ছবিটা পালটে গেল মায়ের পুজো যবে থেকে থিমের পুজো হয়ে উঠলো। থিমবাবু শৌখিন লোক, দশ কুড়ি টাকার চাঁদায় তেনার শখ মিটবার কথাও নয়। আর নব্বই দশকের শেষে এসে বাঙালি হঠাৎ আবিষ্কার করলো যে প্রতিবাদী, বিশ্বনাগরিক বাঙালির এখন কলকারখানায় তালা, পেটে খিদে এবং হাতে হ্যারিকেন! ফলে তার পক্ষে আর শুধু চাঁদা দিয়ে আড়েবহরে বাড়তেই থাকা পুজোর বাজেট ঘাটতি মেটানো সম্ভব নয়। কিন্তু বীর বাঙালিকে আটকানো কি অতই সহজ দাদা? হুজুগে জাতের নবনবোন্মেষশালিনী প্রতিভা আবিষ্কার করলো পুজোর বাজেট যোগাড় করার আরেক উপায়, কর্পোরেট স্পনশরশিপ!
আমার গপ্প সেই নিয়েই।
আমি ম্যানেজমেন্ট শাস্ত্র পাঠান্তে একটি বিখ্যাত পেইন্টস কম্পানিতে জয়েন করি, প্রথমে বিহারের ম্যানেজার হিসেবে ও তারপর কলকাতার। অধুনা পুজোর বাজারে সেরা পুজো বেছে নেবার যে হিড়িক, তার শুভসূচনা করে এই কম্পানিটি, ”শারদসম্মান” ট্যাগলাইন দিয়ে। যদিও পুরো ব্যাপারটাই মুম্বাইয়ের হেড অফিস থেকে নিয়ন্ত্রিত হতো। আমাদের, অর্থাৎ লোকাল টিমের কাজ ছিল সপ্তমীর সন্ধ্যায় কয়েকজন বাছাবাছা ডিলারদের নিয়ে গাড়ি বুক করে বেরিয়ে, কলকাতার সেরা পুজোগুলো (বাগবাজার থেকে বড়িষা, বেলেঘাটা থেকে বাদামতলা ) সারা রাত ধরে দেখে সকালে বাড়ি ফেরা। বুঝতেই পারছেন, লাইনটাইন দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। ভি ভি আই পি হিসেবে খুবই গম্ভীর মুখে ঢুকে, কতই যেন বুঝছি টাইপ মুখ করে মাথাটাথা নেড়ে, পুজো উদ্যোক্তাদের এনে দেওয়া সন্দেশ কোল্ড ড্রিঙ্কস ইত্যাদি গলাধঃকরণ করে, ‘হেঁ হেঁ, আমাদের পুজোটা একটু দেখবেন স্যার’ টাইপের হাত কচলানো মাতব্বরদের দিকে প্রশ্রয়ের মৃদু হাসি হেসে বেরিয়ে আসা, এটুকুই যা কষ্ট!
এর পরে অন্য কম্পানিতে আমাকে দীর্ঘদিন কলকাতা ও দক্ষিণ বঙ্গ, এবং তদপরবর্তী সময়ে সমগ্র পূর্ব ভারতের দায়িত্ব সামলাতে হয়। এবং তখন এই কর্পোরেট স্পনসরশিপের পুরো ব্যাপারটিকে, যাকে বলে পরিপূর্ণ রূপে অবলোকনের সুযোগ পাই।
এখানে একটা ব্যাপার স্পষ্ট করে দেওয়া ভালো যে এতে কিন্তু বিভিন্ন বাণিজ্যিক সংস্থা ও ক্লাবগুলির মধ্যে রীতিমতো ”ডিল” হয়। চমকানো ধমকানোর বা জোরাজুরির কেসই নেই। অনেক ক্ষেত্রেই কম্পানিগুলি নিজেরাই বিভিন্ন পুজো কমিটিগুলিকে ডাকে এবং কত টাকার বিনিময়ে কম্পানিগুলি কি কি সুবিধা পাবে তা ফাইনাল হয়। পলিটিক্যাল লিডারদের চিঠি যে আসে না তা নয়, তবে সে সব ছাপা চিঠি, স্যুভেনিরের সঙ্গে আসে, এবং সব কম্পানির কাছেই আসে, পাত্তা না দিলেও চলে। একবারই শুধু আমার কাছে উত্তর কলকাতার একটি ক্লাবের হয়ে তৃণমূলের এক বিখ্যাত নেতার ফোন এসেছিলো, যিনি অধুনা মন্ত্রীও বটে। তিনি যে ভাষায় অনুরোধ করছিলেন, তাকে কাকুতিমিনতি বললেই চলে। আমি নিজেই ভারি অপ্রস্তুত হয়ে যখন বললাম যে ঠিক আছে, অত করে বলতে হবে না, ব্যবস্থা হয়ে যাবে, তিনি ঝাড়া পাঁচ মিনিট আমার এবং আমার পরিবারের প্রতি প্রাণঢালা আশির্বাণী শুনিয়ে, পুজোতে অষ্টমীতে কিন্তু ক্লাবে এসে ওঁর সঙ্গে ভোগপ্রসাদ খেতেই হবে দাবি জানিয়ে ফোন রাখেন, বোধহয় ফোনে চুমু খাওয়াটাই বাকি ছিল!
এবার আসল কথা, কম্পানিগুলির এতে লাভ কি? লাভ একটাই, নিজের প্রডাক্টস বা সার্ভিস আরো বড় করে লোকের সামনে তুলে ধরা। এটাও এক ধরণের ব্র্যান্ড বিল্ডিং অ্যাক্টিভিটি। ঠিক যে কারণে কম্পানিগুলি টিভি, রেডিও, খবরের কাগজ ইত্যাদি গণমাধ্যমগুলিতে বিজ্ঞাপন দেয়, ঠিক সে কারণেই দুর্গাপূজাতেও স্পনসরশিপ দেয়।
(জনান্তিকে জানিয়ে রাখি, এই যে গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দেওয়া, একে মার্কেটিং এর পরিভাষায় বলে এটিএল বা অ্যাবভ দ্য লাইন অ্যাক্টিভিটি। কার কেন কিসের লাইন, সেসব বিজৃম্ভণক্লিষ্ট আলোচনায় আর ঢুকছি না)।
কিভাবে? আপনারা নিশ্চয়ই যে কোন প্যাণ্ডেলে ঢোকার মুখে দেখেছেন প্রচুর ব্যানার আর ফেস্টুন বাঁশের ব্যারিকেডে সাঁটানো। বা উঁচু উঁচু বাহারি বিজ্ঞাপনী গেট। বা বিভিন্ন কম্পানির স্টল। ওই গেট বা ফেস্টুন ইত্যাদি লাগানোর জায়গাটুকু ভাড়া নেয় বিভিন্ন বাণিজ্যিক সংস্থা, এবং তার মধ্য দিয়ে নিজেদের পণ্যের বিজ্ঞাপন, এই হচ্ছে মোদ্দা কথা। এসবই হচ্ছে গণমানসে আমার কম্পানির আলালের ঘরের দুলালটিকে আপনার মনে একটু একটু করে ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। যাতে পরের বার আপনার তেষ্টা মেটানোর সাধারণ প্রয়োজনীয়তাটুকু যেন শুধুমাত্র কোকা কোলা পানের চাহিদাটি হয়ে ওঠে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকার প্রাথমিক ইচ্ছেটুকু যেন একমাত্র ডাভ সাবান দিয়েই শ্রীঅঙ্গ মার্জনের আকাঙ্ক্ষা হয়ে দাঁড়ায়। ব্যাপারটা আশা করি জলবত্তরলং বুঝে গেছেন।
এসব কাহিনীর শুরু অগাস্টের মাঝামাঝি সময়ে। তখন থেকেই বিভিন্ন পুজো কমিটির স্যুভেনির পাঠানো ও অফিসে এসে তদ্বির তদারক করা শুরু। স্যুভেনিরে থাকে ওঁদের পুজোর ব্যাপারে ভাবগম্ভীর ব্যাখান (”জগদীশ্বরের কৃপায় আমাদের এই মাতৃবন্দনা আজ বিংশতিতম বর্ষে”), কোন কোন প্রাইজ জিতেছেন গত দশ বছরে তার লিস্টি (”নটিগার্ল” হাওয়াই চপ্পল কম্পানি থেকে ”অসুরের সেরা জুতো” পুরষ্কার ), এবং শেষ পাতায় কাজের কথা, অর্থাৎ কিসের বিনিময়ে কত কাঞ্চনমুদ্রা এঁয়ারা ধার্য করেছেন। যত বিখ্যাত পুজো এবং যত বেশি ‘ভিজিবিলিটি’ অর্থাৎ দৃশ্যমানতা, তত বেশি দাম। যেমন গেটের দাম এক লাখ হলে, স্টল পঞ্চাশ হাজার। এক্সিট গেটের সামনে বিশাল ফ্লেক্স হলে ন্য)নপক্ষে পঁচিশ হাজার, আর স্যুভেনিরের কভার পেজ পাঁচ হাজার। আবার সুরুচি সংঘের পুজোর গেট এবং বাবলতলা আমরা সবাই ক্লাবের পুজোর গেটের মধ্যে চাঁদার পরিমাণে আকাশপাতাল তফাৎ।