প্রকাশ পেলো তেনার হাতে কিছু স্কিন প্রব্লেম দেখা দিয়েছে কদিন থেকে, ডাক্তারি পরিভাষায় ইহাকে বলে সোরিওসিস। অ্যালোপ্যাথিতে নাকি ইহার ট্রিটমেন্ট ঠিকঠাক হয় না।অতয়েব তেনার কালেজের জনৈকা আগরওয়ালা পদবীধারী বান্ধবীর দিদি, যিনি নাকি হুমোপ্যাথিতে সাক্ষাৎ চরক কি সুশ্রুত, তেনাকে দেখাতেই ম্যাডাম এখানে এসেছেন। পার্ক স্ট্রীটের আশেপাশের কোন একটা গলিতে সেই অশ্বিনীকুমারীর নন্দনকাননটি!
যাই হোক, সেই বান্ধবীর দিদির সকাশে তো দেখা হলোই। ‘মাই গুডনেস সোমা, ইউ আর লুকিং সো মাচ প্রিটিইই’ বলে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে ভব্য আদানপ্রদানের পর আমাদের বসতে বলা হলো। তিনি তাঁর বরতনুটি গুছিয়ে স্থাপন করলেন, আমি আমার বপুটি থপ করে রাখলাম।আমার পরিচয় করানো হলো ‘স্পেশাল ফ্রেন্ড, ইউ নো, হি হি হি হি’ বলে। যাগগে যাক।
তা হুমোপ্যাথির সওয়াল জবাব বড় কড়া শুনেছি আদ্ধেক হুমোপ্যাথ ডাক্তারবাবু একটা বয়সের পর আদালতে পেশাদার সাক্ষীদের ট্রেইন করার ফ্রিল্যান্সিং করেন। প্রথম প্রশ্নেই মালুম হলো, ‘দিদিমার ছোট দেওরের কি অর্শ ছিলো?’
বিস্মিত হওয়ার অবকাশ পাইনি মাইরি, পরের প্রশ্ন, ‘স্ট্রেসে থাকলে স্ট্রেস রিলিভ করার জন্য কী করো?’
সোমাদেবী সলজ্জ মুখে জানালেন ‘আই শাউট অ্যাট হিম’। হিমটি যে হিমায়িত আমি, সেটা বলার জন্যে কোনও পুরষ্কার নেই।
‘কি খেতে বেশি ভালো লাগে, টক, ঝাল না মিষ্টি’।
এইবারে আর থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করেই ফেল্লুম, ‘এসব তো পোয়াতী মেয়েদের জিজ্ঞেস করে!’
কলি, ঘোর কলি, নইলে সেইদিনই সেই যুগপৎ অগ্নিদৃষ্টির সামনে আমি স্রেফ মিহি ছাই হয়ে পড়ে থাকতাম, বডির একটা পার্টসও খুঁজে অবধি পাওয়া যেত না। শুধু একবার দাঁতে দাঁত ঘষার মধ্যে শুনলাম, ‘পোয়াতী? অবনক্সাস!’
আমি মাইরি নিজেকে চেয়ারের হ্যাণ্ডেলের মধ্যে ঝুলিয়ে রাখা বাজারের ব্যাগের মতন নেতিয়ে রইলুম। সামান্য রাগ হচ্ছিল যদিও।
যাই হোক, বাবার ওজন, মায়ের জুতোর সাইজ, বাড়ির দারোয়ানের কান কটকট করে কি না, পাশের বাড়ির বিড়াল রাত্তির বেলা খাম্বাজ রাগে কাঁদে নাকি বিলাওলে, আমার রাতে ঘুম কিরকম হয়, নাক ডাকে কি না, ইত্যাদির পর ডাক্তারম্যাডাম ফোঁস জিজ্ঞেস করলেন ‘হোয়াট ইজ ইওর সোর্স অফ স্ট্রেস?’
তিনি মৃদু হেসে আমাকে দেখিয়ে বললেন ‘ইতনা বড়া সাইজ কা সোর্স অফ স্ট্রেস নেহি দিখ রহি হ্যায় দিদি, খি খি খি’।
ট্যাং করে মাথায় কোথায় কে একটা ঘন্টি মারলো। বলি হ্যাঁ লা মেয়ে, সবসময়ই তোর মন যুগিয়ে চলি, পান থেকে চুন কেন, জলের ফেঁটাটা অবধি খসতে দিই না, আজ অব্ধি একটা কড়া কথা অবধি বলেছি বলে মনে পড়ে না, তোর সঙ্গে কথা বলার চক্করে আমার যৎসামান্য হাতখরচের টাকায় পাড়ার ফোনবুথ মালিকের দোতলা উঠলো বলে, আর আমিই তোর যাবতীয় স্ট্রেসের সোর্স? বটে?
মধুমাখা স্বরে জিজ্ঞেস করলাম ‘যখন প্রবলেম স্কিনকা হ্যায়, তখন স্ট্রেস লেভেল টাইপকা অপ্রয়োজনীয় চিজ নিয়ে ইতনা জিজ্ঞাসাবাদ কিঁউ?’
ডাক্তার ম্যাডাম উদাস স্বরে বললেন, ‘ক্যায়া করে, সোরিওসিস ইজ আ সাইকোসোমাটিক ডিজঅর্ডার…’
আমি চওড়া হেসে বল্লুম ‘সে তো হোগাই। এমনিতেই এর নামই সোমা, তার ওপর সাইকো। সাইকোসোমাটিক ডিজঅর্ডার তো হোনেকা কথাই থা।’
তারপর কী হল সেসব জিজ্ঞেস করে আর কাজ নেই। তবে ভালোবাসার ব্যাপারে এতটা কড়া জবাব দেওয়াটা হয়তো উচিত হয়নি বলে এখন মনে হয়।
ভালোবাসার পবিত্রতার ওপর আমার সামান্য হলেও যেটকু বিশ্বাস ছিল তাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়েছে এই বছরের ভ্যালেন্টাইন্স ডে’র হাড়কাঁপানো অভিজ্ঞতাটা। তাহলে মন দিয়ে শুনুন কী ঘটেছিল সেদিন।
সেদিন দুপুর বেলা আপিসে বসে কাজ করছি, মানে মার্চে টার্গেট নামের যে বাঁশটা এরিয়া ম্যানেজারদের প্রীতি উপহারস্বরূপ দেবো, তার লেংথ আর ডায়ামিটার নিয়ে খুবই চিন্তিত, এমন সময় মোবাইলে দেখি অচেনা নাম্বার থেকে ফোন।
ফোনটা তুলে হ্যালো বলতেই, ওপার থেকে সুরেলা গলায় ভেসে এলো, ‘কি ভাই চিনতে পারছো? আমি অমুকদি বলছি।’
পারলাম, মানে পারতেই হলো। পঞ্চাশোর্ধ এই ভদ্রমহিলাকে ফেসবুক সূত্রে চিনি ও দিদি বলে ডাকি। সোল্লাসে বললুম, ‘হ্যাঁ দিদি বলো, কি খবর?’
তা চাট্টি আগড়ুম বাগড়ুম বকে, প্রভূত নিন্দেমন্দ করে বেশ চনমনে হয়ে উঠেছি, এমন সময় তিনি বললেন, ‘এই শোন না, তোর কোন বন্ধুর নাকি একটা অনলাইন সাইট আছে? বললে তোরা ভ্যা লেন্টাইন ডে”এ গোলাপ ফুল পাঠিয়ে দিতে পারবি না??’
একটু সন্দেহ হলো, বুইলেন, ‘কাকে পাঠাবে শুনি?’
‘আমার বরকে।’
আপনারা তো জানেন আমি কেমন নরম মনের মানুষ। এই বয়সেও বুড়োবুড়ির ভালোবাসা দেখে মাইরি স্বভাবতই চোখে জল। আহা, একি অপূর্ব প্রেম দিলে বিধাতা এদের! এই বয়সেও গিন্নি নিজে হাতে তাঁর বরকে ভ্যালেন্টাইন ডে তে গোলাপ ফুল উপহার দিচ্ছেন। জয় হোক এই ভালোবাসার, আহা দুজনে যেন শেষ জীবন অবধি এইভাবেই… রুমাল বার করে চোখ মুছতে মুছতে ধরা গলায় জানালাম, ‘পাঠিয়ে দেবো দিদি’।
‘শোন না, একটু পারফিউম ছিটিয়ে দিতে পারবি ভাই?’
কি বলবো দাদা, শুনে আমারই বুকের মধ্যে কেমন কেমন করতে লাগলো, গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো, মনের মধ্যে বসন্ত বাহার গেয়ে উঠলো কেউ…
কোনও মতে কান্না চেপে বললাম, ‘হ্যাঁ দিদি পারবো’।