আমাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছেন রেজাভাই। কফি পান শেষ হলে আমি বললাম, রোজ ক্লিনিকটা কাছেই। চলুন নাসরিনকে দেখে আসি।
রেজাভাই বললেন, এখন সাড়ে দশটা বাজে আর একটু অপেক্ষা করে গেলে সম্ভবত আপনার বান্ধবী নন্দিনীকে সাথে নিয়ে যেতে পারবেন। আমি বাদুড়িয়া থেকে সরাসরি কলকাতায় এসেছি। তাকে গত রাতেই আপনার এখানে আসা, নাসরিনের ঘটনা সব জানিয়েছি। তিনি পারমিশন নিয়ে বেলা বারটার মধ্যে কলকাতায় পৌঁছবেন বলে আমাকে জানিয়েছেন। আমি ম্যাসেজ পৌঁছে দিয়ে রাতেই রওয়ানা হই। নন্দিনী ভালোই আছেন। তবে আপনার জন্যে দেখলাম খুবই চিন্তিত।
পারুল রেজা ভাইয়ের কথায় চকিতে আমার দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল।
কবি ভাইকে আরো এক কাপ কফি দেব?
দে।
পারুল আরো এককাপ কফি আমার কাপে ঢেলে দিয়ে এক চামচ চিনি মিশিয়ে দিয়ে বলল, দিদি যখন বারটায় বাসায় এসে পৌঁছুবেন তখন একটু অপেক্ষা করেই বেরুন।
আমি কোনো কথা না বলে পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে পারুলের কৌতূহলী চাওনি থেকে নিজেকে আড়াল করতে চাইলাম। আমার বোনও সম্ভবত আমার হৃদয়ের এক দোদুল্যমান অন্তরালকে উদ্ঘাটনের চেয়ে নীরব থাকাই বেহতের ভেবে রেজা ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বলল, আপনারা অন্য কামরায় গিয়ে একটু বিশ্রাম নিতে পারেন। দিদি যদি বারটায় আসেন তবে নাওয়া-খাওয়া করেই ক্লিনিকের দিকে বেরুলে ভালো হবে। আমি ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে রান্নার পাট চুকিয়ে ফেলব। মিতুর আব্বাও এর মধ্যেই আশা করি ফিরবেন।
রেজা বললেন, সেটাই ঠিক হবে।
কফি শেষ করে আমরা উঠে গেলাম।
রেজা ভাই আমার কামরায় এসে সোজা জুতোসহ আমার বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে বললেন, গত কয়েক রাত ঘুমোতে পারি নি, আমি এখানে ঘন্টাখানেক গড়িয়ে নিতে চাই কবি।
আমি বললাম, ঘুমোন।
ঠিক ঘুম নয়, একটু শুয়ে গড়িয়ে আপনার সাথে কথা বলব। আচ্ছা, আপনার আর নন্দিনীর ব্যাপারটা কী বলুন তো? নিছক বন্ধুত্ব?
না নিছক বন্ধুত্ব নয় রেজা ভাই। আমি নন্দিনীকে ভালবেসে ফেলেছি বলেই মনে হচ্ছে। সম্পর্কটা আমি ঠিক ব্যাখ্যা করতে পারব না। এদিকে আমার স্ত্রী রয়েছে যিনি মুক্তিযোদ্ধা, মারাত্মক আহত হয়ে ঢাকায় পড়ে আছেন। তার প্রতিও রয়েছে আমার গভীর ভালোবাসা, কর্তব্যবোধ ও প্রেম। এ রকম কেন হয় রেজা ভাই আমি জানি না। আমি নিজেও আমার এ ধরনের আচরণের ব্যাখ্যা করতে পারছি না। আপনারা, সমাজ, আমার আত্মীয়স্বজন কেউ আমার এই দ্বিমুখী প্রেমের কোনো স্বীকৃতি দেবেন না জানি, কিন্তু আমি কাউকেই নিজে থেকে পরিত্যাগ করতে পারব না। অদৃষ্টে আমার যাই ঘটুক।
আমি অত্যন্ত আগ্রহভরে জবাব দিলাম।
আমার কথা শুনে রেজা ভাই হঠাৎ বিছানায় উঠে বসে গেলেন।
আপনি খুব জটিল অবস্থা সৃষ্টি করে ফেলেছেন। এর পরিণাম কী হবে বলা খুব মুস্কিল।
আমি একটা সিগ্রেট ধরিয়ে নন্দিনীর সাথে আমার পরিচয়ের পূর্বাপর সব ঘটনা কমরেড রেজাকে বলে গেলাম। তিনি গম্ভীর হয়ে সব শুনে আমার প্যাকেট থেকে একটা সিগ্রেট তুলে নিয়ে ধরালেন।
আপনার সমস্যার কোনো সমাধান আমার জানা নেই। তবে এই মুহূর্তে আপনার যে কর্তব্য রয়েছে তা আপনার স্ত্রীকে বিপদ থেকে উদ্ধার করা। এ ব্যাপারে আমি ও আমার সহকর্মীরা যে যেখানে আছেন সাহায্য করবেন। আপনার সব কথা শুনে আপনার স্ত্রীর প্রতি আমি এ ধরনের নৈতিক দায়িত্ব বোধ করছি। আপনার ভগ্নিপতি যদি আমাকে পলিটিক্যাল রিকগনাইজ করেন এবং ঢাকা পৌঁছুতে সাহায্য করেন তবে আপনাকে সাথে নিয়ে আমি ঢাকার পথে রওনা হতে পারি।
রিকগনাইজের প্রশ্ন আসে কেন?
আমি অবাক হলাম।
আসে। এই স্বাধীনতা লড়াইয়ের প্রকৃতি এবং আদর্শগত দিকগুলো নিয়ে আমাদের সাথে আওয়ামী লীগের গুরুতর মতো পার্থক্য রয়েছে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার মুহূর্তকাল পূর্ব পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে পাকিস্তানের অস্তিত্ব, ছ’দফা ইত্যাদি বিষয়ে আমাদের মতো পার্থক্য ছিল কম। কিন্তু এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা দেয়ার ক্ষমতা শেখ সাহেবের নেই। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের জেলে আটক আছেন। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা দেওয়ার ক্ষমতা এখন কার হাতে তা আমাদের জানা নেই। আপনার ভগ্নিপতি আওয়ামী লীগের প্রবাসী সরকারেরই সচিব পদমর্যাদার ব্যক্তি। তিনি আমাকে পছন্দ নাও করতে পারেন।
বললেন রেজাভাই। তার চেহারায় রাজনৈতিক কূট আদর্শবাদের তীর্যক রেখা ফুটল। আমি বললাম, আপনি আমার ভগ্নিপতিকে জানলে একথা বলতেন না রেজাভাই। তিনি একজন নিষ্ঠাবান, সৎ সরকারি কর্মকর্তা, তার প্রকৃতপক্ষে কোনো রাজনৈতিক পক্ষপাত থাকতে পারে না।
আমার কথায় হাসলেন কমরেড রেজা।
ইমাম সাহেবকে তার বর্তমান দায়িত্ব ও অতীত কর্তব্যনিষ্ঠা ইত্যাদিসহ আমরা বিচার-বিবেচনা করেছি কবি সাহেব। তা না হলে আহত নাসরিনকে আপনার সাথে তার সাহায্যের আশায় এখানে পাঠাতাম না। আমি পূর্বাপর অনেক বিবেচনা করেই এখানে, আপনার বোনের বাসায় এসেছি। ইমাম সাহেব রাজনৈতিকভাবে বিচার না করে মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপগুলোকে একটু সহায়তার হাত বাড়ালে আমরা অর্থাৎ আমি আমার ইউনিট নতুনভাবে গড়ে তুলতে পারি। আপনি তো জানেন আমাদের কী মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। এই যুদ্ধের মধ্যে আমার বিচ্ছিন্ন কমরেডদের পুনর্গঠনের একটু সুযোগ পেলে আমি কুষ্টিয়া জেলায় একাই পাক বাহিনীর দৌরাত্ম্য ঠেকিয়ে রাখতে পারব। সম্ভবত ইমাম সাহেবও তা জানেন। মেজর জলিল যেমন তার এলাকায় একটা মারাত্মক যুদ্ধ পরিচালনার পরিস্থিতি সৃষ্টি করে নিয়েছেন, তেমনি আমিও পারব। মেজর জলিলের সাথে যেমন আওয়ামী লীগের মৌলিক মতপার্থক্য সত্ত্বেও সহযোগিতা ও সমর্থন বন্ধ নেই তেমনি আমরাও এটুকু সহযোগিতা চাই। আমরা জানি আপনার ভগ্নিপতিই এই যুদ্ধকালীন জরুরি সহযোগিতার পথ উন্মুক্ত করেছেন। আমি এসব বিষয় নিয়েই তার সাথে আলোচনা করতে এসেছি। শুধু নাসরিনকে দেখতেই আসি নি। আর পশ্চিমবঙ্গ সরকার জানে, আমি এখন এখানে আছি।