‘হেঁ হেঁ মানে? বলি এটা কি মশাই ধর্মশালা না আপনার তালুইমশাইএর বৈঠকখানা? কোন আক্কেলে আমার বেডরুমে ঢুকে পড়লেন মসাই? চুরি ডাকাতির মতলব নাকি?’
‘অ্যাঁ? আরে ছিছিছি….রামো রামো, কি বলছেন মশাই? একটু না বাড়িতে ঢুকেই পড়েছি, তাবলে একেবারে চোর জোচ্চর ভেবে বসলেন? বলি ধর্মাধর্ম জ্ঞান নেই একটা আমার?’
‘ইঃ, ধম্মপুত্তুর যুধিষ্ঠির এয়েচেন রে। এই সাতসকালে চুপিসাড়ে টুকটুক করে আমার বেডরুমে ঢুকে পড়ার মানেটা কি অ্যাঁ? পুলিশ ডাকবো নাকি দাদা?’
ভদ্রলোক পুরো কেতরে উঠলেন ‘ প্লিজ পুলিশ ডাকবেন না, কিছুতেই না, ন্না ন্না ন্না’।
খুবই সতর্ক হলেন প্রিয়নাথ। রোগাভোগা শরীর, ঝাঁপিয়ে পড়লে মনে হয় কবজা করতে বেশি অসুবিধা হবে না। বন্দুক ফন্দুক নিয়ে আসে নি তো আবার? মাওবাদী কি সন্ত্রাসবাদী নয় তো? ওদের নাকি অসাধ্য কিছু নেই, যেখানে পারছে ঢুকে বন্দুকফন্দুক চালিয়ে, খুনখারাপি করে, সে একাকার কাণ্ড…
গলা খাঁকড়ে নেন উনি, সন্দেহজনক কারও সামনে যে বসে আছেন সে নিয়ে কোন সন্দেহই নেই, মাওবাদীও হতে পারে, বা পাকিস্তানের এজেন্ট। ছদ্মবেশী বারাক ওবামা হলেই বা আটকাচ্ছে কে? খুবই সতর্ক গলায় জিজ্ঞেস করেন,’ ঝেড়ে কাসুন তো মশাই। বলি মতলবটা কি? আমার বাড়িতে কিন্তু একটা ফুটো কড়িও পাবেন না, আগে ভাগে বলে রাখলুম। বরং একটা ছেঁড়া গামছা আছে, সতের বছরের আগে কিনেছিলুম, অ্যান্টিক হিসেবে ভ্যালু কম নয়, সেইটে দিতে পারি, নিয়ে মানে মানে বিদায় হন দিকিন’।
ভদ্রলোক একবারে হাঁ হাঁ করে ওঠেন, ‘আরে ন্না ন্না, ছি ছি, আমাকে ইয়ে ভেবেছেন নাকি? ছ্যা ছ্যা’ তারপর ঘাড়নাড়া থামিয়ে খুবই লজ্জিত ভাবে মাথা নিচু করে নখ খুঁটতে থাকেন ও ভারি মৃদুস্বরে বলেন ‘ দেখুন ব্যাপারটা বলতে আমার খারাপই লাগছে, কিন্তু কি করি বলুন তো, এদিকে না বললেই নয়। আপনি কিন্তু স্যর কথা দিন কিছু মাইন্ড করবেন না প্লিজ’।
‘দেকুন ন্যাকা মেনিমুখো ম্যাদামারা লোকজন আমার মোটে পচ্ছন্দ নয়। বাঙালি কবিদের এইরকম অম্বলে ভোগা পেটরোগা ম্যাদামারা ন্যাকাপনা থাকে। তা মশাই কি কবি নাকি?’
‘আরে ধুর। লজ্জা দেবেন না। সে বলতে গেলে একবার দুবার ছোটবেলায় লিখেছিলাম বটে, শুনবেন নাকি দুটো লাইন?’
এই বলেই ভদ্রলোক উদাস ভঙ্গিমায় খুবই দরদ দিয়ে আবৃত্তি করতে থাকেন, বেশ হাত পা খেলিয়ে, পয়ার ছন্দে,
‘পাতায় পাতায় ঝড়ে নিশার শিশির/ তাতে কি বা যায় আসে আমার পিসির।
স্কুলে যেতে ভয় করে শীত ও সামার/ সুযোগ পেলেই যাই বাড়িতে মামার।
(সেথা) আচার পাহারা দেয় রামন মিশির/
নিশীথে বানানো আচার আমার পিসির।’
কি ভাব! কি ভাষা!! খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন প্রিয়নাথ, চোখে জল। তারপর লুঙ্গির খুঁট তুলে চোখ মুছে ধরা গলায় বললেন ‘ আহা, আহা, বুকের ভেতরটা কেমন যেন মুচড়ে উঠলো। মশাই যে বেশ নামজাদা কেউকেটা একজন তা পষ্ট বুজতে পারচি। সেই মাইকেল কি নবীন সেন, তারপর এই আপনি। বলি পরের বছরকার নোবেলের দিকে তাগ করচেন নাকি? জমিয়ে করুন দিকিন, দেখবেন যেন ফস্কে না যায়, হেঁ হেঁ। তা এমন গণ্যমান্য ব্যাক্তিটি সক্কাল সক্কাল আমার কাচে যে? আর তাছাড়া মহাশয়ের নামখানি যে বলতে হচ্চে যে এবার। কি করা হয় মহাশয়ের? থাকেন কোথায়? জোড়াসাঁকোর দিকে নয় তো? হ্যা হ্যা হ্যা’।
‘ইয়ে, আমি একজন লোকপাল স্যার। সাউথ থেকে আসছি’
‘লোকপাল?মানে লোকপাল বিল? সে কি পার্লানেন্টে পাস হয়েচে নাকি? যাঃ জানতে পারলুন না যে? টিভিটাও মাইরি…. খবর শোনাচ্ছে না অর্শের বিজ্ঞাপন, বোঝাই যায় না। আর সাউথ থেকে মানে? গড়িয়া না ব্যায়লা?’
‘আরে না না সাউথ, মানে একদম সাউথ’
‘সে কি? এমন চমৎকার ঝরঝরে মিঠে শান্তিপুরী বাঙলা বলছেন যে?’
‘আরে লজ্জা দেবেন না স্যার, আমি এমনিতেও খুবই লাজুক মানুষ, হেঁ হেঁ।’
‘বাঃ বাঃ। আই অ্যাম ভেরি ইম্প্রেসড ইয়াং ম্যান। এই বয়েসেই অত ওপরে উঠেচ, পার্লামেন্টারি ব্যাপারে আচো, অন্য ভাষাও এত চমৎকার বলচ, অথচ এত বিনয়। গুড গুড, এই দ্যাকো, আবার তুমি বলে ফেল্লুম। কিচু মনে কোর না বাপু, বয়সে ছোটই হবে আমার থেকে, কি বল?’
‘আরে সে তো বটেই, সে তো বটেই, হেঁ হেঁ।’
‘তা বাপু নাম গোত্তর কিচু বল। আমরাও ভারি সাউথ ইন্ডিয়ানদের ইয়ে করি, বুজলে। কি কালচারাল ইয়ে, আর কি ফটাফট ইংরেজি, আদ্দেক তো বুজতেই পারি না, হেঁ হেঁ। এই তো পাশের ফ্ল্যাটে রঙ্গনাথনদা থাকেন। ভারি মাই ডিয়ার লোক। এই তো ইচ্ছে আছে এই ডিসেম্বরেই একবার ওদিকে..’
‘আজ্ঞে আমার নাম কৃতান্তকুমার আদিত্য’, ভারি বিনয় সহকারে বলেন ভদ্রলোকটি।
‘বাহ বাহ। একটু সেকেলে বটে, তবে কিনা চমৎকার। বুঝলে বাবা, আমরা তো পুরোন যুগের লোক, আমাদের এই রকম নামই পচুন্দ। বাহ বাহ। তা আমাদের ইস্কুলে পড়াতেন অরূপ আদিত্য, হাওড়ার প্রজ্ঞানানন্দ সরস্বতী বিদ্যালয়, তা তেনার কেউ হও নাকি? না বলচ? তা বেস। তা বাবাজীবন এয়েচ কি করতে সেটা তো খোলসা করে বলতে হচ্চে এবার।’
একটু গলাটা খাঁকড়ে নেন কৃতান্তবাবু, তারপর খুবই মিষ্টি হাসিমুখে বলেন ‘এবার একটু উঠতে হচ্ছে যে স্যার। আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি।’
মুহূর্তে চনমনে হয়ে ওঠেন প্রিয়নাথ। নেমন্তন্ন নাকি? অথবা কাঙালিভোজন? নাকি হরিসংকীর্তন? নাকি কোন সভাসমিতি? ও হো, এ সেই ‘নিখিল বংগ কৃপণচূড়ামণি সমিতি’র সংবর্ধনা নয় তো?