প্রৌঢ়া ভদ্রমহিলা পানের ছোপ ধরা দাঁত মেলে বললেন, ‘ছেলেটাকে ডাক্তার কাছে নিয়ে গেছিলুম বাবা। কয়েকদিন ধরে জ্বরজারিতে বড় কাহিল হয়ে আছে বেচারি।’
মাসি ভাইপোর এই স্নেহালাপ হয়তো অনেকক্ষণ চলতো। কিন্তু তখন আমি ফুল নাটুকে মুডে আছি, সাইত্যস্পন্দিত বুকে মনে হয় আমিই সুনীল! উনুনের অল্প আঁচের দিকে চেয়ে হেঁড়ে গলায় আবৃত্তি করলাম, ”নিভন্ত এই চুল্লিতে মা একটু আগুন দে।”
বলেই গর্বে ইতিউতি চেয়েছি কি চাইনি, প্রৌঢ়া মৃদু হেসে বললেন, ‘আরেকটুকাল বেঁচেই থাকি বাঁচার আনন্দে!’
আমি তো মাইরি টোটাল হুব্বা! মানে? হাই রোডের পাশের গুমটির মালকিন শঙখ ঘোষ আওড়াচ্ছে?
মাথা নাড়লুম, দিন দিন প্রেজুডিসড হয়ে যাচ্ছি। ভুলে গেসলুম যে এটা নর্থ বেঙ্গল। জায়গাটাকে আমি অকারণে এত ভালোবাসি না।
বাকি দুজন ততক্ষণ আয়েশ করে বসে গপ্প জুড়েছেন। কিছু পরে চা এলো। আমি আবার র”টী খাই। মাসি দেখলাম যত্ন করে একটু আদা আর চাট মশলাও দিয়েছে। তাতে চায়ের স্বাদ দিব্যি খোলতাই হয়েছে, আমি এক চুমুক খেয়ে সজোরে বল্লুম, ‘বাহ, চমৎকার চা। সুন্দর চা। দিব্যি ভালো চা।’
চা খেয়ে দাম দিয়ে উঠে আসবো, এমন সময় জামাল বললো ‘সে কী স্যার, উঠে যাচ্ছেন যে, মাসীর ইসপেসাল মুড়িটাই তো খেলেন না। ওটার জন্যই তো গাড়িটা দাঁড় করালাম।’ বলেই একটা হাঁক পাড়লো, ‘ও মাসী তোমার ইসপেসাল মুড়ি তিনটে দাও দেখি।’
তখন যে আমার মুড়ি খাওয়ার খুব একটা ইচ্ছে ছিলো তা নয়। তবে কি না ”ইসপেশাল” মুড়িমাখা। ভাবলুম খেয়েই দেখি, খুব খারাপ হলে গাড়ি থেকে জানাল গলিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেবো না হয়।
এইবার ভদ্রমহিলা একটা উনিশশো সাতচল্লিশ সালের ভাঙাচোরা মগে মুড়ি, বাদাম, চানাচুর, সর্ষের তেল নিয়ে মাখতে শুরু করলেন। যে সব রংচটা মলিন প্লাস্টিকের কৌটো থেকে ভদ্রমহিলা এসব মালমশলা বার করছিলেন সেসব দেখলেই সেই অনৈসর্গিক মুড়িমাখার ওপর থেকে ভক্তিশ্রদ্ধা চটে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক। তবুও যাবতীয় বিতৃষ্ণা গোপন করে ওয়েট করতে থাকলুম, হায় আল্লা এসবও খেতে হবে নাকি এখন? তাও পয়সা দিয়ে?
মুড়িমাখা শেষ হলো, ভদ্রমহিলা তিনটে ঠোঙায় মুড়ি ঢেলে এগিয়ে দিলেন। পকেট থেকে ওয়ালেট বার করে টাকা দিতে যাবো, এমন সময় দেখি জামাল বুক পকেট থেকে টাকা বের করে তার মাসিকে দিয় ঠোঙাগুলো নিজের হাতে নিলো। আমি সামান্য বিস্মিত হলাম, এমন তো হওয়ার কথা নয়। এসব ক্ষেত্রে সচরাচর আমারই পেমেন্ট করার কথা।
তবে বিস্ময়ের তখনও বাকি ছিলো। সে ছোকরা একটা ঠোঙা নিয়ে এসে আমার হাতে দিয়ে ভারী সলজ্জ ভঙ্গিতে বললো, ‘সারাদিন ধরে হেবি এন্টারটেইনমেন্ট দিলেন স্যার। নিন, এইটা আমার পক্ষ থেকে। আপনাকে খাওয়ালুম!’
মুড়ির ঠোঙা হাতে নিয়ে ছোকরার দিকে স্তম্ভিত চোখে চেয়ে রইলাম !
খুব ছোটবেলায় একবার মামা”র হাত ধরে যাত্রা দেখতে গেছিলুম। সালটা উনিশশো চুরাশি নাগাদ, তখন আমার বয়েস পাঁচ কী ছয়। তখনও হাওড়ার মফস্বলে যাত্রাটাত্রা হতো, যদিও দ্রুতই সেই পাট উঠে যায়। যাত্রাটা ছিলো কোনও এক ধর্মীয় চরিত্র নিয়ে, খুব সম্ভবত রাজা হরিশচন্দ্র। সে মশাই মেলোড্রামার একেবারে হদ্দমুদ্দ, কোথায় লাগে সুখেন দাস, কোথায় লাগে নিরূপা রয়! প্রতিটি সীনে সামনের শতরঞ্চিতে মহিলাকূলের রোলারুলি, এদিকে ওদিকে পূরুষ দর্শকদের মধ্যেও ফ্যাঁচফেঁচ। এদিকে কে তার নাক ভুল করে অন্য কারও লুঙ্গিতে মুছে ফেলেছে, সে নিয়ে আবার এক অন্য বাওয়াল।
তবে যেটা আশ্চর্য লেগেছিলো সেটা হচ্ছে যে যাত্রার শেষে মূল চরিত্রাভিনেতারা ধরাচূড়া পরেই সেই তিনদিক খোলা স্টেজে প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে আছেন, আর দর্শকরা স্টেজে উঠে গিয়ে তাঁদের প্রণাম করে সামনে রাখা কৌটোতে প্রণামী রেখে আসছেন। বেশিরভাগই একটাকা বা দুটাকা দিচ্ছেন, পাঁচটাকা দান করা সেযুগে মস্ত বড় ব্যাপার ছিলো। কম লোকই তা করতে পারতেন।
তখন ব্যাপারটা অদ্ভুত লেগেছিলো বটে। এখন বুঝি, যাঁরা সেযুগে যাত্রা করে আমজনতার মনোরঞ্জন করতেন তাঁদের টাকাপয়সা এতই কম ছিলো যে পারিশ্রমিকের কিছু টাকা এভাবেই উঠে আসতো।
শুধু কি তাই? তার মধ্যে কি কিছুটা প্রশংসাও মিশে থাকতো না? মিশে থাকতো না এই অনুচ্চ ঘোষণা, ”হে কলাবিৎ, আপনার অভিনয়নৈপুণ্যে আমি তৃপ্ত। দয়া করে তার স্বীকৃতি স্বরূপ এই একটি টাকা স্বীকার করুন?” সেই একটি টাকার মধ্যে দয়া বা পুণ্যকামনার সঙ্গে শিল্পীর প্রতি কিছুটা শ্রদ্ধাও মিশে থাকতো না কি?
হোটেল পৌঁছনো ইস্তক সেই বিদুরের খুদ একটু একটু করে তারিয়ে তারিয়ে খেলাম। তার যেমন সোয়াদ, তেমনই সুতার। এখনও জিভে লেগে আছে।