ছোকরা কী বুঝলো খোদায় মালুম। মুখটা খানিকক্ষণ তুম্বো করে আমার দিকে চেয়ে রইলো, তারপর ছলছল চোখে বললো ‘আচ্ছা স্যার। ধীরেসুস্থে চালিয়ে আপনাকে ঝড়ের বেগে আলিপুরদুয়ার পৌঁছে দিতে হবে, এই তো? চেষ্টা করছি স্যার।’
ইতিমধ্যে এরিয়া ম্যানেজার সাহেব ভারী চমৎকার পারফিউম লাগিয়ে চুপিচুপি আমার গাড়িতে এসে বসেছেন। বোধকরি আমার মেজাজ দেখেই সামান্য ম্রিয়মান মনে হলো তেনাকে। নইলে সচরাচর তিনি গাড়িতে উঠেই ‘বস, যদি কালই ভূমিকম্প হয়ে চাদ্দিকে ধ্বসেটসে যায়, আর যদি কাদাখোঁচাকে হাঁড়িচাচা বলে বলে ভুল করি তাহলে কি আমি নেক্সট ইয়ারে প্রমোশন পাবো?’ এইধরণের প্রশ্ন করতে থাকেন। আজ দেখলাম একেবারে স্পিকটি নট।
তিস্তা ব্রিজ পেরোবার পর দুটো রাস্তা আছে আলিপুরদুয়ার যাওয়ার, একটা জামালদহ হয়ে, বাংলাদেশ বর্ডারের গা ঘেঁষে। তবে নেহাতই বাধ্য না হলে সে রাস্তা কেউ ধরে না। আমরা নিলাম সোজা রাস্তাটা, ধূপগুড়ি, ফালাকাটা হয়ে সিধে যে রাস্তাটা আলিপুরদুয়ার পৌঁছচ্ছে সেটা।
গাড়ি সবেমাত্র ময়নাগুড়ি এসেছে, এমন সময় আমার হঠাৎ জ্ঞানবিতরণের অভ্যেসটা চাগিয়ে উঠলো!
ব্যাপারটা নিয়ে দু এক কথা খোলসা করে বলা দরকার। অভিজ্ঞ ব্যক্তিমাত্রেই জানেন যে কচি ছাগলের শিং গজালে সে সর্বত্র তার ধার পরখ করে বেড়ায়। বাঁশগাছ বটগাছে তফাৎ করে না। আমার অবস্থাও খানিকটা তদ্রূপ। নতুন কিছু শিখলেই আশেপাশে সেই জ্ঞানের আলো বিকিরণ করার দুর্মদ ইচ্ছেটা আমার মধ্যে তীব্র হয়ে ওঠে, নিজেকে বেশ লাইটহাউস লাইটহাউস ফীল হতে থাকে। কবি সেই কবেই গেয়ে গেছেন শিক্ষা আনে চেতনা আর চেতনা আনে ভাট বকা। আমি আমার অতি নিরীহ ও নিষ্পাপ সহকর্মীদের ওপর সেই অর্ধপক্ব জ্ঞান দোর্দণ্ডপ্রতাপে লোষ্ট্রবৎ নিক্ষেপ করতে থাকি। তেনারা অতি সুশীল মানুষ, সহনশীল হৃদয়ে এসব প্রলাপ ন্যালাখ্যাপাষু ইগনোরবৎ করে থাকেন।
আগের রাতেই কোথাও একটা স্ট্যাচু বিষয়ক লেখা পড়ছিলাম। তাতে কোনও অশ্বারোহী শহীদ বীরপুরুষের স্ট্যাচুর অশ্বটির সামনের পা ওঠানো না নামানো সেইটা দেখে আরোহী সমরাঙ্গনে শাহাদাত নসীব করেছেন না শান্তির পায়রা ওড়াউড়ির সময় এন্তেকাল করেছেন সেটার ব্যাপারে ভারী মনোজ্ঞ আলোচনা আছে। পড়ার পর থেকে রাতে ভালো ঘুম হয়নি, স্বপ্ন দেখছিলাম নাপোলিঁয় বোনাপার্টের সঙ্গে আউট্রাম ঘাটে বসে রাম খাচ্ছি, এমন সময় রাণা প্রতাপ কোত্থেকে এসে মাথায় গাঁট্টা মেরে বলছেন, ‘ ওই যাচ্ছে ঘটিগরম, ক্যুইক করে দুটো ঠোঙা নিয়ে আয় দিকি।’
সে যাই হোক, হজম না হওয়া সেই জ্ঞানরাজি পেটের মধ্যে বাসি হুইস্কির মতো গজগজ করছিলো। খানিকক্ষণ পর উসখুস করে সে নির্বিরোধী নির্বিবাদী ম্যানেজার সাহেবের উদ্দেশ্যে আলতো করে একটি প্রশ্ন নিক্ষেপ করলাম,
‘ভায়া, কখনও শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে নেতাজীর ঘোড়াটাকে দেখেছো?’
সে ছোঁড়া এতক্ষণ খুবই নিষ্প্রভ এবং ম্রিয়মান হয়ে গাড়ির এক কোণে বসেছিলো। প্রশ্ন শুনেই তড়াক করে লাফিয়ে উঠে সোৎসাহে বললো, ‘হ্যাঁ তো বস, দেখেছি তো। এই কালকেই রাজ মোটর্সে গেছিলাম মার্কেট ভিজিট করতে। সে যে কী বজ্জাত ডীলার আপনাকে কী বলবো! আচ্ছা, বস কাল যদি আমরা ওটাকে বন্ধ করে শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে তাঁবু টাঙিয়ে ল্যুব বিক্রি করি?’
‘পুরসভা আর পুলিশ যৌথভাবে এসে তোমাকে পালিশ করে যাবে’, খুবই বিরক্তি সহকারে খেঁকিয়ে উঠি। কথা হচ্ছে ঘোড়া নিয়ে এমন সময়… ‘বলি ঘোড়াটাকে কখনও ভালো করে দেখেছো কি?’
‘দেখেছি বৈ কি!’
‘দেখেছো তো বুঝলাম, তা সেই ঘোড়াটার মধ্যে বিশেষ কোনও বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করেছো ভায়া?’ জলসাঘরের বিশ্বম্ভরবাবুর মত অটল আভিজাত্যের সঙ্গে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলাম। ডানহাতের কবজিটা অজানতেই নাকের কাছে উঠে এসেছিলো। সেখানে বেলফুলের মালা জড়ানো নেই দেখে নেহাত মনঃক্ষুন্ন হয়েই হাতটা সন্তর্পণে নামিয়ে নিলাম।
‘হ্যাঁ তো, তাও করেছি বস।’ খোকার স্বরে সেই দৃঢ় আত্মপ্রত্যয় আমাকে চমকে দেয়।
‘সেটা কী?’ নিজের স্বরে সন্ধিগ্ধভাবটা আর গোপন করা যায় না।
অবিমিশ্র সারল্যের সঙ্গে উত্তর ভেসে আসে, ‘লক্ষ্য করে দেখেছি ওটা একটা পুরুষ ঘোড়া, বস।’
স্তম্ভিত হয়ে সে দিকে চেয়ে থাকি। অমন একটা স্থাপত্যের মধ্যে তুই শুধু ঘোড়ার ইয়েটাই দেখলি? হ্যাঁ রে, তোর চোখে কি ইয়ের ফিল্টার লাগানো আছে? এই অশ্লীল দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি আমার মনের মধ্যে একটা তীব্র বিদ্বেষ ঘনিয়ে উঠতে থাকে। বলি দেশ জাতি সমাজ, এদের কাছে তুই মুখ দেখাবি কী করে? ছ্যা ছ্যা ছ্যা, কাদের নিয়ে সংসার করি!
ভাবতে ভাবতে নিজেই গভীর মনোযোগের সঙ্গে ভাবার চেষ্টা করছি যে হাতিবাগান না বাগবাজার, কোনদিক থেকে এলে ঠিক বোঝা যাবে যে ওটা পুরুষ ঘোড়া কি না, এমন সময় একটা বিচ্ছিরি খুঁক খুঁক আওয়াজ শুনে দেখি আমাদের ড্রাইভার সাহেব গাড়ি চালাতে চালাতে প্রবলভাবে হাসি চাপার চেষ্টা করছেন!
আমরা দুজনেই একটু অবাক হলাম, বলাই বাহুল্য। সচরাচর সেন্টার থেকে ভাড়া করা গাড়ির ড্রাইভাররা অতি ভব্যসভ্য হন। প্রয়োজনের বাইরে একটিও বাড়তি কথা বলেন না। কোনও হাসি ঠাট্টার কথা তো ভাবাই যায় না। ইনি হাসছেন, এবং বেশ শব্দ করে, বডি কাঁপিয়ে হাসছেন।
‘স্যার কিন্তু ভারী ইয়ে আছেন’ ড্রাইভার সাহেব খ্যাঁক করে হেসে বক্তব্য পেশ করলেন।