‘তা দুর্গাপুজোতে কোথায় যাচ্ছ তোমরা?’
‘এইবার? দার্জিলিং ‘, এইবার খুশিতে মুখটা ঝলমল করে উঠলো, যেন সূর্যের উজ্জ্বল আলোয় উড়ে গেলো একঝাঁক রঙীন প্রজাপতির দল। আহা, কে লিখেছিলেন গো, মেঘের কোলে রোদ হেসেছে বাদল গেছে টুটি? ‘আমি, আমরা সবাই, আর সানিয়া আর ফারহা আর সানিয়া ফারহার পেরেন্টসরা, আর..’
‘সে কি? তুমি দুর্গাপুজোতে কলকাতায় থাকবে না?’ ছদ্মবিষ্ময়ে বলি।
‘না তো, আমরা প্রত্যেকবার কোথাও না কোথাও ঘুরতে যাই। লাস্ট ইয়ার কেরালা গেছিলাম। পরের বছর কুলু মানালি যাবো। তাই না মা?’ তিনি সমর্থন খোঁজার জন্যে ওদিকে ফেরেন।
‘মৌ, আঙ্কলকে ঘুমোতে দাও এবার। অনেক বকবক করেছো, খাবে এসো, খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়ো’, মাতৃদেবীর কড়া নির্দেশ ভেসে আসে। দেখতে পাই ওদিকে ডিনার প্যাক খোলা হয়ে গেছে।
অগত্যা, তিনি গুটিগুটি পায়ে অগ্রসর হন, ফিসফিস করে বলেন, ‘আচ্ছা, দুগগা ঠাকুরের দশটা হাত, আর কি বড় বড় চোখ, আমাদের হেডমিস্ট্রেসের মতন। তোমার ভয় করেনা?’
রাত দশটায় পাঁচ বছরের শিশুকে মা দুর্গার দশপ্রহরণধারণের তাত্ত্বিক ব্যাখা শোনানোটা নেহাৎ চাইল্ড অ্যাবিউজ হয়ে যাবে বলে নিজেকে শাসন করতে বাধ্য হই। খেয়েদেয়ে, পর্দাটা টেনে দিয়ে মোবাইলে ”অয়ি গিরিনন্দিনী” শুনতে শুনতে গভীর ঘুম।
পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙলো দেরিতে, তাও তিনি আমার চুল ধরে টানছিলেন বলে। উঠেই দেখি কামরায় একটা ব্যস্ত হুড়োহুড়ির ভাব, সবাই তৈরি হচ্ছেন নামার জন্যে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি ডানকুনি ক্রস করে যাচ্ছে ট্রেন, মানে আর আধঘণ্টার মধ্যে হাওড়া পৌঁছবো। তড়াক করে উঠে বেসিনে গিয়ে চোখেমুখে জল দিয়ে আসি। ফিরে এসে সিটে বসে জুতো পরছি, এমন সময় তিনি এলেন, এসেই চ্যালেঞ্জের সুরে, ‘ কাল তুমি আমাকে তো বললে না তুমি কোথায় থাকো?’
গালটা টিপে দিয়ে বলি, ‘ আমি লেকটাউনে থাকি মৌ। কেন তুমি কি আমাদের বাড়ি আসবে?’
খানিকক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তিনি কি ভাবেন, তারপর বলেন, ‘আগে তুমি আমাদের বাড়িতে এসো, তারপর ভেবে দেখছি।’ সেই গুরুগম্ভীর গিন্নিবান্নী হাবভাব দেখে এবার ফিক করে হেসে ফেলি, ‘আচ্ছা তোমাদের বাড়ি কি করে যেতে হয় বলো, দেখি। আমি অ্যড্রেসটা নোট করে নিই। বলো, ‘ বলে মিছিমিছি কিছু টাইপ করার ভঙ্গিতে মোবাইল বাগিয়ে ধরি। তিনিও বলতে থাকেন, ‘লিখে নাও, ভালো নাম শবনম আখতার, ডাক নাম মৌটুসি, খিদিরপুর সেকেন্ড বাই লেন, বাড়ির নাম পার্ক প্যালেস, আর আমার নাম করলেই সব্বাই দেখিয়ে দেবে, না চিনলে বলবে মোগলি যাদের বাড়ি থাকে। ও তোমাকে মোগলির কথা কিছু বলিনি, না? মোগলি হচ্ছে আমাদের সোসাইটির সওওওবচেয়ে কিউট বেড়াল। লেজখানা তো দেখোনি, এই ইয়্যাত্তোবড়…..’
কোথাও কি সূক্ষ্ম কিছু ঘটে গেলো আমার মধ্যে? মানে নামটা শোনামাত্র কি এই নিষ্পাপ অপাপবিদ্ধ শিশুটির যে চারিত্রিক অবয়ব আমার চেতনায় ও ইন্দ্রিয়ে ছিলো, তাতে কি আমারই অবচেতন মন থেকে অনাবশ্যক কিছু রঙের ছিটে এসে পড়লো? কোথাও কি সামান্য হলে, অতি সামান্য হলেও একটা অস্বচ্ছন্দ দূরত্ব তৈরি হলো? মানে যদি সত্যিই এর নাম মৌটুসিই হতো, পদবী হতো মুখার্জি কি মণ্ডল ,নিদেনপক্ষে গঞ্জালভেস কি কউর, তাহলে কি আমার এই যে হঠাতই ‘ও আচ্ছা, মেয়েটা মুসলিম?’ চিন্তাটা মাথায় আসতো?
না, বোধহয় আসতো না। কোথায় যেন আমরা দুপক্ষই একে অন্যকে অন্যভাবে দেখাটা অভ্যেস করে ফেলেছি। এ দায় কার কে জানে!
জোর করে এই অস্বস্তিকর চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করছি, এমন সময় আরেকটা চিন্তা মাথায় উদয় হলো, ও আচ্ছা, মুসলিম ফ্যামিলি। তাই দুর্গাপুজোয় কলকাতায় থাকে না, তাই মা দুর্গাকে দশ হাতে অত ভয়ঙ্কর লাগে তাই না?
এবং মুহূর্তের মধ্যেই বুকের ভেতরে বসে থাকা আদ্যন্ত মদ্যপ, খিস্তিবাজ, এবং কাউকে রেয়াত না করা কিঞ্চিৎ উদ্ধত লোকটা বলে উঠলো, ‘বটে? তোমার মামাশ্বশুররা যে গুষ্টিসুদ্ধ ফিবছর পুজোতে বেড়াতে যায় তার বেলা? আর এর পদবী আখতার বলে বিচার করছো দুগগাঠাকুরকে কি বললো, বলি তোমার নিজের মেয়ে গত বছর ভদ্রমহিলাকে পলিগন বলে ডেকেছিলো, সে কথাটা মনে আছে?’
খানিকক্ষণ মাথাটা ঝাঁকিয়ে নিলাম। না হে, ভুলই করছিলাম বোধহয়, বুদ্ধিশুদ্ধি সোজা রাখা খুবই জরুরি, খারাপকে খারাপই বলতে হয়, কিন্তু ঘণ্টাকর্ণ হওয়াটা কোনও কাজের কথা নয়।
এমন সব ভাবছি, এমন সময় তিনি খুবই অন্তরঙ্গ ভাবে এসে কোলে উঠে বললেন, ‘শোনো না, তুমি এলে সাতাশ তারিখে এসো কেমন? মানে ঈদের দিন এসো বুঝলে? অনেক রান্নাবান্না হবে তো, আর তুমি যা হ্যাংলা..হি হিহি…আর শোনো, তোমার সঙ্গে ফারহা সানিয়া মল্লিকা ঈশানী এদের সঙ্গে ফ্রেণ্ডশিপ করিয়ে দেবো, কেমন? তোমারও অনেকগুলো নতুন ফ্রেণ্ড হয়ে যাবে, তাই না?’
এমন লাভজনক প্রস্তাবে একমত হবো না এমন পাষণ্ড এখনও হইনি, ফলে দ্রুত সম্মতি দিয়ে ফেলি। তারপর কি একটা মনে পড়ে যেতে ফিসিফিসিয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘আচ্ছা মৌটুসি, তুমি ঈদে ঈদী কি নেবে?’
তিনি অপাঙ্গে মায়ের দিকে চেয়ে নেন, তারপর আরও ফিসফিস করে বলেন, ‘অ্যানা আর এলসার দুটো ডল এনো কেমন?’, বলেই চকাম করে একটা হামি খেয়ে ফেলেন! চোখ বুজে সেই হামি উপভোগ করতে থাকি, একটা মিষ্টি দুধেদাঁতের শিশুগন্ধ বুকের মধ্যে নরম অমাভুক জ্যোৎস্নার মতই ছেয়ে যায়। কচি গলায় কে যেন ভেতরে বলে ওঠে এক্সপেক্টোওওও পেট্রোনাম…