*
করুণাসিঞ্চন
(কবি জসীমউদ্দীন শ্রদ্ধাস্পদেষু)
অভিশপ্ত ঐ কবিকে এখন তোমরা করুণায় সিক্ত করে অসহায়
একাকী কবিকে!
ওঁর নতুন চরের মতো মুখখানি জীবনেও কখনো পেলো না!
ওঁর কোরানোর মতো কালো কালো রাখাল ছেলেরা সেই যে গিয়েছে আর
দুধেল গাভীটি নিয়ে লোকালয়ে এখনো ফেরেনি।
ওঁর সুজনেরা ওঁকে ছেড়ে চলে গেছে, ওঁরা আজ আঘাটায়
পেতেছে বহর
ওঁর সব মানুষেরা গ্রামের গোমরা মুখে থুথু দিয়ে এখন অঢেল
দলে দলে শহরে আসছে, তারা খুবই অসহায়,,
ওঁও-তো এখন খুব অসহায়, ওঁকে করুণায় সিক্ত করো, ওকে!
বহুদিন নকশীকাঁথার দিকে যাত্রা ভুলে গেছে ঐ কবি,
ওঁ এখন আপন ছায়ায় ডানা গুটিয়ে নিজের কাছে নিজেই কেমন
যেনো বসে থাকে কথা নেই কাজ নেই যেমন মোরগ
দিন শেষে খোপের ভেতরে তার একা একা বসে থাকা, একা
একা শুধু জেগে থাকা!
কবে ডানকানা মাছ মানুষের মতো ওঁকে কাদা ও জলের কাছে নিয়ে..
এখন কোথায় কাদা, কোথায় সে জল? মাটির পুতুল বাঁধা মাছ দেখে
এখন কেবল কবি কামনায় সেই শাদা মাছটিকে ফিরে পেতে চায়!
ঘরে বসে বাঁশির শরীরে হাত জ্যোত্সা রাত যতটা না তার চেয়ে
এখন অধীর কবি শূন্যতায় নারীর নিদ্রায় নিজ আঙ্গুল বুলিয়ে পায়
জীবনের হারানো কবিত্ব কিছু কিছু!
কখনো বা মধ্যরাতে মাঝদরিয়ায় আহা ডুবন্ত নাবিক
মরণ চিৎকার যেনো আজো তার ফেলে আসা তীর ছুঁতে চায়
সেই শীতল পাটির স্নেহ সরল নদীর গ্রাম, গাছ পালা, মাছ,
বেদে, মাঝির বহর!
*
টানাপোড়েন
প্রতি পদপাতে এক একটি রোমশ ভয় আমুণ্ডু আচ্ছন্ন করে।
যখন আমাকে
আবিষ্কার করি ও কোটরের সাপগুলো বিষজিহ্বা দিয়ে সব নিচ্ছে টেনে
বাকলের সমস্ত শরীর!
কোনটা ধরে রাখি আর কোনটা ফেলে দেই!
কোটর বাকল সবই আমার!
একটায় বিষধর সাপ, অন্যটায় প্রকৃতির পাখির নখের নৃশংসতা!
প্রতি পদপাতে এক একটি রোমশ ভয় আমুণ্ড আচ্ছন্ন করে
যখন আমাকে
আবিষ্কার করিঃ মৃত্যু তার কালো শুঁড় দিয়ে সব টেনে তুলছে।
জীবনের পাল্টে যাওয়া বয়সে পাথরগুলোকে!
কোনটা ধরে রাখি আর কোনটা ফেলে দেই
একটায় অবলুপ্তি, অন্যটায় অন্ধ জাগরণ!
*
ভুবন ডাঙ্গায় যাবো
(মাহফুজুল হক খান বন্ধুকে)
ভূবন ডাঙ্গায় যাবো তার আগে কী কী নেবো? কী কী আমরা নেবো?
রঙ্গীন রুমালে কিছু ফুলমূল, সবুজ তণ্ডুল নাও, তরতাজা তারুণ্য আর
তিনটি রমণী নাও, ধানশীষ মাটির কোদাল।
পথে যেতে দেখা হবে সময় ঘাঁটির সৈন্য, দেখা হবে ভিক্ষুক শ্রমণ
বাম দিকে দেখতে পাবে অমর করবী ফুল, জোড়াদিঘি, ঘরের অঙ্গন!
একটি ভিক্ষুক হাসতে থাকবে ভিক্ষুণীর অর্ধকোল জুড়ে!
ভুবন ডাঙ্গায় যাবো, তার আগে কী কী দেখবো? কী কী দেখতে পাবো?
দক্ষিণে দারুণ যুদ্ধ পেরেকে বিদ্ধ হচ্ছে নর-নারী আগুন! আগুন!
সামনে পুড়ছে সব- পদ্মফুল, বেশ্যালয়, ঘোলা মদ্যশালা!
ঐ সব পিছে রেখে ডানে এগুলেই একটি গ্রামের ভিতর
দেখতে পাবে খড় এনে আজো ঘর বাঁধছে ঘরামী!
তিনটি রমণী তার কাঁধে নিয়ে ত্রিকালের জলের কলস
হেসে হেসে বাড়ী ফিরছে, বাড়ী ফিরছে, বাড়ী…
*
প্রবাহিত বরাভয়
তোমরা ঐ বারোয়ারী মেয়েটিকে নিয়ে নাচো, মত্ত হও!
আপাততঃ আমি যাই
দ্রাবিড়-দেবদূত
আমি যেখানে যা পাই
ঐ মহান মিথুন মূর্তি
গুনগুন কুমারীর ঘুণ,
রক্তলোহা পেছল আগুন
মৃত্যু
ঠায় অভিমান ঐ
বকুলবাগান
যাই
যেতে যেতে
সমস্তই শুভ!
যেতে যেতে
যেখানে যা পাই
পথের উপর দল
হালহল।
ঐ যে পাগলগুলি
খল খল হাততালি দেয়
চলি,
যেতে যেতে
শান্ত হবে চলি!
যেতে যেতে
এই জনস্থলী
হবে সবই ধ্রুব
হবে সবই ফুল,
যেতে যেতে
জেনো সব ঘাটের মাস্তুল
ফিরে পাবে নাও!
মেলা থেকে ফেরোনি কি ব্যাকুল লণ্ঠন?
— যাও
একলা বন্ধন টুটে চলেছেন ওরা
নবকুমারেরা–
যাও,
পরাও মুকুট
যাও
সময়ের খুট ধরে টেনে আনো
শস্যমন্ত্র আর
নিরাকার সহিষ্ণু আঁধার
টেনে আনো মাটিতে আবার
তুমি ফলাও উদ্ভিদ
যাও,
শীতল পাটিতে বসো
হারানো আসনে
থাক
পিছনে অশুভ।
*
একজন ধর্মপ্রণেতা
(আশরাফুল আলমকে)
ছিলাম প্রথম ভ্রূণ খড়ের গাদায, ছিলাম তপ্ত লোহা, তোমার জ্বলন্ত ধাতু
ছিলাম মাটির বাসে লুকনো মোহর, ছিলাম শিল্পের লিপ্সা
জটিল বন্ধন।
আমাকে সমুদ্রস্নানে নিয়ে যাওয়া হলো একদিন, অসতী নারীর সঙ্গে,
আমাকে অরণ্যে নিয়ে যাওয়া হলো একদিন অসতী আলোর সঙ্গে,
এক যুবতীর জলের উপরে আমাকে ভাসতে দেওয়া হলো একদিন।
আমাকে জলের অর্থ বলে দেওয়া হলো এক জেলেনীর সঙ্গে শুতে দিয়ে।
আমাকে ঝর্ণার নৃত্য, সীমাবদ্ধ সমুদ্র দেখতে নিয়ে যাওয়া হলো
মরুদ্যানে, হায়
আমি কত কমনীয় খর্জুর বৃক্ষ দেখলাম!
আরব্য রজনী, শাহী গণিকাদের গোলগাল নাভির অপেরা হাউস!
আমি নৃত্যপরা তাবুর ভিতরে কত দেখলাম ঘুঙগুরের ঝাঁঝট তরঙ্গ
কত দেখলাম দহন চুম্বনে বদ্ধ সিংহমূর্খ, নরনারী
শিশু ও লোবান আর মৃত্যু ও আতরদানী কত দেখলাম।
সার্কাস কুমারী ছিল একজন, সেইখানে তাবুর ভিতরে
সে আমার দিকে তার ছিন্ন ঘাঘরার দ্যুতি ছুঁড়ে দিল,
নিদ্রার মিথুন মুদ্রা ছুঁড়ে দিল সেই প্রথম।
আমাকে মায়ের সঙ্গে পিতার কবর খুঁড়তে যেতে হলো, সেই প্রথম
গ্রীষ্মের ঝাপটা লাগা রাত্রিতে একদিন,
শুক্লা দ্বাদশীর রাত্রে জ্যোৎস্নায় আমি মায়ের নারীত্ব ছুঁই সেই প্রথম।