বলেছিলাম না, মায়ের প্রসাদ, যা পাওয়া যায় তাইই ভালো!
বলেছিলাম না, মায়ের প্রসাদ, যা পাওয়া যায় তাইই ভালো!
দিল্লি থেকে কলকাতা ফিরছিলাম দুরন্ততে, কালকেই।
কেন জানি না, আমার সব সফরেই অতি অল্প হলেও বলার মতন কিছু না কিছু ঘটে। তারই কিছু বেঝেবুঝে আপনাদের পায়ের কাছে ‘মার্কেট ভিজিট’ বলে পেশ করি। আপনারাও যে নেহাত স্নেহজড়িত কারণে নাদান বালকের এই দুর্বল প্রচেষ্টায় করুণাবশতই ঠেকা দিয়ে চলেন তাও বুঝি। এবারেও প্রায় সেরকমই একটা ঘটবে বুঝতে পেরেছিলাম, যখন আমার সিটের উল্টোদিকে তিনি এবং তাঁর দিদিমা এসে অধিষ্ঠান হলেন।
দিদিমার বয়েস পঞ্চাশ প্লাস। ‘তিনি’র মা তাঁকে স্টেশনে ছাড়তে এসেছিলেন, মায়ের বয়েস ৩২ এর মতন, এবং অত্যধিক পৃথুলা, দেখলেই আমার নিজের বোনের কথা মনে পড়ে!
বোঝা গেলো যে দিদিমা মাস তিনেকের জন্যে নাতনিকে নিয়ে কলকাতা যাচ্ছেন। মা সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, তেনার কাজ আছে দিল্লিতে, তাই তিনি যেতে পাচ্ছেন না। আর ট্রেন ছাড়ার ঠিক আগের মুহূর্তে সেই বছর তিরিশের মা যখন জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে নিজের রক্তপুত্তলিটির দিকে চেয়েছিলেন, সে সজলকরুণ দৃষ্টি দেখিয়া যাহার হৃদয় দ্রব হয় না, সে পাপমতি নির্ঘাত পাষাণ, অবশ্যই পাষাণ!
ও, বাই দ্য ওয়ে, তেনার বয়েস হচ্ছে দুই!
নাম? টিয়া। মানে Tia.
তা ট্রেন ছাড়ার পর কথাবার্তা শুরু হলো। ওঁরা যে ক্রিশ্চান সেটা দিদিমার মোবাইলের স্ক্রিনসেভারে প্রভু যীশুর ছবি দেখে দিব্যি বুঝেছিলাম। এঁরা সপরিবারে ডেট্রয়েটে থাকেন, দেশে ফিরলে গুরগাঁওয়ে কিনে রাখা দামী ফ্ল্যাটে ওঠেন। দিদিমা কলকাতা যাচ্ছেন তাঁর মায়ের সঙ্গে নাতনির দেখা করাতে! দিদিমার মায়ের বয়েসও আশির ওপর। লাস্ট মোমেন্টে ফ্লাইটের টিকিট পাননি তাই….. এঁদের পরিবারের কথাবার্তার মাধ্যম আবার ইংরেজি। এবং শুধু ইংরেজি নয়, চমৎকার ব্রিটিশ ইংলিশ, মার্কিনি সস্তাংরেজির চিহ্নমাত্র নেই।
কথাবার্তার মধ্যে দিয়ে ব্যাপারটা খোলাসা হলো। দিদিমা লোরেটো বউবাজারের মেয়ে। একে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, তদুপরি লোরেটো। ফলে ইংরেজিটা প্রাণপাত করেই শিখেছেন। এবং শুধু ল্যাংগুয়েজ নয়, লিটারেচারেও দেখলাম তিনি অনন্যা। জেন অস্টেন থেকে বিক্রম শেঠ অবধি অবাধ গতিবিধি!
আমিও মশাই লাইনের লোক, কথায় আলাপ জমাতে দেরি হলো না। আর সামান্য আলাপ জমতেই বাঙালির যা সাধারণ প্রশ্ন, জিজ্ঞেস করেই ফেললাম,
বাড়ি? কোথায় যাবেন কলকাতায়? আমি লেকটাউন যাবো। আপনি?
উই আর গোইং টু বো ব্যারাকস। হার্ড অ্যবাউট দ্যট?
প্রথম যৌবনের অনেক যন্ত্রণার কথা মহর্ষি অঞ্জন দত্ত বলে দিয়েছেন বছর বিশেক আগে। সেই থেকে বো ব্যারাকস চিনি বৈ কি! কলকাতার মধ্যে সে এক গাঢ়তর কলকাতা! সেলসের কাজেও অনেকবার মার্কেট ভিজিট করতে হয়েছে।
আলাপচারিতা শেষ হয়েছে কি হয়নি, এরপরেই শুরু হলো খেল। এই বুঢ়ি অওরতের ইতনা বড়া সাহস যে মহারাণীকে মায়ের থেকে কেড়ে আনে? ব্রিটিশ জমানা হলে বোধহয় দিদিমাকে ইণ্ডিয়া গেটের সামনে কোর্ট মার্শাল করা হতো। হায়, সে মিসেস মাউন্টব্যাটেনও নাই সে নেহরুও নাই! ফলে তাঁর মানে টিয়ারাণীর তো ভয়ানক ক্রুদ্ধ হওয়া ছাড়া আর কোনও উপায়ই থাকতে পারে না! তা প্রথমেই বোঝা গেলো যে কিছুতেই দিদিমার কোলে থাকবেন না। আঁচড়ে কামড়ে নানা অবর্ণনীয় ভাষায় নিজের ক্ষোভ ব্যক্ত করে তো তিনি দিগ্বদিক সচকিত করে তুললেন। সেই ভাষার সঙ্গে ধ্বন্যাত্মক দিক থেকে চাইনিজের সঙ্গেই মিল বেশি। তবে মন দিয়ে শুনলে বুঝতে ভুল হওয়ার কথা নয়। আরে চাচ্চু, ভাওনাঁও কো সমঝো!
যাই হোক, সারমর্ম হলো যে ভদ্রমহিলা ক্রুদ্ধ, সাতিশয় ক্রুদ্ধ! নিজের মায়ের আঁচল থেকে ছিঁড়ে নিয়ে এলে কারই বা মন মেজাজ ভালো থাকে মশাই! বিশেষ করে তেনার বয়েস যখন দুই?
এখন কথা হচ্ছে যে গান্ধারী বলেছিলেন ‘যথাধর্মোস্ততোজয়ঃ’। তিনি স্বেচ্ছান্ধ মহিলা হয়ে যে কথাটা অত সহজে বুঝলেন, ‘ন্যায় ও অধিকার’ নামের মহিলা সেটা তাঁর কালি কালি আঁখে ড্যাবড্যাব ফ্যায়লাকে বুঝবেন না সেটা হয় না। ফলে মিস টিয়াকে একটা গ্রেসফুল এক্সিট মেরে সাইড চেঞ্জ করতে হলো।
মুশকিল হচ্ছে সাইডের ওপারে দিদিমা তুমি রাধে, এপারে আমি! বেশি কিছু বোঝবার আগেই মিস টিয়া, বয়েস বছর দুই, হ্যাঁচোরপ্যাঁচোর করে আমার কোলে অধিষ্ঠিতা হয়ে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন ‘আঙ্কিলাভুমিচংচুংহাম্মা?’ এসব প্রশ্নের নঞর্থক উত্তর হয় না, হতেই পারে না, ফলে আমিও একগাল হেসে জবাব দিলুম ‘আরে হ্যাঁ হ্যাঁ, আই অ্যাম ফিলিং চমৎকার সৌভাগ্যবান। আপনার কোনও কষ্ট হচ্ছে না তো মহারাণী? ‘
এরপর আমাদের মধ্যে সাংকেতিক ভাষায় নানা ভব্য আলোচনা হয়। সেসব আধ্যাত্মিক গূঢ় আলোচনার কথা না হয় একদিন আপনাদের সময় সুযোগ পেলে বলবো। তাতে ট্রাম্পের বিদেশনীতি থেকে শুরু করে আইটি ইন্ড্রাস্ট্রির ভবিষ্যৎ সবই ইনক্লুডেড ছিলো। ইন ফ্যাক্ট একবার তো টাকার অবমূল্যায়ন নিয়ে আমাদের গভীর আড্ডার মাঝখানে অরসিকা দিদিমা এসে রসভঙ্গ করলেন, বিরসবদনে শুদ্ধ বাংলায় শুধোলেন, ‘টিয়া তুমি কি খাবে?’
আই লা, অ্যাংলো দিদিমা দিব্য ব্রিটিশ ইংরেজি কপচাচ্ছিলেন, বাগবাজারী বাংলায় কি করে ডাইভ মারলেন গা?
এইবার দিদিমা খাপ খুললেন। তেনার বাপ শ্যামবাজারের রকের বিশিষ্ট ইয়ে ছিলেন। সৎমায়ের গঞ্জনায় ভাগ্যান্বেষণে বম্বে যান এবং গিয়ে কার্যসূত্রে আলাপিত এক গোয়ানিজ কন্যায় যদিদং হৃদয়ং মমটি সম্পন্ন করেন। বিয়ের পরে দেশে ফিরে কুলাঙ্গার ছেলেটির আর পৈতৃক বাড়িতে ঠাঁই হয়নি, ফলে কচি বউকে নিয়ে তিনি এক জাহাজি পিদ্রুর সহায়তায় প্রথমে খিদিরপুর, পরে বো ব্যারাকে বাসা বাঁধতে বাধ্য হন।
© 2023 BnBoi - All Right Reserved
© 2023 BnBoi - All Right Reserved