সেই কখন। মামানিই তো আব্বা-আম্মাকে জাগিয়ে বিদায় নিয়ে তারপর ট্যাক্সি ডেকে বেরিয়ে গেল।
বলল মিতু। তার মামানির এভাবে চলে যাওয়াটা সম্ভবত তার কাছেও একটু বিসদৃশ ঠেকেছে। আমি বললাম, আমাকে জাগিয়ে দিলে পারতি।
মামিই তো দিল না। বলল তোর মামা একটু ঘুমাক। এখন অত ভোরে জাগাতে হবে না। আমি গত রাতেই তোর মামার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রেখেছি।
আমি কোনো কথা না বলে বিছানায় উঠে বসলাম। মিতু বলল, মামা আপনাকে চা দিতে বলি?
আমার পায়ের ওপর থেকে কম্বলটা সরিয়ে দিয়ে খাট থেকে নামতে নামতে বললাম, যা বলে আয়।
মিতু খুশিতে নাচছে। নতুন বাড়িতে যাওয়ার কিশোরীসুলভ আনন্দ। সে লাফ দিয়ে বেরিয়ে গেল। দরজার ছিটকিনিটা তুলে দিয়ে আমি টয়লেটে এসে ঢুকলাম। ঢুকেই চোখে পড়ল সামনের আয়নার ওপর একজোড়া খাকি রংয়ের চুলের ফিতে শুকুচ্ছে। কাল হামিদার বেণীতে এই ফিতে দুটি ছিল। যাওয়ার সময় সে হয়তো বেণী বাঁধবারও সময় পায় নি। কেন জানি না বুকের ভেতর থেকে প্রবল হু হু শব্দে একটা কান্না বেরিয়ে এল। আমি নিজেকে আর সামাল দিতে পারছিলাম না। বেসিনের কলটা ছেড়ে দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলাম।
.
আমরা গোছগাছ করে ট্যাক্সি ডাকার আগে নাস্তার জন্য নিচে নেমে এলাম। আমাদের সবারই মালপত্র রুমের বাইরে দোরগোড়ায় রেখে এসেছি। শুধু গৌহাটিতে পাওয়া টাকার ব্যাগটা আমি হাতে করে নিচে নিয়ে এসেছি। আমার হাতে ব্যাগটা দেখে একবার ইমাম বলেছিল, আপনি এটা কষ্ট করে টানছেন কেন? বেয়ারাই আনতে পারত।
আমি বললাম, ব্যাগটা নন্দিনীর। এটা বরং আমার হাতেই থাক।
ইমাম হেসে বলল, নন্দিনী কী সত্যি আমাদের সাথে থাকবেন?
তার আত্মীয়বাড়ি যাবার আগে নন্দিনীর সাথে এ ধরনের কথাইতো হয়েছিল। এখন অবশ্য তার আত্মীয়-স্বজনের সন্ধান পেয়ে তার মতের পরিবর্তনও হতে পারে। আমি ঠিক করে কিছু বলতে পারছি না।
বললাম আমি।
ইমাম বলল, তিনি যদি আমাদের সাথে থাকতে চান তাহলে আমার প্রতিশ্রুতি তাকে স্মরণ করিয়ে দেবেন। এখন তো তার এখানে আসার কথা ছিল বলে শুনেছি।
তার কথা শেষ হবার আগেই নন্দিনী এসে আমাদের খাবার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে সকলকে সালাম জানাল, আমি এসে পড়েছি।
নন্দিনী একা এসেছে দেখে আমি বললাম, ভবানীপুর থেকে কেউ আসে নি?
নন্দিনী বলল, না একাই এসেছি। আমি ঠিক চিনে চলে এসেছি। মনে হয় কলকাতায় ছোটো বয়সে একবার যে এসেছিলাম সেটা এখন একটু একটু কাজে লাগছে। এখন কোনো কিছুই আর অপরিচিত মনে হচ্ছে না।
আমি বললাম, অনুপদা আর তার বোন কেমন আছে। তাদের নিয়ে এলে না কেন?
তারা আসতে চেয়েছিলেন। আমিই বরং বলেছি নতুন বাসার ঠিকানা নিয়ে গিয়ে একদিন তাদের নিয়ে আসব।
বলল নন্দিনী। তার কথায় একটা আনন্দ উচ্ছ্বল ভাব।
আমি বললাম, তোমাকে খুব খুশি খুশি লাগছে নন্দিনী।
নন্দিনী হাসল।
পার্ক সার্কাসের একটা ফ্ল্যাটবাড়ির চারতলা ইমামের জন্য বরাদ্দ হল। আমরা উডস্ট্রীটের আর্মেনিয় হোটেলটি সকালেই ছেড়ে এসেছি। সারাদিন বাসাটা গোছগাছ করতেই পারুল ও নন্দিনীর কেটে গেল। আমিও খানিকটা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। যদিও গোছানোর মতো ঢাকা থেকে আমরা কিছুই নিয়ে আসি নি, এমন কী পারুলদেরও উল্লেখ করার মতো আসবাপত্র তেমন কিছু ছিল না, তবুও একটা নতুন বাসায় উঠলে ঝাড়পোছ ও ধোয়ামোছা তো করতেই হয়। তাছাড়া রান্নাবান্নার ডেগডেকচির জন্য ইমাম একজন লোককে বাজারে পাঠিয়ে সবকিছু সংগ্রহ করাল। সকালেই বাড়ির বুড়ো মুসলমান দারোয়ান কোত্থেকে যেন এক ওড়িয়া কাজের মেয়েকে জোগাড় করে আনল রান্না আর ঘর মোছার জন্য। মেয়েটি ষোল সতের বয়সের। বেশ চটপটে। এসেই দুপুরের রাঁধাবাড়ায় লেগে গেল। ঘরবাড়ি গুছিয়ে খেতে খেতে বেলা গড়িয়ে যাওয়ার অবস্থা। ক্লান্তশ্রান্ত হয়ে গোছল সেরে এসে সকলে যখন খাওয়ার টেবিলে বসলাম বেলা তখন সাড়ে তিনটা। এতক্ষণ নন্দিনীর সাথে মন খুলে কথা বলার ফুরসৎই পাওয়া যায় নি।
আমি বললাম, নন্দিনী তোমার আমাদের সাথে থাকার সিদ্ধান্ত কী অনুপদা জানেন? তারা কী তোমাকে এ ব্যাপারে সম্মতি দিয়েছেন?
আমি তাদের বলেছি আমার দেশ ও জাতির এই দুর্দিনে আমার একটা কর্তব্য আছে। আমি স্বেচ্ছায় দেশ ছেড়ে আসি নি। বাধ্য হয়ে এখানে এসেছি আর ততোধিক বাধ্য হয়েই মুক্তিবাহিনীর পক্ষে দাঁড়াব। আমি সীমাদির মৃত্যুর ঘটনা, আমার ওপর পাশবিক লাঞ্ছনার বিবরণ খোলাখুলি আমার কুটুম্বদের বলেছি। তোমার কথা, পারুল ও ইমাম ভাইয়ের দয়ার কথা সবি বলে এদের অনুমতি নিয়ে ভবানীপুর ছেড়ে এসেছি। ফের সেখানে গেলেও ওদের গলগ্রহ হতে যে চাই না এটা অনুপদাকে বুঝিয়েছি। শুধু আমার বোনটা একটু কেঁদেছে সীমাদির জন্য। এখন ইমাম আর পারুল যদি না তাড়ায় এখানেই থাকব।
ইমাম বলল, সাবাস। আমরা আর আপনাকে বলব না যে আপনি এখানে থাকবেন কী না। জানব আমাদের মতো দেশ থেকে এসেছেন এবং আমাদের সাথেই বিজয়ী হয়ে ফিরে যাবেন।
ইমামের কথায় খাওয়ার টেবিলে খুশি আর আশ্বাসের আবহাওয়া যেন ছড়িয়ে পড়ল। মিতুর খুশিটা বোঝা যায়। সে একবার আমার দিকে মুখ তুলে হাসল। পরমুহূর্তেই পারুলের সতর্ক গভীর দৃষ্টির ইঙ্গিতে মাথা নুইয়ে খেতে লাগল।