ভদ্রলোকের পেছন পেছন আমরা সিকিউরিটি বেষ্টনী পার হয়ে সর্বশেষ ওয়েটিং রুমে চলে এলাম। এখানকার সবগুলো সোফাই শূন্য। কারণ এখনও যাত্রীদের কেউ প্রবেশাধিকার পায় নি। আমরা এসে কামরার ভেতর দাঁড়াতেই অফিসারটি ইমামের সাথে সেকহ্যান্ড করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, যাত্রা শুভ হোক। আমার নাম অমরনাথ। আমিও একদা ঢাকারই লোক ছিলাম। এনাউন্স হলেই প্লেনে গিয়ে উঠবেন। আপনাদের আর কোনো চেকিং হবে না। আমি এখানকার সিকিউরিটি অফিসার। আপনাদের আসার ব্যাপারে আগেই আমাদের এলার্ট করা আছে। দমদমেও আপনাদের জন্য লোক থাকবে। তারাই যথাস্থানে পৌঁছে দেবে। আর কোনো অসুবিধে নেই। নমস্কার।
.
আমরাও তাকে হাত তুলে সালাম বললাম। স্মিত হেসে ভদ্রলোক দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলে আমরা সোফার ওপর আরাম করে বসলাম। নন্দিনী আমার পাশে। এখন তার মুখখানা উজ্জ্বল। আমার বোন ও ভাগ্নিটাও খুশি। কলকাতার বিমান আমাদের জন্য রানওয়েতে দাঁড়িয়ে আছে। একটু পরেই উড়াল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই কামরাটা যাত্রী নারীপুরুষে ভর্তি হয়ে গেল। কালো মতো মোটা এক ভদ্রলোকে সুটাটাইপরা, হাতে দুটি বিশাল ব্যাগ নিয়ে নন্দিনীর গা ঘেঁষে বসে পড়ল। হ্যান্ড ব্যাগ দুটি একটু অস্বাভাবিকভাবে আমার পায়ের কাছে রেখে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, আপনারা কী জয়বাংলার লোক?
আমরা ঢাকা থেকে এসেছি।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও জবাব দিলাম আমি।
আমি নারায়ণগঞ্জ থেকে এসেছি।
কোথায় যাবেন?
আপাতত কলকাতায়।
আপনার হ্যান্ডব্যাগগুলো খুব ভারী মনে হচ্ছে। আপনি তো হাঁপাচ্ছেন।
আর বলবেন না ভাই। ব্যবসার কাগজপত্রের বোঝা। পাটের ব্যবসা করি কিনা।
আমি আর কিছু না বলে ইমাম ও পারুলের দিকে তাকালাম। এরা আমাদের সোফা থেকে একটু দূরে এদের বারো বছরের মেয়ে মিতুর নানা কৌতূহলী প্রশ্নে জবাব দিতে ব্যস্ত। মিতু একবার হাসিমুখে আমার দিকে তাকিয়ে হাসল, এই যে কবি মামা, একটু পরেই কলকাতা।
মিতুর মুখে আনন্দ উছলে পড়ছে দেখে আমি ও নন্দিনী হাসলাম। নন্দিনীর হাসিটা খুব ভালো লাগল।
একটু পরেই প্লেনে ওঠার ঘোষণা শুনে আমরা উঠে দাঁড়ালাম। ইমাম পারুল ও মিতুকে নিয়ে যাত্রীদের লাইনের ভেতর দাঁড়িয়ে আমার ও নন্দিনীর দিকে হাতের ইশারা করল। আমরা লাইনের দিকে যেতে উদ্যত হলে পাশের সেই ভদ্রলোক আমার হাত চেপে ধরে হঠাৎ মিনতি করল, আমাকে একটু সাহায্য করুন, এই ব্যাগটা একটু প্লেন পর্যন্ত পৌঁছে দিন না।
এ অবস্থায় আমি যখন দ্বিধান্বিত নন্দিনী হাত বাড়িয়ে বলল, ঠিক আছে দিন। আমি নিয়ে যাচ্ছি।
আমি কিছু বলার আগেই নন্দিনী ব্যাগটা হাতে তুলে বলল, খুব ভারী তো।
আমি বললাম, দাও আমাকে।
লাগবে না, এসো।
নন্দিনী আমার আগে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে গেল। তার পেছনে আরও দুজনের পর আমি ও নারায়নগঞ্জের ব্যবসায়ী ভদ্রলোক ঠাঁই পেলাম।
যাত্রীরা লাইন বেঁধে হেঁটেই বিমানের সিঁড়ির কাছে বিশাল লাইনে থেকে চেকিং করিয়ে বিমানে উঠছে। এদিকে একজন চেকিং অফিসার নন্দিনী পর্যন্ত ওপরে উঠতে অনুমতি দিয়ে বোর্ডিং কার্ড হাতে নিয়ে লাইনটাকে থামাল। নন্দিনী তর তর ওপরে উঠে গেলে ভদ্রলোক আমার বোর্ডি কার্ডের হলুদ শ্লিপটা নেড়ে চেড়ে দেখল। ঠিক সেই মুহূর্তে তার হাতের ওয়াকিটকিতে কী যেন কথা বেজে উঠতেই সে আমার পেছনের ব্যবসায়ীটির দিকে ফিরে বলল, আপ লাইনসে নিকাল আইয়েজি।
বলেই ভদ্রলোক আমার বোর্ডিং কার্ডটি আমার হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বলল, আপ যাইয়ে, জলদি।
আমি দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে ওপরে চলে এলাম। যাত্রীরা এখনও সবাই সঠিক সীট খোঁজাখুজি করছে। আমি উন্মুখ হয়ে নন্দিনীকে খুঁজতে গেলে দেখলাম সে প্লেনের সম্মুখভাগে একটি জানালার পাশে বসে হাতের ইঙ্গিতে আমাকে ডাকছে।
আমি সামনের দিকে এগোতে গিয়ে দূরেই পারুলদের দেখলাম। কিন্তু একবার পেছন ফিরেও দেখলাম না ব্যবসায়ী ভদ্রলোকটি এখনও ভেতর আসতে পারল কিনা। নন্দিনীর পাশের সীটে বসেই বললাম হ্যান্ড ব্যাগওয়ালা লোকটাকে সিঁড়ির কাছে আটকে দিয়েছে।
বলো কী, এখন কী হবে?
এক্ষুণি হয়ত ছেড়ে দেবে।
আমার কথায় নন্দিনী জানালার দিকে মুখ ফেরাল।
সর্বনাশ লোকটাকে তো পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে। এখন কী হবে?
তার কথায় আমিও নিচের দিকে দেখার চেষ্টা করলাম। দুজন পুলিশ লোকটাকে তার অবশিষ্ট হ্যান্ডব্যাগসহ ঠেলতে ঠেলতে ওয়েটিং লাউঞ্জের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
আমরা নিরুপায়ের মতো পরস্পরের দিকে তাকালাম। নন্দিনী ধরা গলায় ফিসফিস করে আমাকে বলল, ভগবান জানেন এ ব্যাগটায় কী আছে?
নন্দিনী পায়ের কাছে সীটের ফাঁকে ব্যাগটা খাড়া করে রাখা। আমি বললাম, চুপ করে থাক। যাই থাক ব্যাগটা এখন তোমার আমার কাছে। এর ভেতরকার সবকিছুর জন্য দায়দায়িত্ব আমাদের ওপর বর্তাবে। আর এ নিয়ে কথা বলো না।
নন্দিনী একদম চুপ হয়ে গেল। তার মুখ রক্তশূন্য ফ্যাকাশে। আমি বললাম, একটুতেই ভয় পাও কেন?
একটু পরেই বিমানের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। আমি নন্দিনীর সীট বেলট বেঁধে দিয়ে নিজেরটা বাঁধলাম। একজন এয়ারহোস্টেস আমাদের পাশের গলিপথ দিয়ে আমাদের দিকে আড়চোখে দেখতে দেখতে হেঁটে চলে গেলে বিমানেরও রানওয়ের ওপর দিয়ে চলা শুরু হল।
একটু পরেই বিমানটি মেঘলা আকাশের ভেতর ঢুকে পড়লে আমি ও নন্দিনী হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। নন্দিনী অনুচ্চ স্বরে আমাকে বলে, হ্যান্ডব্যাগটা ওপরে তুলে রাখলে হয় না?