‘বটে?’ ম্যানেজারবাবুর গলায় স্পষ্টই ঝড়ের আভাস।
‘আচ্ছা স্যার,’ এবার আমার উদ্দেশ্যে, ‘আপনি কখনও শিবাজী মহারাজের স্ট্যাচু দেখেছেন?’
দেখেছি তো বটেই, গোটা চারটে বছর মুম্বাইতে কাটালাম, গাদাগুচ্ছের দেখেছি।
‘আপনি মুম্বাই ছিলেন স্যার?’ সে প্রায় লাফিয়েই ওঠে, ‘আমি তো এগারো বচ্ছর ওখানে ছিলাম স্যার। ডোম্বিভিলিতে থাকতাম, আর এক বিল্ডারের গাড়ি চালাতাম।’
এইবার বেশ কিছু টুকটাক কথাবার্তা শুরু হয়। মুম্বাইয়ের লোক ও লোকাল, কাজ ও কর্ম, অটো ও বৃষ্টি নিয়ে বেশ কিছু চমকপ্রদ অভিজ্ঞতা শেয়ার করি।
এমন সময়ে সঙ্গী ভদ্রলোক ধরে বসেন, ‘বস, মুম্বাইয়ের কিছু গল্প বলুন না।’
সেই লোকাল ট্রেনের গল্পটা দিয়ে শুরু করি। এক বেচারা দেহাতি লোকাল ট্রেন থেকে নামতে গিয়ে কীরকম নাজেহাল হয়েছিলো সেই গল্প। তারপর বৃষ্টির রাতে অটো ধরে বাড়ি ফেরার গল্প। লোকাল ট্রেনেই কার একটা লুঙ্গি উড়ে যাওয়ার গল্প, ইত্যাদি। এবার দেখি খ্যাঁকম্যাক করে দুজনেরই সে কী হাসি! গাড়ি কেঁপে কেঁপে উঠছে প্রায়!
ততক্ষণে বীরপাড়া পেরিয়ে গেছি, হাসিমারা আসবে আসবে করছে। জলদাপাড়ায় গাড়ি থামিয়ে চা বিস্কুট খাওয়া হলো। বলা বাহুল্য, এসব খরচা যাত্রীকেই মেটাতে হয়। চুক্তিমত এজেন্সিকে ড্রাইভারদের খরচা বাবদ যা পেমেন্ট করি তার মধ্যে খাওয়া খরচাও ধরা থাকে বটে, কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি এঁদের চা বা লাঞ্চ খাইয়ে থাকি বা টাকা দিয়ে থাকি। একে এঁরা যে টাকাটা পান সেটা হাস্যকরভাবে কম, তাছাড়া লম্বা জার্নিতে যাই, ড্রাইভার সাহেবরা খুশি থাকলে কাজেকর্মে একটু সুবিধা হয় আর কি! ক”টা টাকারই বা মামলা?
কুচবিহার পৌঁছত পৌঁছতে সাড়ে এগারোটা। তারপর সেখানে কাজকর্ম মিটিয়ে যখন শঙ্কর হোটেলে ঢুকলাম তখন বাজে প্রায় দেড়টা, খিদের চোটে পেট চুঁইচুঁই করছে।
খাওয়া দাওয়া মেটাতে মেটাতে প্রায় সোয়া দুটো। লাঞ্চের পর একটা পান খাওয়া আমার বরাবরের শখ। সেসব বায়নাক্কা মিটিয়ে রওনা হতে হতে প্রায় আড়াইটে।
ফিরতি পথে যখন জলদাপাড়া পেরোচ্ছি, রাস্তার ওপর গাছের ছায়া ক্রমেই লম্বা হয়ে আসছে, এমন সময় ড্রাইভার সাহেব, (এতক্ষণে বছর তিরিশেকের ছেলেটির নাম জেনে গেছি, জামাল) ইরশাদ করলেন ‘স্যার, জমিয়ে গল্পগুলো বলছিলেন মাইরি, আরও দু এক পিস ছাড়ুন না।’
কী আর করা। আগডুম বাগডুম দু একটা গল্প বলতেই হলো। খেয়াল করলাম বিকেল নেমে আসছে। চারদিকে ঘন জঙ্গল, বেশ একটা গা ছমছমে পরিবেশ। মওকা বুঝে একটা চেনা গল্প বলতে শুরু করলাম,
‘একটা গল্প বলি শোনো। অনেকদিন আগের কথা, বুঝলে। তখন দেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানীর রাজত্ব। ভোপাল নবাবের একটা গোপন খবর নিয়ে আহমেদ খাঁ বলে একটা লোক যাচ্ছিলো সগরে। সগর মধ্যপ্রদেশেরই একটা শহর। একে সেই সময় দেশে আইনকানুন বলে কিছু ছিলো না, তার ওপর রাস্তাঘাটের অবস্থা ছিলো খুব খারাপ, প্রাণ হাতে করে যাতায়াত করতে হতো। কারণ একদল লোক, বুঝলে কী না, গরীব পথিকদের সঙ্গে রাস্তাতেই আলাপ জমাতো। তারপর রাতের অন্ধকারে….’
গল্পটা বলতে লাগলো প্রায় মিনিট কুড়ি। এতক্ষণ দুজনের কেউ কথা বলেননি। গল্প শেষ হওয়ার পর ম্যানেজার সাহেব শুকনো ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় গলায় বললেন, ‘জামাল, গাড়িটা একটু সাইড করো তো ভাই, ইয়ে করবো।’
শুধু তিনি কেন, গাড়ি থামিয়ে জামালও যেভাবে ঝোপঝাড়ের দিকে দৌড়ে গেলো, দেখে বোঝা গেলো যে প্রকৃতিদেবী অনেকক্ষণ থেকেই দুজনকে ঢালাও আমন্ত্রণ জানাচ্ছিলেন।
তারপর বেশ খানিকক্ষণ চুপচাপ। গাড়ি তখন বীরপাড়া ছাড়িয়ে প্রায় ধূপগুড়ির কাছে। গাড়ি থামিয়ে ফের একপ্রস্থ চা জলখাবার খাওয়া হলো।
‘আরেকটা গল্প শুনবে নাকি হে?’ গাড়িতে বসেই বেশ সহাস্যে জিজ্ঞেস করলুম।
সঙ্গী ভদ্রলোকটি হাঁ হাঁ করে উঠতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তার আগেই জামাল সম্মতি জানিয়ে ফেলেছে, ‘আরেকটা বলুন তো স্যার। তবে অত পুরোনো কালের গল্প নয়, স্যার। শুনলেই কেমন ভূতভুতুম করে। ‘
‘একালের গল্প শুনবে? তাহলে শোনো,’ এই বলে আমি আরেকটা চেনা গল্প শুরু করলাম, ‘সাউথ কলকাতায় নেতাজীনগর আছে না? সেখানে আমার এক চেনা লোক থাকে, বুঝলে, নাম অতীন। বাপ মা নেই, একটা এফএমসিজি কম্পানীর ট্রেড মার্কেটিং এ চাকরি করে। খুব ভদ্র ছেলে, কোনও নেশাভাং নেই, ব্যবহার অতি মার্জিত। নেশা বলতে শুধু কিউরিও থেকে পুরোনো জিনিসপত্তর কেনা। এইভাবেই একদিন তার হাতে একটা একটা অদ্ভুত মূর্তি এলো….’
এটা শেষ হতে প্রায় মিনিট পঁচিশ। তখন ময়নাগুড়ি ছাড়িয়ে গাড়ি আরেকটু এগিয়েছে, তিস্তা ব্রিজ পার হবো হবো করছি। অখণ্ড নৈঃশব্দের মধ্যে ব্রিজটা পেরোলাম। তিস্তার শুকনো খাতে চাঁদের আলোয় বালি চিক চিক করছে। দু একটা বাইক ছাড়া আর বিশেষ জনমনিষ্যি নেই। আকাশে ভুতুড়ে চাঁদ, ঘোলাটে মেঘে আদ্ধেক ঢাকা।
এমন সময় ব্রিজটা পেরিয়েছি কি পেরোইনি, একটা চায়ের গুমটির সামনে গাড়ি থামালো জামাল। শুকনো গলায় বললো, ‘একটু চা খেয়ে নিই স্যার?’
আমারও পরাণডা চা চা করছিলই, ফলে অনুমতি দিতে দুবার ভাবতে হয়নি। ম্যানেজার সাহেবকে দেখে মনে হলো সীটে পুরো জমে গেছেন, তেনাকে বোধহয় বেলচা দিয়ে তুলতে হবে!
সে যা হোক, তিনজনে নেমে টিমটিমে হ্যারিকেন জ্বলা গুমটির দিকে হাঁটা মারলাম। গিয়ে দেখি দোকানী ভদ্রমহিলা উনুনে সবে আগুন দেবেন দেবেন করছেন। জামাল দাঁত কেলিয়ে প্রশ্ন করলো, ‘কী গো মাসি, আজ দেরী হলো যে বড়?’