‘আমি অভিলাষের, মানে বরের বন্ধু। আপনার থেকে অনেক ছোটই হবো, আমাকে তুমিই বলুন ‘।
‘বাহ বাহ, চমৎকার। আজকাল তো এসব উঠেই গেছে হে, এমন বিনয়ী ইয়ে চট করে দেখাই যায় না, হ্যা হ্যা। তা বাপু তুমি কি বরের ছোটবেলার পাড়ার বন্ধু না স্কুল কলেজের?’
‘দুইই বলতে পারেন। আমরাও ওই, ইয়েবেলার বন্ধু আর কি’।
‘বাহ বাহ। তাহলে ওদের সব খবরই জানো বলতে হবে ভায়া। তা ছেলের বাড়ি তো শুনলাম বেশ পয়সাওয়ালা, না কি?’
‘ওই আর কি। কলকাতা দুর্গাপুর মিলিয়ে তিনটে সোনার শোরুম, কলকাতা শহরে খান চারেক বাড়ি, সাউথ সিটিতে দুটো ফ্ল্যাট, দার্জিলিঙে একটা বাগানবাড়ি… ‘
‘বাহ বাহ, বেশ বেশ, শুনে ভারি খুশি হলুম। তা ছেলে তো এমনিতে ভালোই শুনলাম, তাই তো? লেখাপড়াতে তো ভালোই, না কি?’
‘সি ইউ থেকে ফার্স ক্লাস ফিজিক্স অনার্স, আর তারপর ওখান থেকেই এমবিএ। সিটিব্যাঙ্কে বারো লাখটাকার অফার ছিলো, ছেড়েছুড়ে বাবার বিজনেস দেখতে এসেছে। এখন একে যদি লেখাপড়া বলতে চান…’
‘বলো কি হে! এ তো রীতিমতো শিক্ষিত দেখছি। আমার তো ধারণা ছিল এইসব বড়লোক বিজনেসম্যানদের ছেলেগুলো একেকটা তেএঁটে বদমাশ হয়। রাতদিন কলেজে লাফাঙ্গাগিরি করে, মেয়েদের বিরক্ত করে আরা সারাক্ষণ মদ গাঁজা খায়’।
‘ইয়ে, কাকু বোধহয় খুব বাংলা সিনেমা দেখেন, না?’
‘অ্যাঁ? হেঁ হেঁ, তা আর না বলি কি করে ভাই। আজকাল অবশ্য কমই হয়, টাইম কই? এককালে খুব দেখেছি বুইলে, স্বপন সাহার কোনও ছবি বাদ দিইনি। আহা, কিসব হলকাঁপানো ছবি ছিলো রে ভাই, ”বাবা কেন চাকর”, ”সখি তুমি কার?”, ”মানুষ কেন বেইমান”, ”সন্তান যখন শত্রু”, উফফফ। ভাবলেও গায়ে কাঁটা দেয় ভাই। যাকগে যাক, তা ছেলে ভালোই বলছো? ‘
‘হীরের টুকরো ছেলে কাকু, নিজের বন্ধু বলে বলছি না। ছোটবেলা থেকে তো চিনি। অত্যন্ত সভ্যভব্য, সৎ ছেলে, বন্ধুদের দেখে, গরীবলোক দেখলে দানধ্যান করে, মা বাবার কথা শোনে, লোক ঠকায় না, ভদ্র ব্যবহার। পার্টিতে গেলে এক আধ পেগ মদ খাওয়া ছাড়া আর কোনও নেশাই নেই। আর কাকু কাকিমাকেও তো চিনি, খুবই ভদ্র সজ্জন ফ্যামিলি। পাড়ায় খুবই জনপ্রিয়।’
‘বাহ, তাহলে তো ভালোই বলতে হবে।’
‘ইয়ে, একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনতে পেলাম নাকি?’
‘অ্যাঁ? আরে না রে বাপু। বলি আমাদের বুলু, সেও কি কম নাকি? লেখাপড়া খেলাধূলা সব মিলিয়ে চৌখস মেয়ে। ক্যারাটেতে ব্ল্যাক না কি একটা বেল্ট, সাইক্লিং আর সাঁতারে স্টেট চ্যাম্পিয়ন। তার ওপর যাদবপুর থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং করে সিভিল সার্ভিস দিয়ে আইপিএস অফিসার, হে হে হে, মেয়ে কিন্তু আমাদের কম নয় বাবা।’
‘সে আর আর বলতে? হাড়ে হাড়ে চিনেছি, বাপ রে। যা গরম মেজাজ।’
‘তা পুলিশের মেজাজ গরম হবে না তো কি আইসক্রিমের মতন ঠাণ্ডা মোলায়েম হবে, অ্যাঁ?’
‘তা নয়। তবে কিনা…’
‘হ্যা হ্যা হ্যা। তোমার বন্ধু কিন্তু শক্ত পাল্লায় পড়তে চলেছে ভাই, হ্যা হ্যা। ক্লাস টেন না ইলেভেনে পড়ার সময় বেপাড়ার দুএকটা ছেলে আমার মেয়েকে কিছু টোনটিটকিরি কেটেছিল, বুইলে। আমার মেয়ে হলো গিয়ে আবার বুলুর এক্কেবারে বুজুম ফ্রেণ্ড। তারপরে, বুলু গিয়ে তিনটে ছেলেকে সে কি মার, কি মার! একটার তো হাত ভাঙলো, আরেকটার বোধহয় বাঁ পা, আর শেষেরটার বোধহয় নাক আর তিনটে দাঁত। সে থানাপুলিশ, পাড়া বেপাড়ার ছেলেপিলে নিয়ে কি হুলুস্থুলু কান্ড রে ভাই। থানার ওসি তো শুনে হাসতে হাসতে মরে আর কি। তারপর বুলুকে ডেকে মাথায় হাত রেখে বলে ”বেটা, পোলিস মে আনা হ্যায় তো বাতা”, তারপর ছেলে তিনটেকে কেঁৎকা দিয়ে খ্যাঁক খ্যাঁক করতে করতে চলে গেলো। শেষে হরিসাধন নিজে এগিয়ে এসে ছেলেগুলোর চিকিৎসার পয়সা দিতে সব ঠাণ্ডা হয়। উফ, সে যে কি ঝামেলা রে ভাই, কি বলবো। আমার মা তো বলেই দিয়েছিল, এই ধিঙ্গি মারকুট্টে মেয়ের বিয়ে হবে না, হতেই পারে না। শাস্ত্রে যেন কি একটা লেখা আছে না, স্ত্রিয়াশ্চরিত্রম বলে?’
‘ভাগ্যিস..’
‘অ্যাঁ? কিছু বললে নাকি? ‘
‘না, সে কিছু বলিনি। বলছি এসব অবশ্য আমরা আগেই শুনেছি। তা আপনার মেয়ের জন্যে এত কিছু হলো, সে কিছু বললো না?’
‘সে আর কি বলবে? বুলু ওর বুজুম ফ্রেণ্ড বললুম, না! মা আমার ভারি লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে, কোনও ঝুটঝামেলার মধ্যেই নেই, সাত চড়ে রা কাড়ে না। তার ওপর বলতে নেই দেখতেও প্রতিমার মতন। ওর মায়ের রঙ আর রূপ পেয়েছে কিনা, হেঁ হেঁ হেঁ, সাক্ষাৎ লক্ষ্মীঠাকুরটি। হোম সায়েন্সে বি এ, আর কি ঠাণ্ডা ব্যবহার আর কি বলবো..তবুও….’
‘তবুও কি? ও কাকু, ফের একটা ফেঁৎ করে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন যে!’
‘এই তো বুলুর মতই বয়েস আমার মেয়ের। রূপে লক্ষ্মী, গুণে সরস্বতী, তবুও দেখো, গত একবছর ধরে যে পাত্রই দেখি তাকেই আমার মেয়ে না করে দিচ্ছে, কি কেস জিজ্ঞেস করলেই বলে তার নাকি পছন্দ নয়! কি যে চায়, আইনস্টাইন নাকি প্রসেনজিৎ, কিছুই বুঝতে পারছি না। কি বলি বলতো ভায়া? একমাত্র মা মরা মেয়ে, কড়া করে কিছু বলতেও পারি না। বলি অমন মারকুট্টে মাথাগরম মেয়েটার অবধি বিয়ে হয়ে গেলো, আমার মেয়েটাই কি…’
‘আরে কাকু, সেসব নিয়ে চিন্তা করবেন না। বেদে না বাইবেলে কিসে একটা বলেছে না, ম্যারেজস আর মেড ইন হেভেন? সময় হলে দেখবেন, নিশ্চয়ই…
‘বলছো, অ্যাঁ? বলছো? জয়ত্তারা! তোমার মুখে ফুলচন্দন পড়ুক হে। নাহ, এইবার মেজাজটা বেশ খোলতাই লাগছে। তা ইয়ে, একটা কথা বলো তো বাপু। আমি শুনেছি এই বিয়ের ভেতরে কি একটা নাকি গল্প আছে? বলি কেলেঙ্কারি কিছু আছে, না? খোলসা করে বলো দিকিন বাপু। আরে না না, এই শর্মা কাউকে বলবে না, ভগবানের কিরে’।