‘আচ্ছা, দুটোই বলো’
‘স্কুলে প্রেরণা আর সানা। আর সোসাইটিতে সানিয়া আর ফারহা। মল্লিকা আর ঈশানীও ফ্রেন্ড বটে, কিন্তু বেস্ট ফ্রেণ্ড না। মানে প্রেরণার মত বেস্ট ফ্রেণ্ড না। তবে আইশরইয়ার থেকে বেশি ফ্রেণ্ড। তবে ঈশানী যতটা ফ্রেণ্ড আইশরইয়া তার থেকে বেশি ফ্রেণ্ড। মল্লিকা আর সানিয়াকে তুমি সেম সেম ধরতে পারো। তবে সত্যি করে বলতে গেলে কিন্তু ফৌজিয়াও আবার গুড ফ্রেণ্ডসদের মধ্যে আছে, বুঝলে? ধরো আইশরইয়া আর মল্লিকার থেকে বেশি, কিন্তু ফারহার মতন অতটা নয়….’
ঈশ্বর পরম কারুণিক, বেশিক্ষণ এই ক্লাসিফিকেশন আর পেকিং অর্ডার শুনতে হলে মাইরি অজ্ঞান হয়ে যেতুম, জিএসটি বিলের সাবক্লজ বোঝা বরং এর থেকে ঢের সহজ। এর অর্ধেক মেহনতে শার্লক হোমসের নতুন সিরিজ বার করা যায়, হ্যারি পটার তিনবার নতুন করে লেখা যায়, গেম অফ থ্রোন্সের জি বাংলা ভার্শান বার করা যায় (টিরিয়ন ল্যানিস্টারের চরিত্রে রুদ্রনীল!)। আমি খানিকক্ষণ শিবনেত্র হয়ে তাকিয়েছিলুম, হাফ বোতল হুইস্কি সাবড়ে তার ওপর দু’পুরিয়া গাঁজা মারলে ওর থেকে বেশি হ্যাল হওয়া সম্ভব না। পরে ধাতস্থ হতে দেখি তিনি আমার কেনা চানাচুরের প্যাকেটটি খুলে খুবই মন দিয়ে সেটি সাফ করার চেষ্টায় আছেন। সেদিকে খুবই করুণ চোখে তাকাতে (স্প্রাইটে হাফ হাফ করে মিশিয়ে বাকার্ডি এনেছিলুম বটে। এখন বিনা চানাচুরে কি করে … থাক এযাত্রা বোধহয় বাড়িতে গিয়েই…), তিনি দয়াপরবশ হয়ে বললেন, ‘তুমিও একটু খাবে নাকি? দেখো, খুব ঝাল কিন্তু’! এই বলে সামান্য প্রসাদ আমার হাতে দিলেন। আমিও বুভুক্ষুর মতন মায়ের প্রসাদ, যা পাওয়া যায় তাই ভালো, ভেবে গালে চালান করে দিলুম। তারপর আড়চোখে আরেকবার চাইতেই তিনি চোখ পাকিয়ে বললেন ‘খুব ঝাল বল্লুম যে, আবার চাইছো? তোমার মা বলেনি যে গ্রিডি হওয়া ভালো নয়?’
এরপর আরেকটু চানাচুর চায়, এমন সাহস কার? আমিই বা কোন বাহুবলী হে? হাত চাটতে চাটতে জুলজুল করে চেয়ে রইলাম, আর তিনি প্যাকেটটা শেষ করে হু হা করতে করতে তাঁর জন্যে নির্দিষ্ট বোতল থেকে আধ বোতল জল সাবাড় করে দিলেন। আমি আর কি করি, অগত্যা হতাশ্বাস হয়ে ফের একেনবাবু খুলে বসেছি, (আহা, সুজন দাশগুপ্ত মহাশয়ের জয় হউক), তিনি দেখি ফের কাছে ঘেঁষে এলেন, ‘তোমার আরও খেতে ইচ্ছে করছিলো, তাই না?’
ছোট্টবেলা থেকে শিখেছিলাম মিথ্যে বলা পাপ, তাই দ্রুত ঘাড় নাড়িয়ে সম্মত হলাম।
ও ম্মা, এইটে শোনামাত্র তিনি দেখি গুটিগুটি পায়ে গিয়ে তেনার মায়ের পাশ থেকে একটা এত্তবড় হলুদ রঙের প্যাকেট বার করলেন, মুখে সলজ্জ হাসি। ওটা কি রে? ত্তাই ব্বলো, একটা আস্ত পট্যাটো চিপসের প্যাকেট! এইটে না বার করে আপনি আমারই চানাচুর আমাকেই দয়াদাক্ষিণ্য করে দিয়ে…. কি নিষ্ঠুর কি নিষ্ঠুর…
তিনি সন্তর্পণে প্যাকেটটা ছিঁড়লেন, যাতে আওয়াজ তেনার মায়ের কানে না যায়। তাঁর সেই চার্লস শোভরাজকে লজ্জা দেওয়া সূক্ষ্ম হাতের কাজ দেখে মালুম হয় যে একাজে তিনি রীতিমতো দক্ষ…শশশকরে অবশ্য আওয়াজও করলেন আমার মতন বুরবককে সতর্ক করার জন্যে … তারপর … তারপর… তারপর… ভাবতেও জিভে লাল গড়াচ্ছে.. লিখতেও এই পাতি কলমচির আঙুলগুলি শিহরিত হচ্ছে…তিনি একটি মাত্র চিপস তুলে, সেটি ভেঙে এক চতুর্থাংশ মাত্র আমার হাতে দিয়ে অত্যন্ত গম্ভীরভাবে বললেন যে, ‘বেশি চিপস খেলে পেট ব্যাথা করে, তোমার মা তোমায় বলেনি?’ এই বলে তিনি একমুঠো চিপস নিজের মুখের মধ্যে পুরে কড়মড় করে চিবোতে চিবোতে আমার দিকে সপ্রশ্ন চোখে চেয়ে রইলেন। আমিও সমুদ্রশোষণকারী অগস্ত্যকে চামচে করে জল খেতে দেওয়া হয়েছে এমন মুখ করে আঙুল চেটেচুটে বসে রইলুম।
বল্লাম না, মায়ের প্রসাদ, যা পাওয়া যায় তাইই ভালো!
এরপর অনেক রাত হয়েছে, এই বিধায় আমি আমার সিটে বিছানা বিছোতে লাগলুম, এরপর খেয়ে দেয়ে শোবো এই অভিপ্রায়। আমার দেখাদেখি এঁর মা’ও তাঁদের বিছানা তৈরি করতে লাগলেন। তিনিও অবশ্য সোৎসাহে তাঁর মা’কে সেই পুণ্যকর্মে সহায়তা করতে লাগলেন। মাতৃদেবী যথারীতি বিস্তর বিরক্ত হচ্ছিলেন। এখন কাজ এবং আকাজের মধ্যে এক্স্যাক্টলি কি পার্থক্য সেই নিয়ে ভিন্নরুচির্হি লোকাঃ বলে একটা ভারী দামি কথা আছে। মুশকিল হচ্ছে যে বড়রা কথাটা একদম মানতে চান না।।ফলে তেনার পিঠে উপর্যুপরি দুইবার দুম দুম করে কার্পেট বম্বিং হওয়ার পর তিনি গম্ভীর মুখে যেন ডানকার্কের সেই বন্দর থেকে, ‘গ্লোরিয়াস রিট্রিট’ করে ফের আমার কাছে ফিরে এলেন।
তিনি গম্ভীর মুখে বসে আছেন দেখে সামান্য মায়া হলো। আরেকটু কাছে ঘেঁষে এলাম,
‘তোমরা কোথায় গেছিলে মৌটুসি’।
‘এলাহাবাদ’, অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত উত্তর, যা লোকে সচরাচর ক্ষিপ্ত হলেই দেয়।
‘ইয়ে, ঘুরতে?’ প্রশ্নটা করা সঙ্গত হলো কি না বুঝলাম না।
‘আঙ্কলের বিয়ে’। নাহ, বুঝলাম, ন্যায়শাস্ত্রে যে বলে পর্বতো বহ্নিমান ধূমাৎ, এই সেই ধূম! অবশ্য পিঠে দুম করে পড়লে…
‘হুমম। তা মৌটুসি, তুমি ঘুরতে যেতে ভালোবাসো?
‘হুঁ’।
‘বাহ বাহ। তা এবার সামার হলিডেতে কোথাও ঘুরতে গেছিলে তোমার?’
‘না। সামার তো শেষই হয়ে গেলো।’
যাক, মনোসিলেবলের গেরোটা কেটেছে। জ্জয়ক্কালী। হাত দিয়ে ঘাম মুছে অতি সন্তর্পণে পরের প্রশ্নে যাই।