- বইয়ের নামঃ উড়ালকাব্য
- লেখকের নামঃ আল মাহমুদ
- বিভাগসমূহঃ কাব্যগ্রন্থ
অনড় অবশিষ্ট
স্বপ্নে, কল্পনায় এবং মধ্যাহ্নের ভাতঘুমে যদি
লিফটের শব্দের মত অকস্মাৎ
তোমার ধারণা এসে দুয়ারে দাঁড়ায়
জানালার পর্দা সবি পদ্মা হয়ে ফুলে ওঠে ঘরে।
মাছের চলার শব্দে ভরে যায় গৃহস্থালী। দেখি
এক নৌকা এসে লগি বাঁধে পড়ার টেবিলে।
তুমি মানে এইসব,
নাও নদী ঘটিবাটি এবং প্রকৃতি
কে আর সেখানে ফেরে? এমনকি স্বপ্নেও পৌছবো না কোনদিন—
কে না জানে, তোমার দুয়ারে।
কি করে বা যাওয়া যায়? অর্ধেক শরীর যার হয়ে গেছে
সঘন সিমেন্ট।
কদাকার ভাস্কর্যের মত বেঁচে থাকা।
এখনও আধেক আছে। সেখানেই বাসা বেঁধে স্বপ্নের পাখিরা
তোমার নামের গানে ভরে দেয় অবশিষ্ট
রক্ত চলাচল।
আমার অন্ধকারে আমি
আমার জন্য দৃশ্যের মায়া ফুরিয়ে গেছে।
অন্ধকার তো দেখার বিষয় নয়। অনুভব করার বিষয়। আমি
তাই অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বসে থাকতে
মোটই ভয় পাই না। কারণ অন্ধকারই আমাকে জানিয়ে দেয়, একদা আমারও দুটি
চোখ ছিল। বর্ণ, গন্ধ, প্রেম আর প্রত্যাখ্যান বুঝতে ইশারাই যথেষ্ট নয় চোখেও চেখে
নিতে হয়।
এখন আমার দৃষ্টি এক রকম নেই বললেও চলে কিন্তু বাতাসে প্রাণ ও প্রকৃতির গন্ধ
আমার মনে শ্লোক সৃষ্টির প্রেরণা দেয়
হৃদপিণ্ডের চারদিকে যেন দৈববাণীর বিদ্যুৎ তরঙ্গ বইছে।
তবুও আমাকে কানা বলে বন্ধুরা এ-ওর
গায়ে ঢলে পড়তে তাদের কী আনন্দ।
ব্যাপারটা এমন যে আমার দুটি চোখই কানা হয়ে গেলে কল্পনার মায়াহরিণী যেন তাদের
বন্দুকে বিদ্ধ হবে।
চোখে লেজার নিয়ে ফিরে আসার সময় ডাক্তার হারুনের আফসোসের কথা তোমার
মনে আছে? আমি আর প্রকৃতি নিচয়ের বর্ণ গন্ধের ভোক্তা হবে না বলে
দৃষ্টিবিশারদ সেই বৃদ্ধ চিকিৎসকের কী আফসোস!
তখন কি জানতাম আমরা দুই বৃদ্ধই সমান অন্ধ? তিনি মানুষের দৃষ্টি ফিরিয়ে
দিতে দিতে
তার পাশে দাঁড়ানো মৃত্যুর ছায়া টের পাননি।
কি কাজে বিলেত গিয়ে কোমায় পড়লেন। আর ফেরেননি।
আমি তো তোমার চেহারা আর বইয়ের অক্ষর দেখতে পাচ্ছি না বলে আঁতকে উঠি।
অথচ ভবিষ্যৎ দেখার জন্য কে যেন আমার ভেতরের চোখ একটু একটু মেলে দিচ্ছেন।
সেই অন্তরের চোখ জোড়া রণসাজে সজ্জিত এক পৃথিবীকে দেখছে। মানব জাতির
শেষ যুদ্ধ। সেই যুদ্ধের মহাকাব্যের জন্য কবির চোখ লাগে না। লাগে অন্তর্দৃষ্টি যা
অন্ধ হোমার হাতড়ে হাতড়ে ঠিকমত সাজিয়ে তুলেছিলেন।
ঈগল থাকবে ইতিহাস থাকবে না
১
ভাবো, ইতিহাসের গতি রুদ্ধ। মানুষের আর কোনো ইতিহাস থাকবে না। ফেরাউন থাকবে কিন্তু মুসা থাকবেন না। পুঁজি থাকবে, সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ববিচরণশীল লুণ্ঠন থাকবে কিন্তু না বলার মত দেশ থাকবে না। আফগানিস্তান বা ফিলিস্তিন কেউ না। কেবল মহাকালব্যাপী ঈগল খচিত বোমারু বিমানগুলো উড়বে কিন্তু মাটি, পাহাড় বা সাগর থাকবে না। পৃথিবী বা মানচিত্র থাকবে না। ধর্ম থাকতে চান থাকুন কিন্তু কোনো মিনার থেকে আজান হবে না। গীর্জাগুলো তো আগেই নিলামে বিক্রি হয়ে গেছে। এখন না ঘন্টাধ্বনি না আজান। প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ থাকলে বোমা হামলাও থাকবে। কারণ ইতিহাসের আর প্রয়োজন নেই। ইতিহাস থাকবে না।
রাজরাজড়াদের দিগ্বিজয়ের কেচ্ছা না হয় থাকলো না, কিন্তু প্রেম? প্রেমেরও কি কোনো ইতিহাস কোথাও কেউ গাথাচ্ছলে গেয়ে উঠবে না? যেমন বন্দীরা প্রার্থনা সংগীত গেয়ে ওঠে প্রতিটি শতাব্দীর অন্তিম প্রান্তে দাঁড়িয়ে। এত বোমাবর্ষণের মধ্যেও কবিরা কেন শুনতে পায় মুক্তির জন্য আদম সন্তানদের আহাজারি। মানুষের ভালোবাসার গান বিধ্বস্ত পৃথিবীর কন্দরে দূর্বাঘাসের মতো ছোপ ছোপ সবুজের মায়া বিছিয়ে পড়ে থাকবে কিন্তু মানুষের কোনো দয়িতা থাকবে না।
২
বুশের বোমায় তেলজল একাকার
মধ্য এশিয়া মুক্ত উদরে শোয়া;
খুলে গেছে নাভী, ঐশ্বর্যের দ্বার
আকাশে উড়ছে মৃত বিবেকের ধোঁয়া,–
জ্বলছে কাবুল, লুটালো কান্দাহার।
পুঁজির শত্রু কোথা চীন, কোথা রুশ?
সবার পাছায় থাপ্পড় মারে বুশ।
জাতিসংঘও লেজ নাড়ে যথারীতি
তার কাজ শুধু ছড়ানো বিশ্বভীতি,
মধ্যপ্রাচ্যে হামাসের দুরমুশ।
পারস্য জপে পরম প্রভুর নাম
পাখতুন নামে ভারতের জ্বর আসে
মাজারী শরীফে হত্যার পয়গাম
কাশ্মীর কাঁপে রক্তের উচ্ছ্বাসে।
পাকিস্তানে কি দম্ ফেলে ইসলাম? ,
৩
জ্ঞানের বিষাদ এসে দাঁড়িয়েছে হত্যার বিজ্ঞানে
কেবল প্রযুক্তি খোজে শাদামাথা হতার নায়ক
সিদ্ধহস্ত খুনীদের নব্যতর বিশ্বের বিধানে
এক ঠ্যাঙে বসে আছে জাতিসংঘ বিবেকের বক।
এক গুঞ্জরিত কবির আত্মা
দুনিয়াতে কেবল আমারই দাঁড়াবার জায়গা খুঁজে হয়রান হলাম।
কত ঘাট আর বন্দর পেরুলাম। কত আন্তর্জাতিক উড়াল কেন্দ্রে
ঠেলাঠেলি করে শেষে জেটপ্লেনের উদরে সেঁধুলাম। যেন
অতিকায় উড়ন্ত তিমি আমাকে উগরে দিতে একটা পছন্দমত
রানওয়ে না পেয়ে আছড়ে পড়েছে ঢাকার শেওলাধরা জিয়া
আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে।
আমার কোনো লটবহর নেই কয়েকটা রংচটা কবিতার খাতা
ছাড়া। কোথায় যাব এই ভাবনার চেয়ে এই মুহূর্তে দাঁড়াবার মত একটা
জায়গা দরকার
পায়ের তলায় মাটি চাই। খালি পায়ে যারা এই ভূপৃষ্ঠ মাড়িয়ে গেছেন
তাদের মত ক্ষতবিক্ষত দুখানি পা চাই আমার। কি হবে চকচকে
উডল্যান্ড সুতে! আহা গান্ধীজী তার খটখটে খড়ম জোড়া
কোথায় রেখে গেছেন তা যদি জানতাম?
প্রকৃতপক্ষে দাঁড়াবার কথা বললে, কোথায় থামতে হবে তা আমি
জানি। প্রতিটি জেটিতে ধাক্কা খাওয়া জাহাজের মাস্তুলে বসা
সন্ত্রস্ত গাঙচিল আমি। দরিয়া ও নীলিমার মেশামেশি দেখে
মাঝে মাঝে ডানা ঝাড়া দিই। যাতে ভেজা নুনের বিন্দু
আবার অপরিসীম লবণেই মিশে যায়। আমার ডানার এই
শ্বেতাভ ধূসরতায় স্বাদের কোন সঞ্চয় নেই। আমি জমা করিনি
কিছুই তাই পেছন থেকে আমাকে কেউ ডাকে না। তবে না থামার
ছন্দ তা আমাকে অসীম শূন্যতার মধ্যেও ভেসে থাকার কৌশল
শিখিয়েছে। আমি নিজেই তো কবিতা যা ভবিতব্যের কলমে
রচিত। তাহলে
আমাকে কেন কবি বলে পাশ কাটিয়ে যাওয়া!