এসব রেট প্রথমবার দেখে প্রাণান্তকর হেঁচকি উঠলেও পরের দিকে ব্যাপারটা চট করে বুঝে ফেলি। এক্ষেত্রে হাতির খাওয়ার দাঁত আর দেখানোর দাঁতের মধ্যে দুর্গম গিরি কান্তার মরু টাইপের ব্যবধান। একলাখি গেট সামান্য হাসিঠাট্টাতেই পঁচিশে নেমে আসে। এক্সিট গেটের ফ্লেক্স (‘ওটা কিন্তু দাদা পঁয়েরোর কমে হবে ন্না ন্না ন্না’) এককাপ চায়ের পরই সাড়ে সাতে ফাইনাল হয়ে যায়। ‘স্যুভেনিরটা একটু দেখবেন ভাইটি’ অনুরোধমত পাঁচহাজারি কভার পেজটি অক্লেশে এক হাজারে বুক হয়ে যায়।
মুশকিল হয় যদি আপনার অফিসের সামনে কোন বড় পুজো হয়। আমার অফিস ছিল পার্ক সার্কাস দরগা রোডে, গলির উলটোমুখেই পার্কসার্কাস সার্বজনীন। সেখানের ক্লাব কমিটির লোকজন সেপ্টেম্বর নাগাদ হানা দিতেন, সবচেয়ে শাঁসালো গেট বা ফ্লেক্সের জায়গাটি আমাদের জন্যে ছেড়ে। তাঁদের যিনি দলনেতা বা সেক্রেটারি ছিলেন, মধ্যচল্লিশের সেই ভারি সুপুরুষ যুবকটির সঙ্গে আমার বেশ হৃদ্যতাই হয়ে গেছিলো।
তিনি এসেই ভারি আন্তরিক ভাবে ‘অ্যাক্কাপ চা খাওয়ান ভাইটি’ বলে বেশ জাঁকিয়ে বসতেন। চা পানান্তে তিনি ভারত ও মার্কিন সম্পর্কের ভবিষ্যৎ, আধুনিক বাংলা সাহিত্য কোন পথে, পশ্চিমবঙ্গে শিল্পের দুরবস্থা, আজকালকার ছেলেমেয়েদের মূল্যবোধের অভাব তথা সর্বব্যাপী সামাজিক অবক্ষয় ইত্যাদি বিষয়ে খুবই মনোজ্ঞ আলোচনার পর আসল বিষয়ে অবতীর্ণ হতেন। চায়ে শেষ চুমুকটা দিয়ে একটা গভীর তৃপ্তির ‘আঃ’ উচ্চারণ করে ভারী গলায় বলতেন ‘আপনাদের পাড়ারই পুজো, বেশি কিছু বলার নেইও, বড় গেটটাই আপনাদের জন্যে রেখেছি। একলাখের বেশি একটি পয়সাও ঠেকাবেন না কিন্তু, এই বলে রাখলুম’। তবে প্রথম যেবার আমার সঙ্গে, যাকে বলে ”নয়নে নয়ান” হয়, সে অভিজ্ঞতা বোধহয় ভদ্রলোকের জন্যে খুব একটা সুখকর হয় নি। উনি যেই বলেছেন, ‘আপনাদের পাড়ারই পুজো ভাই’, আমিও ছলছল চোখে গলদশ্রু হয়ে বললাম ‘আপনাদের পাড়ারই কম্পানি দাদা, আপনাদের ওপর তো আমাদেরও তো একটা অধিকার আছে, না কি? গেটটাই যখন রেখেছেন দাদা, নিশ্চয়ইই নেবো, কিন্তু দশের বেশি দিতে পারছি না, বিশ্বাস করুন, এর বাইরে আমাদের বাজেটই নেই!’ ভদ্রলোক খানিক্ষণ স্তম্ভিত অবিশ্বাসের চোখে আমার দিকে চেয়ে থেকে বললেন, ‘ভাইটি কি বাঙাল?’
বাঙালকে বাঙালই চেনে ভালো!
তবে যাঁরা এতটা পড়ে ভাবছেন এতেই কম্পানির পক্ষে ভারপ্রাপ্ত ব্যক্তিটির কর্তব্যকর্ম শ্যাষ, তাঁদের সবিনয়ে জানাই, আপনার মতন অজ্ঞানতিমিরান্ধস্যর কিন্তু ভালো দেখে এক পিস জ্ঞানাঞ্জনশলাকার আশু প্রয়োজন। আরে মশাই এ তো গেলো সাবস্ক্রিপশনের খরচা, আসল কাজ তো এর পর। এর পর যে ফ্লেক্স, ব্যানার, বা দ্রষ্টব্য বস্তুটি উক্ত স্থানে ঝুলিত বা শোভিত হইবেক, তাহারও তো ব্যবস্থা করতে হয়। এর প্রথম পর্যায় হলো ব্র্যাণ্ড ম্যানেজারকে ফোন করে ফ্লেক্স বা ব্যানারের ডিজাইনটি আনিয়ে নেওয়া, এবং এইখান থেকেই আপনার অগ্নিপরীক্ষার শুরু। সচরাচর প্রথম যে ডিজাইনটি আসে তার বাংলা বানান বা বাক্যগঠন দেখলে বাক্যি হ’রে যায়, গায়ের রোঁয়া দাঁড়িয়ে পড়ে, রক্ত টগবগ করে ফুটতে থাকে ও ধর্মেন্দ্রবিক্রমে ‘কুত্তে, কমিনে, ম্যায় তেরা খুন পি জাউঙ্গা” বলে ম্যানেজারটির ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে কামড়ে দিতে ইচ্ছে করে। অতঃপর সেই কচি ম্যানেজারশাবকটিকে যথেষ্ট মানসিক যন্ত্রণাদানের পর ঠিকঠাক ডিজাইন তো এলো, এরপর ভেন্ডর ডেকে বাকি কাজ। এইসময়ে কাজের চাপ এতো বেড়ে যায় যে, দুদিন আগে যে কর্মপ্রার্থী ভেন্ডরভাইটি দুবেলাই কাজের খোঁজে অফিসে ধর্ণা দিতেন, পুজোর আগে তিনি সাক্ষাৎ ঝিলিকের মা! এতদসত্বেও অনেক কষ্টেসৃষ্টে, পুর্বজন্মের অশেষ সুকৃতির ফলে তাঁকে পাকড়াও করে দায়িত্ব সঁপে দিয়ে যদি ভাবি নাহ, এইবার পুজোগণ্ডার দিনে আণ্ডাবাচ্চা নিয়ে কিছু গুষ্টিসুখ অনুভব করবো, তবে দাদা শুনে রাখুন সে গুড়ে শুধু বালি নয়, পুরো চন্দননগর!
মহালয়া থেকে পঞ্চমী অবধি নিত্যি ঝামেলা। রণেবনেবাথরুমে ফোন আসছেই।’ অ দাদা, মাঠে ড্যেঁইড়ে আচি তো দুফর থিক্যে, গেটের মাপ নেবু বল্যে, কমিটির লুকজন ত কেউ কত্থাও নাই গ’ শুনে চিড়বিড়িয়ে উঠেই ভাবছি ব্যাটার গর্দান নেবো কি না, এমন সময়ে ভারি সুললিত গলায় ‘ইয়ে, স্যার, আপনার কত ইঞ্চি? মানে ফ্লেক্সের পেছনে যে বাটাম দেবো তার ইঞ্চি কত?’ শুনে আতঙ্কে স্তব্ধ হয়ে যেতে হয়। তারপর প্রাজ্ঞ ভেন্ডরটি যখন অকুস্থল থেকে ফোন করেন, ‘সরকারবাবু, আপনার সঙ্গে পুজো কমিটির কথা হয়েছিল যে এক্সিটের ফ্লেক্সটা আপনাদের। এখন দেখছি ওখানে এগারোটা ফুচকার স্টল নিয়ে হার্বাল ফুচকাজোন তৈরি হচ্ছে, আপনার ফ্লেক্স কিন্তু ঢাকা পড়ে যাবে, ওটা এন্ট্রি গেটে করে দিই?’ তখন উপায়ান্তর না দেখে সহমত হতেই হয়। এদিকে ষষ্ঠী এসে গেছে, পুজোর বাজার হয়নি, গিন্নির নৈমিত্তিক গঞ্জনাতে জীবন দুর্বিষহ। ফলে বেরোতেই হয়, এবং গিন্নির পছন্দের জুতোটি কেনার সময় ফের সেই ফোনার্তনাদ, ‘ছ্যার, এয়াগো গ্যাটের বাশখান তো দেহি ব্যাবাক ত্যাড়া, প্যারেকখান সান্ধাইতাসে না, করুমডা কি?’ তখন একহাতে বাহারি জুতো নিয়ে আরেক হাতে ফোন ধরে এই জ্ঞানপিপাসুকে বঙ্কিম বংশদণ্ডে পেরেক পোঁতার অ্যালগরিদম বাতলাতে থাকি। আশেপাশের লোকজন শুনেই ছিটকে যায় ! গিন্নির মুখচন্দ্রমা ঘনকৃষ্ণ নবজলধর রূপ পরিগ্রহ করে।