খুব ভাল করেছেন।
ডাক্তার এখনই এসে অবস্থা জানাবেন। এখনও সম্ভবত জ্ঞান ফেরে নি।
জ্ঞান ফিরেছে।
ইমামের কথা শেষ হবার আগেই ডাক্তার রায় এসে ঘরে ঢুকলেন। চেয়ারে বসে ইমামের দিকে ফিরে আমায় বললেন, দৈহিক পীড়ন যেমন মারাত্মক তেমনি মানসিক ভীতিও মারাত্মকভাবে চেপে বসেছে। সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠতে দুসপ্তাহ সময় লেগে যাবে মনে হচ্ছে। আপনারা সাত নং কেবিনে গিয়ে দেখে আসুন। এর নিকট আত্মীয় কেউ এখানে আছেন কি?
আমি বললাম, আমি আছি।
এর মা বাবা কেউ নেই?
ওর মা বাবা এখনও কিছু জানে না সম্ভবত। তবে পরিস্থিতি তেমন হলে তাদের না হয় খবর দিয়ে আনানো যাবে।
বললাম আমি।
ডাক্তার আমার দিকে ঔৎসুক্য নিয়ে তাকালে পারুল বলল, ইনি আমার ভাই কবি হাদী মীর। দেশের ভেতরে একটা অপারেশন থেকে ফিরলেন।
ডাক্তার রায় আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, দরকার হবে না। সুস্থ হয়ে উঠলেই বরং গার্জিয়ানদের খবর দেবেন। তবে দিন পনেরো মিসেস ইমাম বিকেলের দিকে এসে রোগীকে সঙ্গ দেবেন। আর আপনাদের মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী আপনার কাছে পরে একদিন শোনা যাবে। এখন আপনারা গিয়ে রোগিনীকে দেখে আসুন।
সাত নং কেবিনে এসে দেখি একজন নার্স নাসরিনকে হাসপাতালের সাদা জামাপায়জামা পরিয়ে দিয়ে চুল আঁচড়ে পরিপাটি করে দিচ্ছে। এখন তার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে না দীর্ঘ সময় অজ্ঞান হয়েছিল। আমাদের ঘরে ঢুকতে দেখে সে খুব অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি এগিয়ে গিয়ে তার হাত ধরে বললাম, নাসরিন আমি হাদী। এখন কেমন আছ?
নাসরিন কোনো জবাব দিল না। তার বেডের অপর দিক থেকে একজন নার্স বলল, এখন একে কোনো প্রশ্ন না করাই ভালো। মাত্র বিশ মিনিট আগে জ্ঞান ফিরেছে। ব্যথা বেদনা কমানোর ইনজেকশনের ফলে চোখ মেলে তাকিয়েছে। এখন একটানা চারঘণ্টা ঘুমিয়ে উঠলে গা গতর নাড়াতে পারবে। আপনারা কথা বলে রোগীর টেনশন বাড়াবেন না।
আমার নার্সের কথায় চুপ করলে সে সেলাইনের টিউব ইত্যাদি ঠিক করতে করতে আমার দিকে ফিরে বলল, আপনাদের মধ্যে রেজা কে?
আমি বললাম, তিনি এখানে নেই।
তাকে বলবেন একবার রোগীকে দেখে যেতে। সেন্স ফেরার সাথে সাথে তার নাম বলছিল।
আমি বললাম, কমরেড আলী রেজা রোগিনীর গার্জিয়ান এবং রাজনৈতিক শিক্ষক। একজন মুক্তিযোদ্ধা। সময় পেলে তিনি নিশ্চয়ই একবার নাসরিনকে দেখে যাবেন। আমরা তাহলে আসি।
আসুন। কোনো চিন্তা করবেন না। দিন পনেরোর মধ্যে রোগী সেরে উঠবে।
আমরা ডাক্তার রায়ের চেম্বারে গিয়ে তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ইমামের গাড়িতে এসে উঠলাম।
গাড়ি পার্ক সার্কাসের দিকে মোড় নেয়া মাত্র ইমাম আমার দিকে ফিরে বললেন, আপনার জন্য আরও একটি দুঃসংবাদ দিতে হচ্ছে বলে দুঃখিত কবি ভাই।
আমি হতভম্ব হয়ে ইমামের দিকে ফিরে দুঃসংবাদটি জানতে চাইলাম।
হামিদা ভাবি ঢাকায় গুরুতর আহত হয়ে একটা গোপন জায়গায় আশ্রয় নিয়ে আছেন। তাকে সীমান্ত পার করে আনা এখন এই মুহূর্তে অসম্ভব। আবার দেশের ভেতরে অর্থাৎ রাজধানী ঢাকাতেই তিনি এখন যে অবস্থায় যেখানে আছেন যে কোনো মুহূর্তেই ধরা পড়ে যেতে পারেন। আমি মাত্র গতকালই আমাদের সোর্স থেকে এ খবর পেয়েছি। আপনার বোন বা ভাগ্নিকেও এখবর জানাতে পারি নি কারণ এদের উৎকণ্ঠা বাড়বে।
হামিদা কী গুলিবিদ্ধ হয়েছে?
না। সিদ্ধিরগঞ্জের কাছে একটা পাওয়ার গ্রীড কাটতে গিয়ে মাইন বিস্ফোরণে উরুর হাড় ভেঙ্গে গেছে। তাকে দ্রুত সরিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে রাখা হয়েছে কিন্তু যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না। তার সাথের বিশজনের মধ্যে নজনই স্পট ডেড। বাকি এগারজনের একজন ভাবি যিনি গুরুতরভাবে আহত। বাকি দশজনের গায়ে কোনো আঁচড়ই লাগে নি। এ সংবাদ আপনাকে এ সময় না জানানোই ভালো ছিল। তবে তাকে ঢাকার বাইরে নিয়ে আসার ব্যাপারে আপনি একটা পথ বাৎলাতে পারেন ভেবে আপনাকে বলা। অপারেশনের নেতৃত্বে দুজন ছিলেন। একজন পোলের ওপর ইলেক্টিফায়েড হয়ে শহীদ হয়েছেন। অন্যজন ভাবি, পোলের গোড়ায় সমস্ত দল নিয়ে পাহারা দিচ্ছিলেন। গোড়ায় যে মাইন পাতা থাকতে পারে চিন্তা করেন নি। হঠাৎ বিস্ফোরণ। আশেপাশের গাঁও গেরামের সমস্ত মুক্তিযোদ্ধারা দ্রুত সাহায্যের জন্য এগিয়ে না এলে ভাবিসহ পুরো দলটাই ধরা পড়া যেত। এরা ব্যাপারটা হঠাৎ আন্দাজ করতে পেরে অত্যন্ত বিপদের মধ্যে রাত তিনটায় রাস্তাঘাটে এ্যাম্বুশ করে পাঞ্জাবিদের ঠেকিয়ে দ্যায় এবং ভাবিসহ অন্যরা নিরাপদ জায়গায় সরে যেতে পারে।
ইমামের কথায় হতবুদ্ধি হয়ে আমি ও পারুল গাড়ির ভেতর বসে পরপর মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। ইমাম এমন একটা মারাত্মক সংবাদ আমার বোনকেও জানায় নি। পারুলের মুখ দেখে বোঝা যায় ইমামের এই চেপে রাখার ব্যাপারে সে অসন্তুষ্ট হয়েছে। ইমাম আমাদের মনোভাব বুঝতে পেরে বলল, আপনার বোনের কাছে বিষয়টা বললে সে অযথাই উদ্বিগ্ন হয়ে কান্নাকাটি করত। এখান থেকে ভাবিকে সাহায্য করার আমি যে সামান্য চেষ্টাচরিত্র করছি তাতে বাধা পড়ত। এখন আপনি কিছু একটা করবেন ভেবেই বললাম। আমার অপরাধ নেবেন না।
আপনি বলুন কলকাতায় বসে আমি এর এখন কী বিহিত করতে পারি? আমার মাথায় তো কোনো উপায় খেলছে না।