পানকৌড়ির রক্ত – আল মাহমুদ
প্রথমে কালো পাখিটাকে আমি দেখিনি। আমার লক্ষ্য ছিল একটা শাদা বগার ওপর। বগাটা ছিল বিশাল আর ধবধবে শাদা। নিশ্চিন্ত মনে ঘাড় বাঁক করে স্বচ্ছ পানির ভেতরে সে তার ধারালো চঞ্চ উঁচু করে ঠোকর মারার জন্যে প্রস্তুত হয়েছিল। আমিও ধীরেসুস্থে পা ফেলেই যাচ্ছিলাম। বেশ একটু দূর থেকে গুলি করলেও যে বিশৃদশ পাখিটাকে ফেলা যাবে, এ ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ ছিল না। আর এছাড়া আমার তাড়াহুড়া না করার অন্য একটা কারণও ছিল। এ অঞ্চলে বালি হাঁস বা বটকল জাতীয় লোভনীয় বড় পাখি, যা শিকারিরা দেখামাত্রই সতর্ক হয়ে যায়, তা ছিল না। সারা মাঠ আর বিল জুড়ে কেবল কটা ধূসর কালিবগা আর ঘলবগা উড়ে বেড়াচ্ছে। আর ওড়াওড়ি করছে শালিকের ঝক। তাদের কুৎসিত চিৎকারে কানে তালা লেগে যায় পাশ দিয়ে গেলেই, উড়ে পালাতে গিয়ে মহা চেঁচামেচি জুড়ে দিচ্ছে। এই হতচ্ছাড়া শালিকগুলোকে নিয়ে কী করে যে জীবননান্দ দাশ কবিতা লিখতে পারলেন, তা আমি এখনও বুঝে উঠতে পারিনি। আমি বন্দুকটাকে যথাসম্ভব নিস্পৃহভাবে ডানহাতে নিয়ে আস্তে পা ফেলে হেঁটে যাচ্ছিলাম। মাঠটা পার হয়ে বিলের কাছে পৌঁছতেই দেখলাম বিলও শুকিয়ে গেছে। কোথাও গর্তেটর্তে একটু আধটু পানি জমে থাকলেও সারা মাঠই হাঁটু সমান কাদাতে ভর্তি।
এখন শীতের মাঝামাঝি সময়, পৌষ মাস। বিল শুকিয়ে গিয়ে কাদা হয়েছে বনশুয়োরের চামড়ার মতো ভারি আর নরম। এর ওপর এই কদিনেই আবার একি ধরনের ঘাস জন্মেছে, দেখলে মনে হবে এরা বুঝি বাতাসের সাথে বাড়ে। কাদার ওপর লম্বা পাপড়িঅলা ফুলের মতো ছড়িয়ে আছে ঘাসগুলো। রক্ষা, এইজাতীয় ঘাস ঘন। সংবদ্ধ হয় না। বেশ দূরে দূরে ছড়ানো ভাবে থাকে। ফলে দূর থেকে বিলটাকে নতুন ঘাসে ঢাকা সবুজ চত্বরের মতো মনে হলেও, কাছে এলে অন্যরকম। তখন মনে হয়, অকূল কাদার তরঙ্গের মধ্যে কয়েকটা সবুজ পাপড়িঅলা অচেনা ফুল ফুটেছে।
আমি শাদা বগাটার এক ঝলক তাকিয়ে কাদায় নামলাম। আমার প্যান্ট আগেই গোটানো ছিল। শুধু একটু হাঁটুর ওপর টেনে তুলে কাদায় পা রাখলাম। না, একেবারে হাঁটু পর্যন্ত দেবে গেল না। আমি সতর্ক থাকাতেই সম্ভবত মাত্র গোড়ালিটা ডুবেছে। এখন থেকে আমি পা টেনে সতর্ক হয়ে হাঁটছিলাম। বগাটাকে এখন প্রয়োজনীয়। দূরত্বের মধ্যে দেখা যাচ্ছে। আর একটু এগিয়ে গিয়ে একটা সুবিধামতো জায়গা থেকে গুলি করব। আমি সেরকম সুবিধামতো একটা জায়গা খুঁজছিলাম।
আমার সামনেই ছিল পাপড়িঅলা ঘাসের একটা বড়সড় সবুজ ফুল। এর ওপর দাঁড়িয়ে তাক করলে মন্দ হয় না। আমি আস্তে আস্তে, যাতে ঘাসের পাপড়িগুলো। দেবে না যায় এমনভাবে, পা টিপে উঠে দাঁড়ালাম। আমার পায়ে জুতো ছিল না, ঘাসের চাবড়াটা একটু চেপে গেল বটে কিন্তু বেশিদূর দেবে গেল না। আমি আরও সাবধানে দুপা ফাঁক করে দাঁড়ালাম। আর একটু পা প্রসারিত করে দাঁড়াতে পারলে ভালো হত। গুলি চালাতে বেশ সুবিধে হত। বন্দুকের ধমকটা বগলের নিচ দিয়ে চালিয়ে দেওয়া যেত। ঘাসের চাবড়াটা এত বড় নয় যে আর একটু সুবিধা করে দাঁড়ানো যাবে। আমি একবার চারদিকটা নজর বুলিয়ে নিলাম। আমার পেছনে প্রায় পোয়ামাইল দূরে আমার শ্বশুরবাড়ির গ্রাম দেখা যাচ্ছে। বারবাড়ির ঘরেরসামনে আধ শুকনো খড়ের স্তুপে দুটি গাই মুখ লাগিয়ে খাচ্ছে। পাশে বিশাল আমগাছটা দাঁড়িয়ে আমি বন্দুক নিয়ে রওনা হওয়ার সময় আমার স্ত্রী আদিনা রসিকতা করে বলেছিল, আমার জন্যে ধনেশ পাখির ঠোঁট নিয়ে এস। না ফেরা পর্যন্ত আমি এখানেই গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকব।
থাকো দাঁড়িয়ে। শুধু ধনেশ পাখির ঠোঁট কেন তোমার জন্যে বাতারে পালক তুলে নিয়ে আসব।
আমার কথা শুনে আদিনা মুখে কাপড় চাপা দিয়ে এমনভাবে হেসে উঠেছিল যে, হাসির কাঁপুনিতে তার পিঠটা নুয়ে পড়েছিল। সে হাসতেই হাসতেই আশেপাশে পেছনে চেয়ে দেখছিল, শেষে কেউ আবার আমাদের স্বামী-স্ত্রীর হাসাহাসিটা দেখে ফেলে এ ভয়ে আদিনা তটস্থ। আমাদের বিয়ে হয়েছে আজ সাতদিন। সামাদের ঠাট্টামস্করা মুরুব্বিরা কেউ দেখে ফেললে ভারি শরমের ব্যাপার হবে বলে আদিনা মনে করে। অথচ আদিনাকে ঠিক গ্রামের মেয়ে বলা যায় না। বাপ-মা সহ আদিনারা কুমিল্লা শহরে বাসাবাড়ি করে আছে। আমাদের পাশের বাড়িটাই তাদের বাসা। পনের বছর ধরে তারা আছে আমাদের পাশে তার আব্বা গোমতীর বাঁধের নি নম্বর তদারকি অফিসার। পাঁচটি সন্তান নিয়ে একটি পরিশ্রমী পরিবার। বড় দুই ভাই মোটর, বাইসাইকেল, রিক্সা ইত্যাদির খুরা পার্টসের একটি ছোটখাটো দোকান কষ্টে সৃষ্টে চালিয়ে যায়। আদিনার ছোট দুই বোন স্কুলে পড়ে। আর আদিনা কলেজে। এবারই ম্যাট্রিক পাশ করে কলেজে ভর্তি হয়েছে। আর ভর্তি হবার পর আমাদের বিয়ে, আমার বৌ।
আমি দেখলাম ধনেশ পাখির ঠোঁটের আশায় আদিনা আমের ছায়ায় দাঁড়িয়ে নেই। আর মুখ ঘুরিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে দেখি আমার লক্ষ্যবিন্দুটি, আমাকে এভাবে দাঁড়িয়ে তাকাতে দেখে গলা বেশ লম্বা করে দেখছে। হাবভাবটা চকিত হয়ে উঠেছে। আমার আর দেরি করা ঠিক হবে না। আমি আমার একনলা বন্দুকটা সোজাসুজি সামনের দিকে তাক করলাম। আশ্চর্য, পাখিটা কী ভেবে যেন তার ভয়ের ভাবটা মুছে ফেলে আবার পানির দিকে মুখ নামিয়েছে। গুলি করলাম। পাখিটা তাসের ঘরের মতো ফানির ওপর শাদা দুটি বড় পাখা খুলে বিছিয়ে দিল। একটুও নড়ছে না।