‘বাবা আমাকে সুকুমার রায়ও পড়িয়েছেন, শরতচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথও অল্প অল্প পড়েছি।’ সলজ্জ মুখে জানালেন ভিয়েনা গঞ্জালভেস ( নামটা চেঞ্জ করলাম, বোধগম্য কারণেই)। হ্যাঁ, মায়ের পদবীটাই ব্যবহার করেন তিনি।
এদিকে মিস টিয়া তো গোঁ ধরে বসে আছেন, তিনি বর্ডারের ওপারে যাবেন না। ফলে আমাকেই কিছু খাওয়াতে হলো। সেই কবে নিজের মেয়েকে খাইয়ে দিয়েছি..এখন অন্যের মেয়েকে…
আর অন্যের মেয়ে, ‘দিডিঘুচিমিংচুং’ বলে হাসিমুখে উজ্জ্বল চোখ মেলে তাকালে কি আর খেয়াল থাকে মশাই যে এ কার মেয়ে?
যাই হোক, বহুকষ্টে কিছুমিছু খেয়ে তিনি আমাকে ধন্য তো করলেন! এরপর শুরু হলো নতুন বায়নাক্কা!
তিনি আমার সঙ্গে শোবেন! কিচ্ছুত্তেই ওই বৃদ্ধা ‘আংরদিম্মাম্মম্নেই’এর সঙ্গে শোবেন না!
মাইরি বলছি, আমার মেয়ে যখন এই বয়সের ছিলো, আমি অত্যন্ত ভয়ে ভয়ে ঘুমোতাম। এক বিছানায় শুলেই ভয় হতো ঘুমের ঘোরে যদি আমার ওই ভীমসেন মার্কা হাত পা কচিটার গায়ে উঠে যায়? যদি কোথাও লাগে? বেচারিতো বলতেও পারবে না যে কোথায় ব্যথা লেগেছে!আর এখন এ কি ধর্মসঙ্কট বলুন দেখি!তদুপরি দুবছরের শিশু যদি কোলে উঠে গলা আঁকড়ে ঝুলে পড়ে, তাকে ঠিক কি উপায়ে নিরস্ত করা যায়? গলা আঁকড়ে থাকা কচি হাতের বাঁধন জোর করে খুলতেও তো মায়া লাগে! আর একটিবার চেষ্টা করলেই ওই দুই বছরের শিশু যা তীব্র অভিমানী চোখে তাকাচ্ছে, তার কাছে পৃথিবীর যাবতীয় প্রতিরোধ সূচ্যগ্রপরিমাণধূলসম অর্থহীন!
অবশেষে নিঠুর নিদয়া দিদিমা অসাধ্যসাধন করলেন। নানাবিধ চমকপ্রদ ইংরেজিতে বকাঝকা করে মিস টিয়াকে সিটের ওপর সদ্য পাতা বিছানায় জোর করে শোয়ালেন। তারপর লাইট অফ করে কড়া বললেন, ‘লেট বোথ অফ ইউ স্লিপ নাউ’।
অন্ধকার কম্পার্টমেন্ট। মিস টিয়ার খুঁ খুঁ আওয়াজ ভেসে আসছে। এমন সময়ে দিদিমার অ্যাপোলোজেটিক গলা ভেসে এলো মৃদুস্বরে…’অ্যাকচুয়ালি ওর মা ডিভোর্সি। দিস কিড হ্যাজ নেভার সিন হার ফাদার…দ্যাটস হোয়াই…আই হোপ ইউ ডিডন”ট মাইন্ড’।
এসব কথার উত্তর হয় না, দিতে নেই। চুপ করে শুয়ে রইলাম।
খানিকক্ষণ পর শুনি বাঙালি বাবার মেয়ে তাঁর নাতনিকে গুণগুণ করে গান গেয়ে ঘুম পাড়াচ্ছেন, ‘টিয়া টিয়া টিয়া, অজ পাড়াগাঁয়ে থাকে…’
গাঢ় কষ্টের ঘুম নেমে এলো দুই শিশুর চোখে। একজনের বয়েস দুই।
আরেকজনের?
আটত্রিশ।
রায়, অভিজিৎ রায়
‘প্রভু, বলি ও প্রভু, শুনছেন?’
‘কে র্যা? শান্তিতে যে দুদন্ড ঘুমুব তার জো নেই, অ্যাঁ? রাত নেই, দিন নেই, সকাল সন্ধ্যে এত্ত প্রভু প্রভু কিসের হে?’
‘ইয়ে, সকাল হলো যে, সভার কাজ শুরু হতে দেরি হচ্ছে যে প্রভু, লোকজন সব আসতে শুরু করেছে যে। (সজোরে) অভয় দিলেন যদি করি নিবেদন/ শুনিতে ইচ্ছা কিছু অমৃতবচন’।
‘উরিশ্লা, সক্কাল সক্কাল কোবতে মারাচ্ছ, উমম, চুল উষ্কখুষ্ক, লাল চোখ, নাঃ এখনো তোমার হ্যাংওভার কাটেনি দেকচি। শোন একটা টোটকা বলি, চশমাটা দাও দিকিন,হ্যাঁ। সক্কাল সক্কাল এমন হলে না, একছিপি স্কচ নীট মেরে দেবে, বুইলে? ওইদিকে যাও, বাঁ দিকের তাক থেকে ওই লম্বাপানা বোতলটা নামাও দিকিন, গ্লেনফিডিচ, ওইখান থেকে…’
‘আহ, প্রভু, সক্কাল সক্কাল কি শুরু করলেন? একটা কাজের কথা কি বলা যাবে না শান্তিতে? রাদ্দিন মালের ধুনকিতে বুঁদ হয়ে থাকবেন?’
(ব্যাকগ্রাউন্ডে, ‘জয় সদাপ্রভুর জয়। ধ্বংস হোক সদাপ্রভুর শত্রুদের জীবন ও সমস্ত সম্পদ। বিধর্মী ও নারীরা নিক্ষিপ্ত হোক নরকের আগুনে। প্রভুর শত্রুদের ঘাড়গর্দানে আঘাত হানো জোড়ায় জোড়ায়। প্রভু অবশ্যই দয়ালু ও ক্ষমাশীল…..’)
‘না বুঁদ হয়ে উপায় কি বাওয়া? শুনতে পাচ্ছো? অ্যাই শুরু হল। রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠতেই রাজ্যের বাজারি কেচ্ছা। রোজ রোজ এগুলো শুনতে ভাল্লাগে না মাইরি, কতবার বলবো অ্যাঁ? আহা, ভাষার কি ছিরি, শুনে তো মাইরি আমি নিজেই ঘাবড়ে গেসলুম, আমি ভগবান না সিসিলির মাফিয়া, অ্যাঁ? ‘
‘ইয়ে ঠিক আছে প্রভু, পরের বার নাহয় ল্যাঙ্গুয়েজটা আরেকটু মিঠে করে দেবো, হেঁ হেঁ… ‘
‘আর বিউগলের সংগে প্যাঁ প্যাঁ করে ওটা কি বাজাচ্ছে হে?’
‘হেঁ হেঁ, এটাকে ভুভুজেলা বলে প্রভু, মহর্ষি নারদ এইবার এটি ইডেন গার্ডেনের গেটের বাইরে থেকে কুড়িয়ে এনেছেন’।
‘নারুকে বলবে এটা রোজ সকালে, ইন্দ্রের কানের কাছে বাজাতে। সে মহাপ্রভু কোথায় এখন?’
‘মহর্ষি নারদ? উনি এখন নন্দনকাননের পারিজাত বনে প্রভু?’
‘বাঃ বাঃ, হুলও ফোটাচ্ছে, আবার ফুলও? তা ভালো। কিন্তু নারু নয় চিতু, আমি ইন্দ্রের কথা জিজ্ঞেস করছি’।
‘ইয়ে, উনি একটু ব্যস্ত আছেন প্রভু….’
‘কিসের ব্যস্ত হে? দেশে ঠিকঠাক বৃষ্টি নেই, একের পর এক ক্ষেতের ফসল জ্বলে যাচ্ছে, আর উনি কি উর্বশীর ভাইটাল স্ট্যাট মাপতে ব্যস্ত? ওটাকে বলবে রোজ সকালে এটা দুঘণ্টা করে ওর কানের কাছে বাজানো হবে, আমার আদেশ। ‘
‘ইয়ে, তাহলে প্রথম আগন্তুককে পেশ করতে বলি প্রভু?’
‘বলবেই? আটকানো যায় না? আচ্ছা, বলো।’
‘ইয়ে, ওহে প্রতিহারী, প্রথম আগন্তুককে পেশ করা হোক’।
(আগন্তুকের প্রবেশ)
‘প্রভু, প্রভু, আপনিই কি সেই? ওঁ জবাকুসুমসঙ্কাশং মঙ্গলমূর্তি কাশ্যপেয়ং হে চরাচরসারে দর্শনমাত্রেনমানাকামনাপূর্তি কুচযুগশোভিত মুকুতাহারে জয় জয় বিষহরি….’
‘ওরে থাম থাম, ও চিতু একে থামাও, গনশা থেকে মনসা সব ঘেঁটে ঘ করে দিচ্ছে তো। শান্ত হয়ে বসো বাপু। ধীরে সুস্থে, অ্যায়, এইভাবে, থেবড়ে বসো দিকিন। চিতু এর জন্যে একটা বড় দেখে পাতিয়ালা বানিয়ে আনো তো,বাঁ দিকের তাক থেকে ওই লম্বাপানা বোতলটা, হাফ বোতল গ্লেনফিডিচ এখনো রয়ে গেছে বোধহয়, খবদ্দার, জল মেশাবে না….’