে কত পেগ হয়?’।
বিপিন ‘ন্না ন্না স্যার, হরলিক্স আর চন্নামেত্ত ছাড়া আর কিচ্চু খাইনা, মাইরি বলছি’ বলতে যাচ্ছিল, শেষে ডাক্তারবাবু খুনে দৃষ্টিতে তাকাতে মিউমিউ করে বলল, ‘ওই আ-আড়াই থেকে তিন পেগ স্যার’।
ডাক্তারবাবু হিমশীতল গলায় বললেন ‘ক্রিয়েটিনিন, ট্রাইগ্লিসারাইড, কোলেস্টেরল তিনটেই মাথা উঁচু করে দেখতে হচ্ছে যে মশাই, টঙে চড়ে বসে আছে যে। কিন্তু যেটা ভয়ের কথা, সেটা হচ্ছে যে ইউরিনে প্রোটিন পাওয়া গেছে’।
খুব খুশি হল বিপিন, ‘সে তো খুউউপ ভালো কথা স্যার, মানে আমার শরীরে হেবি প্রোটিন আচে, নয়?’
ডাক্তারবাবু পেপারওয়েটটা তুলে নিয়েছিলেন খুব সম্ভবত ছুঁড়ে মারবেন বলে। কি মনে হতে সেটা রেখে বললেন, ‘না, নয়। এর মানে আপনার কিডনি ঠিকঠাক কাজ করছে না। এমত অবস্থায় ট্রিটমেন্ট না করিয়ে তো আমি আপনাকে ফিট সার্টিফিকেট দিতে পারছি না মশাই’!!
বিপিন খানিকক্ষণ হতভম্ব হয়ে চেয়ে থেকে হাঁউমাউ জুড়ে দিল। অলরেডি আগের কম্পানিতে রেজিগনেশন দিয়ে দিয়েছে। এখন এই তুচ্ছ কারণে যদি এইটা হাতছাড়া হয়,ফ্যামিলি নিয়ে পথে বসা ছাড়া বিপিনের আর কি উপায় আছে,সেটা ক্ষমাঘেন্না করে ডাক্তারবাবুই বলে দিন না হয়!
যা হোক, ডাক্তারবাবু বললেন যে সক্কাল সক্কাল ইউরিন নেওয়া হয়েছিল বলে হয়তো একটুখানি প্রোটিন ঘুমচোখে পথ ভুলে ধাঁ করে এসে পড়েছিল। উনি আরেকবার সুযোগ দেবেন। কাল সকালে আরেকবার ইউরিন স্যাম্পল নিতে লোক যাবে। বিপিন যেন খুব করে জলটল খেয়ে ঘুমোতে যায়, ইত্যাদি নানা সদুপদেশ দিয়ে রেহাই দিলেন।