এসব দেখে ভারি দুঃখ হলো। মহাতপাঃ নবারুণ বাঙালি জাতিকে অসহায় ছাড়াও আরেকটি সুচিন্তিত এবং মনোহারী আখ্যায় ভূষিত করেছেন। অধম অতি দ্রুত সেই আখ্যার সঙ্গে নিজেকে আইডেন্টিফাই করতে বেশি সময় নেন নি। ফলে যাবতীয় খেচর, উভচর এবং জলচর বাঙালির সার্বিক মঙ্গলার্থে ভাবলাম এসব লেখা একত্রে বই হিসেবে প্রকাশ করলে কেমন হয়? কয়েকজন বন্ধুবেশী শত্রু খুবই উৎসাহ দিতে থাকলেন, সেসব শুনে নিজেকে মুজতবা আলি কি নবনীতা দেবসেনের সমকক্ষই বোধ হতে লাগলো।
কিন্তু বই প্রকাশ করতে প্রকাশক দরকার, তদুপরি ‘টাকা মাটি, মাটি টাকা’র যুক্তি প্রকাশনা জগতে চলে না। আর তাছাড়া প্রতিষ্ঠিত প্রকাশকরা আমার মতন অর্বাচীনের বই ছাপাবেন, এহেন দুরাশা স্বপ্নেও করিনি। তবে এই দেখে আশা হয়েছিল যে কয়েকজন উৎসাহী যুবক বাংলা প্রকাশনা ব্যবসার মরা গাঙে তরী ভাসাতে রাজি হয়েছেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি তাঁদের নিবিড় আগ্রহ সত্যিই প্রশংসনীয়। তাঁদেরই একজন, দ্য কাফে টেবল-এর অরিজিৎ ভদ্র, যেদিন নিজে থেকে প্রকাশনার দায়িত্ব নিতে রাজি হলেন, যেদিনই ঝট করে মনে পড়ে গেছিলো কবিগুরু একবার বলেছিলেন বটে, প্রকাশকের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ!
যাই হোক অরিজিতবাবুর সৌভাগ্য অক্ষয় হোক, কলেজ স্ট্রীটের সামনে ওঁর মর্মরমূর্তি স্থাপিত হোক, এই নাদান বালকের প্রথম বইটি তাঁরই কৃপায় প্রকাশিত হয়েছিল, এ কথা জীবনান্তেও ভুলব না।
বইটি বহুদিন আউট অফ প্রিন্ট থাকার পর দীপ প্রকাশনের কর্ণধার দীপ্তাংশু পুনঃপ্রকাশের জন্য বইটি চেয়ে বসলেন। আমি তাঁকে অনেক করে বোঝালাম যে এই বই আর বিক্রি হওয়ার চান্স নেই বললেই চলে। একে এসবের অধিকাংশই সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগে লেখা, সেসব কাঁচা হাতের কলমবাজি দেখলে নিজেরই লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করে। তাছাড়া বহুদিন ধরে তক্কে তক্কে আছি যে চিন্তাশীল সারস্বত সমাজে কল্কে পাব। সেখানে বিভিন্ন তাৎপর্যসন্ধানী তত্বভুবনে আশ্চর্য স্বকীয়তায় ঋদ্ধ বিশ্লেষণপদ্ধতি এবং তৎসন্নিহিত মগ্নচৈতন্যে নিবিষ্ট বীক্ষাভুবন- এসব গুরু গম্ভীর বিষয় নিয়ে আলোচনা চলে। সেই থেকে নিজের কথাবার্তায় ভাবভঙ্গিতে একটা উদাস ইন্টেলেকচুয়াল ভাব আনার চেষ্টায় আছি। সেখানে এসব সস্তা ছ্যাবলামি করলে ব্র্যাইন্ড ভ্যালু লিক করে যাবে না?
কিন্তু ভদ্রলোক কিছুতেই শুনলেন না, রাতবিরেতে ফোন করে খুব কড়া গলায় শাসাতে লাগলেন। ফলে ”তোমার ভুবনে মা’গো এত চাপ” ইত্যাদি ভেবেটেবে মাভৈঃ বলে পাণ্ডুলিপিখান পাঠাতেই হল।
যাই হোক, অলমিতি বিস্তারেণ। অনেক প্যাচাল পাড়ার পর আপাতত এখানেই এই মনোলগ শেষ করলাম। আশা করি সুধী জনগণ বইটা বুকে তুলে নেবেন, বুকে না নিয়ে অন্ততপক্ষে হাতে তুলে নিলেও হবে। ভালো লাগলে জানাবেন, আর খারাপ লাগলে অতি অবশ্যই জানাবেন। ভালো থাকবেন, ঠাণ্ডা লাগাবেন না, দেখে রাস্তা পার হবেন আর হ্যাঁ, পরের বার মার্কেটে গেলে অধমের কথা মনে করতে ভুলবেন না কিন্তু!
অথ কণ্ডোম কাব্য
(কঠোরভাবে প্রাপ্তবয়স্ক এবং প্রাপ্তমনস্কদের জন্যে, আগেই গেয়ে রাখলুম বাপু)
জীবনের দশটা মূল্যবান বছর বিভিন্ন হোস্টেলে কাটিয়েছি। ছোটবেলায় অহরহ শুনতে হতো, ‘তুই আর মানুষ হবি না’। মানুষ হতে পেরেছি কিনা সে নিয়ে আমার গুরুজনদের ঘোরতর সন্দেহ আছে বটে। কিন্তু তদসত্বেও যে এই ভবের হাটে করেকম্মে খাচ্ছি, সে অনেকটাই ওই হোস্টেলে থাকার সময় অর্জিত সারভাইভিং টেকনিকের দৌলতে।
তা এই গল্পটি হায়দ্রাবাদে চাকরি করার সময় যে ইঞ্জিনিয়ার্স ট্রেইনি হোস্টেলে থাকতাম, তখনকার। রসিকেষু রসস্য নিবেদনমকরে বাজারে ছেড়ে দিলুম!
প্রথম চাকরি করার সময় আমার বুজুম ফ্রেণ্ড ছিল এক ঔড্রনন্দন। উচ্চতায় পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি, রোগা প্যাংলা, এবং ঘোর কৃষ্ণবর্ণ সে ছোকরার একমাত্র পাসটাইম ছিল হস্তমৈথুন। প্রতি শনিবার ইঞ্জিনিয়ারিং ট্রেনি হস্টেলে ওর রুমে আসর বসতো। ছোকরা খাটের ওপর কটিমাত্র বস্ত্রাবৃত হয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় খুব দরদ দিয়ে ‘বিবি নরম, পড়োসি গরম’, ‘লুট লিয়া মচলতি জওয়ানি’ ইত্যাদি শীর্ষক অতি উচ্চাঙ্গের গদ্যসাহিত্য আবৃত্তি করতো। আর আমরা নিচে বোতল নিয়ে বসতাম। কোক, রাম আর মস্তরাম। আহা, অমন রসালো অবসর বিনোদন কবেই জীবন থেকে অবসৃত!
বিশেষ বিশেষ জায়গায় আবার রিপিটের অনুরোধ আসতো। ছোকরা ভারি উৎসাহ পেয়ে আরো নাটকীয় ভাবে রসালো টিকাটিপ্পনি সহ সেসব বিবৃত করতো। দু একটা নমুনা বুকের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে, কিন্তু এখানে দেওয়া মানে সোজা শ্রীঘরবাস। তাছাড়া কবি রস আলাপনটা স্রেফ অন্তরঙ্গ সঙ্গে করার জন্যই খুব করে বলে গেছেন। বহিরঙ্গে সেসব নাম সঙ্কীর্তন না হয় আপাতত থাক!
হায় পাঠক, আপনারা কী হারাইলেন তা জানেন না।
ছোকরা একবার খুবই দুঃখ করে আমাকে বলেছিল কত বিবেকানন্দ এবং সুভাষ বোস সাবানের সঙ্গে বাথরুমে আহুতি দিয়েছে সে, কত শচীন আর অমিতাভ বচ্চন ওর বিছানার চাদরে বা শর্টসের কাপড়ে অবহেলায় ধুঁকে ধুঁকে প্রাণত্যাগ করেছে তার ইয়ত্তা নেই। আহা, সেই যৌবনজলতরঙ্গ যদি ও বয়েসকালে একটু সামলেসুমলে রাখতো! এখন ওর বাচ্চা পয়দা হলে যে পাক্কা ওর মতই একপিস হারামি হবে, এ বিষয়ে ছোকরা নিঃসংশয় ছিল।