‘হেঁ হেঁ, নিজের বন্ধুর গোপন কথা ফাঁস করতে বলছেন কাকু? কথা এদিকওদিক হবে না তো? প্রমিস?’
‘আরে, বাবা লোকনাথের নামে প্রমিস রে ভাই। বিশ্বাস হচ্ছে না? হচ্ছে না? ঠিক হ্যায়, না হয় তো শ্রীরামকৃষ্ণর নামে করছি…’
‘না না ঠিক আছে। শুনবেনই তাহলে? এক্কেবারে ছাড়বেন না? তবে শুনুন।
অভিলাষদের যে তিনটে যে শোরুম, তাদের মধ্যে সবচাইতে বড় যেটা, সেটা হচ্ছে সল্টলেকে, অভিলাষ ওখানেই বসে। তা ধরুন বছর দেড়েক আগেকার এক অক্টোবর মাস নাগাদ, সেই দোকানে একটা কেলো হয়।
অভিলাষের আরেক বন্ধু আছে বুঝলেন, রজত নামের, রজতশুভ্র মণ্ডল। পাজির পাঝাড়া এক নম্বরের, পাক্কা শয়তান, কম করে তিন তিনটে থানায় ওর নামে এগারোখানা কেস ঝুলছে। আমরা যত বারণ করি ওর সঙ্গে মিশিস না, কে কার কথা শোনে? যাই হোক, সেই অক্টোবরের মাঝামাঝি নাগাদ, খুব সম্ভবত বুধবারই হবে, অভিলাষ দোকান বন্ধ করে লেকটাউনে রজতের বাসায় গেছিল কি একটা পরামর্শ করতে। পরে শুনেছি রাত দশটা অবধি ওইখানেই ছিলো। হঠাৎ সেখান থেকেই নাকি ওদের দোকানের সিকিওরিটি ওকে খবর দেয় ভেতরের অ্যান্টি বার্গলারি অ্যালার্ম বেজে উঠেছে, অভিলাষ যেন এক্ষুণি দোকানে আসে।
যা হয়, ওখান থেকেই পুলিশে খবর দিয়ে অভিলাষ আর রজত তো দৌড়ল দোকানের দিকে। এদিকে খবর পেয়ে কাকু, মানে অভিলাষের বাবাও গিয়ে হাজির।’
‘বাপ রে। সোনার দোকানে ডাকাতি? খুব ডেয়ারিং ডাকাত বলতে হবে’।
‘সে আর বলতে? যাই হোক, তা খবর পেয়ে তো আপনাদের বুলু ম্যাডাম এসে হাজির, তিনিই তখন বিধাননগর দেখতেন কি না, সঙ্গে বিশাল পুলিশ ফোর্স। তা সারা দোকান ঘিরে মাইকে করে প্রচুর ধমকি টমকি দেওয়া হলো, সল্টলেক তো প্রায় ভেঙে পড়েছিল নাটক দেখতে।’
‘তারপর? চোর ধরা পড়লো?’
‘সেইটেই তো কথা। মাইকিং করে কোনও কাজ না হওয়াতে শেষে চাবি দিয়ে শাটার খুলে দরজা খোলা হলো। কাকু তো অভিলাষকে কিছুত্তেই ভেতরে যেতে দেবেন না। ওদিকে পুলিশ গুলো অবধি ইতস্তত করছে, কটা ডাকাত আছে, তাদের হাতে কি আর্মস আছে হাতে কেউ জানে না। ও মা, ম্যাডাম দেখি সার্ভিস রিভলভার হাতে দরজায় দাম করে একটা লাথি মেরে ঢুকে সোজা ঢুকে গেলেন’।
‘বুলুটা চিরকালই ডেয়ারডেভিল। তা বাপু তুমিও ছিলে নাকি? নইলে দেখলে কি করে?’
‘উরিত্তারা, কাকুর অবজার্ভেশন পাওয়ার তো সাংঘাতিক! ঠিক ধরেছেন কিন্তু! আসলে ওদের সঙ্গে আমাদের ফ্যামিলির অনেকদিনের আলাপ, তার ওপর এতদিনের বন্ধুত্ব। না গিয়ে পারি বলুন?’
‘হ্যা হ্যা হ্যা। অডিটে ছিলাম পাক্কা সাঁইতিরিশ বচ্ছর ভাই। আমার নজর ফাঁকি দেওয়া… হ্যা হ্যা হ্যা। যাই হোক, তারপর? চোর ধরা পড়লো?’
‘আরে সেইটাই তো মজা কাকু, গিয়ে দেখা গেলো কেস এক্কেবারে করেকেটেঘ্যাঁচাং।’
‘মানে?’
‘মানে শর্টসার্কিট কেস। অ্যালার্মের সার্কিট শর্ট হয়ে গিয়ে এই বিপত্তি!’
‘বোঝো কাণ্ড! তারপর? পুলিশ নিশ্চয়ই খুব হম্বিতম্বি করলো? বুলু কিন্তু খুব শর্ট টেম্পার্ড মেয়ে, মুহূর্তেই মেজাজ গরম হয়ে যায়। আর হাত পা চলে তো…’
‘আরে না না, তেমন কিছু বলেনি। অভিলাষের বাবা তো লজ্জাটজ্জা পেয়ে মাফ চেয়ে নিলেন। তারপর অত রাতেই মিষ্টি আর কোল্ড ড্রিঙ্কস এনে খাওয়ালেন সব্বাইকে।’
‘তারপর নিশ্চয়ই ব্যাপার চুকেবুকে গেলো?’
‘যেত, যাওয়ারই কথা। ঝামেলা পাকালো রজত’।
‘সেই লেকটাউনের বন্ধু? এর নামেই খুব একচোট গালমন্দ করলে না একটু আগে?’
‘হ্যাঁ, সেইই। এক নম্বরের উচক্কা বদমাশ, মিটমিটে ডান একটা, পেটেপেটে খালি কুবুদ্ধি..’
‘ওরে বাবা, গুণধর ছেলে মনে হচ্ছে! তা সে কি করলো?’
‘রজতের পাক্কা জহুরির চোখ, নিজেও পাক্কা মেয়েবাজ কি না। সে তো অভিলাষের মুগ্ধ চোখমুখ দেখে বুঝেছে কেস খুব ঘোরালো। সে নিজেই গিয়ে ম্যাডামের সঙ্গে আলাপটালাপ করে ম্যাডামের ফোন নাম্বার যোগাড় করে… ‘
‘বাপ রে, বলো কি? মানতেই হবে, ছোকরার এলেম আছে হে। ওইভাবে বুলুকে অ্যাপ্রোচ করা আর বাঘের গুহায় মাথা গলানো একই ব্যাপার। তাহলে বলি শোনো, বুলু যখন ক্লাস এইটে পড়ে, সরস্বতীপুজোর দিনে পাশের পাড়ার কে যেন একজন রিকশা করে ধুতি পাঞ্জাবি পরে ফুলবাবুটি সেজে এসেছিল বুলুকে প্রেমপত্র দেবে বলে। সে তো রিক্সা দাঁড় করিয়ে সোওজা গিয়ে বুলুদের বাড়ির কলিং বেল টিপে দাঁতটাঁত কেলিয়ে প্রপোজ করে একশা….তারপর ক্কি ক্কান্ড!’
‘তারপর?’
‘তারপর আবার কি? দুর্ভাগ্যক্রমে সেদিন বাড়িতে হরিসাধন আর বাকিরা কেউ ছিলো না। নইলে সে ছোকরা বেঁচে যেতো। ‘
‘বেঁ..বেঁচে যেতো মানে?
‘মানে আবার কি? যে রিক্সা চড়ে এসেছিলো, শেষে সেই বেচারাকে ওই রিকশাই নিজে চালিয়ে ফিরতে হয়, স্রেফ জাঙিয়া পরে। রিক্সাওয়ালা ছোকরা তো সেই রণংদেহী মূর্তি দেখে সোজা পগারপার, বোধহয় সিধে ছাপরা পৌঁছে নিঃশ্বাস নিয়েছিলো। উফফ, সেও আরেক কাণ্ড, ভাবলেও গায়ে কাঁটা দেয়। তা তোমাদের সেই রজত ছোকরা দিব্যি গিয়ে ফোন নাম্বার চেয়ে নিলো?’
‘আরে মেয়ে পটাতে রজতের জুড়ি আছে নাকি? বল্লুম যে, এক নম্বরের লাফাঙ্গা! তা সে যাই হোক। রজতের তো জহুরীর চোখ, সে তো দেখামাত্র বুঝেছে, আপনাদের বুলুর বীরত্বে অভিলাষের মিডল স্ট্যাম্প ছিটকে একেবারে দর্শকদের মধ্যে। সে করলো কি, ফেব্রুয়ারির ছয় তারিখে, মানে অভিষেকের জন্মদিনে, এক এলাহি বার্থডে পার্টির আয়োজন করে বসলো। বলা বাহুল্য আমন্ত্রিতদের মধ্যে স্টার অ্যাট্রাকশন বুলু ম্যাডাম স্বয়ং!’