- বইয়ের নামঃ অসহ্য সাসপেন্স সমগ্র
- লেখকের নামঃ অদ্রীশ বর্ধন
- বিভাগসমূহঃ সমগ্র
আটটা ঝিনুকের বোতাম
বন্ধুবর ইন্দ্রনাথের গুণ অনেক। সে ভারত বিখ্যাত প্রাইভেট ডিটেকটিভ। মিষ্ট ভাষণে তার জুড়ি নেই। অনুভূতির সূক্ষ্মতায় তাকে শিল্পী বলা চলে। বুদ্ধির তীক্ষ্ণতায় সে ইন্ডিয়ান শার্লক হোম।
কিন্তু চাঁদেরও কলঙ্ক থাকে। ইন্দ্রনাথেরও একটা বদ্ দোষ আছে। তা হল তার অহংভাব। পাঁচজনের সামনেই এমন টিটকিরি মেরে বসে যা শুনে কান-টান ঝাঁ-আঁ করে ওঠে।
সেদিন এই নিয়ে লঙ্কাকাণ্ড হয়ে গেল আমাদের মধ্যে।
রবিবারের বিকেলে ইন্দ্রনাথের মেসে গেছিলাম আমি আর গৃহিণী কবিতা। গিয়ে দেখি লঙ্কা পায়রার মতো এক ফুলবাবু জোড়হস্তে দাঁড়িয়ে।
ইন্দ্রনাথের ললাটে কুটি। এবং যেন কিছু বিব্রত।
আমাদের দেখেই বললে–এসো ভায়া এসো। বসো বউদি। তোমাদের কথাই হচ্ছিল।
কালো চোখ নাচিয়ে লাল ঠোঁট বেঁকিয়ে কবিতা বললে–কী সৌভাগ্য আমাদের।
কিন্তু উপলক্ষ্যটা কী? জিগ্যেস করলাম আমি।
এই ভদ্রলোকের নাম লম্বোদর লস্কর। আর ইনিই সেই কুখ্যাত সাহিত্যিক মৃগাঙ্ক রায়। জীবনসঙ্গিনী কবিতা রায়। যাঁদের কথা আপনাকে বলছিলাম লম্বোদরবাবু।
নমস্কার-প্ৰতিনমস্কারের পালা শেষ হলে বিনয়-গলিত হেসে লক্কাপায়রা যুবকটি বললেন– এজ্ঞে, আমি এসেছিলাম ইন্দ্রনাথবাবুর কাছে অ্যাপ্রেন্টিস হতে।
কীসের অ্যাপ্রেন্টিস?
গোয়েন্দাগিরির।
হাসি চেপে বললাম–, ইন্দ্রনাথ বলে কী?
এজ্ঞে, উনি বলেন আপনাদের দ্বারাও যখন অ্যাদ্দিনে কিছু হয়নি, তখন আমার দ্বারাও হবে না।
কী!
ফস করে দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালিয়ে ইন্দ্রনাথ বললে–কথাটা কি মিথ্যে বলেছি, মৃগ? এতদিন ধরে আমার সাগরেদি করে শুধু ছাইভস্ম লেখা ছাড়া আর কিছু করতে পেরেছ আজ পর্যন্ত? বৌদির কথা বাদই দিলাম, মেয়েদের দ্বারা জগতে কোনও মহকর্ম সাধিত হয় না।
মুখ লাল করে কবিতা বললে–ঠাকুরপো তোমার বড় দেমাক হয়েছে।
রেগে গিয়ে আমি বললাম–সুযোগ এলে তোমার দর্প আমি চূর্ণ করব।
অট্টহেসে ইন্দ্রনাথ বললে–সুযোগ এসেছে।
কীরকম?
জয়ন্ত ফোন করেছিল। রাঁদেভু হোটেলে একজন খুন হয়েছে। বেরুতে যাচ্ছি এমন সময়ে এলেন লম্বোদরবাবু। তারপরেই তোমরা।
তাই নাকি? তাই নাকি? জ্বলজ্বলে চোখে বললে লম্বোদর।
চ্যালেঞ্জটা অ্যাকসেপ্ট করবে কিনা ভেবে দেখ, বলল ইন্দ্রনাথ। মুরোদ থাকে চলো আমার সঙ্গে। বউদি তুমিও এসো। লম্বোদরবাবু, যাবেন নাকি? গোয়েন্দা হওয়ার যোগ্য কার আছে আর কার নেই–তা জয়ন্তর সামনেই একটা টেস্ট কেসেই প্রমাণিত হয়ে যাক।
গল্প-টল্প লিখে ইদানীং আমারও একটু দম্ভ হয়েছিল বোধহয়, তা না হলে লম্বোদয় লস্করের সামনে ইন্দ্রনাথের টিপ্পনীতে অত অপমানিত বোধ করব কেন।
তক্ষুনি লাফিয়ে উঠে বললাম–চলো দেখা যাক কেরামতিটা কার বেশি।
পাঞ্জাবির দিকে হাত বাড়িয়ে ইন্দ্ৰনাথ শুধু বললে–চলো।
পরে অবশ্য অনুতপ্ত হয়েছিলাম এই হঠকারিতার জন্যে।
.
পার্ক স্ট্রিট। রাঁদেভু হোটেল।
লবিতে গিজগিজ করছে পুলিশ, রিপোর্টার আর হোটেল-গেস্ট। কনক্রিট দেওয়ালের মতো পথ আটকে দাঁড়িয়ে সার্জেন্ট অচল দত্তর বিপুল দেহ। পাশেই দাঁড়িয়ে খর্বকায় এক পুরুষ। উদ্বেগের কালো ছাপ চোখে-মুখে। পরনে নেভী ব্লু সার্জ সুট, সাদা শার্ট আর কালো বোটাই।
সপারিষদ ইন্দ্রনাথকে দেখে একগাল হেসে পার্শ্ববর্তী ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলে অচল দত্ত–মিঃ পিটার ড্যানিয়েল। হোটেল ম্যানেজার।
কাষ্ঠ হেসে করমর্দন করল পিটার ড্যানিয়েল। বলল–ব্যাড। ভেরী ব্যাড। আপনি পুলিশের লোক?
এমনভাবে মাথা নাড়ল ইন্দ্রনাথ যাতে হা-না দুই বোঝায়। লম্বোদরের মুখটা দেখলাম একটু শুকিয়ে গেছে পুলিশ দেখে। ফ্ল্যাশগান বাগিয়ে সাংবাদিকরা তাগ করছে, সুযোগ বুঝলেই শাটার টিপবে। একই রকম ধূসর রঙের শার্ট, প্যান্ট, টাই পরা হোটেল ক্লার্ক আর অন্যান্য কর্মচারীরা একযোগে প্যাট-প্যাট করে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। সব মিলিয়ে এমন একটা থমথমে পরিবেশ যে অস্বস্তি বোধ না করে উপায় নেই।
অচল দত্ত বললে–লাশ চোখে পড়ার পর থেকে কেউ বাইরেও যায়নি, ভেতরেও আসেনি। ইন্সপেক্টর চৌধুরীর অর্ডার। এঁরা আপনার সঙ্গে যাবে তো?
হ্যাঁ। জয়ন্ত কোথায়?
তিন তলায়। রুম নং ১০৯।
পা বাড়াল ইন্দ্রনাথ। কয়েক ধাপ উঠে এসে মুচকি হেসে বললে–চলো হে গোয়েন্দারা। এখনি নার্ভাস হলে চলবে কেন?
কবিতা কিছু বলল না। তবে মুখ দেখে বুঝলাম সহজ হবার চেষ্টা করছে বেচারি।
১০৯ নাম্বার কামরার সামনেই পেছনে হাত দিয়ে পায়চারি করছিল ডিটেকটিভ জয়ন্ত চৌধুরী–আমাদের বাল্যবন্ধু।
জয়ন্তর ললাট চিন্তাকুটিল। কবিতাকে দেখে জাকুটি করে বললে–কী ব্যাপার, একেবারে সদলবলে যে। লম্বোদরকে লক্ষ্য করে–ইনি কে?
আমার অ্যাপ্রেন্টিস৷ বলল ইন্দ্রনাথ।
অ্যাপ্রেন্টিস? তার মানে?
তার মানে শিক্ষার্থী। মৃগ আর বউদিকেও তাই বলতে পারো। এইটাই হল টেস্ট-কে। বোর্ড অফ এগজামিনারের মধ্যে থাকছ তুমি আর আমি।
ললাট রেখা সরল হয়ে গেল জয়ন্তর। এত চিন্তার মধ্যেও ফিক্ করে হেসে বললে–বেশ তো, ভেতরে চলো।
চোখ পাকিয়ে তাকাল কবিতা। আমারও প্রবল বাসনা হল দুকথা শুনিয়ে দেওয়ার। কিন্তু স্থান-কাল-পাত্র ভেবে মুখ বুজে রইলাম।