- বইয়ের নামঃ অসহ্য সাসপেন্স সমগ্র
- লেখকের নামঃ অদ্রীশ বর্ধন
- বিভাগসমূহঃ সমগ্র
আটটা ঝিনুকের বোতাম
বন্ধুবর ইন্দ্রনাথের গুণ অনেক। সে ভারত বিখ্যাত প্রাইভেট ডিটেকটিভ। মিষ্ট ভাষণে তার জুড়ি নেই। অনুভূতির সূক্ষ্মতায় তাকে শিল্পী বলা চলে। বুদ্ধির তীক্ষ্ণতায় সে ইন্ডিয়ান শার্লক হোম।
কিন্তু চাঁদেরও কলঙ্ক থাকে। ইন্দ্রনাথেরও একটা বদ্ দোষ আছে। তা হল তার অহংভাব। পাঁচজনের সামনেই এমন টিটকিরি মেরে বসে যা শুনে কান-টান ঝাঁ-আঁ করে ওঠে।
সেদিন এই নিয়ে লঙ্কাকাণ্ড হয়ে গেল আমাদের মধ্যে।
রবিবারের বিকেলে ইন্দ্রনাথের মেসে গেছিলাম আমি আর গৃহিণী কবিতা। গিয়ে দেখি লঙ্কা পায়রার মতো এক ফুলবাবু জোড়হস্তে দাঁড়িয়ে।
ইন্দ্রনাথের ললাটে কুটি। এবং যেন কিছু বিব্রত।
আমাদের দেখেই বললে–এসো ভায়া এসো। বসো বউদি। তোমাদের কথাই হচ্ছিল।
কালো চোখ নাচিয়ে লাল ঠোঁট বেঁকিয়ে কবিতা বললে–কী সৌভাগ্য আমাদের।
কিন্তু উপলক্ষ্যটা কী? জিগ্যেস করলাম আমি।
এই ভদ্রলোকের নাম লম্বোদর লস্কর। আর ইনিই সেই কুখ্যাত সাহিত্যিক মৃগাঙ্ক রায়। জীবনসঙ্গিনী কবিতা রায়। যাঁদের কথা আপনাকে বলছিলাম লম্বোদরবাবু।
নমস্কার-প্ৰতিনমস্কারের পালা শেষ হলে বিনয়-গলিত হেসে লক্কাপায়রা যুবকটি বললেন– এজ্ঞে, আমি এসেছিলাম ইন্দ্রনাথবাবুর কাছে অ্যাপ্রেন্টিস হতে।
কীসের অ্যাপ্রেন্টিস?
গোয়েন্দাগিরির।
হাসি চেপে বললাম–, ইন্দ্রনাথ বলে কী?
এজ্ঞে, উনি বলেন আপনাদের দ্বারাও যখন অ্যাদ্দিনে কিছু হয়নি, তখন আমার দ্বারাও হবে না।
কী!
ফস করে দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালিয়ে ইন্দ্রনাথ বললে–কথাটা কি মিথ্যে বলেছি, মৃগ? এতদিন ধরে আমার সাগরেদি করে শুধু ছাইভস্ম লেখা ছাড়া আর কিছু করতে পেরেছ আজ পর্যন্ত? বৌদির কথা বাদই দিলাম, মেয়েদের দ্বারা জগতে কোনও মহকর্ম সাধিত হয় না।
মুখ লাল করে কবিতা বললে–ঠাকুরপো তোমার বড় দেমাক হয়েছে।
রেগে গিয়ে আমি বললাম–সুযোগ এলে তোমার দর্প আমি চূর্ণ করব।
অট্টহেসে ইন্দ্রনাথ বললে–সুযোগ এসেছে।
কীরকম?
জয়ন্ত ফোন করেছিল। রাঁদেভু হোটেলে একজন খুন হয়েছে। বেরুতে যাচ্ছি এমন সময়ে এলেন লম্বোদরবাবু। তারপরেই তোমরা।
তাই নাকি? তাই নাকি? জ্বলজ্বলে চোখে বললে লম্বোদর।
চ্যালেঞ্জটা অ্যাকসেপ্ট করবে কিনা ভেবে দেখ, বলল ইন্দ্রনাথ। মুরোদ থাকে চলো আমার সঙ্গে। বউদি তুমিও এসো। লম্বোদরবাবু, যাবেন নাকি? গোয়েন্দা হওয়ার যোগ্য কার আছে আর কার নেই–তা জয়ন্তর সামনেই একটা টেস্ট কেসেই প্রমাণিত হয়ে যাক।
গল্প-টল্প লিখে ইদানীং আমারও একটু দম্ভ হয়েছিল বোধহয়, তা না হলে লম্বোদয় লস্করের সামনে ইন্দ্রনাথের টিপ্পনীতে অত অপমানিত বোধ করব কেন।
তক্ষুনি লাফিয়ে উঠে বললাম–চলো দেখা যাক কেরামতিটা কার বেশি।
পাঞ্জাবির দিকে হাত বাড়িয়ে ইন্দ্ৰনাথ শুধু বললে–চলো।
পরে অবশ্য অনুতপ্ত হয়েছিলাম এই হঠকারিতার জন্যে।
.
পার্ক স্ট্রিট। রাঁদেভু হোটেল।
লবিতে গিজগিজ করছে পুলিশ, রিপোর্টার আর হোটেল-গেস্ট। কনক্রিট দেওয়ালের মতো পথ আটকে দাঁড়িয়ে সার্জেন্ট অচল দত্তর বিপুল দেহ। পাশেই দাঁড়িয়ে খর্বকায় এক পুরুষ। উদ্বেগের কালো ছাপ চোখে-মুখে। পরনে নেভী ব্লু সার্জ সুট, সাদা শার্ট আর কালো বোটাই।
সপারিষদ ইন্দ্রনাথকে দেখে একগাল হেসে পার্শ্ববর্তী ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলে অচল দত্ত–মিঃ পিটার ড্যানিয়েল। হোটেল ম্যানেজার।
কাষ্ঠ হেসে করমর্দন করল পিটার ড্যানিয়েল। বলল–ব্যাড। ভেরী ব্যাড। আপনি পুলিশের লোক?
এমনভাবে মাথা নাড়ল ইন্দ্রনাথ যাতে হা-না দুই বোঝায়। লম্বোদরের মুখটা দেখলাম একটু শুকিয়ে গেছে পুলিশ দেখে। ফ্ল্যাশগান বাগিয়ে সাংবাদিকরা তাগ করছে, সুযোগ বুঝলেই শাটার টিপবে। একই রকম ধূসর রঙের শার্ট, প্যান্ট, টাই পরা হোটেল ক্লার্ক আর অন্যান্য কর্মচারীরা একযোগে প্যাট-প্যাট করে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। সব মিলিয়ে এমন একটা থমথমে পরিবেশ যে অস্বস্তি বোধ না করে উপায় নেই।
অচল দত্ত বললে–লাশ চোখে পড়ার পর থেকে কেউ বাইরেও যায়নি, ভেতরেও আসেনি। ইন্সপেক্টর চৌধুরীর অর্ডার। এঁরা আপনার সঙ্গে যাবে তো?
হ্যাঁ। জয়ন্ত কোথায়?
তিন তলায়। রুম নং ১০৯।
পা বাড়াল ইন্দ্রনাথ। কয়েক ধাপ উঠে এসে মুচকি হেসে বললে–চলো হে গোয়েন্দারা। এখনি নার্ভাস হলে চলবে কেন?
কবিতা কিছু বলল না। তবে মুখ দেখে বুঝলাম সহজ হবার চেষ্টা করছে বেচারি।
১০৯ নাম্বার কামরার সামনেই পেছনে হাত দিয়ে পায়চারি করছিল ডিটেকটিভ জয়ন্ত চৌধুরী–আমাদের বাল্যবন্ধু।
জয়ন্তর ললাট চিন্তাকুটিল। কবিতাকে দেখে জাকুটি করে বললে–কী ব্যাপার, একেবারে সদলবলে যে। লম্বোদরকে লক্ষ্য করে–ইনি কে?
আমার অ্যাপ্রেন্টিস৷ বলল ইন্দ্রনাথ।
অ্যাপ্রেন্টিস? তার মানে?
তার মানে শিক্ষার্থী। মৃগ আর বউদিকেও তাই বলতে পারো। এইটাই হল টেস্ট-কে। বোর্ড অফ এগজামিনারের মধ্যে থাকছ তুমি আর আমি।
ললাট রেখা সরল হয়ে গেল জয়ন্তর। এত চিন্তার মধ্যেও ফিক্ করে হেসে বললে–বেশ তো, ভেতরে চলো।
চোখ পাকিয়ে তাকাল কবিতা। আমারও প্রবল বাসনা হল দুকথা শুনিয়ে দেওয়ার। কিন্তু স্থান-কাল-পাত্র ভেবে মুখ বুজে রইলাম।
না থেকেও উপায় ছিল না। কেননা ঘরের মধ্যে যে দৃশ্য দেখলাম, তা দেখামাত্র শিরশির করে উঠল আপাদমস্তক।
পুরু কার্পেটের ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে এক ব্যক্তি। দু-হাত ছড়ানো দুপাশে–সাঁতারুর মতো। কে যেন এক বালতি লাল রং ঢেলে দিয়ে গেছে মাথার ওপর…লাল রং জমাট বেঁধেছে কালো চুলে…গড়িয়ে এসেছে ঘাড় বেয়ে।
নিষ্প্রাণ নিস্পন্দ দেহটির দিকে দেখলাম বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে লম্বোদয় লস্কর।
আর কবিতা? মৃত ব্যক্তির পাশে রক্ষিত শয্যার সাদা চাদরের চাইতেও বুঝি সাদা হয়ে গেছে তার মুখ। রক্তহীন। রংহীন।
এ হেন বীভৎস দৃশ্যের প্রতিক্রিয়া নিশ্চয় আমার মুখেও দেখা গিয়েছিল। তাই আমাদের তিনজনের মুখের ওপর দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে বিলক্ষণ হৃষ্টচিত্তে বলল ইন্দ্রনাথ রুদ্র–বন্ধু জয়ন্ত, নাম-ধামগুলো এবার বলে ফেলো দিকি।
নাম, টংগু লিনচান। বয়স বিয়াল্লিশ। বার্মিজ খ্রিস্টান। বিয়ে হয়েছিল কলকাতায়। স্ত্রীর সঙ্গে ডাইভোর্স হয়েছে বছর দুই আগে। রিপ্রেজেন্টেটিভ। মালিকের চাল আর কাঠের কারবার আছে মান্দালয়ে। বছরখানেক সাউথ আফ্রিকায় ছিলেন। নেটিভদের মারধোর করায় বিতাড়িত হয়েছেন ব্রিটিশ আফ্রিকা থেকে। রাঁদেভু হোটেলে নাম লিখিয়েছেন হপ্তা খানেক আগে। দিন তিনেকের জন্যে ঢাকায় গিয়েছিলেন আত্মীয়ের সঙ্গে দেখা করতে। আজ সকালেই ফিরেছেন। সাড়ে নটার সময়ে হোটেলে ঢুকেছেন। বারোটা পাঁচে মরে পড়ে থাকতে দেখেছে পারুল।
পারুল কে? প্রশ্ন করে ইন্দ্রনাথ।
ঝি। মানে, ঘরদোর ঝটপাট দেয়।
টংগু লিনচানের আগের ইতিহাস?
খুব অল্পই পাওয়া গেছে। মিশুকে। সামাজিক। যদূর জানা গেছে, শত্রু নেই। আফ্রিকা থেকে যে জাহাজে ফিরেছেন, সে জাহাজেও শত্রু সৃষ্টির মতো কিছু করেননি। তবে হ্যাঁ, টংগু লিনচান নাম্বার ওয়ান লেডি কিলার। বউকে ডাইভোর্স করার আগে থেকেই লটঘট ছিল একটা মেয়ের সঙ্গে। কারবারের নাম করে নাকি তাকে নিয়েই পালিয়েছিলেন আফ্রিকায়। ফেরবার সময়ে ভদ্রমহিলাকে ফেলে এসেছেন। কলকাতাতেও তার এক প্রেয়সী আছে।
কাকে সন্দেহ হয়?
চিন্তাচ্ছন্ন চোখে বর্মী পর্যটকদের মৃতদেহর দিকে তাকিয়ে বলল জয়ন্ত–আজ সকালেই টংগু লিনচানের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল তার কলকাতার প্রেয়সী। নাম, ভায়োলেট অ্যালক্যাটরা। ভায়োলট চাকরি বাকরি করে না–অথচ ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের ফ্ল্যাটে রানির হালে থাকে। টংগু যখন ঢাকায়, তখন একবার এসে খোঁজ করে গেছিল ভায়োলেট। এনকোয়ারী কাউন্টারে খোঁজ নিয়ে জেনেছিল আজ সকালেই মিঃ লিনচানের ফেরার কথা। তাই ভায়োলেট এসেছিল এগোরোটা পাঁচে। রুম নাম্বার নীচ থেকে নিয়ে লিফটে করে উঠেছিল তিন তলায়। কখন বেরিয়ে গেছে কেউ জানে । দরজায় টোকা মেরে কারো সাড়া না পেয়ে চলে যায় ভায়োলেট। বাইরেও অপেক্ষা করেনি। টংগু লিনচানের সঙ্গে নাকি তার দেখাও হয়নি।
ঠিক এই সময়ে মৃতদেহের চুলের ডগা থেকে নখের ডগা পর্যন্ত তীক্ষ্ণদৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে খাটের কিনারায় বসে পড়ল কবিতা।
সবিস্ময়ে লক্ষ্য করলাম চাপা উল্লাসের রোশনাই ওর তমালকালো দুই চোখে। তবে কি…তবে কি সূত্রের সন্ধান পেয়েছে কবিতা?
নিরীহ কণ্ঠে বলল ইন্দ্রনাথ–পা টন্ করছে বুঝি? কর্ণপাত না করে জয়ন্তকে জিগ্যেস করল কবিতা–বউ কী বলে?
বউ? টংগু যে আফ্রিকা থেকে ফিরে এসেছেন, তাই নাকি সে জানে না–দেখা হওয়া তো দূরের কথা। সকালে চৌরঙ্গিতে গেছিল সিনেমার টিকিট কিনতে।
গিন্নির তৎপরতায় আমার জড়তাও অন্তর্ধান করেছিল। জয়ন্তর কথা শুনতে শুনতে সন্ধানী চোখ বুলোচ্ছিলাম ঘরের এ-কোণ থেকে সে-কোণে–হঠাৎ পাওয়া কোনও সূত্রের আশায়।
ঘরটা আর পাঁচটা প্রথম শ্রেণির হোটেল ঘরের মতোই। বৈশিষ্ট্যহীন। সিঙ্গলবেড। ওয়ার্ডরোব। কাঁচের দেরাজ। নাইট টেবিল। চিঠি লেখার ডে। আর চেয়ার। স্রেফ ঘর সাজানোর জন্যে ডামি ফায়ারপ্লেস।–ওপরের তাকে টাইমপিস আর একারি বিভিন্ন স্বাদের ইংরেজি নভেল।
মৃতদেহের পাশে নতজানু হয়ে বসে পড়ল ইন্দ্রনাথ। ঘাড়খানা সারস পাখির মতো বাড়িয়ে ঝুঁকে পড়ল লম্বোদয়। তাই দেখে চেয়ারে বসতে বসতে ফিক করে হেসে ফেলল জয়ন্ত চৌধুরী।
মৃতদেহটাকে চিৎ করে শুইয়ে দিল ইন্দ্রনাথ। রাইগর মার্টিসে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তখন আড়ষ্ট হয়ে উঠেছে। হিমকঠিন দেহ আর পোশাকের ওপর দ্রুত হাত চালিয়ে নিয়ে বলল–বউদি, মৃগ, লম্বোদরবাবু। শুরু করা যাক এবার। বউদি, তুমিই আগে বলো। বলো কী দেখেছ?
টপ করে খাট থেকে লাফ দিয়ে নেমে এল কবি। বোঁ করে এক চক্কর ঘুরে এল লাশটাকে।
ইন্দ্রনাথ সকৌতুকে বললে–ব্যাপার কী? এখনও কিছু চোখে পড়ল না? এতদিন কি বৃথাই গপপো শোনালাম তোমাকে?
লাল ঠোঁটে টুক করে জিভ বুলিয়ে নিয়ে রুদ্ধশ্বাসে বললে কবিতা–দেখছি পুরোদস্তুর বিলিতি পোশাক পরার অভ্যেস টংগু লিনচানের। পায়ে কার্পেট স্লিপার। আর হ্যাঁ–সিল্কের আন্ডারওয়্যার।
ঠিক, ঠিক। এ ছাড়াও আছে কালো সিল্কের মোজা আর গার্টার। কোট-প্যান্টে ওস্তাগরের নামও রয়েছে–ম্যাকিনসন্স, জোহানেসবার্গ। আর কী?
বাঁ-হাতে একটা রিস্টওয়াচ। আর…আর ঘড়ির কঁচটা চিড় খেয়ে গেছে। কাটা আর ঘুরছে না। দাঁড়িয়ে গেছে ১১-৫০ মিনিটের ঘরে।
চমকার! চমৎকার! জয়ন্ত, ডাক্তার কী বলে?
টংগু লিনচান মারা গেছেন এগারোটা থেকে সাড়ে এগারোটার মধ্যে। আমার মনে হয়—
জ্বলজ্বলে চোখে বলে উঠল কবিতা–তার মানে কি এই নয় যে–
ধীরে, ধীরে, বউদি। যদি কিছু মাথায় এসে থাকে, তবে তা মাথার মধ্যেই রাখো। ঝট করে সিদ্ধান্তে পৌঁছনো ভালো গোয়েন্দার লক্ষণ নয়। ব্যস, এবার তোমার ছুটি। লম্বোদরবাবু, আপনি কী দেখলেন?
কপাল কুঁচকে হাতঘড়ির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল লম্বোদরবাবু। চওড়া চামড়ার ব্যান্ডওলা পুরনো মডেলের হাতঘড়ি। তারপর বললে চিন্তাচ্ছন্ন কণ্ঠে–পুরুষের ঘড়ি। পড়ে গিয়ে ধাক্কা লাগার ফলেই কাঁটা আর নড়ছে না। চামড়ার ব্যান্ডের দ্বিতীয় গর্তে একটা খাঁজ দেখা যাচ্ছে–বা আঁটা রয়েছে এই গর্তেই। কিন্তু এছাড়াও দেখছি আরও একটা খাঁজ–আরও গভীর দাগ–তৃতীয় গর্তে
সাবাস! সাবাস লম্বোদরবাবু! তারপর?
বাঁ-হাতে ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়েছিল–সে রক্ত এখন শুকিয়ে গেছে। বাঁ-হাতের তালুতেও রক্ত লেগেছিল–কিন্তু দাগটা অনেক আবছা, যেন রক্তমাখা তালু দিয়ে কিছু আঁকড়ে ধরেছিলেন টংগু লিনচান, তাই বেশির ভাগই মুছে গেছে তালু থেকে। একটু খুঁজলেই এই ঘরেই পাওয়া যাবে জিনিসটা–টংগু লিনচানের হাতের ছাপও রয়েছে তাতে।
লম্বোদরবাবু, আপনার মতো অ্যাপ্রেন্টিস পাওয়ায় আমি গর্বিত। ওহে, জয়ন্ত, রক্তমাখা হাতের ছাপ লাগা কিছু পেয়েছ ধারে কাছে?
জয়ন্তর মুখের হাসি মিলিয়ে গেছিল। তীক্ষ্ণচোখে বলল–এক্সেলেন্ট। কিন্তু রক্তের দাগ লাগা সে-রকম কিছু তো পাইনি। কার্পেটেও তেমন ছাপ নেই। খুব সম্ভব হত্যাকারী তা সঙ্গে করেই নিয়ে গেছে।
কপাল কুঁচকে ইন্দ্রনাথ বলল–তুমি পরীক্ষক, পরীক্ষার্থী নয়। কাজেই আর ইঙ্গিত দিও না। মৃগ, তোমার কিছু বলার আছে?
তাড়াতাড়ি বললাম–মাথার ক্ষত দেখে মনে হচ্ছে ভারী কিছু দিয়ে বেশ কয়েকবার চোট মারা হয়েছে। বিছানার চাদরের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে ধস্তাধস্তিও হয়েছিল। আর মুখটা
বটে! বটে! বটে! মুখটাও লক্ষ্য করে ফেলেছ? বলো দেখি কি দেখছ?
সদ্য দাড়ি গোঁফ কামানো। গালে আর চিবুকে এখনও লেগে রয়েছে ট্যালকম পাউডার। বাথরুমটায় চোখ বুলোলে হত না?
কাচুমাচু মুখে কবিতা বললে–মুখটা আমিও লক্ষ্য করেছিলাম ঠাকুরপো। কিন্তু কথাই বলতে দিল না…পাউডারটা লাগানো হয়েছে মসৃণভাবে। কোথাও বেশি, কোথাও কম নয়।
লাফিয়ে উঠে বলল ইন্দ্রনাথ-বউদি, তোমার শার্লক হোমস্ হওয়া রোখে কে। জয়ন্ত, অস্ত্র পাওয়া গেছে?
পাথরের ভারী হাতুড়ি। এক্সপার্টের মতে, আফ্রিকান কিউরিও। বেজায় ভারী, কিন্তু এবড়ো খেবড়ো পাথর। খুব সম্ভব টংগু লিনচানের ব্যাগের মধ্যেই ছিল হাতুড়িটা–ট্রাঙ্ক তো এখনো এয়ারপোর্ট থেকে এসে পৌঁছয়নি।
ইন্দ্রনাথ আর কিছু বলল না। আনমনা চোখে তাকিয়ে রইল শয্যার দিকে। রেক্সিনের ট্র্যাভেলিং ব্যাগটা খাটের ওপরেই বসানো ছিল। পাশেই চারকোল গ্রে কালারের ইভনিং স্যুট–পরিপাটি ভাবে ভাঁজ করা কোট আর ট্রাউজার্স। সাদা শার্ট। হাতের বোতাম। সাদা সিল্কের রুমাল। খাটের তলায় দুজোড়া কালো বুট। এত জিনিস দেখেও যেন সন্তুষ্ট হতে পারল না ইন্দ্রনাথ। বার বার চোখ বুলোতে লাগল ঘরের অন্যান্য জিনিসগুলোর ওপর। অশান্ত চোখ। যেন কিছু একটা খচ খচ করছে বুকের মধ্যে। খাটের পাশেই চেয়ারে পড়ে একটা ময়লা শার্ট, একজোড়া ময়লা মোজা, ময়লা গেঞ্জি আর আন্ডারওয়্যার–কিন্তু রক্তের ছিটেফোঁটাও নেই ময়লা জামা কাপড়ে। চিন্তান্বিত ললাটে কার্পেটের দিকে তাকিয়ে রইল ইন্দ্রনাথ।
জয়ন্ত বললে–হাতুড়িটা আমরা নিয়ে গেছি। রক্তে আর চুলে মাখামাখি হয়েছিল বলেই এক্সপার্টরা..আঙুলের ছাপ কিন্তু কোথাও পাওয়া যায়নি। যেখানে খুশি হাত দিতে পারো। সব কিছুরই ছবি তোলা হয়ে গেছে, আঙুলের ছাপও খোঁজা হয়েছে।
নিরুত্তরে একটা কাচি ধরাল ইন্দ্রনাথ। আমি আর লম্বোদরবাবু হাঁটু গেড়ে বসে পড়লাম মৃতব্যক্তির পাশে। দুজনেরই উদ্দেশ্য রিস্টওয়াচটা আরো ভালোভাবে দেখা। কবিতা দেখলাম আঠার মতো লেগে রয়েছে ইন্দ্রনাথের পেছনে।
লম্বোদরের উৎসাহ একটু বেশি। তাই ঝটিতি কব্জি থেকে ঘড়িটা খুলে নিয়ে খুটখাট শুরু করে দিলে পেছনের ডালাটা নিয়ে এবং কি কৌশলে জানি না অচিরেই খুট করে খুলে ফেললে ডালাটা। সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল সোল্লাসে–পেয়েছি! পেয়েছি!
ডালার পেছনে খানিকটা সাদা কাগজের ছিন্ন অংশ আঠা দিয়ে সাঁটা। যেন কিছু একটা টান মেরে ছিঁড়ে নেওয়া হয়েছে সেখান থেকে।
তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বললে লম্বোদরবাবু–একটা আইডিয়া মাথায় এসেছে। বলেই একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল টংগু লিনচানের নিষ্প্রাণ মুখের দিকে। সন্ধানী চোখে কি যেন খুঁজতে লাগল।
মৃগ তুমি? বলল ইন্দ্রনাথ।
ইন্দ্রনাথের মেস থেকে বেরুবার সময় তাক থেকে ওরই আতসকাঁচটা নিয়ে এসেছিলাম। এখন তা বার করে ঘড়িটা উল্টেপাল্টে দেখতে দেখতে বললাম–এখন কিছুই বলব না। তবে ঘড়িটা আমার বন্ধুর ল্যাবরেটরিতে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করার অনুমতি দিলে ভালো হয়।
ইন্দ্রনাথ জয়ন্তর দিকে তাকাতেই জয়ন্ত ঘাড় নেড়ে সায় দিলে। ইন্দ্রনাথ বললে–নিতে পারো। জয়ন্ত, ঘর, ফায়ারপ্লেস, বাথরুম–সমস্ত তন্ন তন্ন করে সার্চ করা হয়েছে কি?
আঙুল মটকাতে মটকাতে জয়ন্ত বললে–দেখছিলাম কখন তুমি প্রশ্নটা করো। ফায়ারপ্লেসে দারুণ ইন্টারেস্টিং কয়েকটা জিনিস পাওয়া গেছে।
ফায়ারপ্লেসের সামনে গিয়ে দাঁড়াল ইন্দ্রনাথ। ডামি ফায়ারপ্লেস। আগুন কস্মিনকালেও জ্বলে না–শুধু ইউরোপীয় পরিবেশ সৃষ্টির জন্যই তা নির্মিত। কিন্তু এ হেন চুল্লিতেই জমে খানিকটা ছাই। এবং সে ছাই অতি বিচিত্র ছাই–কেন না তা কাঠের নয়, কয়লার নয়, এমনকী কাগজেরও নয়।
যকের ধন প্রাপ্তির আশা নিয়ে ছাইয়ের গাদা খোঁচাতে শুরু করল ইন্দ্রনাথ রুদ্র এবং কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বিচিত্র ভস্মস্তূপের মধ্যে আবিষ্কৃত হল বিচিত্রতর দশটি বস্তু।
অদ্ভুত দশটি বস্তু। ছাইয়ের গাদায় থেকে তারা ভস্মাচ্ছাদিত। তবুও চিনতে অসুবিধে হল না। আটটা চ্যাপ্টা ঝিনুকের বোতাম আর দুটো অদ্ভুত-দর্শন ধাতব বস্তু। একটা তিনকোণা, অনেকটা চোখের আকারে। আরেকটা আঁকশির মতো। দুটোরই আকার খুব ছোট এবং দুটোই খাদ মিশানো কোনও সস্তা ধাতুতে তৈরি। আটটা ঝিনুকের বোতামের মধ্যে দুটো অপেক্ষাকৃত বড়। প্রতিটি বোতামের কিনারায় পল তোলা এবং কেন্দ্রে সুতো গলানোর চারটি ছিদ্র।
দশটি বস্তুই কিন্তু আগুনে ঝলসানো।
বিড়বিড় করে বলল জয়ন্ত–ইন্দ্রনাথ, এই দশটা জিনিস নিয়ে ভাবতে ভাবতেই আমার মাথা ধরে গেল, কিন্তু সুরাহা হল না।
নীরবে পোড়া বোতাম, তেকোণা ধাতু আর আঁকশি নাড়াচাড়া করতে করতে ইন্দ্রনাথ জিগ্যেস করলে–ফায়ারপ্লেস শেষবার কে সাফ করেছে খোঁজ নিয়েছ?
নিয়েছি। পারুলই সাফ করেছে।
কখন?
আজ সকালে সাতটার একটু পরেই। সাতটার সময়ে একজন বোর্ডার ঘর ছেড়ে দেয়। তাই টংগু লিনচান আসার আগেই ঘর সাফ করে দেয় পারুল।
নাইট টেবিলের ওপর বোতাম, আঁকশি আর তেকোণা ধাতুটা রেখে ট্রাভেলিং ব্যাগের ভেতরে দৃষ্টিনিক্ষেপ করল ইন্দ্রনাথ। ভেতরটা অত্যন্ত অগোছালো, যাচ্ছেতাইভাবে হাঁটকানো। চারটে লম্বা নেকটাই, দুটো ধোয়া সাদা শার্ট, মোজা, আন্ডারওয়্যার আর রুমাল ঠাসা ব্যাগের মধ্যে। প্রতিটি শার্ট আর আন্ডারওয়্যারের ওপর লেবেল আঁটা একই ওস্তাগরের–ম্যাকিনস, জোহানেসবার্গ।
দেখে শুনে বন্ধুবরের খিঁচড়ে যাওয়া মেজাজটা কিঞ্চিৎ শরিফ হল বলেই মনে হল। খুশি খুশি মুখে গিয়ে দাঁড়াল ওয়ার্ডরোবের সামনে। টুইডের ট্র্যাভেলিং স্যুট, আর বাদামি রঙের একটা কোট ছাড়া ভেতরে আর কিছুই নেই।
সশব্দে পাল্লাটা বন্ধ করে ঘুরে দাঁড়াল ইন্দ্রনাথ। সঞ্চরমান দৃষ্টি স্থির হল দেরাজের ওপরে। প্রথম তাকটা শূন্য। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ড্রয়ার খুলেও কিছু পাওয়া গেল না।
জয়ন্ত বললে–বৃথা খুঁজছ। জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখবারও সময় দেওয়া হয়নি মিঃ লিনচানকে। উঁহু, টেবিলেও কিছু নেই। যা আছে তা বাথরুমেই।
যেন এই কথাটুকুর জন্যেই অপেক্ষা করছিল কবিতা। জয়ন্তর কথা ফুরোতে না ফুরোতেই জ্যামুক্ত শায়কের মতো সাঁ করে ছুটে গেল বাথরুম লক্ষ্য করে। পেছন পেছন সমান বেগে ছিটকে গেল লম্বোদর লস্কর। অগত্যা আমিও পেছনে পড়ে থাকাটা বুদ্ধিমানের কাজ মনে করলাম না।
চৌকাঠে দাঁড়িয়ে ঠোঁটের কোণে আলগোছে একটা কাচি ঝুলিয়ে আমাদের কীর্তিকলাপ লক্ষ্য করতে লাগল ভারতের প্রথম কনসাল্টিং ডিটেকটিভ ইন্দ্রনাথ রুদ্র।
বেসিনের ওপর ভোলা রেক্সিনের টয়লেট-কিট। সাবান আর চুল লাগা আধোয়া সেফটি রেজরের পাশেই দাঁড় করানো ভিজে শেভিং বুরুশ। এক টিউব শেভিংক্রিম। ছোট্ট একটি ট্যালকম পাউডার আর এক টিউব টুথপেস্ট। কলের পাশেই গড়াগড়ি যাচ্ছে প্লাস্টিকের শেভিং বুরুশ রাখবার আধার–ঢাকনাটা পড়ে টয়লেট কিটের ওপর।
লম্বোদরবাবুর মুখটা লম্বা হয়ে গেল। নিরাশ কণ্ঠে বললে–কিসসু নেই এখানে।
আমি বললাম–সত্যিই তাই। শুধু বোঝা যাচ্ছে, দাড়ি কামানো শেষ হতে না হতেই খুন হয়ে গেছেন টংগুমশাই। সেটটা ধুয়ে রাখবারও সময় পাননি।
কবিতা কিন্তু কালো হিরের মতো ঝিকিমিকি চোখে বলল–তুমি কিগো, অন্ধ নাকি! বলেই গটগট করে বেরিয়ে গেল বাইরে। পেছনে লম্বোদর লস্কর।
বিমূঢ়ভাবে জিনিসগুলো আর একবার উল্টেপাল্টে দেখলাম। শেভিং বুরুশের ঢাকনা উল্টে দেখলাম ভেতর দিকে খাপে খাপে লাগানো এতটুকু একটা প্যাড। উল্লেখযোগ্য আর কিছুই না পেয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখলাম অপলক চোখে ঢাকনিটার দিকে তাকিয়ে ঘন ঘন সিগারেট ফুঁকছে ইন্দ্রনাথ রুদ্র।
বেডরুমে ফিরে এসে দেখি হোটেল ম্যানেজার পিটার ড্যানিয়েল হাত-মুখ নেড়ে তর্ক করছে জয়ন্তর সঙ্গে। মুখ টিপে জয়ন্ত শুনে যাচ্ছে।
পেছন পেছন ইন্দ্রনাথ এসে বললে–ব্যাপার কী? গোলমাল কীসের? চারদিকে ঢি ঢি পড়ে গেল যে। এদিকে সকাল থেকে স্টাফকে ধরে রেখেছেন আপনারা। নাইট শিফট আরম্ভ হতে চলল, বাড়ি যাওয়ার জন্য সব ছটফট করছে–আমারও সেই অবস্থা। অথচ আপনারা
মাঝপথেই ড্যানিয়েলকে থামিয়ে দিয়ে ইন্দ্রনাথ বলল–জয়ন্ত, তোমরা যা দেখবার দেখেছ। আমরাও দেখলাম। এখন আর খামোকা এঁদের হয়রান করে কোনও লাভ নেই।
অলরাইট মিঃ ড্যানিয়েল, আপনারা যেতে পারেন। বললে জয়ন্ত।
পিটার ড্যালিয়েল উধাও হতেই ইন্দ্রনাথ ফিরে দাঁড়াল আমাদের দিকে। হিরো-হিরো কায়দায় একমুখ ধোয়া ছেড়ে বললে–লম্বোদরবাবু কিছু বলবেন?
আমার একটা ঠিকানা চাই।
ফস করে কবিতা বলে উঠল–আরে, আমিও তো তা চাই।
আমি বললাম–আমি চাই এমন একটা জিনিস যা এই হোটেলেই আছে।
বেশ তো, স্মিত মুখে বলল ইন্দ্রনাথ। তোমাদের যা যা দরকার, একতলায় সার্জেন্ট অচল দত্তের কাছে চেয়ে নাও। তারপর দু-ঘণ্টা সময় দিলাম। দু-ঘণ্টা পরে সন্ধে সাড়ে ছটার সময়ে আমার মেসে এসে দেখা করো। দেখা যাক কার দৌড় কদ্দূর পর্যন্ত।
সবার আগে ঘর থেকে বেরুল কবিতা এবং সবার শেষে আমি। বেরুতে বেরুতে শুনলাম ইন্দ্রনাথ বলছে–ওহে জয়ন্ত, তোমার সঙ্গে আমার কিছু সিরিয়াস আলোচনা আছে।
দু-ঘণ্টা পর। ইন্দ্রনাথের মেস। সেই ভাঙা তক্তপোষ, নড়বড়ে চেয়ার আর টেবিল।
কলের পুতুলের মতোই এতক্ষণ চা-বিস্কুট খাচ্ছিল লম্বোদবাবু আর কবিতা। আমি মৌনীবাবা হয়ে গেছিলাম সাময়িকভাবে।
একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে ইন্দ্রনাথ বললে–আর দেরি কেন? লম্বোদরবাবু, বলুন আপনার সিদ্ধান্ত।
শুধু সিদ্ধান্তই নয় ইন্দ্রনাথবাবু, তার চেয়েও এক কাঠি এগিয়েছি আমি।
যথা?
সমাধানে পৌঁছেছি।
তাই নাকি! তাই নাকি! কীভাবে পৌঁছলেন বলুন তো?
আমার একমাত্র সূত্র হল রিস্টওয়াচটা। চামড়ার ব্যান্ডে দুটো দাগ। যে দাগটা সবচাইতে কম গভীর–সেই দাগেই ঘড়ি পরে আছেন টংগু লিনচান। এই থেকেই সিদ্ধান্তে পৌঁছলাম যে ঘড়িটা আসলে তাঁর নয়।
তবে কার?
হত্যাকারীর।
কিন্তু অকুস্থলে হত্যাকারী নিজের ঘড়ি ফেলে যাবে কেন?
পুলিশকে বিপথে চালনা করার জন্যে। ডাক্তার বলছেন, মিঃ লিনচান মারা গেছেন এগারোটা থেকে এগারোটা তিরিশ মিনিটের মধ্যে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ঘড়ির কাটা দাঁড়িয়ে গেছে এগারোটা পঞ্চাশ মিনিটে। কেন?
কেন?
কারণ, হত্যাকারী খুন করার সময়টা ইচ্ছে করেই এগিয়ে দিতে চেয়েছে। অথচ নিহতর হাতে ঘড়ি নেই। তাই নিজের হাতের ঘড়ি খুলে আছড়ে মেরে কাঁচ ফাটিয়েছে, কলকজা বিগড়েচে–
তারপর কাটা ঘুরিয়ে এগারোটা পঞ্চাশ মিনিটের ঘরে এনে পরিয়ে দিয়েছে মিঃ লিনচানের কব্জিতে। কিন্তু তার কব্জি মোটা অথচ হত্যাকারীর কব্জি সরু–তাই ব্যান্ডটা লাগল অন্য ঘাঁটিতে।
ব্রিলিয়ান্ট। কিন্তু এটা তো সমাধান হল না। হত্যাকারী কে?
হত্যাকারী একজন স্ত্রীলোক। তাই তার কব্জি সরু।
বটে! বটে। কিন্তু কে সে?
টংগু লিনচানের তালাক দেওয়া বউ। খুনের মোটিভ, গায়ের জ্বালা মিটানো।
শুনে নাকের ডগাটা সামান্য কুঁচকালো কবিতা। আমিও বিশেষ উৎসাহ বোধ করলাম না। দেখে শুনে মিইয়ে গেল লম্বোদর লস্কর। মিনমিনে স্বরে বললে–আরও প্রমাণ আছে।
আছে নাকি?
ঘড়ির পেছনের ডালায় ভেতর দিকে খানিকটা ছেঁড়া কাগজ লেগে ছিল। যেন টান মেরে কিছু ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। ঘড়ির ভেতরে একটি জিনিসই রাখার রেওয়াজ ছিল এককালে-ফটোগ্রাফ। টংগু লিনচানের ঘড়িতেও ছিল একটা ফটো এবং সে ফোটোতেই সম্ভবত ছিল হত্যাকারীর চেহারা। তাই যাবার সময়ে ছিঁড়ে নিয়ে গেছে ছবিটা। আমি রিপোর্টারের ছদ্মবেশে দেখা করলাম মিঃ লিনচানের আগের বউয়ের সঙ্গে। তার টেবিলেই একটা ফ্যামিলি অ্যালবাম দেখলাম। একটু নাড়াচাড়া করতেই পেলাম একটা ফটোগ্রাফ–একজন পুরুষ আর স্ত্রী পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। কিন্তু তাদের মুন্ডুদুটোই নেই–গোল করে কেটে ফটো থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে–রয়েছে শুধু ধড়। আর প্রমাণের দরকার আছে?
ঈষৎ দমে গিয়ে বললে ইন্দ্রনাথ–না, আর দরকার নেই। মৃগাঙ্ক, তোমার সিদ্ধান্ত?
লম্বোদরবাবুর মতো আমারও সূত্র ওই ঘড়ি, বললাম আমি। তবে ব্যান্ড নিয়ে অযথা মাথা ঘামাইনি। ঘামিয়েছি ঘড়ির শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ে।
ঘড়ির আবার শ্বাসপ্রশ্বাস! বলো কি হে?
ঘাবড়াও মৎ। জগদীশ বোসের থিওরি আওড়াচ্ছি না। তবে ঘড়িও নিশ্বেস নেয়, নিশ্বেস ছাড়ে।
ভারি ইন্টারেস্টিং ব্যাপার তো। রীতিমতো গবেষণা।
ঠাট্টা করো না। হাতের চামড়ায় ঘড়ি লেগে থাকার সময়ে গায়ের উত্তাপে ঘড়ির ভেতরকার বাতাসও গরম হয়ে প্রসারিত হয়ে যায়। আয়তনে বেড়ে যায়। আয়তনে বেড়ে যাওয়ার ফলে বাতাস পেরিয়ে যায় কাঁচের ফাঁক দিয়ে, ছোটখাটো চিড় দিয়ে। সেকেলে ঘড়ির ক্ষেত্রে এ জিনিসটা আরও বেশি দেখা যায়। টংগু লিনচানের ঘড়িও আধুনিক নয়।
বেশ।
ঘড়ি যখন হাত থেকে খুলে নামিয়ে রাখা হয়, তখন ভেতরের বাতাসও আবার ঠান্ডা হয়ে সঙ্কুচিত হয়। ফলে বাইরের বাতাস ফুটো কাঁচের ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়ে ভেতরে। সেই সঙ্গে বাতাসের ধুলোও পথ করে নেয় ভেতরে।
তারপর?
সেই কারণেই, রুটিওলার ঘড়িতে পাওয়া যায় ময়দার ধুলো, ইটের পাঁজার মালিকের ঘড়িতে জমে ইটের ধুলো। টংগু লিনচানের ঘড়িতে কি পেয়েছি জানো?
কী?
মেয়েদের ফেস-পাউডার।
বটে!
জানো তো, খুঁতখুঁতে মেয়েরা গায়ের রং মিলিয়ে ফেস পাউডার কেনে। ঘড়ির মধ্যে যে ফেস পাউডার পেলাম তা সাধারণত কালো মেয়েরাই ব্যবহার করে।
এবং সে কালো মেয়েটি কে? ইন্দ্রনাথের স্বর এবার তীক্ষ্ণ।
বুক ভরে বিশ্বাস নিয়ে সগর্বে বললাম–পারুল।
ভীষণ চমকে উঠল ইন্দ্রনাথ–পারুল কি হে?
কেন নয়? দুশ্চরিত্র টংগু লিনচান নিশ্চয় পারুলের গায়ে হাত দিতে গেছিল, তাই–
খুক খুক শব্দ শুনে দেখি মুখে শাড়ির খুঁট চাপা দিয়ে ওদিকে তাকিয়ে আছে কবিতা।
গরম হয়ে বললাম–এত হাসি কীসের?
জবাব দিলে ইন্দ্রনাথ। বলল–বউদি হাসছে পর্বতের মূষিক প্রসব দেখে। সাধে কি বলি গল্প লিখলে ঘিলু কমে যায়। আরে ব্রাদার, পারুলকে দেখে মনে হয় কি ফেস পাউডারের বিলাসিতা করার মতো সখ অথবা সাধ্য তার আছে? ঘড়ি পরা তো দূরের কথা। দূর, দূর। বউদি, তুমিই শুধু বাকি রইলে। শোনাও তোমার থিওরি।
সঙ্গে-সঙ্গে কবিতা বললে–ঘড়ির সূত্রটা কোনও সূত্রই নয়। এ নিয়ে এতটা সময় নষ্ট করা স্রেফ আহাম্মকি।
তেড়ে উঠে বললাম–বাজে কথা না বলে প্রমাণ করো এটা কোনও সূত্রই নয়।
করবই তো, সমান তেজে জবাব দিল কবিতা। পাকিস্তান সময় আর ভারতীয় সময়ের তফাতটা জানা আছে?
বিদ্রূপতরল কণ্ঠে বললাম–তার সঙ্গে খুনের সম্পর্ক কি?
কণ্ঠে ততোধিক শ্লেষ ঢেলে কবিতা বলল–সেইটাই তো একমাত্র সম্পর্ক। ঘড়িটা টংগু লিনচানেরই। ঢাকায় গিয়ে তিনি পাকিস্তানের ঘড়ির সঙ্গে সময় মিলিয়েছেন। কলকাতায় এসে এখানকার সময়ের সঙ্গে ঘড়ি মিলনোর ফুরসৎ পাননি। কে না জানে, ঢাকার সঙ্গে ইন্ডিয়ার সময়ের তফাত পুরো আধ ঘণ্টা। মানে, ঢাকায় যখন বারোটা, এখানে তখন সাড়ে এগারোটা।
মেশিনগানের মতো মোক্ষম যুক্তি বর্ষণে মুখ শুকিয়ে গেল আমার। লম্বোদরবাবুর মুখটা আবার লম্বা হয়ে গেল। আর ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হয়ে উঠল ইন্দ্রনাথের চোখ।
বলল–ক্যাপিটাল বউদি, ক্যাপিটাল। শার্লক হোমস হওয়ার যোগ্যতা একমাত্র তোমারই আছে। এ পর্যন্ত ঠিকই বললে, তারপর?
খুনি কে, তা আমি জানি। না, না টংগুর তালাক দেওয়া বউ নয়, পারুলও নয়। আগে শোনোই না। সবাই দেখেছ, মিঃ লিনচানের মুখের পাউডারের প্রলেপ। খুব মসৃণ প্রলেপ। গাল আর সেভিং সেটের অবস্থা দেখে জানা গেল খুন হওয়ার ঠিক আগেই দাড়ি কামিয়েছেন তিনি। ঠাকুরপো, দাড়ি কামানোর পর তুমিও পাউডার লাগাও।
লাগাই বই কি।
কীভাবে লাগাও?
এটা আবার কি প্রশ্ন?
বলোই না, কীভাবে লাগাও?
কেন আঙুল দিয়ে লাগাই।
ঠিক। আমার কর্তাটিরও সেই অভ্যেস। আশা করি, লম্বোদরবাবুরও। আসলে পুরুষমাত্রই গালে পাফ লাগানোর ধার ধারে না। তাই তারা আঙুলে করে পাউডার নিয়ে গালে ঘষে দেয়। ফলে জ্যাবড়া হয়ে কোথাও বেশি কোথাও কম ভাবে লেগে থাকে পাউডার। কিন্তু মেয়েরা পাফ ছাড়া পাউডার লাগায় না। তাই তাদের মুখে পাউডার অমন মোলায়েম ভাবে মাখানো থাকে। যেমন আমার। পাউডার মেখেছি বলে মনে হয়?
তা হচ্ছে বই কি–
হলেও তোমাদের মতো অত বিশ্রিভাবে মনে হয় না, ঝটিতি জবাব দিল কবিতা। টংগু লিনচানের মুখে কিন্তু যেভাবে পাউডার লাগানো হয়েছে, তা পাফ ছাড়া লাগানো সম্ভব নয়। কিন্তু তার ঘরে তন্নতন্ন করে খুঁজেও পাফ পাওয়া যায়নি।
এতক্ষণ রুদ্ধশ্বাসে শুনছিল ইন্দ্রনাথ। এবার যেন স্বস্তির নিঃশ্বেস ফেলে বললে–তাহলে বউদি, তুমি বলতে চাও যে, টুংগু লিনচানের দাড়ি কামানো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল একজন মেয়েছেলে, কামানো শেষ হলে আদর করে নিজের ভ্যানিটিব্যাগ খুলে পাউডারও মাখিয়ে দিলে ভদ্রলোককে এবং তার পরেই দমাস করে পাথরের হাতুড়ি মেরে গুঁড়িয়ে দিল মাথা। তাও কি সম্ভব?
ডাইভোর্স করা বউয়ের পক্ষে সম্ভব না হতে পারে, কিন্তু রক্ষিতার পক্ষে সম্ভব। একমাত্র তারাই আগের মুহূর্তে দেবী, পরের মুহূর্তে দানবী হতে পারে। টংগু লিনচানের কলকাত্তাই প্রেয়সী ভায়োলেট অ্যালক্যাটরার সঙ্গে ঘন্টাখানেক আগেই দেখা করে এসেছি আমি। জ্ঞানপাপী তো, তাই কিছুতেই স্বীকার করতে চাইল না যে টংগু লিনচানকে পাউডার মাখিয়ে এসেছে আজ সকালে।
পোড়া সিগারেটটা টোকা মেরে জানলাপথে উধাও করে দিয়ে ইন্দ্রনাথ বললে–তোমরা তিনজনেই মৌলিকতার পরিচয় দিয়েছ। প্রত্যেকেই নিজের নিজের যুক্তি অনুযায়ী নিজস্ব থিওরি গড়ে নিয়েছ। সেজন্যে আরিফ করছি তিনজনকেই। তবে কি জানো
কী? সমস্বরে জিগ্যেস করি আমরা।
তোমরা তিনজনেই ভুল করেছ।
কিছুক্ষণ সব চুপ।
তারপর, শাড়ির খুঁট আঙুলে পাকাতে পাকাতে বাঁকা সুরে কবিতা বলে উঠল–তোমার মতো দেমাকি মানুষের কাছ থেকে ঠিক এই কথাটাই শোনার আশায় ছিলাম এতক্ষণ।
আরে! আরে! আবার সেই মেয়েলি অভিমান। ঠোঁট না ফুলিয়ে আমার দুটো কথা যদি দয়া করে শ্রবণ করো, তাহলেই বুঝবে কেন বললাম তিনজনেই ভুল করেছ।
ভণিতা না করে বললেই হয়।
তোমরা তিনজনেই সেই একই ভুল করেছ। অর্থাৎ, চোখ-কান খোলা রেখে নতুন নতুন সূত্রকে কাজে না লাগিয়ে আগে থেকেই গড়ে নেওয়া থিওরিকেই খাড়া করার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করেছ। একই সূত্র ধরে একই যুক্তির পথ বেয়ে প্রত্যেকেই চোখ-কান বুজে দৌড়েছ নিজের নিজের সিদ্ধান্তের দিকে। আশপাশে তাকাওনি। তাই ফেল করলে শোচনীয় ভাবে।
লম্বোদরবাবু, আপনার থিওরি ঝুলছে একটি মাত্র সুতোর ওপর–গোল করে কেটে নেওয়া ফটো। কিন্তু সেটা তো নেহাতই কাকতালীয় হতে পারে। এর বশে তো কোনও ভদ্রমহিলাকে খুনি সাব্যস্ত করা যায় না। যায় কি? অসম্ভব।
মৃগাঙ্ক, তুমি যে এমন আনাড়ির মতো থিওরি খাড়া করবে, আশা করিনি। রং মিলিয়ে ফেস পাউডার ব্যবহার করা অথবা হাতে রিস্টওয়াচ পরা পারুল কেন, বাংলাদেশের ঝি-শ্রেণির কোনও মেয়ের পক্ষেই সম্ভব নয়।
আশা ছিল বউদির ওপর। ঢাকার সময়ের সঙ্গে ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ড টাইমের প্রভেদটুকু পর্যন্ত তুমি দিব্বি বললে। ভয় হয়েছিল, হয়তো টেক্কা মারবে আমার ওপর। কিন্তু যে বনেদের ওপর তোমার থিওরি খাড়া করলে, গোড়ায় গদল রয়ে গেল সেইখানেই। তুমি বলছ, পাফ দিয়ে পাউডার মেখেছেন টংগু লিনচান, অথচ ঘরে পাফ নেই। কিন্তু আমি বলব আছে।
কোথায়?
শেভিং ব্রাশ রাখার প্লাস্টিক কৌটোটা দেখেছ?
দেখেছি।
তার ক্যাপটা?
দেখেছি।
দেখোনি। দেখলে পাফটা দেখতে পেতে। ভেতর দিকে ছোট্ট একটা মখমলের পাফ লাগানো ছিল আগে থেকেই–টয়লেট-কিট যারা তৈরি করেছে, তারাই লাগিয়ে দিয়েছে। সুতরাং বউদি, অতীব দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, খুনির কাছাকাছি এসেও পাশ কাটিয়ে গেলে সব চাইতে মজার ব্যাপার, তিনজনেই খুনি সাব্যস্ত করলে একজন স্ত্রীলোককে। অথচ আমার হিসেব অনুযায়ী হত্যাকারী একজন পুরুষ।
প্রমাণ? বন্দুকের বুলেটের মতো প্রশ্ন নিক্ষেপ করলাম আমি।
সামনেই ছিল। কিন্তু চোখের ব্যবহার করোনি–প্রত্যেকেই আগে থেকেই ভেবে নেওয়া সিদ্ধান্তকে কায়েমি করার মতলবে অমন চোখে আঙুল দেওয়া প্রমাণ দেখেও দেখোনি। আমি আটটা ঝিনুকের বোতাম আর ধাতুর টুকরো দুটোর কথা বলছি।
যে ফায়ারপ্লেসে কখনো আগুন জ্বলে না, সেখানে খানিকটা ছাই পড়ে। টংগু লিনচান নিশ্চয় হাত-পা ছড়িয়ে বসার আগে কিছু পোড়ানোর জন্যে ব্যস্ত হননি। তবে কাজটা কার? নিশ্চয়ই হত্যাকারীর। আগুন জ্বালিয়ে প্রমাণ নিশ্চিহ্ন করার অপচেষ্টা। ছাইটা কাগজের নয়, কাঠের নয়, কয়লার নয়। ছাইয়ের গাদায় পড়ে আটটা পোড়া বোতাম। ছটা ছোট, দুটো বড়। পৃথিবীতে একটিমাত্র জিনিসই আছে যার মধ্যে থাকে এই আটটা বস্তু। শার্ট। ওপেন ব্রেস্ট ফুলশার্টের সামনে থাকে ছটা ছোট বোতাম আর দু-হাতায় দুটো বড় বোতাম। ছাইটা কাপড়ের। অর্থাৎ ফায়ারপ্লেসে কেউ একটা ফুলশার্ট পুড়িয়েছে–পোড়াবার সময়ে খেয়ালই ছিল না যে ঝিনুকের বোতাম আগুনকেও কদলী প্রদর্শন করতে পারে।
এবার ধাতুর জিনিস দুটো। একটা তেকোণা আর একটা আঁকশি। ওপেনব্রেস্ট ফুলশার্ট যে পরে, সে টাউজার্স পরে। আর টাউজার্স যে পরে, সাধারণত সে টাই পরে। ধাতুর জিনিস দুটোও এসেছে বো-টাই থেকে। রেডিমেড বো-টাই বাজারে কিনতে পাওয়া যায় কিনলে বোবাঁধার ঝাট পোহাতে হয় না।
লম্বোদরবাবু, আপনি বললেন বটে, টংগু লিনচান রক্তমাখা হাতে কিছু একটা আঁকড়ে ধরেছিলেন। কিন্তু সেটা যে হত্যাকারীর শার্ট হতে পারে, তা বললেন না। বিছানার চাদর দেখেই তো বোঝা যায় ধস্তাধস্তি হয়েছে। মাথায় প্রথম বাড়ি খেয়ে লড়েছেন মিঃ লিনচান, খামচে ধরেছিলেন হত্যাকারীর শার্ট আর বো-টাই। কিন্তু তবুও প্রাণে বাঁচেননি।
লুটিয়ে পড়লেন মিঃ লিনচান। এদিকে হত্যাকারী পড়ল বিপদে। রক্তমাখা শার্ট আর বো-টাই নিয়ে বেরোনো যায় কী করে? হত্যাকারী যদি হোটেলের বাইরের লোক হত অথবা হোটেলের বোর্ডার হত, তাহলে কোটের কলার তুলে বো-টাই ঢেকে বেরিয়ে গেলেই কারো সন্দেহ হত না। বে-টাই যে পরে, সে কোটও পরে। কিন্তু তা না করে হত্যাকারী রক্তমাখা শার্ট আর বো-টাই আগুনে পুড়িয়ে মিঃ লিনচানের ব্যাগ হাঁটকে সাদা শার্ট আর বো-টাই পরে বেরিয়ে গেছে। এইজন্যেই ব্যাগের মধ্যে লম্বা নেকটাই পাওয়া গেছে। কিন্তু বো-টাই পাওয়া যায়নি। ইভনিং সুটের পাশেও তা ছিল না।
হত্যাকারী তাহলে বাইরের লোক নয়, বোর্ডারও নয়। তাহলে কি হোটেলেরই কর্মচারী? নিশ্চয়ই তাই। কেননা, কর্তব্যরত অবস্থায় রাঁদেভু হোটেলের প্রত্যেকেই ফিটফাট থাকতে হয়। ডিউটি ছেড়ে কোথাও যাওয়াও সম্ভব নয়। তাই নিজের শার্ট আর বো-টাই পুড়িয়ে পরের শার্ট আর বো-টাই পরে ফিরে যেতে হয়েছে তাকে ডিউটিতে।
আমরা যখন তদন্ত করছি, হত্যাকারী তখন হোটেলেই অন ডিউটিতে রয়েছে। পরনে আছে সাদা শার্ট আর কালো অথবা সাদা বো-টাই। খুব সম্ভব কালো। কিন্তু আমরা দেখেছি রাঁদেভু হোটেলের প্রত্যেক কর্মচারীর শার্টের রং ধূসর, টাইয়ের রং ধূসর। শুধু একজনের বাদে…হোটেলে ঢুকেই তফাতটা নিশ্চয় লক্ষ করেছিলে?
করোনি? অন্ধ অন্ধ, তোমরা তিনজনেই চোখ থেকেও অন্ধ। যাকগে, তোমরা বিদেয় হতেই জয়ন্তকে নিয়ে সেই একজনকে জেরা করতেই সব ফাঁস হয়ে গেল। তারপর শার্ট পরীক্ষা করতেই পাওয়া গেল সেই একই ওস্তাগরের লেবেল–ম্যাকিনস, জোহানেসবার্গ অর্থাৎ সাউথ আফ্রিকায় তৈরি জামা যেখানে বছরখানেক থেকে এসেছেন টংগু লিনচান কিন্তু আমাদের সন্দেহভাজন ব্যক্তিটি যে দেশে জীবনে যায়নি।
তিন মিনিটের মধ্যেই সবকিছু স্বীকার করে বসল হত্যাকারী। অনেক দিন আগেই তার বউকেই ভাগিয়ে নিয়ে গেছিলেন টংগু লিনচান, তারপর প্রয়োজন ফুরোতেই ছেঁড়া ন্যাকড়ার মতো ফেলে এসেছেন। হপ্তাখানেক আগে রাঁদেভু হোটেলে নাম লিখতেই হত্যাকারী তাকে চিনেছে এবং প্রতিশোধ নেওয়ার প্ল্যান এঁটেছে। আজ সকালে ঢাকা থেকে ফিরতে না ফিরতেই হাতুড়ি পেটা করে যমালয়ে পাঠিয়ে শোধ নিয়েছে স্ত্রী-হরণের।
আলোকিত চোখে বললাম–হত্যাকারী তাহলে–
হোটেল ম্যানেজার মিঃ পিটার ড্যানিয়েল, বলে কাচির প্যাকেট হাতড়াতে লাগল ইন্দ্রনাথ রুদ্র। * সিনেমা জগৎ (জুন, ১৯৬৯) পত্রিকায় প্রকাশিত।
আদুরে খোকা
রাত তখন দুটো।
টেলিফোন এল শিকাগোর সীমানা ঘাঁটি থেকে। রাইটউড অ্যাভিন্যুতে ছোট্ট একটা পানাগারে এইমাত্র একটা রাহাজানি হয়ে গেল। টেলিফোনেই ঘটনাটার খুঁটিনাটি বিবরণ শুনলাম কর্তব্যরত সার্জেন্টের কাছ থেকে।
জায়গাটা শহরের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে। কাজেই চট করে একটা গাড়ি নিয়ে ঝটিতি পৌঁছে গেলাম অকুস্থলে। গিয়েই দেখা হয়ে গেল মার্টিন চৌয়ানস্কির সঙ্গে। দারুণ উত্তেজনায় প্রায় লাফাচ্ছিলেন ভদ্রলোক। ধড়ে যে তখনও প্রাণটা রয়ে গেছে, এ জন্যেও আনন্দের অবধি ছিল না তার। ভয়ে প্রাণ উড়ে গিয়েছিল ভদ্রলোকের এবং সেই বৃত্তান্তই আমাকে বলতে পেরে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।
দুটো বাজতে তখনও দশ মিনিট বাকি। দোকান বন্ধ করব করব ভাবছি, এমন সময়ে একটা লোক এসে হাজির। লোকটাকে আমি চিনিই না। ঠিক বন্ধের মুখে হুট করে আসার জন্যে মেজাজ খিঁচড়ে গেল আমার। তাই সাফ বলে দিলাম, চটপট এক ঢোক গিলেই বিদেয় হতে হবে। খদ্দের বেশি ছিল না তখন। কপোত-কপোতীর মতো একটি যুগল মূর্তি আর মের্ডাড বসাকি। মেডার্ড বসাকিকে তো আপনি চেনেনই। উনিও তো পুলিশ অফিসার। আজ রাতে ওঁর কোনও ডিউটি ছিল না।
লোকটাকে জিগ্যেস করলাম কী ধরনের সুরা তাকে দেব। কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর-টুত্তর দিয়ে ফস করে এক জোড়া রিভলভার বার করে আমার দিকে তাগ করে ধরল সে। আর তার পরেই এক হুঙ্কার–টাকাগুলো বার করে দিলে কীরকম হয়?
শুনেই বসাতি হাত বাড়ালেন তাঁর রিভলভারের দিকে। লোকটা কিন্তু ভারী হুঁশিয়ার। সঙ্গে সঙ্গে যেন কিছু হয়নি এমনি সবে বলে উঠল–আপনি বরং ওটা টেবিলের ওপরেই রেখে দিন। তা না হলে আজ রাতেই একজনকে অক্কা পেতে হবে।
আমিই বললাম বসাকিকে–শুনুন শুনুন, রিভলভারটা সরিয়েই রাখুন। আমি চাই না খামোকা একটা খুনোখুনি হয়ে যাক এখানে। নগদ যত টাকা আছে তা না হয় ওকে দিয়ে দিচ্ছি আমি।
কথা শুনলেন বসাকি। গোঁয়ার্তুমি করলেন না। বাস্তবিকই, আমাকে অথবা অন্য কাউকে বিপদে ফেলার ইচ্ছে তো ওঁর ছিল না।
বন্দুকধারী এবার বসাকিকেই উদ্দেশ্য করে বললেন,–ভালো মানুষের মতো রিভলভারটা আমার দিকে ঠেলে এগিয়ে দিন দিকি মশাই। কথার সঙ্গে সঙ্গে ক্লিক করে শব্দ হল দুটো রিভলভারেরই।
প্রথম থেকেই লক্ষ্য করলাম লোকটা একেবারেই নিরুত্তেজ, নিরুদ্বেগ, আর সংহত। বসাকি রিভলভারটা বারের টেবিলের ওপর দিয়ে ঠেলে এগিয়ে দিলে পর নির্বিকারভাবে লোকটা তা তুলে নিয়ে গুঁজে রাখল পকেটে। তারপর আমাকে লক্ষ্য করে বললে–এবার স্মার্ট ছেলের মতো চটপট টাকা কড়িগুলো বার করে দিন তো। সবুজ রঙের যা কিছু নোট-ফোট আছে, তাই দিন। খুচরা নিয়ে মাথা ঘামাবেন না।
বাক্যব্যয় না করে কড়কড়ে ষাটটা ডলার তুলে দিলাম লোকটার হাতে। টাকাটা পকেটস্থ করেই এক দৌড়ে চোখের আড়াল হয়ে গেল সে।
বসাকি এরপর এক মুহূর্তের বেশি সবুর করেননি। কিন্তু আততায়ী তার চাইতে অনেক বেশি ক্ষিপ্র। কাজেই পথে বেরিয়ে লোকটার টিকিও দেখতে পাননি বসাকি। রাস্তায় শুধু তাল তাল অন্ধকারই ছিল না, ছিল অজস্র আঁকাবাঁকা সরু গলি। যে-কোনও একটার মধ্যে ঢুকে সটকান দেওয়া এমন কি আর কঠিন কাজ।
আমি আসার আগেই বেরিয়ে গিয়েছিলেন বসাকি। খুব শিগগিরই তাঁর সঙ্গে দেখা হওয়ার সম্ভাবনাও কম। তবুও বন্দুকধারী আগন্তুকের নিখুঁত দৈহিক বর্ণনা পেতে বিশেষ বেগ পেতে হল না আমাকে। লোকটা ধূমকেতুর মতো যখন ঢুকে পড়ে মদ্যশালায়, তখন যে তরুণ-তরুণী দুটি ছিল ঘরের মধ্যে, তাদের কাছ থেকে এবং চৌয়ানস্কির মুখে যা শুনলাম, তা থেকেই লোকটা স্পষ্ট হয়ে উঠল মনের চোখে। বয়সে সে যুবাপুরুষ, কালো-কালো এক মাথা চুল, ছিপছিপে চেহারা–দেখতে শুনতে মন্দ নয়। পরনে তার কালো প্যান্ট। খাটো হাতা স্পোর্টস শার্টটা প্যান্টের ওপর এমনভাবে ঝুলিয়ে দিয়েছিল সে যে বেল্টে গোঁজা রিভলভার দুটো তাইতেই ঢাকা পড়ে গিয়েছিল।
বসাকি আসার আগেই বেশ বুঝেছিলাম লোকটাকে। বসাকির কাছে পরে শুনলাম লোকটার চেহারার আর এক দফা বর্ণনা। আর এরকম হরিণের মতো দৌড়োতে নাকি তিনি এর আগে আর কাউকে দেখেননি। ঘাঁটিতে বসে এ সম্বন্ধে বেশ কিছুক্ষণ আলোচনা হল আমাদের মধ্যে। ১৯৫৫ সালের এপ্রিল ফুলের তারিখ দেওয়া আমার রিপোর্টটাও সঙ্গে ছিল। লেফটেন্যান্ট ফ্র্যাঙ্ক পেপে রিপোর্টটার ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে এক কথায় বলে দিলেন এ অপকর্ম কোনও মহাপ্রভুর।
বললেন–এ কাজ ওই বোম্বেটে কার্পেন্টার ছোকরার। এই নিয়ে সত্তরবার হল। কিন্তু ওকে আমি বার করবই। এই যদি আমার জীবনের শেষ গ্রেপ্তার হয়, তাহলেও জেনো, ওর রেহাই নেই।
বাস্তবিকই রেগে আগুন হয়ে গিয়েছিলেন ফ্র্যাঙ্ক পেপে। ঝানু অফিসার হিসেবে তার অভিজ্ঞতা তো বড় কম নয়। সহকর্মীরা তাঁকে যেমন ভালোবাসত, শ্রদ্ধা করত ঠিক তেমনি তাকে যমের মতো ভয়ও করত আর দু-চক্ষে দেখতে পারত না শিকাগোর অপরাধদুনিয়ার বাসিন্দারা। বেশ কয়েকবার গুলি-গোলা চলেছিল পুলিশ আর শহরের গুন্ডাদের মধ্যে। ফ্র্যাঙ্ক পেপে কিন্তু লড়াই-অন্তে এমন আটজন মূর্তিমানবকে শ্রীঘরে পাঠিয়েছিলেন, খুন-জখম আর ডাকাতির জন্যে যারা কুখ্যাত।
পেপের সঙ্গে কথাবার্তা, শেষ হলে পর ফিরে এলাম আমার অফিসে। ধার করলাম রিচার্ড কার্পেন্টারের ইয়া মোটা ফাইলটা। ১৯৫৩ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে লোকটাকে খুঁজছি আমরা। উচ্চতায় সে পাঁচ-ফুট এগারো ইঞ্চি। ওজন ১৬৫ পাউন্ড। মাঝে মাঝে গোঁফ রাখে। কোটরে-বসা চোখ। বয়স ছাব্বিশ বছর। বিস্তর ডাকাতির মামলা ঝুলছে তার নামে। কিন্তু গত পনেরো মাস যাবৎ আরও ঘন ঘন আর বেশি সংখ্যায় রিপোর্ট আসা শুরু হয়েছে তার কীর্তিকলাপের ধরন দেখে মনে হয় শিকাগো শহরের বাইরে সে কোনও দিনই যায়নি। মুদিখানা, পেট্রোল পাম্প, পানাগার, হোটেল, লন্ড্রি ইত্যাদি ছোটখাটো জায়গায় ক্ষমতা জাহির করেই খুশি সে৷ ছদ্মবেশ ধারণের প্রচেষ্টা কোনও দিনই করেনি কার্পেন্টার এবং একলা কাজ করাই পছন্দ করে সে। এখনও কাউকে সে যমালয়ে পাঠায়নি বটে, তবে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস একদিন না একদিন সে তা করবেই।
অনেক তথ্যই জানা গিয়েছিল ওর সম্বন্ধে। প্রতিবারই ক্যাশ লুঠ করার সময়ে হুমকি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পিস্তল দুটো বার করে ফেলে ও। তারপর কোনও গাড়ির সাহায্য না নিয়েই চক্ষের নিমেষে অন্তর্হিত হয় নগদ সমেত। দারুণ চটপটে সে। দৌড়োতেও পারে হরিণের মতো অস্বাভাবিক দ্রুত বেগে। এবং যেখানেই তার আবির্ভাব হোক না কেন, রিভলভার দুটো সব সময়ে তার সঙ্গে থাকবেই। ভয় দেখাবার জন্যে পিস্তলের হ্যাঁমার ঠুকে ক্লিক ক্লিক্ শব্দ করাও তার আর একটা নিয়মিত নষ্টামি। বাঁধাধরা সূচি অনুসারেই কাজ চালিয়ে যায় কার্পেন্টার। দেখা গেছে, প্রতিদিন প্রায় পঁচিশ ডলার দরকার পড়ে ওর। উদাহরণ স্বরূপ, কোনও জায়গায় চড়াও হওয়ার পর যদি একশো ডলার হাতে পারে কার্পেন্টার, তাহলে অন্ততপক্ষে চারদিন আর কোনও উৎপাত করতে শোনা যায় না ওকে। আবার কখন-সখন যদি এর দ্বিগুণ অর্থ পকেটস্থ করতে পারে, তাহলে তো পুরো এক হপ্তা পায়ের ওপর পা তুলে দিয়ে জিরিয়ে নেয়। মদ্যশালায় তার আবির্ভাব ঘটে শুধু রাত্রে–দোকান বন্ধ করার সময়ে। কেননা, এই সময়ে ক্যাশে যত টাকা জমা পড়ে, তত টাকা সারা দিনে অন্য কোনও সময়ে পাওয়া সম্ভব নয়। কোনও কোনও পানাগারে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা সামনে বিয়ারের গেলাস নিয়ে ঝিমুতে থাকে ও। তারপর কাজ হাসিল করার পরেই গেলাসটি চুরমার করে দিয়ে যায় যাতে তার আঙুলের ছাপ গোয়েন্দাদের হাতে না পড়ে।
এইভাবে যাদের সিন্দুক ও হালকা করেছে তাদেরই একজনকে দিব্বি শান্তভাবে বলেছিল কার্পেন্টার–আরে মশাই নিজের মগজ খাটান। উত্তেজিত হবেন না, নাভার্সও হবেন না। দেখতেই তো পাচ্ছেন কীরকম স্থির আমি। আপনাকে পরলোক পাঠানোর কোনও সদিচ্ছাই নেই আমার। কাজেই আমার মতোই নির্বিকার থাকুন। তবে, বেচাল দেখলেই আপনার ওই আস্ত মগজে একটা ফুটো করে দিতে এতটুকুও দ্বিধা করব না। আর এক মদের দোকানের মালিকের কাছে শুনেছিলাম, কার্পেন্টার নাকি ক্যাশ থেকে তিনশো ডলার হাতিয়ে নিয়ে উধাও হওয়ার পরেও খদ্দেররা বিন্দুবিসর্গ টের পায়নি। পুলিশ আসবার পরে টনক নড়ে তাদের।
একবার ক্যাশ লুঠের পরেই একজন ট্যাক্সি-ড্রাইভারকে আশাহত করেছিল কার্পেন্টার। ড্রাইভারকে ও বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বলে যে, একটা মারমুখো লোকের কাছ থেকে প্রাণ নিয়ে পালাতে চাইছে সে। স্ত্রীর শোবার ঘরে নাকি কার্পেন্টারকে দেখতে পেয়েছিল লোকটা। তাই তার রক্তদর্শন না করলে নাকি স্বামী ভদ্রলোক শান্ত হবে না। কাজে কাজেই যত তাড়াতাড়ি এ অঞ্চল থেকে সটকান দিতে পারে সে, ততই মঙ্গল। ড্রাইভার ভাবলে বুঝি সত্যি সত্যিই আরোহীর জীবনরক্ষা করছে সে। কিন্তু এত ঝক্কি পোহাবার পুরস্কার মিলল মাত্র দশ সেন্ট বখশিশ! নিজের পরিবার ছাড়া, প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই এই একই রকম সঙ্কীর্ণমনা ছিল কার্পেন্টার। তাছাড়া, আরও একটা গুণ ছিল তার। বেশির ভাগ লুঠেরা খোলামকুচির মতো টাকা ছড়িয়ে দুদিনেই ফতুর হয়ে যায়। কিন্তু কার্পেন্টার ছিল বড় হিসেবী। অপচয় করা তার কোষ্ঠীতে লেখা ছিল না।
একবার খবর এল বেশ কয়েক মাস হল নর্থ ক্যারোনিলা অ্যাভিন্যুতে বোবা-কালাদের প্রতিষ্ঠান ক্র্যাকোভার হোম-এ আস্তানা নিয়েছে সে। জোর কানাঘুসো শুনলাম, এখানে গেলেই দর্শন মিলবে মহাপ্রভুর। বাড়িটা ঘেরাও করে ফেললাম আমরা। কিন্তু দেখা গেল দু-হপ্তা আগেই পাখি উড়েছে।
রাইটউড সরাইখানায় তার কুকীর্তির পর দু-মাস কেটে গেল। কিন্তু কোন গর্তে যে সে সেঁধিয়ে বসে রয়েছে, তার কোনও হদিশ পেলাম না আমরা। কার্পেন্টারের মার্জারের মতো ক্ষিপ্রতা আর তড়িৎ-তৎপরতায় প্রতিটি পুলিশকর্মী সজাগ হয়ে উঠেছিল। গায়ে এতটুকু আঁচ না লাগিয়ে পর-পর এতগুলি বে-আইনি কাজ করে সারা পুলিশবাহিনীকেই চ্যালেঞ্জ করে বসেছিল ও। শেষকালে সম্মেলনে বসলাম আমরা। নতুন কৌশল আর কর্মপদ্ধতির উদ্ভাবন করলাম। খুব সম্ভব মেয়েদের কাছ থেকেই পাওয়া যাবে তার বর্তমান ঠিকানা, এই আশায় এই ধরনের হেন মেয়ে নেই, যাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে ছাড়লাম আমরা। কিন্তু কার্পেন্টরের ছবি দেখা সত্ত্বেও কেউ চিনতে পারল না ওকে। শেষকালে বারমেড, সস্তা হোটেলের রিসেপশন ক্লার্ক, এবং অপরাধ দুনিয়ার ছিঁচকে চোর-ছ্যাচোড় থেকে শুরু করে রাঘব-বোয়ালদেরও রেহাই দিলাম না। কিন্তু বৃথাই। দেখা গেল, কার্পেন্টার বাস্তবিকই নির্বান্ধব। শিয়ালের মতো ধূর্ত সে। নিজের জীবিকা সমস্যার সমাধান করে সে নিজের বুদ্ধি-শক্তি দিয়েই–দুনিয়ার কারোর ওপর আস্থা নেই তার।
লোকটার সম্ভবপর গতিবিধি বিশ্লেষণ করার জন্যে হয়তো একজন মনোসমীক্ষকেরই দরকার ছিল আমাদের। অনেকবার এমন সম্ভাবনাও এসেছে আমাদের মাথায় যে হয়তো শহরতলীরই কোনও সম্মানজনক প্রতিষ্ঠানে দিনের বেলা ঘাপটি মেরে বসে রয়েছে সে। আর রাতের বেলা শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে কোনও কারখানায় দিনের তৎপরতা গোপন করার জন্যেই। কিন্তু শিকাগো শহরটা তো আর ছোট শহর নয়। কাজেই এত সহজে এরকম চিরুনি-আঁচড়ানো তল্লাশি পর্ব পরিচালনা করা সম্ভব ছিল না কোনওমতেই।
কার্পেন্টারের জন্ম হয় ১৯২৯ সালে। অর্থনৈতিক নিস্তেজনার সেই সঙ্কটময় দিনগুলিতে শান্তি ছিল না পরিবারে। ঝগড়াঝাটি লেগেই ছিল বাবা আর মায়ের মধ্যে। শেষকালে বিবাহবিচ্ছেদ করে পৃথক হয়ে গেলেন ওর মা ছেলেমেয়েদের নিয়ে। আর, তার কিছুদিন পরেই মোটর দুর্ঘটনায় মারা গেলেন ওর বাবা। রিচার্ড কার্পেন্টারের বয়স তখন মাত্র দশ বছর। জীবন-বীমা না থাকায় দারুণ চাপ পড়ল ওর মায়ের ওপর। অভাব-অনটনের নিত্য নেই নেই হাহাকারে দেখতে দেখতে বুড়িয়ে গেলেন তার মা। তবুও ভেঙে পড়লেন না ভদ্রমহিলা। কষ্টেসৃষ্টে কোনওমতে শান্তি বজায় রাখলেন ছোট্ট পরিবারটির মধ্যে। রিচার্ড, তোর দুই বোন, আর নিজে–এই নিয়ে ছিল তার ছোট্ট সংসার। ছেলেমেয়েদের মধ্যে রিচার্ডকেই তিনি বেশি ভালোবাসতেন। তাছাড়া, আশ্চর্য একটা সম্প্রীতিবোধ ছিল তিন ভাইবোনের মধ্যে। এমন বড় একটা দেখা যায় না। রিচার্ড কিন্তু মা বলতে অজ্ঞান। মা ছাড়া তার এক দণ্ডও চলত না। মায়ের কোলে বসে আদর পাওয়ার মতো লোভনীয় জিনিস তার কাছে আর কিছুই ছিল না। একদিন এইভাবেই কোলে বসে মাকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলেছিল রিচার্ড। কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল–মা, নিজেকে বড় একা লাগছে আমার। আমাকে ছেড়ে যেও না। এরকম পরিস্থিতিতে সে যে মায়ের সবচেয়ে আদুরে হয়ে উঠবে, তা বলাই বাহুল্য।
সংসারের টানাটানি আরও বৃদ্ধি পেল। শেষকালে নিরুপায় হয়ে মিল-অকির একটা অনাথ আশ্রমে রিচার্ডকে পাঠিয়ে দিতে বাধ্য হলেন ওর মা। রিচার্ড কার্পেন্টারের পরবর্তী জীবনে যে কলঙ্কময় অধ্যায়ের সৃষ্টি হয়েছিল, তার সূচনা কিন্তু এইখান থেকেই। রিচার্ডের সঙ্গে কেউই নিষ্ঠুর ব্যবহার করেনি। বরং যত্ন পরিচর্যার সীমা ছিল না সেখানে। কিন্তু বাড়ি থেকে অনেক দূরে থাকার ফলে তার মানসিক অশান্তির সীমা-পরিসীমা ছিল না। কাজেই শত চেষ্টাতেও ওর শিক্ষকেরা এদিক দিয়ে ওকে সুখী করে তুলতে পারেননি। কোনও রকম ত্রুটি ছিল না তার আচার ব্যবহারে। চোখে-মুখে এমন একটা ছেলেমানুষি মিষ্টিভাব ছিল যে ভালো না বেসে পারা যেত না। কিন্তু পড়াশুনোর দিক দিয়ে ক্রমশই পিছিয়ে পড়তে লাগল রিচার্ড। আপ্রাণ চেষ্টা করলেন শিক্ষকরা। কিন্তু কিছুতেই স্কুলের পড়াশুনোয় মন বসাতে পারল না রিচার্ড কার্পেন্টার।
ষোলো বছর বয়সে তার চাইতে অনেক কমবয়সি ছেলেদের ক্লাসে বসতে হল তাকে। সমবয়সি ছাত্ররা তাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া, চেহারায়, পোশাকে নোংরা থাকার বদভ্যাস শুরু হয় এখান থেকেই। স্কুল ছেড়ে বেরিয়ে আসার পর ও ঘুরতে থাকে এক কাজ থেকে আর এক কাজে। কখনও হয়েছে জাহাজঘাটার কেরানী, কখনও ট্রাক-ড্রাইভার। কখনও নিয়েছে ডিশ ধোওয়ার কাজ এবং এই ধরনের আরও কত ছোটখাটো কাজ। কিন্তু কোথাও বেশিদিন টিকে থাকতে পারেনি ও। যতবার চাকরি গিয়েছে তার, ততবারই সহানুভূতির স্নিগ্ধ প্রলেপে মনের জ্বালা জুড়োনোর জন্যে ছুটে গেছে মায়ের কাছে। প্রতিবারই অভিযোগ জানিয়েছে বড়ই অসুখী আর নিঃসঙ্গ সে।
আঠারো বছর বয়েসে সৈন্যবাহিনীতে নাম লেখাল রিচার্ড কার্পেন্টার। কিন্তু মিলিটারি সম্পত্তিতে ক্ষতি করা থেকে শুরু করে এত রকম নিয়ম লঙ্ঘন আরম্ভ হল যে গার্ডহাউসেই বিস্তর সময় ব্যয় করতে হল ওকে। শেষকালে এ ধরনের অবাঞ্ছিত লোককে বরখাস্ত করা ছাড়া আর কোনও উপায় রইল না। সৈন্যবাহিনী থেকে বেরিয়ে এল রিচার্ড কার্পেন্টার শুধু একটি জিনিস ভালোভাবেই রপ্ত করে এবং তা হচ্ছে পিস্তল চালানো। কিন্তু তার চরিত্রের আশ্চর্য দিকটুকু জানলে বাস্তবিকই অবাক হতে হয়। এ হেন লোকেরও আতীব্র আসক্তি ছিল সিরিয়াস সঙ্গীত, অপেরা সিম্ফনী আর কনসার্টে। বহু রবিবাসরীয় অপরাহ্নে ক্ল্যাসিকাল রেকর্ড বাজিয়ে শুনিয়েছে ও মা-কে। ভালো ভালো রেকর্ড সংগ্রহের বাতিকেই উড়ে যেত ওর যাবতীয় উদ্বৃত্ত অর্থ।
অপরাধী জীবনের গোড়ার দিকেই দু-দুবার পুলিশ পাকড়াও করে রিচার্ড কার্পেন্টারকে। প্রথমবার সৈন্যবাহিনী থেকে বরখাস্ত হওয়ার পর বেআইনীভাবে বিস্তল বহন করার অপরাধে। সৈন্যবাহিনীতে একসময়ে যারা কাজ করেছে, হামেশাই লুকিয়ে চুরিয়ে পিস্তল সঙ্গে রাখতে দেখা যায় তাদের। কাজেই কার্পেন্টারকেও একপ্রস্থ ধমকধামক দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হল। কঠিন শাস্তি হল না। এগারো মাস পরে বাড়ির মধ্যে বসে দুটো রিভলভার পরিষ্কার করছিল রিচার্ড। হঠাৎ বন্দুক থেকে গুলি ছুটে যায়–গুলি গিয়ে লাগে ওর মায়েরই গায়ে। কপাল ভালো, খুব গুরুতর চোট লাগেনি। কিন্তু পুলিশ যখন জানতে চাইল আসল ব্যাপারটা কী, তখন চটেমটে ওর মা পুলিশমহলকেই অভিযুক্ত করে বসলেন। তারা নাকি, খামোকা তার আদুরে ছেলেকে নাজেহাল করছে।
১৯৫১ সালে রিভলভার উঁচিয়ে একজন ট্যাক্সি ড্রাইভারের কাছ থেকে আট ডলার ছিনিয়ে নেওয়ার অপরাধে গ্রেপ্তার হল রিচার্ড কার্পেন্টার। মূল সাক্ষী কিন্তু নিশ্চিতভাবে জানত না যে কার্পেন্টারই প্রকৃত অপরাধী। তা সত্ত্বেও গ্রেপ্তার করা হল ওকে। আটটা ডলার আর একটা রিভলভারও পাওয়া গেল ওর কাছ থেকেই। তাতেই আদালতের আর কোনও সন্দেহই রইল না কয়েদীর কুকীর্তি সম্বন্ধে। এক বছর কারাবাসের দণ্ড দিলেন ধর্মাবতার।
বড় কড়া দাওয়াই দেওয়া হল রিচার্ডকে। অন্তত সেইভাবেই শাস্তিটাকে নিয়েছিল ও। এক বছরের মধ্যে কোনও কয়েদীর সঙ্গেই বন্ধুত্ব করতে দেখা গেল না ওকে। মা মাঝে মাঝে আসতেন। সঙ্গে আনতেন মিঠাই আর কেক। কার্পেন্টার কাউকেই ভাগ দিত না এইসব খাবারদাবারের। খুপরির অন্যান্য কয়েদীরা আদুরে থোকা বলে খেপাত ওকে। ফলে, উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে লাগল ওর মনের জ্বালা।
শ্রীঘর থেকে বেরিয়ে এসে কার্পেন্টার প্রতিজ্ঞা করল জীবনে আর কখনও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে খেলা করবে না। খুঁজে পেতে একটা ট্যাক্সি ড্রাইভারের কাজ জুটিয়ে ফেলল ও। প্রতি হপ্তায় আশি ডলার রোজগার করতে লাগল কার্পেন্টার। চরিত্রের মধ্যে অতিনৈষ্ঠিক বৈশিষ্ট্যের অঙ্কুরও দেখা গিয়েছিল সে সময়ে। বারবনিতা বা জুয়াড়িদের ট্যাক্সিতে তুলত না ও। নিঃসঙ্গ নেকড়ের মতোই ভয়াবহতা ওর প্রকৃতির কন্দরে সুপ্ত ছিল তখন। কিন্তু মাঝে মাঝে দুই বোন আর একজন খুড়তুতে বোনকে নিয়ে প্রায়ই সিনেমায় যেত। স্কেটিং করতেও যেত সবাইকে নিয়ে। পরে এই খুড়তুতো বোনের কাছে শুনেছিলাম–রিচার্ড নিজে কিন্তু স্কেটিং জানতো না। তবুও রাত্রে আমাদের একলা ছেড়ে দিতে চাইত না ও। অনেক সৌভাগ্য থাকলে তবে এরকম ভাই পাওয়া যায়।
তিন বোনের জন্যে সুন্দর সুন্দর পোশাক কিনে আনত রিচার্ড। নিজে কিন্তু নোংরা অগোছালো বেশবাস পরেই দিন কাটিয়ে দিত। একটি মাত্র সুট ছিল ওর। জুতোর অবস্থাও ছিল শোচনীয়–ঘন ঘন মেরামত না করলে চলত না। রীতিমতো উত্তেজনার ঝেকে যখন সন্ত্রাস সৃষ্টি করে চলছে কার্পেন্টার, তখনও কিন্তু ওর ঠাকুরদা বিশ্বাস করতে চাননি যে রিচার্ড কার্পেন্টার একজন বিপজ্জনক প্রকৃতির অপরাধী। জোর গলায় বলেছিলেন বৃদ্ধ–ভারী ভালো ছেলে ছিল ডিকি। একটু খামখেয়ালী ছিল বটে কিন্তু তাতে কি আসে যায়? ও যখন ট্যাক্সি চালাত, তখন আমার জন্যে দুটো-তিনটে সিগার আনতে কোনওদিনই ভুল হত না ওর। বাজে সিগার নয় যথেষ্ট ভালো সিগার।
রিচার্ড কার্পেন্টারের পরিবারের সবাই ভাবলে ছেলেটির এত মানসিক অশান্তির মূল কারণ হল পুলিশের হয়রানি আর আদালতের সমবেদনার অভাব। ১৯৫৩ সালের ডিসেম্বর মাসের চার তারিখে আর একবার স্বরূপ প্রকাশ করে ফেলল কার্পেন্টার। একটা মোটর চুরি করল ও। পরে প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল গাড়িটা ওরই হাতে। একটা মুদিখানায় হানা দিয়ে লুঠ করল একশো ডলার। এই ঘটনার পর থেকে আর কোনওদিন সে ফিরে আসেনি নিজের বাড়িতে। পরিবারের কারোর সঙ্গেও আর দেখা করেনি। পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে লাগল কার্পেন্টার। পায়ে তার ক্রেপসোলের জুতো। বেল্টে গোঁজা একজোড়া রিভলভার। পরপর দুঃসাহসিক রাহাজানির এক ভয়ঙ্কর তালিকার সূচনা কিন্তু এই ঘটনা দিয়েই শুরু।
পুরো আঠারো মাস সবার চোখে ধুলো দিয়ে গা-ঢাকা দিয়ে রইল রিচার্ড কার্পেন্টার। পুলিশ মহলের প্রত্যেকেই তখন খুঁজছে ওকে। তারপর এল ১৯৫৫ সালের আগস্টের সেই শোকাবহ দিনটি। আমার বন্ধু আর সহকর্মী ডিটেকটিভ মর্কি বাড়ি থেকে হেডকোয়ার্টার আসছিল মাটির তলার রেলে চেপে। ডাকাতির তদন্ত করাই ছিল চশমাচোখে মর্ফির একমাত্র কাজ। কার্পেন্টারের রাহাজানি সম্পর্কিত সবকটা স্টাফ মিটিংয়ে হাজির ছিল মর্ফি। কাজেই চলন্ত ট্রেনে বন্দুকধারী ছোকরাকে দেখে চিনতে ভুল হয়নি ওর। তৎক্ষণাৎ লম্বা লম্বা পা ফেলে রিচার্ডকে গ্রেপ্তার করে ফেলে ও। রুজভেল্ট রোড আর স্টেট স্ট্রিটের প্ল্যাটফর্মে কার্পেন্টারকে নিয়ে নেমে পড়ে মর্ফি। তারপর এক অসতর্ক মুহূর্তে পকেট থেকে কার্পেন্টারের ফোটোগ্রাফ বার করে যখন আসল লোকটার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে ব্যস্ত, ঠিক তখনই রিভলভার বার করে এক গুলিতেই মর্ফিকে খতম করে দিলে কার্পেন্টার। ফোটোগ্রাফ গিয়ে পড়ল মেঝের ওপর। উদ্যত রিভলভারের সামনে ভয়চকিত জনতাকে স্থাণুর মতো দাঁড় করিয়ে রেখে ও গিয়ে উঠে পড়ল একটা মস্ত গাড়ির মধ্যে সাবওয়ে থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথ দিয়েই বাইরে যাচ্ছিল গাড়িটা। দরজা খুলেই ভেতরে উঠে পড়ে কার্পেন্টার। বিদ্যুৎ গতিতে আবার কার্তুজ ভরে নেয় রিভলভারে। এবং পরক্ষণেই ড্রাইভারকে লক্ষ্য করে নলচেটা স্থির করে রেখে গর্জে ওঠে চাপা কণ্ঠে–এইমাত্র কয়েকজনকে খুন করে এলাম আমি। চেঁচামেচি না করে গাড়িটা না চালিয়ে গেলে আপনাকেও খুন করব আমি।
গাড়িটা চালাচ্ছিলেন তেষট্টি বছরের বুড়ো মিঃ চার্লস এ কোপার। কার্পেন্টারের বজ্রগর্ভ হুমকি শুনেই আঁতকে উঠে প্রাণ হাতে নিয়ে বায়ুবেগে গাড়ি চালালেন তিনি। দেখতে দেখতে পৌঁছে। গেলেন শিকাগোর সবচেয়ে সরগরম স্থান লুপ, ডিয়ারবর্ণ আর ম্যাডিসন স্ট্রিটের কেন্দ্রে। একলাফে গাড়ি থেকে নেমেই উল্কাবেগে উধাও হয়ে গেল কার্পেন্টার।
প্রথমেই যে পুলিশ প্রহরীটির সঙ্গে দেখা হল, তার কাছেই হাউ হাউ করে কোর্পার সাড়ম্বরে বর্ণনা করলেন এইমাত্র কি ভয়ঙ্কর ঘটনাটা ঘটে গেল। আঙুলের ছাপের বিশেষজ্ঞ এসে কোপারের গাড়ি থেকে উদ্ধার করলেন তালু আর তিনটে আঙুলের ছাপ। কার্পেন্টারের ছাপের সঙ্গেই তা হুবহু মিলে গেল।
পুলিশ অফিসারকে নিকেশ করেছে কার্পেন্টার। কাজেই পুলিশ ফোর্সের প্রত্যেকে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করলে তার পায়ে বেড়ি পরানোর। যেভাবেই হোক ফাঁদে ফেলতে হবে কার্পেন্টারকে, কিন্তু প্রতিজ্ঞা করা যত সহজ, তাকে পূরণ করা ততটা সহজ নয়। একটা বাড়তি সূত্র অবশ্য পেয়েছিলাম। মিঃ কোপারের কাছে শুনেছিলাম হানাদার লোকটার মুখটা নাকি রোদে পোড়া তামাটে রঙের–প্রায় কালোই বলা চলে। স্থির করলাম, লেক মিচিগানে বেলাভূমিতে যে-কটা সমুদ্রস্নানের স্থান আছে, সবকটাতেই একবার আমার যাওয়া দরকার। এ যেন অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়া, লাগলেও লেগে যেতে পারে।
কিন্তু কিছুই হল না। চাঞ্চল্যকর গল্পে বোঝাই রইল খবরের কাগজের পাতাগুলো। আমাদের কাছেও এল এন্তার মিথ্যা সংবাদ। শিকাগোর একটি সংবাদপত্র পাঁচ হাজার ডলার পুরস্কার ঘোষণা করে বসল। এমনকী সাহায্য করার জন্যে এফ. বি. আই. (Fedral Bureau of Investigation) কয়েকজন এজেন্টকেও পাঠিয়ে দিলে আমাদের দপ্তরে। সবই হল। কিন্তু কার্পেন্টারের টিকি দেখা গেল না কোথাও।
ডিটেকটিভ মর্ষি নিহত হওয়ার তিনদিন পর পুলিশকর্মী ক্লারেন্স কের ছেলেমেয়েদের বাড়িতে রেখে বউকে নিয়ে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলেন একটা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত হলে। মজার ব্যাপার কী জানেন? যে ছবিটা দেখতে গিয়েছিলেন ক্লারেন্স কের, তার নামও কিন্তু কল মি লাকি।
সিনেমা হলে ঢুকেই ক্লারেন্স-এর চোখ পড়ল একটা লোকের ওপর। পেছনের সারিতে নাক ডাকিয়ে অকাতরে ঘুমোচ্ছিল লোকটা। এক নজরেই রিচার্ড কার্পেন্টারকে চিনতে পেরেছিলেন ক্লারেন্স। গোলমাল না করে বউকে বললেন, গাড়িতে ফিরে তার জন্যে অপেক্ষা করতে।
ইতস্তত করতে লাগলেন তার স্ত্রী। তার ইচ্ছে ছিল ফোন করে পুলিশ ফৌজ ডেকে আনা। কিন্তু ক্লারেন্সের সেই এক গোঁ–কাজটা যখন আমারই আওতায় পড়ছে, তখন আমি একাই সামলাতে পারব তা।
মাত্র বছরখানেক হল পুলিশ ফোর্সে যোগদান করেছিলেন ক্লারেন্স। নবাগত তিনি, অভিজ্ঞতাও ছিল অল্প। তাই বুদ্ধিমতী স্ত্রীর পরামর্শ শুনলেই ভালো করতেন। ঘুমন্ত কার্পেন্টারকে ঝাঁকুনি দিয়ে কড়া গলায় শুধোলেন ক্লারেন্স-এটা কি ঘুমোবার জায়গা?
নিজের চরকায় তেল দিন। ঘুম জড়ানো স্বরে উত্তর এল তখুনি।
আমি পুলিশ অফিসার। লবিতে আসুন আমার সঙ্গে।
ধীর পদে উঠে এল কার্পেন্টার। এমনভাবে এল, যেন তখনও পুরোপুরি ভাবে জেগে ওঠেনি ও। এক হাতে রিভলভার আর এক হাতে ব্যাগ নিয়ে সজাগ হয়ে রইলেন ক্লারেন্স।
ঘুম-ঘুম স্বরে আবার বলে ওঠে কার্পেন্টার–বাইরে বড় গরম, তাই ঠান্ডায় বসে একটু জিরিয়ে নিচ্ছিলাম। বে-আইনী কিছু তো করিনি।
লবিতে প্রবেশ করে দুজনে। ঠিক এই সময়ে হোঁচট খাওয়ার ভান করেই রিভলভার বার করে সোজা ক্লারেন্সের বুকের ওপর গুলিবর্ষণ করলে কার্পেন্টার। ক্লারেন্সও পাল্টা গুলিবর্ষণ করলেন বটে, কিন্তু গুলিটা লাগল পলায়মান কার্পেন্টারের পায়ে। তিরবেগে ও ছুটে গেল জরুরি অবস্থায় বাইরে বেরোনোর দরজার দিকে। আড়াইশো লোক বসা থাকলেও তখনও বেশ অন্ধকার বিরাজ করছিল সিনেমা হলেন মধ্যে। পটাপট শব্দে জ্বলে উঠল আলোগুলো কিন্তু আবার পাঁকাল মাছের মতোই হাত ফস্কে অদৃশ্য হয়ে গেল রিচার্ড কার্পেন্টার।
গুলি ছোঁড়ার আওয়াজ শুনেই লবির দিকে ছুটে গেলেন ক্লারেন্সের স্ত্রী। রাস্তা দিয়ে একজন যাজক যাচ্ছিলেন–ফায়ারিংয়ের শব্দে তিনিও বিলক্ষণ আঁতকে উঠেছিলেন। আসবার সময়ে তাঁকেই হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে এলেন ক্লারেন্স পত্নী। এসে দেখলেন টমাস ব্র্যান্ড নামে একজন মেডিক্যাল ছাত্র প্রাথমিক শুশ্রূষা করার পর চেষ্টা করছেন কেরের বুক থেকে ফিনকি দিয়ে ছুটে আসা রক্তস্রোত বন্ধ করতে। ক্লারেন্সের চেতনা তখন বিলুপ্ত প্রায়। সেই অবস্থাতেই দুর্বোধ্য ভাবে বিড়বিড় করে চলেছেন–কার্পেন্টার…কার্পেন্টার..আমি চিনেছি ওকে, কার্পেন্টার…।
সেন্ট মেরী অফ নাজারেথ হাসপাতালে পুরো পাঁচ ঘণ্টা অপারেশন টেবিলে শুইয়ে রাখা হল ক্লারেন্স কের-কে। শিকাগোর সবচেয়ে নামকরা বুক আর হৃদযন্ত্র অস্ত্রোপচারক ডক্টর এডোয়ার্ড এ অ্যাভারী দুরূহ অস্ত্রোপচার করে জীবনরক্ষা করলেন ক্লারেন্সের। অত্যন্ত পল্কা সুতোর ওপর ঝুলছিল তার জীবন। কেননা হৃদযন্ত্রের কাছেই একটা ধমনী জখম হয়েছিল গুরুতরভাবে। পরে ডক্টর অ্যাভারী আমাদের বলেছিলেন–হৃৎপিণ্ডের স্পন্দনই নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে কের-কে। বুক ফুঁড়ে বুলেটটা বেরিয়ে যাওয়ার সময়ে সঙ্কুচিত হয়েছিল ওর হৃদয়যন্ত্র। তা না হয়ে যদি প্রসারিত হয়ে থাকত, তাহলেই কিনারা কেটে বেরিয়ে যেত গুলিটা–সেক্ষেত্রে ওর মৃত্যু ছিল অবধারিত। কিন্তু এখন আর কোনও ভয় নেই।
কার্পেন্টারের এই সর্বশেষ পাশবিক কুকীর্তির খবর ফলাও আকারে ছড়িয়ে পড়ল খবরের কাগজ, টেলিভিশন আর রেডিও মাধ্যমে। সে যে কোথায় ঘাপটি মেরে বসে রয়েছে, সে সম্বন্ধেও মন্তব্য করতে ছাড়ল না খবর পরিবেশকরা। কিন্তু এই একটিমাত্র সমস্যার সমাধান করতে গিয়েই পুলিশ হিমসিম খেয়ে গেল! কোন কোটরে যে সেঁধিয়েছে আহত কার্পেন্টার, তার কোনও হদিশই পেল না পুলিশমহল। জখম অবস্থায় গাড়ি না নিয়ে বেশি দূর যাওয়া কার্পেন্টারের পক্ষে সম্ভব নয় নিয়ে। সেইজন্যেই আশা ছিল এবার জনসাধারণের পূর্ণ সহযোগিতা পাওয়া যাবে। তাছাড়া, কম করে ষাটটা পুলিশ স্কোয়াডকেও মোতায়েন করা হয়েছিল খুনে বন্দুকবাজকে পাকড়াও করার জন্যে। প্রতিটি হাসপাতালে খবর চলে গিয়েছিল–যে-কোনও মুহূর্তে ক্ষতস্থান চিকিৎসার জন্যে কার্পেন্টারের আগমন ঘটতে পারে। রেলপথ আর বাস স্টপেজেও তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখেছিল গোয়েন্দারা। আজে-বাজে লোকের কাছ থেকে টেলিফোন মারফত কয়েকটা লোমহর্ষক গল্পও শুনলাম। তারা নাকি স্বচক্ষে দেখেছে রাস্তার অন্যদিক দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ছুটে চলেছে খুনে কার্পেন্টার। কেউ কেউ তাকে লুকিয়ে থাকতে দেখেছে বিশেষ কোনও ফ্ল্যাটে অথবা দোকানের মধ্যে। সে নাকি নতুন একপ্রস্থ পোশাক কেনবার চেষ্টা করছে, লেক মিচিগানের নৌকোয় তাকে নাকি উঠতে দেখা গেছে, এবং নিশ্চিন্তভাবে সে-ই নাকি একটা মালবাহী গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে পড়েছে–এমনও দেখা গেছে। জনা ছয়েক তরুণকে হাতকড়া লাগিয়ে টেনে আনল পুলিশ। কিন্তু কার্পেন্টারের সঙ্গে তাদের মুখের কোনওরকম সাদৃশ্যই পাওয়া গেল না। একজন আঁতকে উঠে হন্তদন্ত হয়ে খবর আনলে একটা সিনেমাবাড়ির ছাদে নাকি খুনেটাকে দেখতে পেয়েছে সে। সঙ্গে সঙ্গে স্কোয়াডের অফিসাররা বাড়িটা ঘেরাও করে তল্লাশী করলে তন্নতন্ন করে। পরিশেষে ছাদের ওপর পাওয়া গেল শুধু দুজন অর্ধ বসনা তরুণীকে–রৌদ্র-সুখ উপভোগ করছিল তারা।
এ হেন গদ্যময় পরিস্থিতিতে কার্পেন্টার গ্রেপ্তার হলে বাস্তবিকই ক্লাইমাক্স থেকে বঞ্চিত হত এই চমকপ্রদ কাহিনি। কিন্তু এরপর যা ঘটল, তাকে হলিউডি রীতি ছাড়া আর কিছু বলা চলে না–অলীক উপন্যাস যেন চাঞ্চল্যকর বাস্তবে রূপান্তরিত হল। যে রাত্রে সিনেমার মধ্যে পুলিশকর্মী ক্লারেন্স কের গুলিবিদ্ধ হলেন, ঠিক সেই রাত থেকেই বিচিত্র এই কাহিনির মধ্যে জড়িয়ে পড়ল একটা অতি সাধারণ মার্কিন পরিবার–ট্রাক-ড্রাইভার লিওনার্ড পাওয়েল, তার বউ আর সাত বছরের ছেলে রবার্ট আর তিন বছরের মেয়ে ডায়ানা। ওয়েষ্ট পোটোমাক অ্যাভিন্যুতে এদের নিবাস।
সেই রাতেই উৎসব ছিল পাওয়েলের বাড়িতে। সাড়ম্বরে ডিনারের আয়োজন করেছিল পাওয়েল তার নবম বিবাহ বছরে পদার্পণ উপলক্ষ্যে। বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজন নিয়ে ফুর্তিতে উচ্ছল হয়েছিল তারা রাত দশটা পঁচিশ মিনিট পর্যন্ত। অতিথিরা যখন বিদায় নিলে, তখন পাওয়েলের ছোট মেয়ে অকাতরে ঘুমোচ্ছে, আর ছেলে অন্য ঘরে বসে টেলিভিশন দেখছে। দারুণ গরম পড়েছিল সে রাত্রে–গাছের পাতা নড়ানোর মতো হাওয়াও বইছিল না। রান্নাঘরে গিয়েছিল লিওনার্ড রেফ্রিজারেটর থেকে কোল্ড ড্রিংক বার করার জন্যে, এমন সময়ে পর্দা লাগানো দরজায় টোকা মারার শব্দ শুনতে পেল ও! সামনেই দাঁড়িয়েছিল রিভলভার হাতে রিচার্ড কার্পেন্টার। লিওনার্ড ওর দিকে ফিরতেই তুহিন-শীতল স্বরে বলল–জানেন তো আমি কে?
নীরবে মাথা হেলিয়ে লিওনার্ড জানালে, হ্যাঁ, সে জানে।
এইমাত্র আরও একজন পুলিশের লোককে গুলি করে এলাম আমি। আমি যা বলি, তা যদি করেন তো কোনও ক্ষতি হবে না আপনার। আর তা যদি না করেন, যদি দরজাটা খুলতে না চান–এইখান থেকেই আপনাকে গুলি করব আমি। খুলে দিন দরজাটা।
কয়েক মাস আগে মদ্যশালায় পুলিশ কর্মী বসাকির যে রিভলভারটা পকেটস্থ করেছিল কার্পেন্টার, সেইটাই অকম্পিত হাতে উঁচিয়ে ধরে সে লিওনার্ডের দিকে।
স্বর শুনেই রান্নাঘরে ছুটে এসেছিল মিসেস পাওয়েল। খুব ধীরস্থিরভাবে সংক্ষেপে বলে উঠল লিওনার্ড–ডার্লিং, উত্তেজিত হয়ো না। এরই নাম কার্পেন্টার। ও বলছে, ওর কথামতো কাজ করলে ও গুলি করবে না। আমাদের কোনও ক্ষতিই হবে না। চেঁচিও না।
অন্য ঘরে টেলিভিশন সেটটা চালিয়ে দিল ববি। কথা বলার শব্দ কানে আসতেই সচকিত হয়ে ওঠে কার্পেন্টার। সুধোয়–ওঘরে কে?
আমাদের দুই ছেলেমেয়ে। ববি এখন টেলিভিশন দেখছে। কিন্তু এখুনি এ-ঘরে আসবে ও শুভরাত্রি জানাতে। পিস্তলটা পকেটে রাখলে ভালো করতেন। ওকে বুঝিয়ে বলব-খন আমাদেরই বন্ধু আপনি। ও তা বিশ্বাস করবে। গণ্ডগোলও করবে না। কিন্তু রিভলভার দেখিয়ে ভয় পাইয়ে দিলে হয়তো ও চেঁচিয়ে কান্নাকাটি করতে পারে।
ববি ঘরে ঢুকতেই রিভলবার আড়ালে সরিয়ে রাখল কার্পেন্টার। মদে জড়ানো গলায় আস্তে আস্তে কয়েকটি কথাও বলল তার সঙ্গে। কোনও কিছু সন্দেহ না করে শুতে চলে গেল ববি।
পর পর দু-গেলাস জল খেল কার্পেন্টার। তারপর মিসেস পাওয়েলকে হুকুম করলে ক্ষতস্থান বাঁধার জন্যে একটা ব্যান্ডেজ নিয়ে আসতে। লিওনার্ড নিজে থেকেই ওষুধের দোকানে গিয়ে বীজবারক (অ্যান্টিসেপটিক) কিনে আনতে চাইল। কিন্তু কার্পেন্টার বড় হুঁশিয়ার। বাড়ি ছেড়ে বেরোনো তো দূরের কথা, একটু বেচাল দেখলেই ভয়ংকর পরিণতির সম্ভাবনাটা সঙ্গে সঙ্গে স্মরণ করিয়ে দিলে সে।
এরপর ট্রাউডার খুলে ফেলে আহত ঊরুর ওপর ব্যান্ডেজ বাঁধলে কার্পেন্টার। কের-এর প্রথম বুলেটটা মাংসর মধ্যে দিয়ে গেলেও দ্বিতীয় বুলেটটা গা ঘেঁষে বেরিয়ে গেছে–এতটুকু আঁচড়ও লাগেনি। মিসেস পাওয়েলকে দিয়ে টোস্ট আর কফি তৈরি করিয়ে আনল ও। কিন্তু খেল খুব অল্পই।
ক্ষুগ্নিবৃত্তি এবং ক্ষতস্থান শুশ্রষার পর লিভিংরুমে গিয়ে পাওয়েল দম্পতির সঙ্গে টেলিভিশন দেখতে বসল কার্পেন্টার। প্রোগ্রাম বন্ধ করে বিস্তারিতভাবে তার সর্বশেষ কীর্তির বুলেটিন প্রচারিত হওয়ার সময়ে নেকড়ের মতো দাঁত বের করে হি-হি করে হেসে উঠল কার্পেন্টার।
ট্রাক চালানোই লিওনার্ড পাওয়েলের পেশা। ছ-ফুট চার ইঞ্চি উঁচু বিশাল শরীরে শক্তি বড় কম নেই। ওজনও কার্পেন্টারের চাইতে কম করে ষাট পাউন্ড বেশি। কিন্তু খুনে কার্পেন্টারের মন তো নয়–যেন একটা শক্তিশালী রাডার যন্ত্র। রাডার-মন দিয়ে পাওয়েলের চিন্তাশক্তি আঁচ করে নিয়ে প্রাকুটি করে চিবিয়ে সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন–ও চেষ্টা করবেন না। বউ আর বাচ্চাগুলোর কথা মনে রাখবেন সবসময়ে।
দেহের প্রতিটি তন্তুতে নিঃসীম ক্লান্তির গুরুভার নামলেও রীতিমতো হুঁশিয়ার রইল কার্পেন্টার। অনেকক্ষণ পরে পাওয়েল বললে এবার ঘরের আলো নিভিয়ে দেওয়া দরকার। তা না হলে প্রতিবেশীদের সন্দেহ হতে পারে। খড়খড়ির পাখিগুলো নামিয়ে দিতে হুকুম করল কার্পেন্টার। জানলার আর আলোর ওপরেও আবরণ টেনে দেওয়া হল তার নির্দেশে। দেখতে দেখতে ভ্যাপসা গরমে উনুনের মতোই তপ্ত হয়ে উঠল ঘরটা।
বহুদূর থেকে ভেসে আসছিল পুলিশ সাইরেনের তীক্ষ্ণ তীব্র শব্দ–আশপাশের অঞ্চল তন্নতন্ন করে খুঁজছিল ওরা। যেন নিজের সঙ্গেই নিজে কথা বলছে, এমনিভাবে বিড়বিড় করে ওঠে কার্পেন্টার–আমার সম্বন্ধে খুব বেশি মাথা ঘামাবেন না আপনারা। শুধু এইটুকুই জানিয়ে রাখতে চাই, প্রথম গুলিটা আমি ছুঁড়িনি। যাকগে, ও নিয়ে আর এখন ভেবে লাভ কি।
তন্ময় হয়ে টেলিভিশন শুনতে লাগল কার্পেন্টার। কের তখনও জীবিত ছিল কিনা, সেই খবরই জানার জন্যেই কানখাড়া করে বসে রইল অনেকক্ষণ। তারপর বলল–শুধু একটি দুঃখ রয়ে গেল আমার জীবনে। এমন কোনও কাজ করে গেলাম না যার জন্যে আমার মা আর বোনেরা গর্ববোধ করতে পারে। অত্যন্ত নোংরা আর উদ্ধৃঙ্খল জীবনযাপন করেছি আমি। কিন্তু এখন বড় দেরি হয়ে গেছে। হয় ওই টিকটিকিগুলোর গুলিতে আমাকে মরতে হবে, আর না হলে ইলেকট্রিক চেয়ার তো রয়েছেই। মরবার আগে অন্তত একবারের জন্য মাকে দেখতে পেলে অনেকটা শান্তি পাব আমি।
বন্ধুর মতোই সমবেদনার সুরে বলে লিওনার্ড–চেষ্টা করলে আমার তো মনে হয় অনেক ভালো থাকতে পারতে তুমি, সবার ভালোবাসাও পেতে। তোমার বর্তমান হাল দেখে, এত কষ্ট দেখে, বাস্তবিকই দুঃখ হচ্ছে আমার।
সঠিক মনোবিদ্যা প্রয়োগ করেছিল লিওনার্ড। সমবেদনার স্নিগ্ধ ছোঁয়া পেলেই সবকিছু ভুলে যেত কার্পেন্টার। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না। সঙ্গে সঙ্গে উচ্ছ্বসিত স্বরে বলে উঠল–আজ সারারাত এখানেই থাকব আমি। কাল রাতও থাকব। অন্ধকার হলে তবে বেরুব। ততক্ষণে টিকটিকিগুলো নিশ্চয় এ অঞ্চল ছেড়ে অন্য অঞ্চলে যাবে আমাকে খুঁজতে।
ছেলেমেয়েদের শোবার ঘরে ঘুমোবার ইচ্ছে ছিল কার্পেন্টারের। সেক্ষেত্রে তার রক্ষণাবেক্ষণের ভারটা থাকত নাকি ওদের ওপরেই। কিন্তু মায়ের মন কেঁপে উঠল তাতে। মরিয়া হয়ে এই বলে বোঝালে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে ছোটমেয়ে অচেনা মুখ দেখে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠতে পারে। তাহলেই মহাবিপদ। যুক্তিটা মনে ধরল কার্পেন্টারের। কাজেই বদ্ধ ঘরে পাওয়েল দম্পতির সঙ্গেই রাত কাটানোর আয়োজন করল ও।
একটির পর একটি ঘণ্টা কাটতে থাকে। আরও গুমোট হয়ে উঠতে থাকে ছোট্ট ঘরটা। রিভলভারটা হাতেই রেখেছিল কার্পেন্টার। ঘুম-ঘুম চোখেও সজাগ রেখেছিল দৃষ্টি। ঘুমের দাপটে চোখ দুটো একেবারেই বন্ধ না হয়ে যায় সেজন্যে সারারাত সে কি প্রানান্তকর প্রচেষ্টা তার!
পরের দিন ভোরবেলা লিওনার্ড বললে–আমাকে কাজে বেরুতে হবে। না বেরুলে কোম্পানি আর পাড়াপড়শীরা অনেক প্রশ্ন করতে পারে। অপলক চোখে লিওনার্ডের মুখের দিকে তাকিয়ে কার্পেন্টার শুধু বললে–যাচ্ছেন যান, কিন্তু মনে রাখবেন বাড়িতে রইল আপনার স্ত্রী আর দুই ছেলেমেয়ে। আমি যদি আপনি হতাম, তাহলে এরকম পরিস্থিতিতে আহাম্মকের মতো কিছুই করতাম না। বুঝেছেন?
লিওনার্ড বুঝেছিল। সাড়ে ছটার সময়ে বেরিয়ে গেল সে। রাত্রেই তো আপদ বিদেয় বাড়ি থেকে। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশে ফোন করলেই চলবে খন। ওইটুকু সময়ের মধ্যে বেশি পথ আর যেতে হচ্ছে না বাছাধনকে। লাঞ্চ খাওয়ার অবসরে স্ত্রীকে ফোন করল লিওনার্ড সব শান্ত। কোনও হাঙ্গামা নেই।
দিনের বেলা কয়েক ঘণ্টা ঘুমিয়ে নিল কার্পেন্টার। ঘুম থেকে উঠে এক পেট খেয়েও নিল। তারপর গোঁফটা কামিয়ে ফেলে মুখ পরিষ্কার করে ফেলল। মিসেস পাওয়েলের ভয়ার্ত মুখচ্ছবি দেখে নিশ্চিন্ত ছিল কার্পেন্টার। নিদারুণ আতঙ্কে এমনই অন্তর-কঁপুনি শুরু হয়েছিল তার যে কোনওরকম বিপদের সম্ভাবনাই ছিল না ওদিক থেকে। সেইদিনই বিকেলে মিসেস পাওয়েলের মা এল মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে। এই সময়টা ছেলেমেয়েদের শোবার ঘরে ঘাপটি মেরে রইল কার্পেন্টার।
দারুণ উদ্বিগ্ন মন নিয়ে কাজ থেকে ফিরে এল লিওনার্ড। সঙ্গে এনেছিল সেইদিনকার দৈনিকের সর্বশেষ সংস্করণ! কাগজটা ছিনিয়ে নিল কার্পেন্টার। তারপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল নিজের সম্বন্ধে টাটকা সংবাদ জানার আগ্রহে। আর তখনই অবস্থায় গুরুত্ব উপলব্ধি করে বলে উঠল ও–অন্ততপক্ষে আরও দুদিন এ জায়গা ছেড়ে বেরোনো চলবে না। এখানে থাকার জন্যে আপনাদের খরচপত্রও আমি পরে পুষিয়ে দেব কিছু টাকা পাঠিয়ে।
ডিনার তৈরি করে ডাক দিল মিসেস পাওয়েল। কিন্তু অচেনা লোকের সঙ্গে এক টেবিলে বসে খেতে ছেলেমেয়েরা অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করায় কালো আঙুর আর শাকসজীভরা প্লেটটা নিয়ে সামনের ঘরে উঠে এল কার্পেন্টার। ইতিমধ্যে খেতে খেতে ফিসফাস করে কি শলাপরামর্শ করে নিল পাওয়েল দম্পতি। তার পরেই লিওনার্ড উঠে গেল অন্য ঘরে কার্পেন্টারের কাছে। গিয়ে বললে যে তার ছেলেমেয়েদের একটা নিয়মিত অভ্যাস আছে। প্রতিদিন রাত্রে বাড়ির সামনে গিয়ে ওরা মা আর দাদু-দিদিমার সঙ্গে কিছুক্ষণ বসে থাকে। সে রাতেও ওদের যাওয়া দরকার। দুই কঁধ ঝাঁকিয়ে অনুমতি দিল কার্পেন্টার।
কিছুক্ষণ পরে লিওনার্ড বলে উঠল–এই যাঃ, ভুলেই গিয়েছিলাম। শ্বশুরের সঙ্গে ব্যবসা সংক্রান্ত কিছু কথা কইবো বলেছিলাম। আমারই যাওয়া দরকার নীচে। তা না হলে উনি নিজেই উঠে আসবেন।
কার্পেন্টার বললেন,–অত কথায় কাজ কি। ঠিক দশ মিনিটের মধ্যে আপনার ফিরে আসা চাই। ভুলে যাবেন না আপনার স্ত্রী আর ছেলেমেয়েরা আমার রিভলভারের পাল্লার মধ্যেই রয়েছে।
ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে এল লিওনার্ড। পরক্ষণে গোটা কয়েক লম্বা লাফে পেছনের সিঁড়ি দিয়ে বাড়ির পেছনে এসে ইঙ্গিতে স্ত্রীকে ডেকে বলে দিল ছেলেমেয়ে আর তার বাবা-মাকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যেতে। ঠিক এইরকমটিই আশা করছিল মিসেস পাওয়েল। তারপর কী করা উচিত তা তাকে না বললেও চলত। রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল লিওনার্ড। ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে ছুটতে খেলায় মগ্ন ছেলেমেয়েদের চিৎকার করে সাবধান করে দিলে–পালাও এক্ষুণি–বন্দুক নিয়ে আসছে একটা খুনে গুন্ডা।
ঠিক নটা বেজে এক মিনিটের সময়ে টেলিফোন পেলাম লিওনার্ড পাওয়েলের। ডিটেকটিভদের চিফ ফ্রাঙ্ক ও সুলিভ্যান টেলিফোন পেয়ে ছোট্ট করে বললেন লিওনার্ডকে–গ্যাট হয়ে বসে থাকুন। আমরা আসছি। তৎক্ষণাৎ বেতার বার্তা চলে গেল তিরিশটা পুলিশের গাড়িতে। প্রত্যেকেই চতুর্দিক থেকে এগিয়ে আসতে লাগল পাওয়ালের ফ্ল্যাটের দিকে। কয়েক মিনিট পরেই সার্জেন্ট মিকলাজ-এর গলা শুনলাম :
কার্পেন্টার…কার্পেন্টার…ওপরে হাত তুলে বেরিয়ে এসো। বাড়ি ঘেরাও করে ফেলেছি আমরা। সরে পড়ার কোনও সুযোগই নেই।
জানলার সামনে আবির্ভূত হল কার্পেন্টার। দড়াম করে সার্জেন্টের দিকে গুলিবর্ষণ করেই সাঁৎ করে সরে গেল আড়ালে।
মিকলাজ এবার চিৎকার করে হুশিয়ার করে দিলে বাড়ির অন্যান্য বাসিন্দাদের। সবাই যেন মেঝের ওপর শুয়ে পড়েন–পুলিশ গুলিবর্ষণ শুরু করবে কার্পেন্টারের ওপর। ইতিমধ্যে প্রায় হাজার দুয়েক উৎসুক লোক দাঁড়িয়ে গিয়েছিল রাস্তার ওপর। সবার সামনেই আবার কার্পেন্টার দেখিয়ে দিয়ে গেল তার অসমসাহসিকতা আর অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতা। পাওয়েলদের জানলা থেকে আচম্বিতে সে লাফিয়ে উঠল শূন্যপথে–চার ফুট দূরেই ছিল পাশের বাড়ির জানলাটা। জনতা এবং পুলিশ কিছু বোঝবার আগেই দারুণ শব্দে খোলা জানলাটার ওপর আছড়ে পড়ল সে। ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল সার্সির কাঁচ, অক্ষত রইল না তার মুখ আর হাত। চক্ষের নিমেষে ঘরের মধ্যে সেঁধিয়ে গেল কার্পেন্টার। ঘরের মধ্যে যে কজন ছিল, তারা তো ভয়ে কাঠ হয়ে প্রায় মিশে গেল দেওয়ালের সঙ্গে। কোনও দিকে না তাকিয়ে এক দৌড়ে ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল ও। সেখান থেকে সিঁড়ি টপকে পৌঁছোল আর এক ফ্ল্যাটে। মূর্তিমান বিভীষিকার মতো রিচার্ড কার্পেন্টারকে ধেয়ে আসতে দেখে সে ঘরের বাসিন্দারা আগেই উধাও হয়েছিল।
বাইরের বিস্ময়বিহ্বল দৃশ্য দেখার লোভ সম্বরণ করতে পারল না কার্পেন্টার। তাই জানলা দিয়ে উঁকি মারতেই কালি পটকার স্তূপে আগুন লাগার মতো প্রচণ্ড শব্দে এক ঝাঁক পুলিশের গুলি ছুটে এল তাকে লক্ষ্য করে। সাঁৎ করে কার্পেন্টার আড়ালে সরে এল বটে, কিন্তু টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ল সার্সির কাঁচ আর ঝাঁঝরা হয়ে গেল কাঠের ফ্রেম। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই স্কোয়াড অফিসাররা ঢুকে পড়ল বাড়ির মধ্যে।
মেঝের ওপর বসেছিল কার্পেন্টার। পুলিশ অফিসারদের রণমূর্তি দেখেই নিরীহ নাগরিকদের মতোই বলে উঠল–আমি না, আমি না, আমাকে আপনাদের দরকার নেই। আমি তো এইখানেই থাকি।
কিন্তু এ ধোঁকাবাজিতে ভোলবার পাত্র নয় অফিসার। হিড়িহিড় করে সিঁড়ির ওপর দিয়ে ওকে টেনে নামিয়ে আনা হলে নীচে। একবার তো ফস্ করে রিভলভারটা বার করে ফেলেছিল আর কি! তবে তাতে সুবিধা করা গেল না। রাস্তায় টেনে নামানোর পরও মানুষ-নেকড়ের মতোই ও প্রাণপণে ধস্তাধস্তি করতে থাকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার। হইহই করে এগিয়ে এল মারমুখো জনতা। আর সে কি চিৎকার–মারুন, মারুন, খুন করে ফেলুন খুনে ছুঁচোটাকে!
ঠেলেঠুলে পুলিশের গাড়িতে তুলে দিলাম ওকে, মিনিট কয়েক পরেই চার্জরুমে দেহতল্লাস করা হল ওর। পাওয়া গেল এই কটা জিনিস : দুটো রিভলভার, ছটা ৩৮ কার্তুজ, এক প্যাকেট অ্যাসপিরিন, হাতঘড়ি, পাঁচটা চাবি, দুটো পাঁচ ডলারের নোট আর খুচরো আটটা সেন্ট।
বিচার শুরু হলে কার্পেন্টারের হাত-পা বেঁধে এবং কোমরবন্ধনীর সঙ্গে পুরু চামড়ার ফিতে লাগিয়ে আদালতে নিয়ে যাওয়া হল তাকে। বড় বিশ্রী দেখাচ্ছিল ওকে দাড়ি না কামানোর জন্যে আর চুল না আঁচড়ানোর জন্যে। শুনানির সময়ে আগাগোড়া একজন আত্মীয়ার সঙ্গে কথা কইল কার্পেন্টার। স্টেট প্রসিকিউটর জোর গলায় বললেন, রিচার্ড কার্পেন্টার আইনত সুস্থ মস্তিষ্ক। বেশ কয়েকজন মনোসমীক্ষককে ডেকে তিনি প্রমাণ করে দিলেন কোনটা ন্যায় আর কোনটা অন্যায়, তা বোঝার টনটনে জ্ঞান আছে তার। কৌসিলীর সঙ্গে সহযোগিতা করার মতো বুদ্ধিবিবেচনারও অভাব নেই।
আর তাই, ডিটেকটিভ উইলিয়াম মর্ফিকে হত্যার অপরাধে ১৯৫৬ সালের ১৬ মার্চ আদুরে খোক পুলিশ-হন্তা রিচার্ড ডি কার্পেন্টারকে ইলেকট্রিক চেয়ারে বসিয়ে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়া হল শুনে কেউই অবাক হননি।
* জন ফ্লানেগান (শিকাগো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) রচিত কাহিনি অবলম্বনেও।
আফিং ও ইন্দ্রনাথ রুদ্র
ইন্দ্রনাথ রুদ্রকে অনেক অপকর্মের নাড়ীনক্ষত্র জানতে হয়েছে, কারণ সে প্রাইভেট ডিটেকটিভ। তা সত্ত্বেও একটি কেস নিয়ে নাজেহাল হয়েছিল ইন্দ্রনাথ। হওয়াটা আশ্চর্য নয়। কেন না, এত জেনেও যা নিয়ে কোনওদিন মাথা ঘামাতে হয়নি তাকে, চাঞ্চল্যকর এই মামলার মূল রহস্য ছিল সেইটাই। আমি আফিংয়ের চোরাই কারবারের কথা বলছি।
বড়দিনের সময়ে সাধারণত আমরা কলকাতায় থাকি না। শীতের আমেজ গায়ে লাগলেই মনটা উড়ুউড়ু হতে থাকে। বড়দিনের কটা দিন কোথাও না কোথাও কাটিয়ে আসি। একা কখনো যাই না। গৃহিণী কবিতা সঙ্গে তো থাকেই। সেই সঙ্গে বন্ধুবর ইন্দ্রনাথ রুদ্র।
বছর কয়েক আগে এমনি একটা বড়দিন কাটাতে আমরা এসেছিলাম রাজস্থানে। মরুভূমির শীতের একটা আলাদা আমেজ আছে। ধু-ধু বালির দিকে তাকিয়ে মনটাও কেন যেন হু-হুঁ করে ওঠে। আমার গিন্নি বলে, তুমি নির্ঘাত আরব বেদুইন ছিলে গত জন্মে। আমি ওর থুতনি নেড়ে বলতাম–আর তুমি ছিলে বেদুইন বউ?।
ইন্দ্রনাথ অমনি গলাখাঁকারি দিত পেছন থেকে। বলত–ওহে কপোত-কপোতী, তোমাদের দস্যুবৃত্তির মধ্যে আমি কিন্তু ছিলাম না।
মুখ টিপে হেসে কবিতা বলত–তুমি দস্যু নও, তুমি তস্কর। রমণীকুলের চিত্ত লোপাট করতে অদ্বিতীয়।
ছেলেমানুষ হয়ে যেতাম তিনজনেই। মরুভূমি আমাদের সব ভুলিয়ে দিত। আমরা ভুলে যেতাম আমাদের শিষ্টাচারের আড়ষ্টতা, ভুলে যেতাম কথা বলার ঠাটবাট। সহজ হয়ে যেতাম অন্তর পর্যন্ত। ফলে যে ধরনের ইয়ার্কি-ঠাট্টায় মত্ত হতাম, তা নিষ্পাপ মনেই করতাম।
দিনরাত পাপী-তাপীদের নিয়ে ঘেঁটে ঘেঁটে ইন্দ্রনাথ নিজেও চাইত সব কিছু ভুলে যেতে। কিন্তু এমনই কপাল, কোনওবারেই তা সম্ভব হত না। একটা না একটা ভজকট ব্যাপার এসে জুটতই। যেমন হল সেবার–রাজস্থানে।
বিকানীরে গিয়ে আমরা মরুভূমির রুখু চেহারা দেখে কবিতার পর কবিতা আওড়াচ্ছিলাম, ইন্দ্রনাথ ওর কবি-কবি চেহারা নিয়ে বসে থাকত বালিয়াড়ির ওপর। হাওয়ায় চুল উড়ত। টানা-টানা স্বপ্নালু দুটি চোখে ও কিসের স্বপ্ন দেখত, তা ভগবানই জানেন। দেখে আমার মনটা কীরকম হয়ে যেত। ব্যাচেলর হলেই কি অমনি হয়? আমিও এককালে ব্যাচেলার ছিলাম। বম্বের কোটিপতি কন্যার পাণিপীড়ন করার আগে আমিও নিঃসঙ্গ ছিলাম। কিন্তু ইন্দ্রনাথের একাকীত্বের জাত আলাদা। ওর মনের নাগাল পাওয়ার ক্ষমতা বোধকরি কোনও নারীরই নেই। তাই ও চিরকুমারই রয়ে গেল।
সেদিন হঠাৎ কবিতা বায়না ধরল, ঠাকুরপো চল উটে চড়ি।
চড়ে? ভুরু কোচকালো ইন্দ্রনাথ।
মরুভূমির ভেতর পর্যন্ত চলে যাব। যেখানে মোটরসাইকেল যায় না, জিপ যায় না–সেইখানে চলবে আমাদের উট খপখপ করে। আমরা উটের পিঠে বসে দুলব আর দুলব। গলা ছেড়ে গান গাইব। বালিয়াড়ির ঢেউ দেখব। ফণিমনসা আর কাটাঝোঁপ গুণব। সূর্যাস্তের রঙ মনে গেঁথে নেব। তারপর আবার ফিরবে আমাদের উট খপখপ করে বালির টিলা পেরিয়ে। ভালো লাগবে না?
কবিতার কথার সুরে কী যেন ছিল। জাদু বোধহয় একেই বলে। ঘরকুণো বাঙালি আমরা। কিন্তু অ্যাডভেঞ্চারের নেশা কেন আমাদের রক্তে, এ প্রশ্নের জবাব পাই না। থর মরুভূমির দিকে তাকিয়ে ভাসা ভাসা দুটি চোখে দুর-দিগন্তের ছবি দুলিয়ে কবিতা যা বলল, তা যেন আমাদেরই মনের কথা। আমরা যেন একই সুরে একই গান গেয়ে উঠলাম। সমস্বরে বললাম-তাই ভালো। চল যাই।
এলাম স্টেশনের কাছে। উটের আড্ডা সেখানে। সেইসঙ্গে জিপ আর মোটরসাইকেল। অপরূপা কবিতার দুইপাশে দুই বঙ্গ-তনয় দেখে ছেকে ধরল ড্রাইভাররা। ওদের অনর্গল কথা থেকে এইটুকু বুঝলাম যে বাবুরা শুটিংয়ের জন্যে মরুভূমি দেখতে যাবেন তো? ফার্স্টক্লাস জিপ দেব, চলে আসুন। শুনলাম, শুটিং এখানে হামেশাই হচ্ছে। বিশেষ করে সত্যজিৎ রায় তাঁর গোপী গায়েন বাঘা বায়েন-এর কিছু দৃশ্যগ্রহণ করতে এ অঞ্চলে এসেছিলেন। তারপর থেকেই বেঙ্গলিবাবু দেখলেই আর রক্ষে নেই।
অত কথায় আমরা আর গেলাম না। শুধোলাম–উট আছে?
হাঁ করে তাকিয়ে রইল ওরা।
কবিতা এবার ওর দুর্গাপ্রতিমার মতো বড় বড় দুই চোখ পাকিয়ে ঝঙ্কার দিল–হাঁ করে দেখবার কি আছে? বলি, উট আছে?
উট? এমনভাবে ওরা সাড়া দিল যেন উট জিনিসটা প্রাগৈতিহাসিক জন্তু–এ যুগে দুর্লভ। ডাইনোসর বা টেরোড্যাকটিস-এর মতো উট প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলাও নিরাপদ নয়। একজন তো বলেই বসল–উট কি হবে? উটের পিঠ একতলা উঁচু। পড়ে মরবেন নাকি? হাড়গোড় গুঁড়িয়ে যাবে যে।
কবিতা গেল ক্ষেপে–তাতে তোমার কী? আমরা উট চাই। উটের পিঠে চাপব, মরি মরব। তিনটে উট চাই। সারাদিনের জন্যে।
ওরা অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে রইল। দু-একজন নিজেদের মধ্যে ফিসফাসও করে নিল। তারপর শুনলাম, উট নামক জীবটা নাকি ইদানীং বিকানীরে বড়ই দুর্লভ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চাইলেই তা পাওয়া যায় না। সবুর করতে হবে।
রাগে গজগজ করতে করতে আমরা ফিরে এলাম হোটেলে। কবিতা যদি নাগিনী হত, তাহলে নিশ্চয় আসবার সময় ছোবল বসিয়ে আসত উটের আড্ডায় কাউকে না কাউকে। কিন্তু কিছুই যখন করা গেল না, তখন আমরা গেলাম বিকানীর প্যালেসে। সেখানে পাথরের চত্বরে দাঁড়িয়ে নীচের শহরের দিকে তাকিয়ে আছি, দেখছি সাদা সাদা ঘিঞ্জি বাড়ির চেহারা আর ভাবছি সব দেশীয় রাজ্যেই কি একই দৃশ্য? চকমিলানো মার্বেল প্রাসাদ একজনের, ঝুঁকো বাড়ি সকলের?
এমন সময়ে কবিতা বলল–ঠাকুরপো, বললে তো বলবে মেয়েদের মনে সন্দেহ লেগেই আছে। কিন্তু সেই সকাল থেকে একটা লোক আমাদের পিছু নিয়েছে। লোকটা এখানেও এসেছে।
কবিতা কথাটা বলল যেন হাওয়াকে লক্ষ্য করে নীচের ঘিঞ্জি বাড়ির দিকে তাকিয়ে। ইন্দ্রনাথও কথাটা শুনল যেন হাওয়ার মুখে। দুজনের কেউই পিছন ফিরল না, এদিক ওদিক তাকাল না। অগত্যা আমিও যেভাবে দাঁড়িয়েছিলাম, রইলাম সেইভাবেই দাঁড়িয়ে।
ইন্দ্রনাথ বলল–যদি কেউ পেছনে লেগে থাকে তো তোমার জন্যে।
অপরাধ?
তোমার উর্বশীরূপ। বিদেশ-বিভুয়ে বেরিয়ে রূপটাকে ঢেকে রাখলেই পার।
তুমি গোয়েন্দা না কচু। |||||||||| কেন?
চোখ থাকতেও চোখ নেই। মেয়েদের এইজন্যই গোয়েন্দা হওয়া উচিত।
খুলে বল।
আমরা সোজা চলি। সোজা দেখি। কিন্তু পাশ থেকে কে আমাদের দেখে কী করছে, না তাকিয়েও বুঝতে পারি। যেমন এখন পেরেছি।
সে তো ভালো কথা। কিন্তু সে জন্যে আমি গোয়েন্দা না হয়ে কচু হতে যাব কেন?
যাবে এই কারণে যে লোকটা কার দিকে তাকিয়ে আছে তা তুমি দ্যাখনি–কিন্তু আমি দেখেছি।
কার দিকে তাকিয়ে?
তোমার দিকে।
ইন্দ্রনাথ কোনও জবাব দিল না। পকেট থেকে চন্দনকাঠের কাজ-করা সিগারেট কে বার করল। একটা সিগারেট ঠোঁটের ফাঁকে আলগোছে ঝুলিয়ে নিয়ে কি যেন ভাবতে লাগল। তারপর দেশলাই বার করে জ্বালতে গিয়ে কাঠি নিভে গেল। হাওয়া বোধহয় সামনে থেকে আসছে। তাই পেছন ফিরে হাত আড়াল করে কাঠি জ্বালতেই জ্বলে উঠল। সিগারেটও জ্বলল।
আমি দেখলাম, আঙুলের ফাঁক দিয়ে সেইসঙ্গে অদূরে মার্বেল ক্যানোপির কাছে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকেও দেখা হয়ে গেল ইন্দ্রনাথের।
কাঠিটা ফেলে দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল ইন্দ্রনাথ।
বলল–বউদিকে ধন্যবাদ জানাই। আমার নাম কচু হওয়াই উচিত। লোকটা আমাকেই নজরে রেখেছে।
কিন্তু কেন? শুধোলাম আমি।
বুঝতে পারছি না। আমরা তিনজনেই এ অঞ্চলে বিদেশি। অথচ নজর আমার দিকে। তার মানে একটাই। লোকটা আমাকে চেনে। আমি কিন্তু ওকে চিনতে পারছি না।
এই পর্যন্ত কথা হল বিকানীর প্যালেসে। এবার ফেরার পালা। মনটা আর ততটা হালকা নয়। রোমাঞ্চ-রোমাঞ্চ ভাবের সঙ্গে একটু দুর্ভাবনা তো আছেই। রাজপুতদের দেশে এসে না জানি কি ঝামেলায় পড়তে হয়।
হলও তাই। এঁকাবেঁকা পথে ফিরছে আমাদের অটোরিক্সা। মানে, তিনচাকার মোটর সাইকেল। আচমকা রাস্তার ওপর ডিনামাইট ফাটল।
পরে শুনেছিলাম, রাস্তা চওড়া করার জন্যে অমন ডিনামাইট নাকি হামেশাই ফাটছে শহরে। কখনো ফাটাচ্ছে মিলিটারি, কখনো অন্য কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সেদিনের ডিনামাইটটি কার দয়ায় সমস্ত রাস্তা জুড়ে ফাটল, সে হদিশ আর পাওয়া গেল না।
ফল হল সাঙ্ঘাতিক। বেগে ছুটছিল মোটরসাইকেল রিকশা, আচম্বিতে সামনে দেখলাম রাস্তা উড়ে গেল। তিনতলা বাড়ির সমান ধুলো আর ধোঁয়ার ফোয়ারা লাফিয়ে উঠল।
আর আমাদের অটোরিকশা সোজা গিয়ে আছাড় খেল সেই গর্তে।
তারপর আর কিছু মনে নেই।
জ্ঞান ফিরলে দেখলাম রাস্তাতেই শুয়ে আছি। মাথা ভিজে গেছে রক্তে। রক্তটা আমার চাইতে আমার ড্রাইভারের বেশি। তার খুলি দু-ফাঁক হয়ে গিয়েছে। মারা গিয়েছে সঙ্গে সঙ্গে।
কবিতার হাত ভেঙে গিয়েছে। ইন্দ্রনাথ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। মাথা দিয়ে গড়াচ্ছে রক্ত।
আমাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে অনেকে। তার মধ্যে মিলিটারি দেখলাম, পুলিশ দেখলাম সাধারণ পথচারীও দেখলাম।
মাথার মধ্যে অত যন্ত্রণা নিয়েও চোখ সরাতে পারছিলাম না ইন্দ্রনাথের ওপর থেকে। ইন্দ্রনাথ…যে ইন্দ্রনাথ সহস্র বিপদ-ঝঞ্ঝায় চিরকাল অকুতোভয়, যে ইন্দ্রনাথ বহুবার বহুভাবে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা কষে হাসতে হাসতে কদলী দেখিয়েছে যমালয়কে–সেই ইন্দ্রনাথ সামান্য একটা অ্যাকসিডেন্টের ফলে এমন হয়ে গেল?
হাসছিল ইন্দ্রনাথ। আপনমনে হাসছিল। শব্দহীন হাসি।
শব্দ ওর কণ্ঠেও আর জাগেনি।
.
ব্রেন শক। ডাক্তারেরা তাই বললে। মাথায় এমন চোট লেগেছে যে সহসা কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে ইন্দ্রনাথ রুদ্র। সেই সঙ্গে চিন্তার স্বচ্ছতাও। সংক্ষেপে পাগল হয়ে গিয়েছে দুরন্ত ইন্দ্র…সেই সঙ্গে হয়েছে বোবা।
সে কি কান্না কবিতার। খবর ছড়িয়ে পড়ল দেখতে দেখতে। সারা বিকানীর শহরে যেন জাদুমন্ত্রবলে রটে গেল, কলকাতার বিখ্যাত গোয়েন্দা ইন্দ্রনাথ রুদ্রকে ডিনামাইট ফাটিয়ে কারা যেন বোবা করে দিয়েছে, উন্মাদ বানিয়ে ছেড়েছে। মোমের হাত রহস্য ভেদ করে ভারত সরকারের মুখোজ্জ্বল করেছিল যে ইন্দ্রনাথ রুদ্র, হীরামনের হাহাকার প্রহেলিকায় অভূতপূর্ব মুন্সিয়ানা দেখিয়েছিল যে প্রাইভেট ডিটেকটিভ, মরুভূমির দেশে এসে সে ঘায়েল হয়েছে।
কিন্তু কাদের হাতে?
রহস্য রহস্যই রয়ে গেল। আমি ওকে কলকাতায় সরাতে চাইলাম । কিন্তু নতুন বিপদ দেখা দিল। একমুখ দাড়ি নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় টো-টো করত ইন্দ্রনাথ। এমনও গেছে রাতে ফেরেনি–সারাদিন ফেরেনি। তারপর আবার দেখা দিয়েছে লাল চোখ নিয়ে..মুখে সেই শব্দহীন হাসি। সরল চাহনি। মাঝে মাঝে কী এক আতঙ্কে বিস্ফারিত…তখন যেন চমকে চমকে উঠত অকারণে..খুট শব্দ শুনলেই এমন করে উঠত যেন কানের কাছে আবার ডিনামাইট ফাটল।
জয়ন্তকে চিঠি লিখলাম। জয়ন্ত চৌধুরী। আমাদের কলেজবন্ধু। এখন পুলিশের দাসত্ব করে। চোর-ছ্যাচোড় নিয়ে কারবার। বিপদে-আপদে তিন বন্ধুই তিনজনকে স্মরণ করতাম। এবারও করতে হল। কেননা, ইন্দ্রনাথকে আমি বিকানীর থেকে সরাতে পারছিলাম না কিছুতেই। যার দেখা পাওয়াই ভার, তাকে স্টেশনে নিয়ে যাই কী করে?
জয়ন্ত এল যথাসময়ে। সব শুনল। ইন্দ্রনাথের সঙ্গেও দেখা হল। কিন্তু জয়ন্তকে যেন চিনি চিনি করেও চিনতে পারল না ইন্দ্রনাথ।
কীভাবে যে দিন কেটেছে, ভগবানই জানেন। কবিতা প্রায় নাওয়া-খাওয়া ত্যাগ করেছিল ইন্দ্রনাথের ওই শোচনীয় অবস্থা দেখে। কাকে সামলাই আমি? বন্ধুকে না, বউকে? আমার নিজের অবস্থাও যে শোচনীয়। নার্ভের সহ্যের একটা সীমা আছে তো।
জয়ন্ত স্থানীয় পুলিশ-মহলে গেল। উদ্দেশ্য ছিল ডিনামাইট বিস্ফোরণের কারণ অনুসন্ধান। ইন্দ্রনাথকে যে লোকটা পিছু নিয়েছিল, তার হদিশ পাওয়া গেছে কিনা, এ খোঁজও নিয়েছিল। খবর কিছুই পায়নি। পুলিশ মহল অন্য ঝামেলা নিয়ে নাকানিচোবানি খাচ্ছে। ডিনামাইট বিস্ফোরণ আর উধাও আততায়ী নিয়ে মস্তিষ্ক ঘর্মাক্ত করবার সময় তাদের নেই।
তবে চাঞ্চল্যকর একটা খবর নিয়ে এল জয়ন্ত। বালির দেশের সাজানো গোছানো সুন্দর এই শহরটিতে যে এমন অসুন্দরের কারবার চলছে, তা আমরা স্বপ্নেও ভাবিনি। আমি আফিং, মরফিন, হেরোইনের কথা বলছি।
বছরখানেক আগেই নাকি বোম্বাই, কলকাতা, দিল্লির পুলিশ মহল আর আবগারী বিভাগের টনক নড়েছিল। রাতারাতি মাদকদ্রব্যের চোরাই চালান কেন যে এত বেড়ে গেল, তা ভাবতে ভাবতে চুল পাকবার উপক্রম হয়েছিল কেষ্ট-বিষ্ণুদের। হোমরা-চোমরারা অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে, অনেক তদন্ত-টদন্ত করে জানতে চাইল মালটা আসছে কোত্থেকে? সমস্ত উত্তর ভারত তোলপাড় করে জানা গেল সেই তথ্য।
বিস্ময়কর তথ্য সন্দেহ নেই। প্রথমে সন্দেহ করা গিয়েছিল বোম্বাই আর কলকাতাকে। যত লটঘট ব্যাপার তো অপরাধের এই দুটি ডিপো থেকেই ঘটছে। কাজেই প্রচণ্ড চাপ এসে পড়েছিল দুই শহরের পুলিশ চাইদের ওপর। নাকে কি সরষের তেল দিয়ে ঘুমনো হচ্ছে? মরফিন-আফিং হেরোইনে দেশ যে ছেয়ে গেল।
চাপে পড়ে খোঁজ-খোঁজ শুরু হল। তখনই জানা গেল চাঞ্চল্যকর খবরটা। ঘুণাক্ষরেও যা কেউ কল্পনা করতে পারেনি, ঘটছে তাই। বড় শহর নয়, আফিং আর আফিংজাতীয় সব কিছুই বিপুল পরিমাণে চালান হচ্ছে বিকানীর শহর থেকে।
বিকানীর! যার নাম শুনলেই নেচে ওঠে টুরিস্টরা, চোরাই চালান আসছে সেই শহরেই। সেখান থেকে বিভিন্ন পথে মালটা ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে।
তবে কি টুরিস্টদের হাতেই আসছে চোরাই চালান? অসম্ভব। টুরিস্টরা আসছে কোত্থেকে? অধিকাংশই দিল্লি এবং বোম্বাই থেকে। অথচ পাকা খবর রয়েছে, মাল যাচ্ছে বিকানীর থেকে দিল্লি এবং বোম্বাইতে। ওদিকে থেকে এদিকে আসছে না।
তবে? তখন গবেষকরা বসলেন আফিংয়ের জাত নির্ণয় করতে। জানা গেল এ আফিংয়ের চাষ হয়েছে তুরস্কর মাটিতে। অর্থাৎ তুরস্কর আফিং মরফিন আর হেরোইনের আকারে ভারতে ঢুকছে বিকানীর দিয়ে।
কিন্তু কীভাবে? এই নিয়ে পাগল হবার উপক্রম হয়েছে স্থানীয় পুলিশ। সুরাহা আর হচ্ছে । তুরস্ক আর ভারতের মাঝে রয়েছে পারস্য, আফগানিস্থান, পাকিস্তান। তিন-তিনটে দেশ পেরিয়ে কাঁড়ি কাঁড়ি হেরোইন ভারতে প্রবেশ করছে। অথচ পথটা কিছুতেই ধরা যাচ্ছে না।
জয়ন্ত বলল–মৃগাঙ্ক, আফিং থেকে যে কটা মাদক দ্রব্য তৈরি হয়, তার মধ্যে সবচাইতে মারাত্মক হল হেরোইন। আউন্স পিছু এর দাম নিউইয়র্কে তিনশো থেকে ছশো ডলার। প্যারিসেও তাই। ইন্ডিয়ায় প্রতি আউন্স তিন হাজার থেকে ছহাজারে খুচরো বিক্রি হচ্ছে নীচের মহলে।
শুনে হাঁ হয়ে গেলাম আমি। বললাম–বল কি! তার মানে এক-এক চালানেই তো রাজা বনে যাওয়া যায়।
যায়ই তো। বিকানীর এয়ারপোর্ট থেকে একটা উড়োজাহাজে লেজের মধ্যে লুকিয়ে এক খেপে কত টাকার মাল নিয়ে গিয়েছিল জান?
কত টাকার?
শুনে কথা আটকে গেল আমার। জয়ন্ত দেখলাম খুবই উত্তেজিত। বলল–হিরোইনের যারা চোরাই চালান দেয়, তাদের একটা আন্তর্জাতিক দল আছে। নারকোটিক ব্যুরোর কাছে তাদের নামের লিস্টও আছে। নিউইয়র্ক থেকে চাপ এসেছে আমাদের ওপর। ইন্ডিয়া ঘাঁটি হয়ে দাঁড়িয়েছে হেরোইন পাচারের। ওরা বলছে, তুরস্কর আফিং ইরানের একটা ফ্যাক্টরিতে এসে হেরোইন হচ্ছে। সেখান থেকে ভারত হয়ে চলে যাচ্ছে বোর্নিও। বোর্নিও থেকে আরও ওদিকে। কি ফ্যাচাং বল তো।
আমি বললাম–ফ্যাচাং বলে ফ্যাচাং! কিন্তু তা নিয়ে আমাদের মাথাব্যথার দরকার কি ভাই? ইন্দ্রনাথকে নিয়ে পিট্টান দিতে পারলেই বাঁচি।
জয়ন্ত বললে–তাহলে তো হেরে ভূত হয়ে দেশে ফিরতে হয়।
হেরে ভূত হতে যাব কেন?
ইডিয়ট। ইন্দ্রনাথকে ঘায়েল করেছে যারা, তারা আঁচ করেছিল ইন্দ্রনাথ বিকানীর এসেছে ওদের ঘাঁটি খুঁজতে। বিকানীর পুলিশকে যারা থোড়াই কেয়ার করে, ইন্দ্রনাথকে তারা ভয় পেয়েছে। তাই চেয়েছিল পথের কাঁটা সরাতে। কিন্তু কী হতে কী হয়ে গেল।
খট করে একটা শব্দ হল। দেখি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ইন্দ্রনাথ। কখন জানি ফিরেছে রাস্তা থেকে। কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল তাও জানি না। নিঃশব্দে হাসছে জয়ন্তর দিকে চেয়ে।
মুখের হাসিটা পাগলের হাসি, কিন্তু চোখের হাসিটা যেন কীরকম।
.
দিন কয়েক পরের কথা।
কবিতার প্লাস্টার করা হাত নিয়ে ট্রেনের ধকল সইবে না বলেই বোধহয় জয়ন্ত কলকাতা যাত্রা স্থগিত রেখেছিল। বেরিয়ে যেত সেই সকালে, ফিরত রাতে। শুনতাম কলকাতা বোম্বাই দিল্লির নারকোটিক স্কোয়াড ডিটেকটিভরা এসে রোজ গুলতানি করছে বিকানীরে। এমনকী লন্ডন আর নিউইয়র্ক থেকেও দুজন এক্সপার্ট এসেছে চোরাই চালানের হদিশ বার করতে। কিন্তু ঘোল খেয়ে যাচ্ছে সবাই।
যে দিনের কথা বলছি, সেদিন সকাল থেকেই টিকি দেখা যায়নি ইন্দ্রনাথের। দুপুরের দিকে হন্তদন্ত হয়ে ফিরল জয়ন্ত। এসেই নাকে মুখে গুঁজে সেই যে বেরিয়ে গেল, সারা রাত আর পাত্তা নেই। যাবার সময়ে অবশ্য একটু অদ্ভুত হেসেছিল। বলেছিল, কাল সকালে একটা সারপ্রাইজ নিউজ দেব। তৈরি থাকি।
সুতরাং সারারাত জয়ন্ত না ফেরায় খুব দুশ্চিন্তা হয়নি। ধরে নিয়েছিলাম, হেরোইন নিয়ে নিশ্চয় সাতঘাটের জল খেয়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু সেইসঙ্গে উন্মাদ ইন্দ্রনাথও নিখোঁজ হয়ে যাওয়ায় চোখ থেকে ঘুম উড়ে গেল। কর্তা-গিন্নি দুজনেই ঠায় বসে৷ রাগ হতে লাগল জয়ন্তর ওপর। আফিংয়ের পাহাড়ে ভারত চাপা পড়ে পড়ুক, তাতে আমাদের কী? ইন্দ্রনাথ আগে না আফিং আগে? চটপট কলকাতায় নিয়ে গিয়ে ভালো ডাক্তার দেখালে এখনও হয়তো একটা অমূল্য ব্রেন রক্ষা পেতে পারে।
ছটফট করে কাটালাম সমস্ত রাত। ভোরের দিকে যখন নিজেই পুলিশ ফাঁড়ির দিকে যাব ভাবছি, এমন সময়ে একটা জিপ এসে থামল ফটকের সামনে।
পুলিশ জিপ। প্রথমে নামল জয়ন্ত। পেছনে ইন্দ্রনাথ রুদ্র। হাতে একটা জ্বলন্ত সিগারেট।
সিগারেট! ইন্দ্রনাথ ফের সিগারেট ধরেছে? অথচ ডিনামাইট বিস্ফোরণের পর থেকে সিগারেটের সঙ্গে ওর কোনও সম্পর্কই ছিল না!
.
জয়ন্ত বলেছিল, একটা সারপ্রাইজ নিউজ দেবে। সে নিউজটা যে এমনি পিলে-চমকানো হবে, তা ভাবিনি।
ঘরে ঢুকল ওরা দুজনে। ঢুকেই নাটকীয় ভঙ্গিমায় জয়ন্ত বলল–বন্ধুবর মৃগাঙ্ক এবং বন্ধুপত্নী কবিতা। তোমাদের প্রথমেই একটা সু-খবর জানাই। খবরটা হচ্ছে এই : থ্রি চিয়ার্স ফর ইন্দ্রনাথ রুদ্র! হিপ হিপ হুররে! হিপ হিপ হুররে! হিপ হিপ হুররে!!!
কোটরাগত দুই চোখ নাচিয়ে ইন্দ্ৰনাথ শুধু হাসল। শব্দহীন হাসি। সিগারেটে জপেশ টান দিয়ে বসল সোফায়।
চিরকালই দেখেছি, অধিক উত্তেজনায় আমি তোতলা হয়ে যাই। বিয়ের আগে কবিতার কাছে কতবার হয়েছি। এখনও গিন্নির মুখ-নাড়ায় মাঝে মাঝে হই। কিন্তু সেদিন তোতলা হলাম ইন্দ্রনাথের ওই পাগল মূর্তির মধ্যেও একটা অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ্য করে।
জয়ন্ত মুখ টিপে হাসল। বলল–মৃগ, আফিং-রহস্য ভেদ হল। কাল রাতে পুরো গ্যাংটা ধরা পড়েছে।
কোথায়? যন্ত্রচালিতের মতো প্রশ্ন করলাম।
উটের আড্ডায়।
উটের আজ্ঞায়! বলে ক্ষণেক হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম। তারপর বিজ্ঞের হাসি হেসে বললাম–তাই বল। উট আফিং বয়ে আনছিল। অথচ কেউ অ্যাদ্দিন দেখেনি।
উট আফিং বয়ে আনছিল–ঠিকই ধরেছিস। বলে অদ্ভুত হাসল জয়ন্ত। তবে কেউ দেখেনি। দেখবে কী করে? ফ্লোরোস্কোপ করার বিদ্যে যে কারো জানা ছিল না।
কি কোপ বললি?
ফ্লোরাস্কোপ। মানে যা দিয়ে চামড়া ভেদ করে মেট্যাল ক্যাপসুলগুলো দেখা যায়।
মেটাল ক্যাপসুল! ফ্লোরোস্কোপ! ভাই জয়ন্ত, আমার মাথা ঘুরছে। একে সারা রাত জেগেছি। আর তার ওপর আর হেঁয়ালি ভালো লাগে না। কী হয়েছে খুলে বল। আফিং, উট, ফ্লোরোস্কোপ, মেট্যাল ক্যাপসুল–মানে কী এ-সবের?
হে লেখক, গাঁজাখুরী গপপো না বানিয়ে এ কেস নিয়ে দুকলম লিখো। সুনাম হবে। তুরস্ক থেকে পাকিস্তান পর্যন্ত এসে হেরোইন আর মরফিন কীভাবে থর মরুভূমি পেরিয়ে বিকানীরে ঢুকেছিল তা জান?
জানবার জন্যেই তো আমি বসে।
উটের চলাচল মরুভূমির সীমান্তে খুব সন্দেহজনক কিছু নয়। তাই থর মরুভূমির ও-প্রান্তে ধাতুর ক্যাপসুল খাইয়ে দেওয়া হত উটদের। সাধারণ ক্যাপসুল নয়। ক্যাপসুলের ভেতরে থাকত হেরোইন আর মরফিন। উটের পাঁচকযন্ত্র যে কি বিদঘুঁটে, তা তোমার অজানা নয়। দীর্ঘদিন না খেয়েও শরীরের মধ্যে জমানো খাবার ভাঙিয়ে ওদের চলে যায়। মেটাল ক্যাপসুলগুলো অন্যান্য খাবারের সঙ্গে শরীরের মধ্যেই খাবার জমানোর খুপরিতে গিয়ে জমা থাকত। মরুভূমি পেরিয়ে বিকানীরে আসার পর উট মেরে খুপরির মধ্যে থেকে বার করে নেওয়া হত মেটাল ক্যাপসুল।
উট মেরে?
অবাক হওয়ার কী আছে? এক-একটা উট কত টাকার হেরোইন নিয়ে আসত জান?
আমি নীরব।
জয়ন্ত বলল–লাখখানেক টাকার কম তো নয়। কাজেই একটা উট মরলেও লাভের ভাগ এমন কিছু কমছে না। অথচ কারো চোখে পড়ছে না। তন্নতন্ন করে সার্চ করেও কিছু ধরা পড়ছে না। ফ্লোরোস্কোপ কই?
ফের ফ্লোরোস্কোপ। বলছি না হেঁয়ালি করিসনি। খেঁকিয়ে উঠলাম আমি। সারা রাত জেগে মাথার কি ঠিক থাকে?
থতমত খেয়ে জয়ন্ত বলল–বারে, হেঁয়ালি আর রইল কোথায়? সবই তো বললাম।
আজ্ঞে না, সব এখনও বলা হয়নি।
কী বাকি রইল বন্ধু?
উটকে সন্দেহ হল কেন?
বিকানীরে উট কমে গিয়েছিল বলে, উটের দাম হঠাৎ চড় চড় করে বেড়ে গিয়েছিল বলে, মরুভূমিতে বেড়াতে যাওয়ার জন্যে ইন্দ্রনাথ রুদ্র উট পায়নি বলে।
মরুভূমিতে-বেড়াতে-যাওয়ার জন্যে-ইন্দ্রনাথ-রুদ্র-উট-পায়নি-বলে! যেন আবৃত্তি করলাম…থেমে থেমে প্রতিটি শব্দ ওজন করে করে বললাম। তারপর বুঝি বিদ্যুৎ খেলে গেল মাথায়। বললাম সন্দিগ্ধ কণ্ঠে–ইন্দ্রনাথ কেন বলবে? ইন্দ্রনাথ তে বোবা।
আচমকা অট্টহাসি মানুষকে যে কি সাঙ্ঘাতিক চমকে দেয়, এতদিনে হাড়ে হাড়ে বুঝলাম।
কিঞ্চিৎ ধাতস্থ হয়ে দেখলাম ইন্দ্রনাথ রুদ্র হাসছে। হাসির ধমকে ফুলে ফুলে উঠছে সর্বদেহ। সশব্দ অট্টহাসি–নিঃশব্দ নয়।
ইন্দ্রনাথ রুদ্র হাসছে! শব্দ যার কণ্ঠ থেকে বিদায় নিয়েছিল ডিনামাইট বিস্ফোরণের পর মাথায় চোট পেয়ে, সে হাসছে।
হাসি থামিয়ে বলল ইন্দ্রনাথ রুদ্র–তুই একটা প্রকাণ্ড গভ। আমাকে যারা মারতে গিয়ে মারতে পারল না, তারা আবার আমাকে মরণ-মার মারত যদি না আমি বোবা আর পাগলের ভান করতাম। আমি বোবা নই, পাগল নই, কোনওকালেই হইনি। কেবল অভিনয় করেছিলাম ওদের ঢিঢ করবার জন্যে। উদ্দেশ্য আমার সফল হয়েছে। এবার হে বন্ধু, চল গৃহে ফিরি।
হঠাৎ একটা শব্দ শুনে ফিরে তাকিয়ে দেখলাম, কবিতার সংজ্ঞাহীন দেহ লুটোচ্ছে সোফার নীচে। জ্ঞান নেই। অথচ দুই চোখে বইছে অশ্রুর ধারা। আনন্দ-অশ্রু!
* সিনেমা জগৎ পত্রিকায় প্রকাশিত।
আবার জিরো জিরো গজানন
বেপারিটোলা লেনের অত্যাধুনিক অফিসকক্ষে বসে জিরো জিরো গজানন ওরফে বেলেঘাট্টাই গজানন টেবিলের ওপর দু-পা তুলে দিয়ে পাইপ টানা প্র্যাকটিস করছে। এককোণে টাইপরাইটার নিয়ে বসে উদাসভাবে কাঁচের জানলা দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে আছে তার অ্যাসিস্ট্যান্ট মিস প্রীতি বল ওরফে পুঁতিবালা। বোধহয় নাগরের কথা ভাবছে।
জিরো জিরো গজাননের প্রথম কাহিনি যাঁরা পড়েছেন, তাদের কাছে এই দুজনের নতুন পরিচয় দেওয়ার আর দরকার নেই। গজানন একসময়ে ছিল মেন্টাল ক্লিনিকে রাগের মাথায় লরির ওপর লাফিয়ে উঠে এক লাথিতে উইন্ডস্ক্রিন চুরমার করে ড্রাইভার-ট্রাইভার সবাইকে পিটিয়ে ঠান্ডা করার পরেই তার মাথার গোলযোগ দেখা যায় এবং বন্ধুরা টেনে হিঁচড়ে তাকে নিয়ে যায় পাগলের ডাক্তারের কাছে। ওষুধ নয়, স্রেফ বাক্যের মহিমায় সুস্থ হয় গজানন এবং ডাক্তারের নির্দেশে প্রতিভাকে কাজে লাগায় দেশের স্বার্থে।
অর্থাৎ স্পাইয়ের ব্যবসা করে। এ ব্যবসায় মারপিট উত্তেজনা হাঙ্গামা আছে, প্রাণটা যখন তখন পালাই-পালাই করে এবং সেইটাই গজাননের প্রচণ্ড রাগী ব্রেনটাকে বরফের মতো ঠান্ডা রেখে দেয়।
পুঁতিবালাকে সে সংগ্রহ করেছে হিন্দ সিনেমার সামনে থেকে। সন্ধের দিকে দাঁড়িয়ে কাপ্তেন পাকড়াবার ফিকির আঁটছিল চটুল চোখের ঝলক হেনে, অভাবে স্বভাব নষ্ট আর কী! দেখেই মাথা ঝ-আঁ করে উঠেছিল জিরো জিরো গজাননের।
তার ওই ঝাকড়া অসুর মার্কা চুলের রুদ্রমূর্তি আর তীব্র চাহনি দেখেই প্রমাদ গুনেছিল পুঁতিবালা। কিন্তু পালাবে কোথায়? গজানন তাকে অ্যাসিস্ট্যান্ট বানিয়েছে, তবে ছেড়েছে। তবে বয়সের ধর্ম তো যায় না। শিকার ধরতে বেরোলেই শ্রীমতী পুঁতিবালা একটু-আধটু এদিক-ওদিক করে বসে। গজানন তা জানে। বকে। দরকার হলে টি-টাটিও মারে। দুজনের মধ্যে কিন্তু ভারি মিষ্টি ভাইবোনের সম্পর্ক।
এই গেল গজানন-পুঁতিবালার ইতিবৃত্ত। দার্জিলিঙে হিপনোটিক কিলারদের বিরাট গ্যাংটার বারোটা বাজানোর পর থেকে গজাননের দক্ষিণা আর খাতির দুটোই বেড়ে গেছে। ইন্টারন্যাশনাল সিক্রেট সোসাইটি ত্রিশূল এখন আর তাকে ব্যঙ্গার্থে নেকনজরে দেখে না, সত্যি সত্যিই নেকনজরে দেখে এবং জটিল প্রাণঘাতী কেস না হলে তাকে তলব করে না।
গজাননের সুবিধে হচ্ছে সে একাই অ্যাকশনে নেমে পড়ে। ইন্ডিয়ান আর্মির রেড ডেভিল কম্যান্ডোদের মতো। হয় কাজ শেষ করে ফরসা হয়ে যাও, নইলে মরো–এই হল তার সোজা সরল কাজের দর্শন। কারও সাহায্য চাই না। এসেছি একলা, যাইব একলা, কেউ তো সঙ্গে যাবে না জিরো জিরো গজাননের এটা একটা প্রিয় গান। আর একটা প্রিয় গান হল, যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চল রে। গজানন লেখাপড়া শেখবার চান্স পায়নি কিন্তু গুরুদেবকে বেশ শ্রদ্ধা করে।
হঠাৎ পাইপ টানা বন্ধ করল গজানন। সাদা প্রিয়দর্শিনী টেলিফোনের পাশে লাল ইলেকট্রনিক আলোটা জ্বলছে আর নিভছে।
ত্রিশূল-এর টেলিফোন এসেছে। এসব কারিগরি ত্রিশূল কর্তৃপক্ষদের। স্পেশাল এজেন্টের স্পেশাল ব্যবস্থা তারাই করে দিয়ে গেছে।
মুখ থেকে পাইপ এবং টেবিল থেকে পা দুখানা ঝট করে নামিয়ে নিয়ে রিসিভার তুলে নিল গজানন। মেরুন কালারের টি-শার্টের ওপর সাদা যন্ত্রটাকে প্রায় ঠেকিয়ে সদ্য রপ্ত করা ইয়াঙ্কি টানে বললে–ইয়া..ইয়া…দিস ইজ জিরো জিরো গজানন।
ওপার থেকে ভেসে এল রামভেটকি সুরকিওয়ালার অতীব মধুর কণ্ঠস্বর–গজানন, মাই ডিয়ার গজানন, আর ইউ ফ্রি নাই?
আই অ্যাম অলওয়েজ ফ্রি ফর দ্য কানট্রি। এ কটা কথাও লিখে লিখে প্র্যাকটিস করে নিয়েছে গজানন। দু-চারটে ইংলিশ বুকনি না ছাড়লে এ লাইনে প্রেস্টিজ থাকে না।
গজানন, মাই সুইট গজানন, এখুনি চলে আসুন; ভেরি সুইট গলায় বললে রামভেটকি সুরকিওয়ালা–যার চোদ্দো পুরুষেও রামছাগল, ভেটকি মাছ বা সুরকির ব্যবসা করেনি। গুপ্তচর পেশায় নাকি অদ্ভুত-অদ্ভুত নাম নিলে শত্রুপক্ষের গায়ে কাঁটা দেয়। রামভেটকি সুরকিওয়ালাকে এমনিতে দেখলেও অবশ্য গায়ে কাঁটা না দিয়ে যায় না।
গজাননের সঙ্গে অনতিকাল পরেই দেখা হল এহেন লোমহর্ষণকারী পুরুষটির। ছোট্ট একটা বুলেটপ্রুফ ঘরের মধ্যে বসে তাড়ি খাচ্ছিল রামভেটকি। তাড়ি খেলে নাকি হাঁপানি সেরে যায়। তাই হুইস্কি ছেড়ে তাড়ি ধরেছে অতিশয় কদাকার এবং রীতিমতো ভয়ানক এই মানুষটা। মানুষের আগের কোন এক পুরুষ গরিলা ছিল। কীভাবে জানা নেই, বিধাতার দুর্বোধ্য লীলাহেতু বহু জন্ম পারের সেই বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়ে রামভেটকি জন্ম নিয়েছে। গুলি বিনিময়ের ফলে একটা কান হারিয়েছে। বুকেও একটা ফুটো আছে–সেই থেকেই হাঁপানির ব্যয়রাম, ডাইরেক্ট অ্যাকশনে আর নামতে পারে না। কিন্তু ডাইরেক্ট ডিসিশন নিতে তার জুড়ি নেই। ব্ল্যাক ক্যাট কম্যান্ডো ছিল সে এক সময়ে। যুদ্ধের সময়ে শত্রুপক্ষের পেছনে প্যারাসুট নিয়ে লাফিয়ে নেমেছে, টেলিকমিউনিকেশন সেন্টার ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে, অপারেশনাল হেড কোয়ার্টারে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে, বড় ঝামেলা পাকাচ্ছিল বলে বিশেষ এক কম্যান্ডারকে খতমও করেছে। ফিরে আসার পর এমন প্রস্তাবও উঠেছিল ব্ল্যাক ক্যাট কম্যান্ডের নাম এখন থেকে ব্ল্যাক গরিলা কম্যান্ডো রাখা তোক।
কিন্তু বেসরকারি সংস্থা ত্রিশূল তাকে টেনে নিয়েছে ভারতের স্বার্থরক্ষার জন্যে। এখন রামভেটকি সুরকিওয়ালার ডিম্যান্ড দেশে-বিদেশে–আজ কলকাতায়, এক মাস পরে মস্কোয়, তার পরের মাসে হয়তো ওয়াশিংটনে।
এহেন কালান্তক যমের সামনে অকুতোভয়ে দাঁড়িয়ে বললে আমাদের জিরো জিরো গজানন, ইয়েস বস, হোয়াট অর্ডার?
গজানন, কেস সিরিয়াস। অবতার সিং খতম।
অবতার সিং…অবতার সিং!…কোন অবতার?
ননসেন্স! অবতার সিং আমাদের কান্ট্রির বেস্ট সায়েন্টিফিক ব্রেন মিলিটারি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এমন গবেষণা করেছেন যে ভয়ে কাঁটা হয়ে গেছে তামাম দুনিয়া।
তাই নাকি?
আজ্ঞে হ্যাঁ। একটু কারেন্ট খবর রাখুন, গজানন। এই যে আইসল্যান্ড সামিট ব্যর্থ হল, গর্বাচভ আর রেগান যে যাঁর দেশে ফিরে গেলেন। কারণ কী? স্টার ওয়ার্সের চাইতেও ভয়ানক যুদ্ধ পরিকল্পনা অবতার সিং মাথায় এনে ফেলেছিলেন বলে। খবরটা হাইলি সিক্রেট–তা সত্ত্বেও লীক আউট হয়ে গেছিল। ফলে আইসল্যান্ডের আইস গলল না–মাঝখান থেকে অবতার সিং এর মাথাটা গেল।
মাথাটা গেল? বসে পড়ল গজানন। রামভেটকির শেষের কথায় মাথাটা শব্দের ওপর কেন এত জোর দেওয়া হল? নিশ্চয় তার মানে আছে।
হ্যাঁ, অবতার সিং-এর ব্রেন সমেত মাথাটা উধাও হয়েছে। শুধু চোয়াল আর মাথার পেছন দিকটা গলার সঙ্গে লেগে আছে।
.
দমদম এয়ারপোর্ট থেকে হেলিকপ্টারটা কলাইকুন্ডার যেখানে এসে নামল, তার আশেপাশে ধু-ধু মাঠ! বেশ কয়েক বছর আগে এখানে এয়ারফোর্সের মহড়া দেখে গেছিল গজানন। সে এক সাঙ্ঘাতিক দৃশ্য। ভারতীয় বিমানবহর যে কী দুর্ধর্ষ, সেদিন তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেয়েছিল।
রামভেটকি আগে নামল কপ্টার থেকে। পেছন-পেছন গজানন। এই ফাঁকা মাঠে মুন্ডুহীন একটা দেহ দেখবার প্রত্যাশায় যখন ইতি-উতি তাকাচ্ছে, রামভেটকি তখন হেলিকপ্টারকে পেছনে ফেলে হেলেদুলে এগিয়ে যাচ্ছে ছোট্ট একটা টিলার দিকে। কপ্টারের বিকট আওয়াজ শোনা গেল পেছনে। সচমকে ঘাড় ফিরিয়ে গজানন দেখলে শূন্যে উড়েছে অতিকায় গঙ্গাফড়িং। একটু কাত হয়ে উড়ে যাচ্ছে যেদিক থেকে এসেছে, সেই দিকেই। দেখতে-দেখতে দিকচক্রবালে হারিয়ে গেল যন্ত্রযান।
এটা আবার কী ব্যবস্থা? ফেরা হবে কী করে? চমক ভাঙল পেছন থেকে গরিলা বপুর সুমধুর কণ্ঠস্বরে, মাই ডিয়ার গজানন, হাঁ করে তাকিয়ে না থেকে চলে আসুন।
পেছন ফিরল গজানন। রামভেটকি টিলার কাছে পৌঁছে গেছে। এরকম উইয়ের ঢিপির মতো টিলা অজস্র রয়েছে এ অঞ্চলে। বিশেষ এই টিলাটির সঙ্গে রামভেটকির এত প্রণয় কেন বুঝল না।
তবুও পা দুটোকে টেবিল ফ্যানের মতো বনবন করে ঘুরিয়ে পৌঁছে গেল অতীতের ব্ল্যাক কম্যান্ডোর কাছে।
রামভেটকি ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছিল। গজানন জানে ঠিক ওইরকম স্বর্গীয় হাসি হাসতে-হাসতে রামভেটকি যে-কোনও মানুষের টুটি কেটে দিতে পারে–চক্ষের নিমেষে, অথবা জামাকাপড়ের অদৃশ্য কোনও অঞ্চল থেকে ফস করে আগ্নেয়াস্ত্র টেনে বের করে বেধড়ক গুলি চালিয়ে যেতে পারে নির্ভুল নিশানায়। রামভেটকি মূর্তিমান আতঙ্ক অকারণে হয়নি।
এহেন জীবন্ত বিভীষিকাটি মিঠে হেসে বুক পকেট থেকে একটা সরু ডটপেন বের করে হেঁট হল টিলার ওপর। এক হাতে খানকয়েক নুড়ি আর কিছু মাটি সরাতেই চোখে পড়ল এক ইঞ্চি বর্গক্ষেত্রের একটা ইস্পাতের পাত। ঠিক মাঝখানে ছোট্ট একটা ফুটো।
ডটপেনের যে জায়গা দিয়ে লেখা হয়, সেই জায়গাটা পেঁচিয়ে খুলে নিল রামভেটকি। কালির ছোট্ট টিউবটাও বেরিয়ে এল সেইসঙ্গে। এবার ডটপেন টর্চের মতো ফোকাস করল ইস্পাতের পাতটার ওপর। পেছনের ক্লিপটা ঘুরোতেই সরু রশ্মি রেখা গিয়ে পড়ল প্লেটের মাঝখানকার ফুটোয়। ক্লিপ আরও ঘোরাতেই সরু হয়ে এল রশ্মি–শেষপর্যন্ত বিন্দুর আকারে স্পর্শ করল ছোট্ট ফুটোটাকে।
সঙ্গে-সঙ্গে ভোজবাজি দেখা গেল চোখের সামনে। বেলেঘাটার মস্তান গজানন এরকম ম্যাজিক জীবনে দেখেনি সিনেমা টিনেমায় দেখার কথাটা ধর্তব্যের মধ্যে নয় বলে বাদ দেওয়া গেল।
বাঁ-দিকের কাকড় ছাওয়া ভূতল নিঃশব্দে সরে গেল পাশের দিকে। চৌকোনা ফোকর বেরিয়ে পড়েছে। সিঁড়ি দেখা যাচ্ছে।
চোখ ছানাবড়া করল না গজানন। না করার জন্যে ট্রেনিং নিতে হয়েছে বিস্তর। শুধু বললে সহজ গলায়–যে ফুটোটায় রে ফেললেন, ওটা তো বৃষ্টির জলে নষ্ট হয়েও যেতে পারে।
ডটপেনের রিফিল লাগিয়ে নিয়ে পকেটে রাখতে রাখতে বললে রামভেটকি, মাই ডিয়ার গজানন, ওই গুপ্ত রহস্যটা আপনাকেও দেখাইনি।
মানে?
ফুটোর মুখটা ঢাকা ছিল। পায়ের চাপে অনেক আগেই ঢাকনা সরিয়েছি।
ম্প্রিং টিপে?
হ্যাঁ। কিন্তু স্প্রিং লাগানো বোতামটা কোথায় আছে, তা জানতে চাইবেন না। দেখলেন না হেলিকপ্টারটাকেও সরিয়ে দিলাম। আমাদের এই গোপন আস্তানার খবর যত কম লোকে জানে, ততই ভালো। আসুন! বলে সিঁড়িতে পা দিলে রামভেটকি।
একটু পরেই কবন্ধ দেহ দেখে শিউরে উঠল গজানন।
কলাইকুণ্ডার এই তেপান্তরের মাঠের পাতালে এরকম এলাহি কাণ্ডকারখানা কে কবে দেখেছে? গজানন আবার পাগল হয়ে যাচ্ছে না তো?
দু-হাতের দুই মুঠো দিয়ে আঁকড়া চুল খামচে ধরে মাথাটাকে বেশ করে কঁকিয়ে নিল জিরো জিরো গজানন। স্পেশাল কম্যান্ডো ট্রেনিং নেওয়ার সময়ে সুবেদার ছাতু সিং ওকে পইপই করে বলেছিল, বাপুহে, চুল কেটে ছোট করে নাও। কেউ যেন খামচে ধরে তুলে আছাড় না মারতে পারে।
ভীষণ রেগে গেছিল গজানন, ধরলেই হল? আমার চুল ধরবে আর আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজের আছাড় খাওয়া দেখব? ধরুন না আপনি..চেষ্টা করে দেখুন।
গজাননের কটমটে চোখ আর অসুরমার্কা মুন্ডু দেখে সুবেদারের আর সে ইচ্ছে হয়নি। শুধু বলেছিল, বুঝবে ঠ্যালা।
চুল কাটব না।
হাজার হোক বাঙালি মস্তান। স্যামসনের চুলের মধ্যেই শক্তি নিহিত ছিল। বাঙালি মস্তানরাও তা বিশ্বাস করে। চুল কাটতে দেবে কেন? চুলের বাহারেই যে আসল বল।
তাই চক্ষু চড়কগাছ হয়ে যেতেই চুল ধরে মাথাটাকে কঁকিয়ে নিল গজানন। অন্য কারও ঘিলু হলে নিশ্চয় নড়ে যেত, কিন্তু জিরো জিরোর ঘিলু যে-সে ঘিলু নয়–নিরেট। তাই অমন প্রচণ্ড আঁকুনিতেও স্থানচ্যুত হল না।
কী দেখল গজানন? লম্বা করিডর সিঁড়ির একদম নিচের ধাপ থেকে শুরু হয়েছে। শেষ দেখা যাচ্ছে না–কেননা আলোগুলো সব নিভানো রয়েছে। সিঁড়ির মাথা থেকে দেখেছিল নিরন্ধ্র অন্ধকার বিরাজ করছে পায়ের তলায়। শেষ ধাপে পা দিতেই আপনা হতেই দপ করে জ্বলে উঠেছিল গোপন আলো–ঠিক পনেরো ফুট পর্যন্ত করিডর আলোকিত হয়েছিল সেই আলোর আভায়। রামভেটকি হনহন করে এগিয়েছে, যতই এগিয়েছে, ততই সামনের করিডর আলোকিত হয়েছে এবং পেছনের ফেলে আসা করিডর অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছে।
তাজ্জব হলেও চোখেমুখে তা প্রকাশ করেনি গজানন। সবই অতিরিক্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বা অতি সাবধানতা। দৈবাৎ যদি পাতাল ঘাঁটিতে কেউ প্রবেশ করে, অন্ধকারে নিশ্চয় টর্চ ফেলবে…
ফেলেওছিল গজানন। সিঁড়ির মাথা থেকেই অন্ধকারকে টিপ করে পেনসিল টর্চ ফোকাস করেছিল।
সঙ্গে-সঙ্গে অভূতপূর্ব কাণ্ড। সিঁড়িটা আচমকা লাল আলোয় ছেয়ে গেছিল। দু-পাশের দেওয়ালের গায়ে সারি-সারি ফোকর আবির্ভূত হয়েছিল এবং প্রত্যেকটা ফোকর দিয়ে একটা করে কালচে ইস্পাতের আগুন বর্ষণ করার নল বেরিয়ে এসেছিল। সবকটা নল ফেরানো টর্চ যে ধরে রয়েছে তার দিকে। অর্থাৎ গজাননের দিকে।
মেঘমন্ত্র চ্যালেঞ্জ শোনা গেছিল স্পিকারে–পাতাল পথ গমগম করে উঠেছিল সেই আওয়াজে, হু ইজ দেয়ার?
চকিতে পেছন ফিরে হতচকিত গজাননের হাত থেকে পেনসিল টর্চ ছিনিয়ে নিয়েছিল রামভেটকি সুরকিওয়ালা, স্পিকারে ততক্ষণে কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেছে।
থ্রি..টু…ওয়ান… ।
জিরো বলার আগেই ত্রিশূল বলে চেঁচিয়ে উঠেছিল রামভেটকি, সেইসঙ্গে একটা সংস্কৃত মন্ত্র উচ্চারণ করেছিল। খুবই জটিল এবং খটমট মন্ত্র। কিন্তু কীভাবে জানা নেই, গজাননের গজ মস্তিষ্কে তা অক্ষরে অক্ষরে গেঁথে গেছিল।
ঐন্দ্রীকুলিশপাতেন শততো দৈত্যদানবাঃ।
পেতুর্বিদারিতাঃ পৃথাং রুধিরৌঘ প্রবার্ষিণঃ।
ব্যস, অমনি লাল আলো গেল মিলিয়ে, তার আগেই রোমাঞ্চিত কলেবরে গজানন প্রত্যক্ষ করে নিয়েছিল, সারি-সারি নলগুলোও অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে ফোকরগুলোর মধ্যে।
ভয়ের চোটে যে গা ঘামে, তা সেদিন হাড়ে-হাড়ে উপলব্ধি করেছিল গজানন। কপালের ঘাম মুছতে-মুছতে কাষ্ঠ হেসে জিগ্যেস করেছিল রামভেটকিকে, ওটা কীসের মন্ত্র, বস্?
চণ্ডীপাঠ করলাম। প্রতিবার শ্লোক পালটায়। মুখস্থ করেও লাভ নেই। ইডিয়ট। আর আলো জ্বালাবেন না।
না, আর আলো জ্বালায়নি গজানন। শুধু তখনই মাথার চুল খামচে ধরে ঘিলু নাড়ানোর চেষ্টা করে ধাতস্থ হয়েছিল এবং তারপরেই দেখেছিল, পরের পর অদৃশ্য আলো জ্বলছে আপনা থেকেই করিডর বেয়ে এগোনোর সঙ্গে-সঙ্গে। সুবোধ অনুচরের মতো রামভেটকির পেছনে-পেছনে যেতে-যেতে দেখেছিল দু-পাশে সারি-সারি দরজায় সংস্কৃত অক্ষরে একটা করে লাইন লেখা রয়েছে। গজানন আবার সংস্কৃত পড়েনি। কোনও ল্যাঙ্গুয়েজই ভালোভাবে পড়েনি, সংস্কৃত বয়কট করেছিল বাল্যকালেই। তাই মানে বুঝতে পারেনি। কিন্তু রামভেটকি টোলের পণ্ডিতের মতো প্রতিটি নামের ওপর চোখ বুলিয়ে বিড়বিড় করে পড়তে-পড়তে সহসা থমকে দাঁড়াল একটা দরজার সামনে। পাল্লায় হাত বুলিয়ে অদৃশ্য কোনও বোতামে চাপ দিল বোধহয়–নিঃশব্দে পাল্লা সরে গেল পাশে।
আলো ঝলমল ঘরের মধ্যে দেখা গেল…
.
পুরো ঘরটাই খুব সম্ভব অ্যালুমিনিয়াম জাতীয় ধাতুর প্লেট দিয়ে মোড়া। এমন কিছু পেল্লাই ঘর নয়। লম্বায় চওড়ায় বড় জোর দশ ফুট। ঠান্ডা কনকনে ঘর। মনে হল যেন এইমাত্র ফ্রিজের পাল্লা খোলা হল। ভেতরে পা দিতেই গজাননের হাড় পর্যন্ত কেঁপে উঠল শুধু ঠান্ডায় নয়, টেবিলের ওপর রাখা বস্তুটি দেখে।
একটাই মাত্র টেবিল ঘরের ঠিক মাঝখানে। চকচকে স্টেনলেশ স্টিলের। তার ওপর শায়িত বস্তুটাকে এখন বস্তুই বলা উচিত, কেননা, যার মধ্যে প্রাণের নাচানাচি নেই, তাকে বস্তু বলাই সঙ্গ
এই যে বস্তুটা জিরো জিরো গজাননের হাড় পর্যন্ত কালিয়ে দিল, এর হাত-পা-বুক-পেট অবিকল মানুষের মতোই। কিন্তু মানুষ নামক প্রাণীটার মুণ্ডু বলেও একটা জিনিস থাকে ধড়ের আগায়–এর তা নেই।
শুধু নেই বললে কম বলা হবে, মুন্ডু যেখানে থাকবার কথা, সেখানে রয়েছে কাটা নখের মতো একফালি চোয়াল আর চিবুক। মুখের ওপর দিকটা অবিশ্বাস্যভাবে গোল করে কেটে নেওয়া হয়েছে। চোয়ালের আর চিবুকের হাড় মাখনের মতো যেন কেটে গেছে শল্যচিকিৎসকের ছুরিতে। কিন্তু এক ফোঁটা রক্ত নেই। চুঁইয়েও পড়েনি। ক্ষত মুখ বেমালুম জুড়ে গেছে।
পেটের মধ্যে গুলতানি শুরু হয়েছে টের পেল গজানন। এরকম তো কখনও হয় না। বেলেঘাট্টাই গজানন মুন্ডুহীন ধড় অনেক দেখেছে, নীলরতন সরকার মেডিক্যাল হাসপাতালের মর্গে উঁকি মেরে দেখেছে কবন্ধ দেহ (ফুটবল পেটানোর ফাঁকে-ফাঁকে), কিন্তু মানুষের মুন্ডু নিয়ে এরকম বিচ্ছিরি কারবার কখনও দেখেনি।
চিত্রার্পিত, মানে, ছবির মতোন দাঁড়িয়ে থাকা গজাননের পাশে এসে দাঁড়িয়ে রামভেটকি বললে, এই হচ্ছে অবতার সিং।
ঢোক গিলে গজানন বললে, কালী কালী… (গজানন সার্বজনীন কালী পুজোর বিরাট পাণ্ডা ছিল এককালে)–অবতার সিং বলে চিনব কী করে?
আপনি জীবনে দেখে থাকলে তো চিনবেন। আমরা দেখেছিলাম। এখন চিনেছি ফিঙ্গারপ্রিন্ট মিলিয়ে দেখে।
অবতার সিং!
আধ কলসি জল কঁকুনি দিলে যেরকম আওয়াজ হয়, প্রায় সেই ধরনের একটা আওয়াজ বেরোল রামভেটকির গলা দিয়ে। হাসি না হাহাকার ঠিক বোঝা গেল না।
বললে, না, অবতার সিং নন।
চমকে উঠল গজানন। এত জোরে পাশের দিকে মুন্ডু ঘোরাল যে কঁকড়া চুল চোখে মুখে এসে পড়ল।
বললে স্থলিত স্বরে, একবার বলছেন অবতার সিং, আবার বলছেন অবতার সিং নন। মানে…মানেটা কী?
মাই ডিয়ার ডিয়ার গজানন, হুঁশিয়ার হতে হয় এ লাইনে গোড়া থেকেই। অবতার সিং অদৃশ্য হয়ে যেতে পারেন, এই আশঙ্কায় আমরা নকল অবতার সিংকে বাজারে ছেড়ে রেখেছিলাম– আসল অবতার সিং এখন বহাল তবিয়তে আছেন আমাদের গোপন আস্তানায়।
আসল নকল। গজানন ঈষৎ বিমূঢ়।
ইয়েস, ইয়েস, মাই—
নিককে পেলেন কোত্থেকে?
যমজ ভাই অবতার সিং-এর।
কালী! কালী!
জিরো জিরো গজানন,–অকস্মাৎ কঠিন হয়ে ওঠে রামভেটকির স্বর, এ কাজ নিতে পারবেন?
মুন্ডুকাটাদের ঠিকানা বার করতে হবে?
হ্যাঁ। এভাবে মুন্ডু উড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা কারা ঘটাতে পারে, তারা কোন দেশের মানুষ। কীভাবে ঘটায়–সব জানতে হবে। দেশের স্বার্থে।
দেশের স্বার্থে; প্রতিধ্বনি করল গজানন। কানের মধ্যে অনুরণিত হল ডাঃ বক্সীর উপদেশ, দেশের স্বার্থে প্রতিভাকে কাজে লাগাবে গজানন, মস্তানিতে নয়।
জীবন যায় যাক, নৃশংস হত্যাকারীকে দরকার হলে হত্যাও করতে হতে পারে।
তা আর বলতে, দাঁত বার করে হাসল গজানন। এতক্ষণে বেশ ফ্রি মনে হচ্ছে নিজেকে। কতদিন যে খুনজখম, দাঙ্গাহাঙ্গামা হয়নি।–লাশটা পেলেন কোথায়?
দুর্গাপুরের জঙ্গলে।
.
নক্ষত্ৰবেগে হাইওয়ে ধরে ছুটে চলেছে গজাননের গাড়ি। লেটেস্ট মডেলের মারুতি। মেরুন কালার। ড্রাইভ করছে নিজেই। হাতে কাজ নিয়ে বেপারীটোলা লেনের অফিস ঘরে বসে থাকবার পাত্র সে নয়। পুঁতিবালাকে রেখে এসেছে অফিস ম্যানেজ করতে। ছুটকো পার্টি এলে ভাগিয়ে দেবেখন। গা-গতরের ব্যাপার থাকলে নিজেই ভিড়ে যাবে। ভাবতে ভাবতেই মুচকি হাসল গজানন। পুঁতিবালার এই দেহসর্বস্ব তদন্তধারা খুবই বাজে ব্যাপার সন্দেহ নেই, কিন্তু ওই তো বয়স..বয়সের ধর্ম তো থাকবেই, তাছাড়া কাজও হয় বটে…
আচমকা ব্রেক কষল গজানন। সরু রাস্তার ওপর দমাস করে একটা শালগাছ ফেলা হল। এই হল, এইমাত্র। আর একটু আগে ফেললে নির্ঘাত উলটে যেত মারুতি।
হালকা গাড়ি নিমেষে এক পাক ঘুরে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেল বটে, কিন্তু বগলের তলা থেকে রিভলভারটা টেনে বের করার আগেই ঝনঝন করে জানলার কাঁচ ভেঙে ঠিকরে এল ভেতর দিকে, সেই সঙ্গে ভীমের গদার মতো একটা শাল কাঠের খুঁটি।
খুঁটির টিপ ঠিক করাই ছিল। রগে ধাঁই করে মারতেই যে-কোনও ভদ্র সন্তানের মতো চোখে সরষের ফুল দেখল গজানন।
সিটে এলিয়ে পড়া দেহটার ঠ্যাং চেপে ধরে এক হ্যাঁচকায় রাস্তার ওপর টেনে নামাল যে দৈত্যটা, আকারে আয়তনে সে দানবসমান হলেও মানুষ। ঘাড় পর্যন্ত লুটোচ্ছে বাবরি চুল। কপালের ওপর দিয়ে একটা বড় চিত্রবিচিত্র রুমাল মাথার পেছন দিকে গিঁট দিয়ে বাঁধা। পরনে ঢিলে পায়জামা আর পাঞ্জাবি–দুটোই রঙিন ছিটের! মুখখানা রোদেপোড়া। গোঁফ আর দাড়ি প্রায় জঙ্গলের মতো বললেই চলেকুচকুচে কালো।
যে শালকাঠের খুঁটি দিয়ে গজাননের জ্ঞানলোপ করা হয়েছে, সেটা এক হাতেই ছিল। চটি পরা পা দিয়ে জিরো জিরোর মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা দেহটাকে ঠোক্কর মেরে চিৎ করে শোয়াল মানুষ-দানব। তারপর হাতের খুঁটি দু-হাতে বাগিয়ে ধরে আর একটা মোক্ষম ঘা মারল গজাননের মাথায়।
জিরো জিরোর মাথা বলেই রক্ষে, সাধারণ মানুষের মাথা ওই চোটেই দু-ফাঁক হয়ে যেত। কিন্তু শৈশব থেকেই গজাননের মাথার খুলির হাড় খুব মোটা–বোধহয় মোটা বুদ্ধির সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই স্রষ্টা মাথার ডিজাইনটা করেছিলেন।
খটাং করে করোটিতে চোট পড়তেই গজাননের ব্রেনের ভেতরে রাশি-রাশি নিউরোণের মধ্যে নিমেষে অজস্র সঙ্কেত বিনিময় ঘটে গেল। মগজের রহস্য বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মগজ বিশারদরাও আজও জানতে পারেননি–গজাননের মতো সৃষ্টিছাড়া মগজের খবর কে রাখে?
চক্ষের পলকে চনমন করে উঠল গজাননের সমস্ত সত্তা। ঠিক যেন প্রলয় ঘটে গেল কোষে কোষে, সেন্টারে-সেন্টারে। মুহূর্তের মধ্যে সটান উঠে বসল গজানন। এ আর এক গজানন। বেলেঘাট্টাই গজানন। চোখ জ্বলছে। দাঁত কিড়মিড় করছে।
মাথার খুলি দুফাঁক হওয়া দূরে থাক, এ যে উঠে বসেছে! তাকাচ্ছে অমানুষিক চোখে। দানোয় পেল নাকি? মারাদাঙ্গা দানবটা ক্ষণেকের জন্যে ঘাবড়ে গেছিল।
ওইটুকু সময়েরই দরকার ছিল গজাননের। পুরো শরীরটা বসা অবস্থাতেই শূন্যে ছিটকে গেল বিশাল আততায়ীর দিকে। (এই পাঁচটা জনৈক ব্ল্যাকবেল্ট ক্যারাটে মাস্টারের কাছে শিখেছে গজানন) এবং ছফুট শূন্যে উঠেই জোড়া পায়ের সজোর লাথি কষিয়ে দিল খুঁটিধারীর চোয়াল লক্ষ্য করে।
চোয়াল ভেঙে গেল আততায়ীর। কয়েকটা দাঁত ছিটকে পড়ল এদিকে-সেদিকে এবং সেইসঙ্গে নিজেও উলটে পড়ল পেছন দিকে।
গজানন শূন্য থেকে অবতীর্ণ হল তার বিশাল বপুর ওপর এবং পলকের মধ্যে দমাদম ক্যারাটে মার মেরে গেল চোখ, নাক টুটি লক্ষ্য করে। ফলে লোকটা চোখে অন্ধকার দেখল, ভাঙা নাক দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে টের পেল এবং কণ্ঠনালীর বারোটা বাজায় বিষম শব্দে কাশতে লাগল।
কিন্তু নাম তার খান বুদোশ। জিপসীদের পাণ্ডা খান বুদোশ। পূর্বপুরুষদের ইরানি রক্ত বইছে ধমনী-শিরায়। দু-হাজার জিপসী তার কথায় ওঠে-বসে। পয়সার বিনিময়ে হেন কাজ নেই যা তার পক্ষে সম্ভব নয়।
খান বুদোশের মুখে লাথি? গায়ে হাত? চোখে এমনিতেই অন্ধকার দেখছিল খান বুদোশ, এবার যন্ত্রণায় বুদ্ধির আলোও গেল নিভে। বিকট জিপসী হুঙ্কার ছেড়ে পাঞ্জাবির তলা থেকে টেনে বের করল রিভলভার এবং ট্রিগার টিপে গেল আন্দাজে জিরো জিরোকে তাগ করে।
নিস্তব্ধ বনভূমি শিউরে ওঠে হুঙ্কার এবং গুলিবর্ষণের শব্দে। বনের মধ্যে থেকে শোনা গেল আরও কয়েকজনের চিৎকার। হইহই করে ছুটে আসছে। চেঁচাচ্ছে অনেকগুলো কুকুর।
আসছে খান বুদোশের সাঙ্গপাঙ্গরা। ইরান যাদের নাগরিক অধিকার দেয়নি–তারা। ইরানে ফিরতে না পেরে বনের নেকড়ের মতো রয়েছে যারা তারা।
তারা এসে পড়লে গজাননের মুন্ডু নিয়ে গেণ্ডুয়া খেলা হত নিঃসন্দেহে, হাত-পা-ধড় চিবিয়ে খেত উপোসী কুকুরগুলো।
কিন্তু তার আগেই ঘটে গেল একটা আশ্চর্য ব্যাপার।
খান বুদোশ রিভলভার ধরতেই বিদ্যুৎগতিতে গজানন সরে গেছিল নিরাপদ দূরত্বে। দমাদম শব্দে গুলিগুলো এদিক-ওদিক ধেয়ে যাচ্ছে দেখে নিঃশব্দে শিস দেওয়ার ভঙ্গি করেছিল আপনমনে। মাথার মধ্যে সেই চিড়বিড়ে ভাবটাও অনেক কমে এসেছে।
এমন সময়ে জঙ্গলের গহনে শোনা গেল আগুয়ান কোলাহল।
সচকিত হল জিরো জিরো। কী করবে ভাবছে, অতর্কিতে বনের মধ্যে থেকে কক্ষচ্যুত উল্কার মতো ধেয়ে এল যেন সাক্ষাৎ বনদেবী।
অহো! অহো! কী রূপ! কী বিম্বাধর। কী তনুবর! কী বক্ষদেশ! টাইট জিন প্যান্ট আর গেঞ্জি পরা এহেন রূপসী শরীরী বিদ্যুতের মতো ছুটে এসে গজাননকে বলল, কুইক। খান বুদোশকে তুলুন গাড়ির মধ্যে।
খান বুদোশ। ফ্যালফ্যাল করে অপরূপার দিকে চেয়ে বললে গজানন।
আমাকে দেখবার অনেক সময় পাবেন। (অসহিষ্ণু স্বর বিম্বাধরার–ওরা যে এসে গেল। বলেই কোত্থেকে একটা রিভলভার বের করে দমাস করে মারল খান বুদোশের মাথায়। বেশ ভালো মার। জ্ঞান হারাল জিপসী-পাণ্ডা। ওদিকে গাছপালাদের ফাঁক দিয়ে দলে-দলে বেরিয়ে আসছে রংবেরঙের পোশাক পরা জিপসীদের দল।
দেখেই টনক নড়ল জিরো জিরোর। শুধু জিগ্যেস করলে, সুন্দরী, কে আপনি?
ত্রিশূল।
ও মাই গুডনেস, বলেই বীর বিক্রমে খান বুদোশকে টেনে নিয়ে গিয়ে ঢুকিয়ে দিল মারুতির পেছনের সিটে। ত্রিশূল সুন্দরীও সেখানে বসে পকেট থেকে নাইলন দড়ি বের করে বাঁধতে লাগল জিপসী সর্দারের হাত পা।
ততক্ষণে গাড়ি ঘুরে গিয়ে ছুটছে কলকাতায় দিকে–টপ স্পিডে। মাথার ফুলোটায় হাত বুলোতে-বুলোতে যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে গানটা গলা ছেড়ে গাইছে গজানন।
.
বারান্দায় দাঁড়িয়ে মাথা ঠান্ডা করে ফেলল গজানন। ত্রিশূল সংস্থাটার শুধু টাকার জোর নেই, রুচিও আছে বটে। খাসা বাংলো-বাড়ি! দার্জিলিংয়ে কালিম্পঙে যেমন কটেজ প্যাটার্নের দোতলা বাড়ি দেখা যায়, (গজানন শুনেছে বিলেতেও নাকি এমনই বাড়ি আছে)–অবিকল সেই ধরনের ছিমছাম বাড়ি গড়ে তুলেছে সল্টলেকের এই নিরালা সেক্টরে। চারপাশে অনেকখানি বাগান–মাঝে তন্বী শিখরদশনা পীন পয়োধরার মতো এই বাড়ি। বাস্তবিকই মনোরম।
ত্রিশূল সুন্দরীর নাম এলোকেশী, নামটা শুনে প্রথমে হেসেই ফেলেছিল গজানন। এলোকেশী তো তার পিসির নাম। ন্যাড়ামাথা বুড়িকে কতই না খেপিয়েছে গজানন। আর এই ডানাকাটা অপ্সরীর নাম কিনা এলোকেশী। যার চুল এলিয়ে দেওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। কারণ চুল তো ব্যাটা ছেলের মতো ছোট-ছোট করে কাটা।
এলোকেশী মুক্তাহাসি হেসে গজাননকে নিয়ে এসেছে সল্টলেকের এই ডেরায়। একাই থাকে নাকি এখানে। দেশবিদেশ থেকে ত্রিশূল এজেন্টরা এলে নিশ্চয় ওঠে এখানে। এলোকেশী অবশ্য তা বলেনি, বুঝে নিয়েছে গজানন।
অচৈতন্য খান বুদোশকে একতলার হলঘরে শুইয়ে এলোকেশী গেল একটা দেওয়ালের সামনে। গজাননকে বললে, আপনি বারান্দায় যান–দোতলায়।
গজানন এতটা পথ ড্রাইভ করে এসে ভেবেছিল এলোকেশীর সঙ্গে কিঞ্চিৎ হাস্য পরিহাস করবে অথবা একত্রে রামভেটকিকে ফোন করবে। তাই একটু মনঃক্ষুণ্ণ হয়েই হনহন করে চলে গেল দোতলায়।
যাওয়ার আগে আড়চোখে দেখে নিল পকেট থেকে ডটপেন বার করছে এলোকেশী। এই সেই ধরনের ডটপেন যার দৌলতে রামভেটকি পাতাল বিবরের দ্বার উন্মোচন করেছিল। এখানেও নিশ্চয় সেইরকম ব্যাপার ঘটবে। দেওয়াল চিচিং ফাঁক হয়ে যাবে আলিবাবার রত্ন গুহার মতো।
কিন্তু দাঁড়িয়ে দেখবার প্রবৃত্তি হয়নি। এলোকেশী যখন সরাতে চায়, তখন সরেই যাওয়া যাক।
তখন সবে সন্ধে নামছে। সামনের বাগানে আধো-অন্ধকার। গজানন সিগারেট ফিগারেট খায় না। পাইপ টানে অথবা নস্যি নেয়। নস্যির ডিবেটা বার করে বাঁ-হাতের তেলোতে বেশ খানিকটা ঢালছে, এমন সময়ে চোখের কোণ দিয়ে দেখতে পেল নিচের বাগানে গাছপালার তলা দিয়ে সাঁৎ করে মিলিয়ে গেল একটা ছায়ামূর্তি।
হাতের নস্যি থেকে চকিতে চোখ তুলেছিল গজানন। কিন্তু ছায়ামূর্তি যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। ওপর থেকে ভালো করে ছাই দেখাও যায় না। কাজেই নস্যিটাকে সশব্দে নাকের ফোকরে চালান করে দিয়ে প্রবল বেগে নেমে এল নিচের তলায়। সামনের ঘরটা পেরিয়ে তবে যেতে হবে বাগানে। কিন্তু ঘরটা আর পেরোতে হল না।
সোফা থেকে গড়িয়ে পড়েছে খান বুদোশ। পুরো বুকখানা জুড়ে রয়েছে একটা গোল গহ্বর। ধড়ের ঠিক মাঝখানে এরকম খাঁ-খাঁ শূন্যতা চোখে দেখা যায় না।
গজাননের মনের চোখে ভেসে ওঠে অবতার সিং-এর মুন্ডুহীন ধর। এখানে রয়েছে বক্ষহীন ধড়।
কারা করছে এই কু-কাণ্ড? কীভাবে?
.
ত্রিশূল-এর গোপনঘাঁটির কি শেষ নেই? গজানন তাজ্জব হয়ে গেল এই কলকাতারই বুকে আর একটা অত্যাধুনিক ঘাঁটি দেখে।
ওকে সল্টলেকের বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছিল রামভেটকি। এলোকেশী গুম হয়ে বসে রয়েছে পাশে। নক্ষত্ৰবেগে গাড়ি এল দমদম এয়ারপোর্টের দিকে। তারপর ঢুকে গেল একটা বাগানবাড়ির মধ্যে।
খান বুদোশের বক্ষহীন ধড় আগেই পাচার করে দিয়েছিল রামভেটকি।
গাড়ি দাঁড়াতেই প্লেন ড্রেস পরা একজন কম্যান্ডো (চেহারা দেখলেই বোঝা যায়। কদমছাঁট চুল, বুলডগের মতো মুখ, পেটাই চেহারা।) এসে শুধু বলল গজাননকে, আজকের মন্ত্র?
সব ব্যাটাকে ছেড়ে দিয়ে বেঁড়ে ব্যাটাকে ধর টাইপের ব্যাপারটা হয়ে গেল না? চড়াৎ করে রক্ত চড়ে গেল গজাননের মাথায়। একে তো সংস্কৃতটা সে জানে না, তার ওপর ডাইনে বাঁয়ে ত্রিশূল-এর দুই কেউকেটা থাকতে তাকে মন্ত্র জিগ্যেস করা কেন?
মুচকি হেসে (গরিলা মুখে যতটা হাসা যায়) রামভেটকি বললে, সিকিউরিটি কাউকে বিশ্বাস করে না–আমাদেরকেও নয়। মন্ত্রটা আমাদের তিনজনকেই বলতে হবে।
কিন্তু জিগ্যেস তো করা হল শুধু আমাকে। গজাননের গলা তীক্ষ্ণ হয়ে গেছে।
আপনার মুখ এখানে নতুন বলে,–বলেই রামভেটকি নোটবই বের করে একটা পাতা খুলে বলল, যা লেখা আছে, তাই বলুন।
দেখল গজানন। একটাই মন্ত্র। ছোট্ট।
বলল, হ্রীং।
ক্রিং। বলল রামভেটকি।
ক্রিং। বলল এলোকেশী।
পথ ছেড়ে সরে দাঁড়াল প্লেন ড্রেসের কম্যান্ডো।
গাড়ি ছেড়ে নেমে পড়েছে তিনজনে। গাছপালার মধ্য দিয়ে কিছুদূর যেতেই চোখে পড়ল একটা কটেজ প্যাটার্নের বাড়ি। দু-দিকে অ্যাসবেসটসের এবং অন্য দু-দিকে লাল টালির ঢালু ছাদ। অ্যাসবেসটসের চালে আঁকা একটা লাল হরতন।
এটা কি তাসের দেশ? বলে ফেলেছিল গজানন।
রামভেটকি কিছু না বলে গটগট করে গিয়ে দাঁড়াল দরজার সামনে। দরজা মানে একটা গোটা টেক্কা তাস। সামনে দাঁড়াতে-না-দাঁড়াতেই পাল্লা সরে গেল পাশে। পরপর ঢুকে এল তিনজনে। গজানন দেখল ও-পাশে আর একটা ঘর। এদিকের দরজা থেকে ওদিকের দরজা পর্যন্ত তেরোজন ঘণ্ডামার্কা কম্যান্ডো দাঁড়িয়ে লাইন দিয়ে। প্রত্যেকেই অ্যাটেনশন ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে চেয়ে আছে সামনের দিকে।
এদের সামনে দিয়ে গজানন, রামভেটকি আর এলোকেশীকে যেতে হল ওদিকের দরজার সামনে এবং যাওয়ার সময়ে আড়চোখে গজানন দেখলে প্রত্যেকেই খর চোখে দেখে নিচ্ছে তিনজনের মুখ, কেউ-কেউ হাতের ছবির সঙ্গে মিলিয়ে দেখছে ঠিক লোক যাচ্ছে কিনা সামনে দিয়ে। গজাননের ছবিও তাহলে আছে এদের কাছে।
সামনের দরজা আপনা হতেই খুলে গেল রামভেটকি কপাটের সামনে হাজির হতেই। ভেতরে একটা লম্বা টেবিলে শোয়ানো খান বুদোশের বীভৎস দেহাবশেষ। পাশে দাঁড়িয়ে দাড়িওলা এক বৃদ্ধ। চোখে চশমা, গায়ে সাদা অ্যাপ্রন।
পরিচয় করিয়ে দিল রামভেটকি, জিরো জিরো গজানন, ইনিই আমাদের ব্যালিস্টিক এক্সপার্ট ডক্টর সিঙ্কারো। এককালে হিটলারের কনসেনট্রেসন ক্যাম্পে ছিলেন। গ্যাস চেম্বারে ঢুকে ছেলেবেলায় মরতে-মরতে বেঁচে গেছিলেন। সিঙ্কারো ওঁর ছদ্মনাম, আসল নাম জানলে বুঝবেন হিটলারের কত কাছের লোক ছিলেন ইনি। ডক্টর সিঙ্কারো, কী বুঝলেন? যে অস্ত্র দিয়ে এইভাবে মানুষ খুন করা হচ্ছে, তা তৈরি হয়েছে কোন দেশে?
নো, ছোট্ট জবাব ডক্টর সিঙ্কারোর। বৃদ্ধের চুলগুলো ধবধবে সাদা, এলোমেলো, অনেকটা আইনস্টাইনের মতো মুখে কেবল পাইপটা নেই।
তার মানে কোন দেশ আমাদের পেছনে লেগেছে, তা জানা যাচ্ছে না। আর কোনও খবর? কাঁপা গলায় আশ্চর্য বাংলা বলে গেলেন ডক্টর সিঙ্কারো। গজানন তো হতবাক।
হিটলার যখন বাঙ্কারে বসে বার্লিনের সাবওয়েতে জল ঢুকিয়ে গাদাগাদা মানুষকে ইঁদুরের মতো চুবিয়ে মারছে, তখন একজন বলেছিল, নতুন অস্ত্রটা এদের ওপর পরখ করুন নাজলে চুবিয়ে মেরে কী হবে? চেহারাগুলো হবে এই রকম। বলে একটা কন্ধকাটা নাশ দেখিয়েছিল–যার মুন্ডুটা অবতার সিং-এর মুণ্ডুর মতো মাঝখান থেকে অর্ধেক উধাও।
মাই গড! নিমেষে অ্যাটেনশন হয়ে গেল রামভেটকি। এ অস্ত্র তাহলে জার্মান ব্রেনের?
এগজ্যাক্টলি। কিন্তু এখন আর জার্মানদের হাতে নেই। পরে আমি অনেক খুঁজেছি। অস্ত্রটাকেও চোখে দেখিনি–ডিজাইনও পাইনি।
কীভাবে এরকম গর্ত হচ্ছে বলে মনে হয় আপনার?
মাথা চুলকোলেন ডক্টর সিঙ্কারো, সেইটাই তো মাথায় আসছে না। একটা বিস্ফোরণ ঘটছে। শরীরের মধ্যে কিন্তু রক্ত-মাংস-হাড় সব হাওয়া হয়ে যাচ্ছে কীভাবে, ঠিক বুঝতে পারছি না।
একটা হাতিয়ার হাতে পেয়ে গেলে বুঝতে সুবিধে হবে?
চোখ উজ্জ্বল হল ডক্টর সিঙ্কারোর–নিশ্চয়।
.
গজানন দাঁড়িয়ে আছে মেরিন ড্রাইভার-এর একটা খানদানী হোটেলের বারান্দায়। দুর্গাপুরের জঙ্গল তন্নতন্ন করে খুঁজে খান বুদোশের দলকে আর পাওয়া যায়নি। পায়ে হেঁটে নয়, ট্রেনে চড়ে তারা নাকি এসেছে আমেদাবাদে। দলে আছে গাপ্পা বুদোশ–খান বুদোশের ছোট ভাই। নওজোয়ান গাপ্পা বুদোশ নাকি চেহারায় চলনে বলনে ইউরোপিয়ান। রামভেটকির ধারণা এই গাপ্পাই হল পালের গোদা। ইরান থেকে খেদিয়েছে, এখন কোন দেশের টাকা খেয়ে ইন্ডিয়ায় মানুষ খতম করে চলেছে, তা গাপ্পাকে গায়েব করতে পারলেই ধরা যাবে।
তাই গজানন এসেছে প্রাণটাকে হাতে নিয়ে। একা। কিন্তু ও জানত না ওকে গার্ড দেওয়ার জন্যে এলোকেশীকেও পাঠানো হয়েছে ওর অজান্তে।
জানল বোম্বাই হোটেলে পা দেওয়ার দিনই রাতে। মেরিন ড্রাইভ-এর হাওয়া খেয়ে ঘরে ঢুকতে যাচ্ছে গজানন, এমন সময় নজরে পড়ল মাইক্রো-ক্যামেরাটা টেপ দিয়ে লাগানো দরজার ফ্রেমে পায়ের কাছে।
নিজেই লাগিয়ে দিয়েছিল ঘর থেকে বেরোনোর সময়ে। রামভেটকির দেওয়া ক্যামেরা। ডটপেনের ডগা পেঁচিয়ে খুলে নিলেই বেরোয় এই ক্যামেরা। আর একটা ডটপেনের মধ্যে থাকে মাইক্রোব্যাটারি। পাশাপাশি রাখলেই চুম্বকের টানে জুড়ে থাকে ব্যাটারি আর ক্যামেরা। ক্যামেরা তখন অটোমেটিক হয়ে যায়, অন্ধকারে বা আলোয় ঘরের মধ্যে যে-ই ঢুকুক না কেন, তার ছবি উঠে যাবেই।
ফ্রেমের ফাঁকে প্রায় অদৃশ্য ও খুদে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে হাসল গজানন। এই মুহূর্তে তারও ছবি উঠছে ক্যামেরার। সেকেন্ডে পাঁচটা। বিজ্ঞানের বিস্ময়কর আবিষ্কার।
ঘরে ঢুকল গজানন। দরজা বন্ধ করে দিয়ে আলো জ্বালল। ঘরে কেউ নেই। জামাকাপড় খুলে সটান ঢুকে গেল স্নান ঘরে। পাঁচ তারা হোটেলের স্নান কক্ষ দেখলে দিল্লির বাদশারাও ট্যারা হয়ে যেতেন নিশ্চয়। গজানন তো হবেই। বেলেঘাটায় কে কবে দেখেছে এমন এলাহি ব্যবস্থা।
নরম-গরম জলের শাওয়ারটা খুলে দিয়ে গলা ছেড়ে গান গাইছে, এসেছি, একা যাইব একলা, কেউ তো সঙ্গে যাবে না, হাত থেকে সড়াৎ করে পিছলে গেল সাবানটা। হেঁট হয়ে মেঝে থেকে কুড়িয়ে নিতে গিয়ে হামাগুড়ি দিয়েছে সবে, এমন সময়ে…
শাওয়ারের ঠিক পাশেই গ্লেজড টালি উড়ে গেল পরপর তিনটে। খান-খান হয়ে এসে পড়ল গজাননের মাথাতেই খটাং খট করে।
তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে ঘাড় বেঁকিয়ে তাকিয়েছিল গজানন। টালির জায়গায় তিনটে গর্ত দেখেই চোখ কপালে উঠে গেছিল ক্ষণেকের জন্যে। তারপরই চোখ ঘুরিয়ে দেখলে স্নানকক্ষের প্রবেশ পথের দামি পরদাটাতেও তিনটে ছাদা পাশাপাশি। তখনও ধোঁয়ার সুতো বেরোচ্ছে পরদা থেকে।
অল্পের জন্যে বেঁচে গেছে গজানন–শুধু ওই হড়কে যাওয়া সাবানটার জন্যে। পরদা ফুটো করে টালি উড়িয়ে দেওয়ার পথেই তো ছিল গজাননের প্রিয় নিরেট মাথাটা। এতক্ষণে তারও উড়ে যাওয়ার কথা।
অতএব দিগম্বর গজানন আরও একটু সরে গেল কলতলার বাথটবের দিকে। নজর পরদার দিকে। পরদা দুলে উঠল। প্রথমে দেখা গেল একটা বিদঘুঁটে অস্ত্র। পেটমোটা রিভলভার। জন্মে এমন রিভলভার দেখেনি গজানন।
রিভলভার ধরে যে লোকটি ঢুকল ঘরের মধ্যে, তাকে যেন চেনা-চেনা মনে হচ্ছে। চোখে তার বাঘের চাহনি, পা ফেলার ভঙ্গিমাও বাঘের মতো। লাফ দেয় আর কী!
লোকটা দেখে ফেলেছে শাওয়ারের নিচে প্রত্যাশিত বস্তুটা নেই; অর্থাৎ গজাননের কবন্ধ দেহ নেই। চকিতে বিদঘুঁটে রিভলভার বাগিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে যাচ্ছে, তার আগেই যেন বাজ ভেঙে পড়ল মাথায়।
গজানন, ন্যাংটা গজানন, এখন ফুল ফর্মে। ক্যারাটে গুরু কি বৃথা মার শিখিয়েছেন? বোধহয় আলোর চেয়ে বেশি গতিবেগে দিশি গাঁট্টা মেরেছে গুপ্তঘাতকের মাথায়। ক্যারাটের মশলা মিশোনো গাঁট্টা তো–এক মারেই চোখে সর্ষে ফুল দেখতে-দেখতে বাথটবের মধ্যে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে বদমাশটা। গরম জলের কলটা খুলে দিল গজানন। মুখে ফোঁসকা পড়ুক আগে-পরে আরও পেটানো যাবে।
আগে দেখা যাক বিদঘুঁটে অস্ত্রটা। গাঁট্টার চোটে হাতিয়ার ঠিকরে গেছে কলতলার বাইরে ঘরের কার্পেটে। হেঁট হয়ে পাশে বসল গজানন। কার্পেট পুড়ছে কেন? আশ্চর্য আগ্নেয়াস্ত্রের পেটটা দেখে মনে হচ্ছে যেন গভীর জলের মাছ জেলের জালে পড়ে উঠে এসে পড়ে আছে সমুদ্রের বালির ওপর হাওয়া ঢুকে পেটটা ফুলেই চলেছে। একটু যেন লালও হয়ে উঠেছে। গনগনে আভা ছাড়ছে। কার্পেট পুড়ছে সেই কারণেই।
সভয়ে চেয়ে রইল গজানন। ফাটবে নাকি? কিন্তু একটু আগেই তো এই অস্ত্র ধরেই আততায়ী তার মাথা ওড়াতে গেছিল। নলচেটা বেঁটে, কিন্তু বেশ ফঁদালো। রিভলভার এরকম হয় নাকি? জল-পিস্তল বলেই তো মনে হচ্ছে। দোল খেলার সময়ে পিচকিরির মতো জল ছুঁড়ে দেওয়ার খেলনা।
কিন্তু এ খেলনার মুখ থেকে বেরোয় সাক্ষাৎ মৃত্যু। এ আবার কী ধরনের মারণাস্ত্র?
বিমূঢ় গজাননের চোখের সামনেই বিচিত্র মারণাস্ত্রের উদর আরও একটু স্ফীত হল। গগনে আভা আরও একটু প্রকট হল। কোনও ধাতু যে এভাবে রবারের মতো ফুলতে পারে, তা তো জানা ছিল না গজাননের।
হঠাৎ গজাননের গজ-মস্তিষ্কের কোষগুলোয় কী সঙ্কেত বিনিময় ঘটল, তা দেবা না জানন্তি। মৃত্যুকে সামনে দেখলেই বরাবরই ও এমনিভাবে হাত বাড়িয়ে মৃত্যুকে কাঁক করে ধরতে যায়।
চ্যাপটা হাতল ধরে মারণাস্ত্রটা তুলে দূরের খাটের দিকে তাগ করল গজানন।
সঙ্গে-সঙ্গে একটা জার্ক লাগল হাতে। প্রচণ্ড আঁকুনি। কিন্তু হাত স্টেডি রইল। কানে ভেসে এল একটা বিস্ফোরণের শব্দ।
খাটের ওদিকের স্টিল আলমারিটা বিস্ফোরিত হয়েছে। বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে যে বস্তুটি তা খাটের গদির এদিক থেকে ঢুকে ওদিক দিয়ে বেরিয়েছে।
কী ভয়ানক শক্তি অদৃশ্য বিস্ফোরকের। মাখনের মতো গদি ফুটো করে বেরিয়ে গিয়ে শক্ত আলমারিতে আছড়ে পড়তেই ফাটিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে আলমারি।
হাতের মারণাস্ত্রের দিকে তাকিয়ে থ হয়ে গেল গজানন। পেটের ফুলোটা হঠাৎ এত কমে গেল কী করে? গনগনে আভাটাও আর নেই।
ভয়ে-ভয়ে আজব অস্ত্রকে কার্পেটে নামিয়ে রেখে উঠে দাঁড়াল গজানন। যার হাতে এই অস্ত্র একটু আগে শোভা পেয়েছে সেই ব্যাটাচ্ছেলেকে মনের সুখে এবার ধোলাই দেওয়া যাক।
কলতলার দিকে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখল পরদা সরিয়ে বিহ্বল দৃষ্টি মেলে দাঁড়িয়ে ঘাতক মহাশয়। বিস্ফারিত চক্ষু যুগল নিবদ্ধ কার্পেটের ওপর রাখা বিটকেল অস্ত্রটার দিকে। একটু আগে আলমারি বিস্ফোরণের শব্দ শুনে এবং গরম জলের ছ্যাকা খেয়ে নিশ্চয় সম্বিৎ ফিরে পেয়েছে।
এখন আবার সম্বিৎ হারাবে নাকি? ওরকম আতঙ্কঘন চোখে চেয়ে আছে কেন পেটমোটা দানব অস্ত্রর দিকে?
গজানন যখন এই প্রশ্নটা মাথার মধ্যে এনে মন্থরগতিতে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করছে, ঠিক সেই সুযোগে লোকটা সোজা ডাইভ মারল মারণাস্ত্রের দিকে।
নিমেষে গজানন ফিরে এল গজাননের মধ্যে। বাঁ-পায়ের শট ওর চিরকালই প্রচণ্ড। ঘাতক প্রভু যখন মেঝের ছইঞ্চি ওপর দিয়ে ধেয়ে যাচ্ছে মারণাস্ত্রের দিকে ঠিক তখনি পাশ থেকে বাঁ পায়ে পেনাল্টি কিক করল গজানন–লোকটার পেটে।
কোঁক-ধড়াম–ধুম। পুরো বপুটা নিক্ষিপ্ত হল শূন্য পথে। খাটের ওপর দিয়ে ছিটকে পড়ল জানলার সামনে।
মারণাস্ত্র পাকড়ে ধরে সেইদিকেই তাক করল গজানন। অমনি নরকের বিভীষিকা যেন ফেটে পড়ল খুনে লোকটার চোখেমুখে।
ঠেলে বেরিয়ে আসা দুই চোখ মেলে সেকেন্ড কয়েক চেয়ে রইল বিকট অস্ত্রের দিকে। পরক্ষণেই ম্প্রিংয়ের পুতুলের মতো লাফিয়ে উঠে ছুটে গেল খোলা জানলার দিকে এবং একলাফে জানলা দিয়ে বেরিয়ে গেল বাইরে।
বাইশ তলা শূন্যপথ অতিক্রান্ত হতে গেলে যেটুকু সময়। তারপর বাইশ তলা নিচ থেকে ভেসে এল আছড়ে পড়ার শব্দ।
ফ্যালফ্যাল করে হাতের অস্ত্রটার দিকে চেয়ে রইল গজানন।
গজাননের চমক ভাঙল দরজায় টোকা পড়ায়। খট খটখট খট খট খট…খট!
ত্রিশূল দলের সঙ্কেত! কে এল?
বিকট অস্ত্র হাতে নিয়েই দরজার সামনে ছুটে গেল গজানন। ম্যাজিক হোলে চোখ রেখে দেখল…
বাইরে দাঁড়িয়ে এলোকেশী।
এলোকেশী। এ সময়ে? এখানে?
ঝটাং করে পাল্লা খুলতেই এলোকেশী আঁতকে উঠে বললে, গজাননবাবু, ডোন্ট বি সিলি। বলেই বোঁ করে পেছন ফিরে বললে, জামাকাপড় পরে নিন।
তাই তো! গজাননের খেয়ালই নেই বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসার পর থেকে গায়ে সুতোটি চাপাবার সময় পায়নি। দুই সারি গজদন্তের ফাঁকে বিরাট জিভটা ঠেলে দিয়ে সাঁৎ করে ঢুকে গেল কলতলায় এবং এক মিনিটের মধ্যেই বেরিয়ে এল পাজামায় পা গলিয়ে।
এসেই সে কী তড়পানি, আপনি কোত্থেকে এলেন?
এলোকেশী তখন একটা সোফায় বসে বুকের উপত্যকায় ঝোলানো একটা নেকেড মেয়ের লীলায়িত পোজের লকেটের দিকে নির্নিমেষে চেয়ে রয়েছে। গজাননের প্রশ্নটা শুনে আড়চোখে এমনভাবে তাকাল প্রশ্নকর্তার দিকে যে, সেই ব্যক্তির পায়ের বুড়ো আঙুলের নখ থেকে মাথার চুলের ডগা পর্যন্ত শিরশির করে উঠল অনাস্বাদিত পূর্ব উত্তেজনায়। এ সেই চাহনি যার সামনে মুনিঋষিরা টলে যান, দেব সাধন ভুলে বাৎস্যায়ন শাস্ত্রচর্চায় মত্ত হন।
গজাননের ফুলোফুলো পাথরের মতো পেশিগুলো অনাবৃত অবস্থায় দেখেই যে এলোকেশী এলিয়ে পড়েছে, তা হাড়ে-হাড়ে বুঝল জিরো জিরো।
বাট ডিউটি ইজ ডিউটি–মেয়েরাই সব সাধনার পতন ঘটায়, শাস্ত্র-টাস্ত্র না পড়লেও গজানন তা জানে। তাই গলাটাকে যদূর সম্ভব কর্কশ করে (করা কি যায়!) বললে, এখানে কেন এসেছেন?
কাম-টু-দ্য-বেড় চোখ তুলে তাকাল এলোকেশী। যার সাদা বাংলা হল, এসো, শোবে এসো। কিন্তু ছুঁড়িদের সঙ্গে শোওয়া গজাননের পোষায় না। ওইরকম চাহনি দেখলেই গা পিত্তি জ্বলে যায়। একটু আগে আচমকা চাহনির ঝলকে গা শিরশির করার জন্যে (হাজার হোক পুরুষ মানুষ তো) রাগও হয়ে গেল নিজের ওপর। গজদন্ত খিঁচিয়ে আর একবার যেই দাবড়ানি দিতে যাচ্ছে, এলোকেশী বললে, আমি এসেছি আপনাকে গার্ড দিতে।
এমন নেচে উঠল গজানন (অভিনব পিস্তল হাতেই রয়েছে), পাজামার দড়ি ঢিলে হয়ে গেল। এবং পাজামা নেমে এল ইঞ্চি তিনেক নিচে। খপ করে দড়ি ধরে পাজামা তুলে বললে যথাসম্ভব বজ্রগর্ভ স্বরে, একমাত্র ভগবান শালা ছাড়া আমাকে গার্ড দেওয়ার কেউ নেই।
অহো! অহহ! কী ডুমাডুমো পেশি বুকের! মিঃ ইউনিভার্স হলে পারত গজানন। মুগ্ধ (এবং বিলোল) চোখে চেয়ে এলোকেশী বললে, নিচের তলায় এখুনি একটা লাশ পড়ল আপনার জানলা থেকে।
তিড়বিড়িয়ে ওঠে গজানন, জানলা থেকে জ্যান্তই বেরিয়ে গেছিল–নিচে গিয়ে লাশ হয়েছে।
আপনি ফেলে দিয়েছেন?
আজ্ঞে না, অজান্তেই দাঁত কিড়মিড় করে ফেলে গজানন, ধরতে পারলে মুন্ডুটা ছিঁড়ে নিতাম।
ও, ঠোঁটের ওপর ছোট্ট তিলটা চুলকে নিল এলোকেশী। অমনি গজাননের মনে পড়ে গেল পিসির কথা–ওরে গজানন, ঠোঁটে তিলওয়ালা মেয়ে দেখলেই জানবি পরপুরুষে আসক্তি আছে। ঠিকই বলেছে তো পিসি। এলোকেশীর রকমসকমও ভালো ঠেকছে না। এমনভাবে চাইছে যেন গজানন একটা মুচমুচে নানখাতাই বিস্কুট, পেলেই চিবিয়ে খাবে।
কাজেই শক্ত চোখে চাইতে হল গজাননকে, রাস্কেলটা এসেছিল এই দিয়ে আমার মুন্ডু উড়োতে, দেখাল হাতের বিদঘুঁটে অস্ত্রটা।
জীবনে দেখিনি বাপু এমনি রিভলভার। নিন, ব্যাগের মধ্যে রাখুন, বলে নিজের ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে ধরল এলোকেশী।
গজানন কিন্তু দেখেছে বিটকেল হাতিয়ার মাঝে-মাঝে বিচ্ছিরিভাবে ফুলে ওঠে, লাল হয়, বিস্ফোরণ সৃষ্টি করে। কাজেই টেবিলের ওপর থেকে নিজের বুলেটপ্রুফ ব্রিফকেসটা টেনে নিতে নিতে বললে, এর মধ্যেই থাক।
ব্রিফকেস আর হাতছাড়া করেনি গজানন। রামভেটকি বলেছিল আজব হাতিয়ার একখানা আনতেই হবে। এই সেই হাতিয়ার।
হোটেলের ঘর থেকে বেরোনোর আগে, দরজার ফ্রেমের পাশ থেকে মাইক্রো ক্যামেরা খুলে নিয়ে রেখেছিল ডটপেনের মধ্যে।
এলোকেশী তখন নেমে গেছে। দেখতে পায়নি খুদে ক্যামেরার গোপন অবস্থান। পায়নি বলেই রক্ষে। নইলে…
.
কানহেরী কেভস বোম্বাই শহর থেকে বেশ দূরে। পর্বতগুহা দেখতে বিস্তর টুরিস্ট যায় ইলেকট্রিক ট্রেনে, ফরেন টুরিস্টরা যায় গাড়িতে। ঝকঝকে গাড়ি ধূলি ধূসরিত হয়ে যায় গুহা অঞ্চলে একবার টহল দিয়ে।
কিন্তু সে ধুলো বাইরে, মানে, এই আস্তানার বাইরে। এলোকেশী বিলিতি গাড়িতে চাপিয়ে গজাননকে ঝড়ের বেগে কানহেরী কেভস অঞ্চলের এই গোপন আস্তানায় এনে ফেলার পর বেলেঘাট্টাই মস্তান বেচারার চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেছে একটার পর একটা কাণ্ডকারখানা দেখে।
জবরদস্ত পার্টি বটে এই ত্রিশূল। সংগঠন কাকে বলে দেখিয়ে দিয়েছে, সারা ভারতটাকে রন্ধ্রে রন্ধ্রে ফেলেছে বিবরঘাঁটি আর গুপ্তচর দিয়ে। উদ্দেশ্য একটাই, ভারতের স্বার্থরক্ষা। সরকারি ব্যবস্থায় যে সর্ষের মধ্যে ভূত, তা বুঝে গেছে।
দেশকে সত্যিই ভালোবাসে এই ত্রিশূল। যতই দেখছে গজানন, ততই বিমোহিত হচ্ছে। কোনওকালে ভাবতেও পারেনি গুহা থেকে বেশ খানিকটা দূরে জঙ্গলের মধ্যে এ রকম একখানা আস্তানা বানিয়ে বসে আছে রামভেটকির ওপরওয়ালারা।
গাড়িখানা এলোকেশীই চালিয়ে নিয়ে এসেছে। জঙ্গলের মধ্যে বাঁই-বাঁই করে ঢুকে পড়েছে। দূর থেকে মনে হয় যেন একটা পায়ে চলা পথ কিছুদূর গিয়েই বনের মধ্যে হারিয়ে গেছে অথবা শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু কিছুদূর ঢোকবার পর দেখা যায় মাটির রাস্তা পিচের রাস্তা হয়ে গেছে এবং এক-এক জায়গায় রাস্তা চার-পাঁচটা রাস্তা হয়ে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে গেছে। যে-কোনও নবাগত এই পয়েন্টে পৌঁছেই দুরুদুরু বুকে নিবিড় বনানীর রহস্যময়তা উপলব্ধি করেই পিছু হটে আসবে।
কিন্তু পথ যারা চেনে, তারা পেছোয় না। পিচমোড়া এই রাস্তার গোলকধাঁধা ইচ্ছে করেই সৃষ্টি হয়েছে কৌতূহলীদের দূরে ঠেকিয়ে রাখার জন্যে, দলের লোকেদের নির্বিঘ্নে নিয়ে আসার জন্যে।
এলোকেশীর গাড়িও তাই চরকিপাক দিতে দিতে এ রাস্তা সে রাস্তা হয়ে ঢুকে গেল গভীর থেকে গভীরতর জঙ্গলে। এক জায়গায় একটা পরিত্যক্ত এয়ারপোর্টও দেখতে পেল গজানন। যুদ্ধের আমলে নিশ্চয় বিমানবাহিনী বানিয়েছিল, এখন আর তার খোঁজ কেউ রাখে না। বিলিতি গাড়ি প্রায় নিঃশব্দে গিয়ার চেঞ্জ করতে করতে সেই এয়ারপোর্টের পাশ দিয়েই ঢুকল অন্য একটা রাস্তায়। রাস্তা হঠাৎ শেষ হয়েছে একটা ফাঁকা জায়গায়। যেন টেক অফ করার জন্যেই রাস্তার শেষ ওখানেই।
গাড়িটা কিন্তু টেক অফ করল না, টেক ডাউন করল। মানে, স্রেফ পাতালে ঢুকে গেল। রাস্তাটা যে আসলে ইস্পাতের ঢাকনি তা কে জানত। কবজার ওপর লম্বাটে কৌটোর ঢাকনি যেমন ওপর দিকে খুলে যায়, ঠিক সেইভাবে প্রায় পনেরো ফুট রাস্তা মেঝে উঠে গেল ওপর দিকে।
গাড়ি থেকে নেমে গেল ঢালু পাতাল-বিবরে। মাথার ওপরকার ঢাকনি নেমে এসে বন্ধ করে দিলে বিবর পথ।
আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেল গজাননের। এ কাদের পাল্লায় পড়েছে সে? এরা যে আরব্য রজনীর মতো কাণ্ডকারখানা দেখিয়ে চলেছে ভারতের বুকে।
কাণ্ডর তখনও দেখেছে কী গজানন দ্য গ্রেট। দেখল এরপরেই।
.
গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে দাঁড়াল একটা কুয়োর ওপরকার চাতালে এবং চাতালটা লিফটের মতো নেমে গেল কুয়োর মধ্যে। সাঁ-সাঁ করে বেশ খানিকটা নামবার পর রুদ্ধ হল নিম্নগতি।
আলো ঝলমলে একটা বিশাল হলঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে গাড়ি। জানলার কাঁচের মধ্যে দিয়ে হলঘরের বিশালতা এবং বিচিত্র যন্ত্রপাতির বিপুল সমাবেশ দেখে গজানন দ্য গ্রেট চোখ দুটো প্রায় ছানাবড়ার মতো করে চেয়ে রইল অনেকক্ষণ।
হলঘরের চারপাশে ছড়ানো ছিটোনো যন্ত্রপাতিগুলো চলছে আপনা হতেই। অনেকগুলো বিদঘুঁটে চেহারার রোবট চালাচ্ছে কলকবজা। নিজেরাও তো এক-একটা কল, কাউকে দেখতে বাচ্চাদের মোটরগাড়ির মতো–চাকার ওপর গড়গড়িয়ে যাচ্ছে।
এই রকমই একটা খুদে মোটরগাড়ি সাঁ করে ছুটে এল গজাননদের দিকে। চকিতে টান টান হয়ে গেল গ্রেট স্পাইয়ের আপাদমস্তক। কেননা, আগুয়ান যন্ত্রের মাথার ওপরে একটা ইস্পাতের নল ফেরানো রয়েছে তাদের দিকে। পেটের কাছে একটা টিভি স্ক্রিনের মতো পরদায় রংবেরঙের জ্যামিতিক নকশা আঁকা হয়ে যাচ্ছে অতি দ্রুত ছন্দে।
বগলের তলা থেকে লুগারটা টেনে বের করতে যাচ্ছে গজানন, বাধা দিল এলোকেশী। মুখে সেই অপ্সরা হাসি।
বললে স্টিরিও মিউজিক কণ্ঠে, গজাননবাবু, ঘাবড়াবেন না, রোবট সেন্ট্রিকে গুলি করবারও সময় পাবেন না।
তা বটে। এলোকেশী ওর হাতখানা বেশ মোলায়েম করে ধরে (এত মোলায়েম ভাবে যে সন্দেহ হতে লাগল যার ঠোঁটে তিল…) নেমে পড়ল গাড়ি থেকে। পুঁচকে মোটরগাড়িটা তখন সামনেই দাঁড়িয়ে। মাথার ওপরকার ইস্পাতের নলচের সরু ফুটোটার দিকে সভয়ে তাকিয়ে গজানন।
এলোকেশী হেসে চণ্ডীপাঠ করে গেল। টিভি স্ক্রিনের বুকে লেখা হয়ে গেল–Ok Hop in.
মানে, সব ঠিক আছে। গাড়িতে লাফ দিয়ে উঠে পড়।
বলে কী খুদে গাড়ি। ওইটুকু গাড়িতে…
এলোকেশী ততক্ষণে উঠে গেছে গাড়িতে।
খেলনার গাড়ির সিটের মতো ছোট্ট সিটে বসে হাতছানি দিয়ে আর চোখ টিপে ডাকছে গজাননকে।
–আচ্ছা ঢলানি মেয়ে তো। রাগে ব্রহ্মতালু পর্যন্ত জ্বলে গেল গজাননের। গালের কাটা দাগটাও সুড়সুড় করে উঠল এই সময়ে। কিন্তু অতিকষ্টে সেখানে হাত বুলেল না গজানন। কেননা, ওর মারদাঙ্গা ফিচারের সুইচ ওই কাটা দাগটা। হাত বুলোলেই মাথার মধ্যে পটাং করে যেন তার ছিঁড়ে যায়, তারপর প্রলয় ঘটিয়ে ছাড়ে চক্ষের নিমেষে–নিজের অজান্তেই।
অতএব কাটা জায়গায় হাত বুলোনো সমীচীন হবে না। বিশেষ করে ইস্পাতের নলচেটা এখনও যে ফিরে রয়েছে তার দিকেই।
অগত্যা মুখটা পাচার মতো করে গাড়িতে উঠে এলোকেশীর গায়ে গা দিয়ে বসল গজানন। মুহূর্তের মধ্যে পুঁচকে মোটর ভীষণ বেগে ছুটে গেল হলঘর পেরিয়ে একটা করিডরের দিকে। এ করিডর সে করিডর ঘুরে দাঁড়াল একটা দরজার সামনে।
এলোকেশী নেমে পড়েছে। ডাকছে গজাননকে। হাতের ব্রিফকেস নিয়ে নামতে যাচ্ছে সে, এমন সময়ে একটা কলের হাত এসে খামচে ধরল ওর হাত হাতটা বেরিয়ে এল গাড়ির অজস্র কলকবজার মধ্যে থেকেই।
ফিউরিয়াস হয়ে গেছিল গজানন। সাঁড়াশির মতো আঁকড়ে ধরা হাতটাকে ছাড়াতেও পারছে না, ধস্তাধস্তিই সার।
আবার সেই স্টিরিও মিউজিকের মতো হাসি হাসল এলোকেশী, আমার ব্যাগ রেখে এসেছি দেখছেন না? আপনারটাও রেখে আসুন। কমপিউটার চেকিং হবে।
কমপিউটার চেকিং। সেটা আবার কী?
গজগজ করতে করতে নেমে এল গজানন। কলের হাত ওর হাত ছেড়ে দিয়েই আচমকা পেছন থেকে এমন একটা পদাঘাত করল পশ্চাৎদেশে যে ছিটকে গিয়ে দড়াম করে দরজার ওপর পড়ল গজানন দ্য গ্রেট এবং দরজা স্পর্শ করার আগেই পাল্লা খুলে গেল আপনা থেকে। তাল সামলাতে না পেরে গজানন মুখ থুবড়ে পড়ল ভেতরে।
এ অবস্থায় গজানন কেন, স্বয়ং দশাননও মাথার ঠিক রাখতে পারে না। তিড়িং করে লাফিয়ে মোটরটাকে তুলে আছাড় মারবে বলে বেরোতে যাচ্ছে গজানন এমন সময় দরজা বন্ধ করে দিয়ে ছিটকিনি টেনে সামনে এসে দাঁড়াল এলোকেশী।
আশ্চর্য এইটুকু সময়ের মধ্যেই ভোল পালটে ফেলেছে। জিনস প্যান্ট আর ঢিলে শার্ট অন্তর্হিত হয়েছে। পরনে শুধু ব্রা আর ব্রিফ। ফরসা বডিখানা লীলায়িত ভঙ্গিমায় মেলে ধরেছে গজাননের সামনে। কণ্ঠে মদির আহ্বান, গজানন, এখন আমাদের আধঘণ্টার রেস্ট। কাম, এনজয়–আই ওয়ান্ট ইউ।
বলে কী হারামজাদি! আই ওয়ান্ট ইউ বললেই হল! গজানন কি তেলেভাজা যে ফুটপাতে কিনতে পাওয়া যায় এবং খাওয়া যায়?
কিন্তু…কিন্তু গজানন এরকম হকচকিয়ে যাচ্ছে কেন? ঘরের মায়াময় আলো-আঁধারির জন্যে কি? ছোট্ট ঘর। একপাশে পুরু গদির ডাবল বেড। গজাননকে ওই দিকেই ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে প্রায় বিবসনা এলোকেশী। গজাননের সর্বাঙ্গ অসাড় হয়ে আসছে। হাত বাড়িয়ে গজাননের সার্টের বোতাম খুলে দিচ্ছে এলোকেশী। খাটে বসে পড়েছে গজানন। ভ্যাবা গঙ্গারামের মতো চেয়ে রয়েছে এলাকেশীর সরীসৃপের মতো ক্ষিপ্রতার দিকে। পাশের ছোট্ট টেবিল থেকে একটা মদের বোতল তুলে নিয়ে দুটো গেলাসে ঢেলে একটা এগিয়ে ধরেছে গজাননের দিকে। না…না…গজানন সুরাপান করবে না…কিছুতেই না…! এলোকেশী দু-হাতে দুটো গেলাস নিয়ে সবলে জাপটে ধরেছে গজাননকে–ঠোঁটে ঠোঁট…গরম হলকায় যেন পুড়ে যাচ্ছে গজাননের মুখ..কিন্তু মুখ সরাতে পারছে না..লিপস্টিকে মুখ মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে–তবুও না–গজানন চিৎ হয়ে পড়ে গেছে খাটে। গেলাস দুটো টেবিলে রেখে টান মেরে ট্রাউজার্সটা খুলে দিল এলোকেশী। চকিতে গজাননের দিকে পেছন ফিরেই ব্রায়ের মধ্যে থেকে একটা হোমিওপ্যাথিক গ্লোবিউলের মতো সাদা জিনিস বের করে ফেলে দিল একটা গেলাসে। পরমুহূর্তেই দুটো গেলাস নিয়েই ঘুরে দাঁড়াল গজাননের দিকে। যে গেলাসে পড়েছে সাদা গ্লোবিউল, সেই গেলাসটা ঠুসে ধরল গজাননের হাঁ করা ঠোঁটের মধ্যে।
আর একটু হলেই সুরাপান করে বসত গজানন। তারপর ইয়া আল্লা বলে ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিত নিজেকে। কিন্তু ঠিক সেই সময়ে ছোট্ট ঘরের একদিকের দেওয়ালের খানিকটা সরে যেতেই চৌকো খুপরির মধ্যে দিয়ে আবির্ভূত হল একটা বিকটাকার মুখোশ–শূন্যে ভাসছে। মুখোশের দাঁতের ফাঁকে একটা সিগারেট। সিগারেটের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল একটা ছোট্ট বুলেট–ঢুকল এলোকেশীর রগে।
গজাননের ঠোঁটের সামনে থেকে মদিরাপাত্র ছিটকে গেল খাটে। এলোকেশী তার নরম বুক নিয়ে শিথিল দেহে পড়ে রইল গজাননের ওপর।
.
গজানন এখন জামাপ্যান্ট পরে নিয়েছে। আঙুল দিয়ে আঁচড়াচ্ছে মাথার লম্বা চুল। ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে রামভেটকি এবং ডক্টর সিঙ্কারো নামে সেই দাড়িওলা বৃদ্ধ যিনি কিনা এককালে হিটলারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন।
ডক্টরের হাতে রয়েছে বিদঘুঁটে সেই অস্ত্র। জোরালো স্পট লাইটের তলায় ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখছেন।
রামভেটকি হাসি গোপন করার চেষ্টা করে বলছে, মাই ডিয়ার গজানন, আপনার পদস্খলন হচ্ছিল বলে এলোকেশীকে শট ডেড করা হয়েছে একথা যেন ভাববেন না।
কটমট করে তাকাল গজানন, টার্গেট ছিলাম নিশ্চয় আমি?
জিভ কাটল রামভেটকি। গরিলামুখে জিভ কাটার ফলে আরও হাস্যকরই দেখাল শ্রীহীন। মুখাবয়ব।
বলল, ও নো। কমপিউটার চেকিং-য়ে ধরা পড়ল এলোকেশী ডাবল গেম খেলে চলেছে।
মা–মানে?
দরজার ফ্রেমে লাগানো আপনার ক্যামেরার ফিল্মে কার ছবি উঠেছে জানেন? এলোকেশীর। বিটকেল ওই হাতিয়ার নিয়ে বেরিয়ে আসছে আপনার ঘর থেকে।
এলোকেশী।
ও ইয়েস। যাকে আপনি এনজয় করতে যাচ্ছিলেন।
শাট আপ।
এলোকেশীই প্রথম গিয়েছিল আপনাকে সাবাড় করতে–তখন আপনি ঘরে ছিলেন না। নিশ্চয়–
ডাইনিং রুমে গেছিলাম। রাইট।
তারপরেই এল সেই লোকটা। তার ফটোও উঠেছে সিক্রেট ক্যামেরার।
গজাননের গজমস্তিষ্কে একটা সূক্ষ্ম চিন্তা স্মৃতির আকারে কঁ করে দেখা দিল সেই মুহূর্তে। মস্তিষ্ক কখন যে কী করে বসে তা তাবড় মস্তিষ্কবিশারদরাও জানেন না। তাই আচম্বিতে গজাননের মনে পড়ে গেল সল্টলেকের ত্রিশূল ঘাঁটির দোতলায় দাঁড়িয়ে যখন যে নস্যগ্রহণ করছে, নিচের বাগানে সন্ধের আঁধারে সাঁৎ করে মিলিয়ে গেছিল একটা ছায়ামূর্তি। তড়িঘড়ি নিচে নেমে এসে দেখেছিল খান বুদোশের কবন্ধ দেহ।
এলোকেশীই কি তাহলে…?
সন্দেহটা মুখে প্রকাশ করতেই রামভেটকি সায় দিলে, রাইট ইউ আর। খান বুদোশ অনেক জানত। তাই মুন্ডু উড়িয়ে দিয়েছিল এলোকেশীই ইস তখন যদি জানতাম।
হারামজাদি ওই জন্যেই সরিয়ে দিয়েছিল আমাকে, দাঁত কিড়মিড় করে গজানন।
গলা খাঁকারি দিলেন ডক্টর সিঙ্কারো। ভালো বাংলায় বললেন, মহাশয়গণ, এই সেই অস্ত্র যার গোপন ফরমুলা হিটলার ছাড়া কাউকে জানানো হয়নি।
সিঙ্কারো এখন ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। হাতে সেই ভয়াল অস্ত্র।
বলছেন, অজানা এক দো-আঁশলা ধাতু দিয়ে এর বডি তৈরি হয়েছে। সামান্য তাপ পেলেই রবারের মতো ফুলে উঠতে থাকে। তারপর আগের অবস্থায় ফিরে যায় হঠাৎ। চেম্বারে যে অ্যাটমিক রিঅ্যাকশন ঘটে, তার পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে দেয় প্রচণ্ড প্রেসার দিয়ে। এক সেন্টিমিটার ডায়ামিটারের গোল বুলেট ঠিকরে গিয়ে ফাটে ছোট্ট অ্যাটম বোমার মতো কিন্তু শব্দ হয় না। নিশ্চিহ্ন করে দেয় টার্গেট।
চোয়াল ঝুলে পড়েছিল গজাননের। রবারের মতো বেড়ে যায় এ আবার কী ধাতু?
রামভেটকি কিন্তু চোয়াল শক্ত করে বললে, এরকম কটা গুলি আছে ভেতরে।
আরও ছত্রিশটা।
মাই গড।
এই ট্রিগারটা টিপলেই–
ঘরে ঢুকল একটি মূর্তি। পুরুষ। ভাবলেশহীন মুখে রামভেটকির দিকে তাকিয়ে বললে, মেসেজ এসেছে জিরো ওয়ান ফোর টু থেকে।
গজাননের ঝোলা চোয়াল উঠে এসেছিল লোকটাকে দেখেই। আচমকা সুড়সুড় করে উঠেছিল গালের কাটা দাগটা। অজান্তেই হাত বুলিয়ে ফেলতেই মাথার মধ্যে সব লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল।
রামভেটকি আর সিঙ্কারো দেখলেন শুধু আশ্চর্য দৃশ্য। দাঁড়িয়ে থেকেই বডি থ্রো করল গজানন। দু-হাত সামনে প্রসারিত। কাঁক করে পুরুষমূর্তির গলা টিপে ধরে হেঁকে উঠল ছাদ কাঁপানো স্বরে– অত উঁচু থেকে পড়েও মরিসনি?
রহস্য! রহস্য! রহস্য!
কে এই আগন্তুক যাকে দেখেই গজাননের তাৎক্ষণিক পাগলামি চাগিয়ে উঠল?
এই সেই আততায়ী–বোম্বাই হোটেলে যে বিকট হাতিয়ার নিয়ে গজাননকে কবন্ধ বানাতে গেছিল–গজাননের হাতে হাতিয়ার দেখেই জানলা দিয়ে লাফ মেরেছিল। কিন্তু সে কি মরেনি?
মরেছিল। হাড়গোড় ভেঙে পিণ্ডি পাকিয়ে গেছিল।
তবে এ লোকটা কে?
তারই ডবল।
রহস্য পরিষ্কার হয়েছিল আস্তে-আস্তে অনেক জেরা এবং অনেক কাণ্ডকারখানার পর।
অবতার সিং-এর নকল সাজিয়েছিল ত্রিশূল আসল অবতার সিংকে বাঁচাবার জন্যে। বিকট হাতিয়ারের কোপটা তাই গেছে নকল অবতারের মুন্ডুর ওপর দিয়ে।
কিন্তু যারা এই নৃশংস কাণ্ড করে চলেছে, তারা নকল মানুষ বানানোর ব্যাপারে এগিয়ে গেছে আরও কয়েক ধাপ। যে-কোনও প্রাণীর দেহকোষ থেকে সম্পূর্ণ সেই প্রাণীটাকে সৃষ্টি করতে পারে ল্যাবরেটরিতে। এক কথায় যাকে বলে ক্লোনিং। আফ্রিকান ব্যাঙকে ক্লোন করে নকল ব্যাঙ তৈরির পর নোবেল পুরস্কার বিজয়ী এক বৈজ্ঞানিক হুঁশিয়ার করেছিলেন–খবরদার। মানুষ ক্লোন করতে যেও না। দানব তৈরি হয়ে যেতে পারে।
গুপ্ত শত্রুরা ঠিক তাই করেছে। রামভেটকির এই বিশ্বস্ত অনুচরটিকে মদের আড্ডায় ঘুম পাড়িয়ে তার হাতের চামড়া চেঁচে নিয়ে সেই কোষ থেকে বানিয়েছিল হুবহু দুই অনুচর। একজনকে পাঠানো হয়েছিল গজানন নিধনে। আর একজন মোতায়েন রয়েছে ত্রিশূলেরই এই গোপন আস্তানায়। গজানন যদি তাকে চিনে না ফেলত, না জানি আরও কত নৃশংস কাণ্ড ঘটিয়ে ছাড়ত দানব-মগজওলা এই নকল পুরুষটি।
আসল অনুচরটি তাহলে এখন কোথায়?
সব চেয়ে কঠিন প্রশ্ন!
জবাব পেতে কালঘাম ছুটে গেছিল ত্রিশূলবাহিনীর। নিষ্ঠুর নিপীড়নে প্রাণটাকে শুধু টিকিয়ে রেখেছিল নকল অনুচরদের মধ্যে। তারপর হিপনোটিক সাজেশানের পর বেরিয়ে এল জবাবটা।
আন্দামান আর নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের যে কটি দ্বীপে আগ্নেয়গিরি আছে, তারই একটিতে নিবিড় বনানীতে ভারত-শত্রুদের ঘাঁটিতে বন্দি রয়েছে ত্রিশূলের পরম বিশ্বস্ত এই অনুচরটি। হয়তো তার দেহকোষ থেকে অ্যাদ্দিনে তৈরি হয়ে গেছে আরও অনেক চলমান দানব।
.
ডুবো জাহাজ চলেছে আন্দামানের জলতল দিয়ে। ভারত সরকারের সাবমেরিন। যেন একটা তিমি মাছ।
আগ্নেয়দ্বীপে দিবালোকে বা নিশীথ রাতে ডাঙায় নামা বিপজ্জনক, এ খবরটা আগেই দিয়ে রেখেছিল নকল অনুচর। তাই এই ব্যবস্থা।
গজানন গ্যাঁট হয়ে বসে ছোট্ট একটা চেম্বারে। বেপারীটোলা লেনের অফিসে বসে থাকার মতোই পোজ মেরে রয়েছে। মুখ দেখে মনে হচ্ছে যেন বেড়াতে বেরিয়েছে। মাথার কোটরে যে চিন্তাকীট রাশি-রাশি কুরেকুরে খাচ্ছে, তা প্রকাশ পাচ্ছে না মোটেই। একেই বলে গুরুর ট্রেনিং।
গুরুর নির্দেশটাও সুরুৎ করে চলে যাচ্ছে মগজের অযুত নিযুত রন্ধ্রের মধ্যে দিয়ে। দেশের সেবায় এই দেহমন্দিরকে উৎসর্গ করে চলেছে গজানন দ্য গ্রেট। শত্ৰুপুরীতে প্রবেশ করবে একা।
তারপর?
তারপর নাস্তি।
রামভেটকি এসে দাঁড়াল সামনে। গরিলাআননে সংশয়। পারবে তো গজানন দুর্ভেদ্য দুর্গকে। ভেতর থেকে উড়িয়ে দিতে?
গজানন সটান চাইল রামভেটকির চোখে-চোখে। মাথার মধ্যে চিন্তাকীট রাশি রাশি ফুসফাস করে মিলিয়ে গেল তৎক্ষণাৎ। রামভেটকির ওই সংশয় ভরা চাহনি নিমেষে পালটে দিয়েছে গজাননের মুখচ্ছবি। কঠিন প্রত্যয় আর সর্বনাশা জেদ ফের মাথাচাড়া দিয়েছে।
বললে সংক্ষেপে, নামবার সময় হয়েছে?
হ্যাঁ।
.
গজানন এখন দ্বীপে দাঁড়িয়ে। সাবমেরিন বিদায় নিয়েছে। ইষ্টমন্ত্র জপ করতে গিয়ে পুঁতিবালার নাম স্মরণ করে ফেলেছে গজানন বেশ কয়েকবার। ভাবনাটা যে শুধু ওকে নিয়েই। ছাতার তলায় ছিল এতদিন। গজানন অক্কা পেলে ভেসে যাবে বেচারি। রূপ আর যৌবন…
অন্ধকার অন্ধকার…চারিদিকে নিঃসীম অন্ধকার। আশেপাশে ছোট-বড় গাছের ভিড়। পেছনে সমুদ্রের বিরামবিহীন কলরব। রাতজাগা প্রাণীও কি নেই ছাই এই ভয়ঙ্কর দ্বীপে?
এত নৈঃশব্দ্য ভালো লাগছে না গজাননের। পায়ে-পায়ে নিবিড় বনানী ছাড়িয়ে এক চিলতে ফাঁকা জায়গায় আসতেই আচম্বিতে সারা দেহে অনুরণন অনুভব করল গ্রেট জি।
প্রতিটি লোমকূপ যেন তরঙ্গায়িত হচ্ছে। গোড়ায়-গোড়ায় যেন বিদ্যুৎ সঞ্চারিত হচ্ছে। বডিটাও বেশ হালকা লাগছে। পা ফেলতে গিয়ে সেটা আরও ভালোভাবে টের পাওয়া গেল। পা খানা মাটিতে পড়ল না।
জোর করে পা দিয়ে মাটি স্পর্শ করতে গিয়ে পেছনের পা-খানাও উঠে এল মাটি ছেড়ে– গজানন না চাইতেই।
পায়েদের এবম্বিধ অবাধ্যতা গজানন অন্তত সইতে পারে না। কোনওমতেই না। হেঁট হয়ে তাই দেখতে গেছিল পা দুখানা আছে কোথায়…
চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল তৎক্ষণাৎ।
দুটো পা-ই মাটি থেকে অনেক ওপরে। তা প্রায় দশফুট তো বটেই। অন্ধকারে সঠিক মালুম হচ্ছে না। তবে হাড়ে-হাড়ে টের পাওয়া যাচ্ছে একটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার।
গজানন শূন্যে ভেসে উঠেছে। এবং আরও উঠছে। দেখতে-দেখতে গাছপালার মাথা ছাড়িয়ে দেহমন্দির উঠে এল বেশ উঁচুতে।
আর তারপরেই দেহময় বিদ্যুৎপ্রবাহ এমনই প্রবল হয়ে উঠল অকস্মাৎ যে জ্ঞান লোপ পেল গজাননের।
.
গজানন জ্ঞান ফিরে পেয়েছে। প্যাটপ্যাট করে তাকিয়ে আছে। মাথার ওপর জ্বলছে চৌকো টালির মতো একটা সাদা আলো। নরম আভায় চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে না।
চোখের মণি ঘুরিয়ে (দেহ না নাড়িয়ে) আশপাশ দেখে নিল গজানন। জ্ঞান ফিরে পেলেই তথাকথিত নায়কদের মতো আমি কোথায়? বলার ট্রেনিং সে পায়নি। ব্যাপারটা গুরুতর, তা আঁচ করেছে চৈতন্য ফিরে আসতেই। তার আগে জানা দরকার, বেলুনের মতো শূন্যে ভাসিয়ে তাকে আনা হয়েছে কোথায়।
বিশাল গহ্বর মনে হচ্ছে না? আশেপাশে অনেকদূর পর্যন্ত ফাঁকা তারপর পাহাড়ের দেওয়াল বলেই তো মনে হচ্ছে। সে দেওয়াল আঁধারের মাঝে উঠে গেছে অনেক ওপরে–অনেকটা গম্বুজঘরের মতো গোল হয়ে জড়ো হয়েছে মাথার ওপর।
চৌকো আলোক-টালির ফাঁক দিয়ে বহু উঁচুতে দেখা যাচ্ছে রন্ধ্রপথ। পর্বতচূড়া নিঃসন্দেহে। আকাশ আর তারা দৃষ্টিগোচর হচ্ছে সুস্পষ্ট।
জয় মা কালী! এ কোথায় এনে ফেললে মা আমাকে! এ যে ফোঁপরা পাহাড়। প্রকৃতিতে এরকম বিস্ময় বিরল নয়, তা জানে গজানন। নেচার বহুত মিস্টিরিয়াস। কি কিন্তু শত্রু ঘাঁটি এহেন স্থানে।
জুলজুল করে চেয়েই রইল গজানন। একটা আঙুল আগে নাড়াল। নড়ছে। তারপর টের পেল সারা দেহটাই নাড়ানো যাচ্ছে। অর্থাৎ, শত্রুপক্ষ তাকে না বেঁধেই ফেলে রেখে গেছে। তোবা! তোবা! কিন্তু কেন? লম্ফ দিয়ে চম্পট দেবে নাকি?
কিন্তু তা হল না। ওই একটু আঙুল নাড়ানোতেই সজাগ হয়ে উঠেছিল পাশের একটা যন্ত্র। দেখতে অবিকল স্টার ওয়ার্স সিনেমার পিপে রোবটের মতো। যন্ত্রচক্ষু এতক্ষণ সজাগ নজর রেখেছিল তার ওপর। এবার সরব হল যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর।
গজানন মহাশয়, আপনি অযথা নড়িবেন না। প্রাণ যাইতে পারে।
ওরেব্বাস! এ যে সাধু ভাষায় কথা বলে। গলার আওয়াজটা যদিও খাসা স্টিরিও বাজনার মতো।
যথাসম্ভব মধুর কণ্ঠে গজানন বললে, বৎস রোবট, আমাকে এই স্থানে লইয়া আসিয়াছ কেন?
আপনার মস্তিষ্ক কাটিয়া ক্লোনিং কপি রোবট বানাইব বলিয়া।
ভেতরে-ভেতরে আঁতকে উঠলেও গজানন অকস্মাৎ অট্টহাস্য করে উঠল। যন্ত্ররা বিরক্ত হতে জানে না। তাই অবিচল কণ্ঠে বললে, হাস্যের কারণ জানিতে পারি কি?
নিশ্চয়, নিশ্চয়। বৎস রোবট—
আমার নাম সি-কে-টু-ফোর।
ওকে! ওকে! মাই ডিয়ার সি-কে-টু-ফোর, আমি যে অলরেডি রোবট।
প্রাঞ্জল করিয়া বলুন।
আমি উন্মাদ হইয়া গিয়াছিলাম। মানসিক ডাক্তার আমার ব্রেনটাকে বদলাইয়া দিয়া সুস্থ করিয়াছে।
ব্রেন স্ক্যান করিয়া সেরূপ কোনও লক্ষণ দেখা যায় নাই।
তোমাদের যন্ত্রে দেখা যাইবে না। ইহা এক প্রকার কেমিক্যাল হরমোন-ধাতু নয় যে দেখা যাইবে।
কেমিক্যাল হরমোন?
ইয়েস মাই ডিয়ার সি-কে-টু-ফোর, ইতিপূর্বে ক্লোনিং কপি রোবট বানাইয়াছ এবং আমাকে খতম করিবার জন্য পাঠাইয়াছ, তাহাদের আমি খতম করিয়াছি এই কারণেই।
যন্ত্র চুপ। আর এক দফা অট্টহাসি হাসল গজানন।
বলল, শূন্যপথে আনিলে কীভাবে আমাকে?
হাইপার ফোর্স দ্বারা।
সে বস্তুটা কী?
অ্যান্টিগ্র্যাভিটি।
সে তো কল্পবিজ্ঞানে হয় শুনিয়াছি।
বিজ্ঞান তাহার হদিশ জানিয়াছে। এই পৃথিবীতেই ছশো ফুট ওপর পর্যন্ত হাইপার ফোর্সের অস্তিত্ব রহিয়াছে। আমরা কেবল তাহাকে জোরদার করিয়াছি।
উত্তম করিয়াছ। এবার আমাকে ছাড়িয়া দাও।
তৎপূর্বে আপনার ব্রেনের কেমিক্যাল টেস্ট হইবে।
তোমার মুণ্ডু হইবে, বলেই তড়াক করে লাফিয়ে উঠতে যাচ্ছে গজানন, এমন সময়ে থ হয়ে গেল পুঁতিবালাকে দেখে।
বহু উঁচু থেকে পাহাড়চুড়োর ছিদ্রপথ দিয়ে লম্বভাবে সটান শূন্যপথে নেমে এল একটা নারীমূর্তি। দাঁড়াল তার সামনে।
পুঁতিবালা। কটমট করে তাকিয়ে আছে সি-কে-টু-ফোরের দিকে। সি-কে-টু-ফোর যেন সন্ত্রস্ত হল সেই মূর্তি দেখে। কয়েক ইঞ্চি পেছনে সরেও গেল। কিন্তু তার আগেই ধেয়ে গেল পুঁতিবালা। খোঁপা থেকে একটা চুলের কাটা বের করে ঢুকিয়ে দিলে রোবটের অনেকগুলো ফুটোর একটায়।
সবকটা আলো নিভে গেল সি-কে-টু-ফোরের গায়ে, গোঙানির মতো একটা যান্ত্রিক আওয়াজ কেবল নির্গত হল স্পিকার থেকে।
ঘুরে দাঁড়াল পুঁতিবালা। বললে খুব সহজ গলায়–ফিউজ করে দিলাম।
তু-তুই এখানে কীভাবে এলি? গজানন হতবাক।
সে অনেক কথা। পরে শুনবে, হারামজাদারা অনেক আগেই এনেছিল আমাকে। এদের বস ব্যাটাচ্ছেলের নিজের বউ আছে কিন্তু পরকীয়া লোভী কিনা–তাই… নিগুঢ় হাসল পুঁতিবালা।
গা পিত্তি জ্বলে গেল গজাননের।
এখানেও ওই সব করছিস।
ডিউটি ফাস্ট, উৎকট গম্ভীর মুখে বললে পুঁতিবালা, বাকি সব নেক্সট। পুরো তল্লাটটার খবর নেওয়া হয়ে গেছে। ওরা মোট নজন আছে। ওদিকের স্টিল চেম্বারে একজনকে ক্লোনিং কপি রোবট বানাচ্ছে–আমাকেও করত। পরকীয়ার জোরে ফিক করে হেসে ফেলে পুঁতিবালা।
কী করবি এখন? রাগ চেপে বলে গজানন।
এসো আমার সঙ্গে, এগিয়ে যায় পুঁতিবালা হরিণীর মতো ক্ষিপ্র গতিতে। গজাননও চলে পেছন-পেছন।
সাদা হেলিকপ্টারের সামনে দাঁড়িয়ে বললে পুঁতিবালা, চালাতে জানো?
সব জানি।
তবে উঠে বোসো।
তারপর? পাহাড়ের ওই ফুটো দিয়ে হেলিকপ্টার তো বেরোবে না।
ফুটো দিয়ে নয়, এই বোতামটা টিপলেই– পাহাড়ের গায়ে একটা বোতাম টিপল পুঁতিবালা–চিচিং ফাঁক করে।
হলও তাই। পাথুরে দেওয়াল সরে গেল একপাশে। স্টিল ডোর। পাথরের মতো নকশা করা বলে পাথুরে দেওয়াল বলে মনে হয়েছিল এতক্ষণ।
সামনে খোলা চত্বর। তারপর…
পুঁতিবালাকে ফেলেই ভেতরে উঠে গেল গজানন। রামভেটকির দাপটে তাকে অনেক কিছুই শিখতে হয়েছে। এবার তা কাজে লাগাল।
কিন্তু পুঁতিবালা আসছে না কেন?
হেঁকে ডাকা তো যাচ্ছে না। মুখ বাড়িয়ে চক্ষু স্থির হয়ে গেল গজাননের।
লাল রঙের একটা পেল্লায় ঘড়ির কাঁটা ঘুরোচ্ছে পুঁতিবালা। ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে এক জায়গায় রেখেই দৌড়ে এসে উঠে পড়ল হেলিকপ্টারে।
বললে রুদ্ধশ্বাসে, ঝটপট চলল। পাঁচ মিনিটের মধ্যে সরে যেতে হবে। আওয়াজ পেয়ে ওরা ছুটে এলেই–
আর বলতে হল না গজাননকে। ইঞ্জিন স্টার্ট করে হেলিকপ্টার চালু করল চক্ষের নিমেষে। পর্বতকন্দর থরথর করে কেঁপে উঠল ভীষণ আওয়াজে। হইহই আওয়াজ শোনা গেল দূরে। ঘাড় কাত করে দেখল গজানন নটা মূর্তি ছুটে আসছে এদিকে। দুমদাম শব্দে তপ্ত বুলেট ঠিকরে আসছে ওদের দিকে।
আর তাকায়নি গজানন। ঈষৎ কাত হয়ে হেলিকপ্টার চক্ষের নিমেষে বেরিয়ে এল পাহাড়ের বাইরে এবং সেইভাবেই ছিটকে গেল আকাশের দিকে।
পাঁচমিনিট পূর্ণ হতেই পুঁতিবালার হাতে সেট করা টাইম বোমা বিস্ফোরিত হল।
বর্ণনা নিষ্প্রয়োজন। আন্দামানের সেই দ্বীপটি আজ প্রায় নিশ্চিহ্ন বললেই চলে।
গুপ্তচর বাহিনীর বাকি ঘাঁটিগুলোও নির্মূল হয়েছে এরপরে পুঁতিবালার সংগৃহীত তথ্যের বলে।
অতএব অতীব রোমাঞ্চকর এবং অবিশ্বাস্য এই কাহিনিরও সমাপ্তি এইখানে।
* দ্বীপবাণী পত্রিকায় প্রকাশিত। (শারদীয় সংখ্যা।)
আমার মনের মরীচিকা
অনেক দূরে চলে এসেছি মৃগাঙ্ক, কিছুদিন আমার কোনও খবর পাবে না। বন্ধুভাগ্য আমার ভালো বলেই তোমার মতো বন্ধু পেয়েছি, কবিতাবৌদির মতো বন্ধু স্ত্রী পেয়েছি। আমার এই নিঃসঙ্গ জীবনটাকে তোমরা দুজনে স্নেহ-ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে তুলেছ। ভালোবাসো বলেই আমার এত দিনের আনন্দ এই পেশাবদ্ধ অভিজ্ঞতা নিয়ে কত গল্পই না লিখেছ। সেদিন ভবিষ্যৎ বঙ্গ সাহিত্য সম্পর্কে শরৎচন্দ্রের মন্তব্য পড়ছিলাম। যেদিন আনন্দের ভেতর দিয়ে লিখতে পারা যাবে, সেই দিন আবার সাহিত্য সৃষ্টির দিন ফিরে আসবে। ওঁর মনে হয়েছিল, বড় সাহিত্যিক আমাদের দেশে এখন আর জন্মাবে না। মৃগাঙ্গ, তুমি বড় সাহিত্যিক নও। নিজেকে সাহিত্যিক বলে কখনো দাবিও করোনি। কিন্তু তুমি যা লিখেছ, তা আনন্দের ভেতর দিয়েই লিখেছ। সে আনন্দ আমার ক্ষুদ্র কীর্তিকে পাঁচজনের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার মধ্যে থেকেই পেয়েছ। আনন্দ আমিও পেয়েছি। নইলে আর পাঁচটা বঙ্গসন্তানের মতো চাকরিবাকরি না করে অপরাধী-শিকারে মত্ত হলাম কেন। বহু বছর ধরে এই মৃগয়ায় আনন্দ পেয়েছি মৃগাঙ্ক, এখন আমি ক্লান্ত। বিষাদ কাটিয়ে ওঠার জন্যে বিষয়ান্তরে মনোনিবেশ করার প্রেসক্রিপশন করেন ডাক্তাররা–আমি বোধ হয় নিজে থেকেই তাই এই সৃষ্টিছাড়া পেশায় তন্ময় হয়েছিলাম এতগুলি বছর। মৃগয়া-মত্ত হয়েছিলাম ইচ্ছে করেই। ভুলে থাকার জন্যে। মনের ভেতরে চাপা পড়ে থাকা বেদনাকে এড়িয়ে থাকার জন্যে। কিন্তু মনের সঙ্গে ছলনা দীর্ঘদিন করা যায় না। মরীচিৎকার স্বরূপ একদিন না একদিন ধরা পড়েই। আমার এই আত্মবঞ্চনা আজ আমাকে পীড়া দিচ্ছে। আনন্দের অন্বেষণে এই পেশায় এসে আমার মনে হচ্ছে, অনেকের নিরানন্দের কারণ আমি হয়েছি। এতদিন আত্মশ্লাঘা অনুভব করেছিলাম দেশ আর দশের মঙ্গল করছি। ভুল, ভুল, এই অহঙ্কারই আমাকে অন্ধ করে রেখেছিল এতদিন। দেশ আর দশের সেবা করতে হয় কী করে, তা আটপৌরে মানুষদের কাছেই জেনে নেওয়া উচিত ছিল। সরাসরি তাদের মুখের মধ্যিখানে তাকিয়ে তাদের মনের মানদণ্ডে বুঝে নেওয়া উচিত ছিল তারা কী চায়। তাদের জীবনধারার মধ্যে প্রবিষ্ট হয়ে গিয়ে তাদের ছোট ছোট মঙ্গলের পথগুলিকেই আবিষ্কার করতে পারলেই শ্রীবাস্তব কল্পস্বর্গ এই মর্তেই হয়তো রচনা করা যায়। কিন্তু আমরা কেউ তা করি না। তাই চুরাশিতে অরওয়েলের বিভীষিকাবর্ষের মতো আমিও আমার বিভীষিকাবর্ষ যাপন করেছি। মরীচিৎকার পেছনে ছুটে ছুটে ক্লান্ত হয়ে পালিয়ে এসেছি অনেক দূরে…নিরালায় নির্জনে আত্মসমীক্ষা করে চলেছি। কি পেয়েছি বলতে পারো, এতগুলো বছর ধরে এত অপরাধী শিকার করে? কটা মানুষের প্রাণে আনন্দ দিতে পেরেছি? কজনকে সুখী করতে পেরেছি? কটা জীবনে আশার প্রদীপ জ্বালতে পেরেছি? কটা সংসারে শান্তিসমীরণ বওয়াতে পেরেছি? বরং ঠিক তার উল্টোটাই ঘটিয়েছি। আমার মনের এই মরীচিকা আর অস্পষ্ট নয় আমার কাছে।
ভাষার স্থপতি তুমি নও। গল্প-উপন্যাসের যে বিষয়বস্তু তুমি নির্বাচন করেছ, সেখানে এই স্থাপত্য দেখানোর সুযোগও নেই। ভাষার স্পন্দমায়া তাই তোমার লেখায় কখনো ফুটে ওঠেনি। ভাষাশিল্পের সুরম্য শিবিরে আবদ্ধ হয়ে থাকাটাও তোমার লক্ষ্যমাত্রা নয়। সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়াটাই আমার নেশা, অঘটনের মধ্যে মিশে যাওয়াটাই আমার আনন্দ। তুমি তোমার সরল ভাষার দীপাধার নিয়ে আমার এই নেশা আর আনন্দকেই উদ্ভাসিত করেছ দশজনের সামনে। তোমার গল্পে আমি কখনো হয়েছি রঙমহলের রাজা, কখনো দেখিয়েছ আমার হিরণ হাসির কিরণ। কিন্তু কখনো ভাবোনি, আমার কুটিল হাসিও ঘটিয়ে তোলে জটিল সর্বনাশ। তুমি রুদ্রের ডম্বরধ্বনি শুনিয়েছ তোমার পাঠকপাঠিকাদের, কিন্তু তার জীবনের স্কুল মিথ্যার খেলাকে কখনো ধরতেও পারো নি। তুমি লিখেছ তার শান দেওয়া খর খঙ্গসম ললাটে বুদ্ধি দিচ্ছে পাহারা, কিন্তু শান দেওয়া প্রতারণার ছুরিটা তোমার নজর এড়িয়ে গেছে। তুমি দেখেছ তার তীক্ষ্ণ সজাগ আঁখি, দেখেছ কটাক্ষে তার ধরা পড়ে কোথায় কার ফাঁকি–কিন্তু দেখোনি তার নেশাভ্রান্ত চরিত্রের ঝড়ের কলোগ্লাস, বিদ্যুতের অট্টহাস। তুমি দেখছে। তার উড়োপাখির ডানার মতো যুগল কালো ভুরু, কিন্তু কখনো কি খেয়াল করেছ, কি তীব্র তার হাস্য?
মৃগাঙ্ক, আমিই সেই ইন্দ্রনাথ রুদ্র। তোমার কপট প্রতারক প্রবঞ্চক বন্ধু ইন্দ্রনাথ রুদ্র। আমাকে তুমিও ধরতে পারোনি। ঘরে ঘরে সর্বনাশের বহ্নিশিখা জ্বালিয়ে আজ আমি ক্লান্ত, অনুতপ্ত, বিমর্ষ। আমার চোখ খুলে দিয়েছে একটি মেয়ে। ছোট্ট একটি মেয়ে।
অহল্যা যেমন মুনির শাপে পাষাণ হয়ে গিয়েছিল, মাঝে মাঝে মনে হত, আমিও বুঝি কারো শাপে পাষাণ হয়ে পড়ে আছি জীবনের সুবিস্তীর্ণ প্রান্তর বক্ষের ওপর দিয়ে। আমার শাপান্ত ঘটিয়েছে বোধহয় এই মেয়েটিই। আমার মনের কঠিন শুষ্ক শয্যার ওপর একটি মাত্র কচি স্নিগ্ধ শ্যামল ঘাস বলা যায় এই মেয়েটিকে। নামটিও তার মিষ্টি–শ্রাবণী। নীলবর্ণের বনফুল সেন।
শ্রাবণীকে কিছুদিন হল অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়েছিলাম আমার ঘরদোর মোছা আর বাসন মাজার কাজে। স্বপাকে আহার এখনো করি–বরাবরের অভ্যেস। ওই কাজটি কারও হাতে তুলে দিতে মন চায় না। প্রেশারকুকারে বেশিক্ষণ সময়ও লাগে না। কিন্তু ঘরদোর বাসনপত্র পরিষ্কার রাখতে ইদানীং বড়ই আলস্যবোধ করছিলাম।
মাসান্তে মাত্র পনেরো টাকা বেতনের বিনিময়ে শ্রাবণী আমাকে এই ঝাট থেকে মুক্তি দিয়েছে। খুবই গরিব। মাথার চুলে কোনওদিন তেলের ছোঁয়া লাগে বলে মনে হয় না। রুখু লালচে চুল চিরুনি দিয়ে আঁচড়ে রাখে। একটাই লাল ফ্রক রোজ পরে। রোজ ভোর পাঁচটায় আসে। আমি ঘুম থেকে উঠি কাক ডাকবারও আগে–বেড়িয়ে ফিরি কাক ডাকবার সময়ে। শ্রাবণী আসে তারপর। রোজ শিউলিতলা থেকে ফুল কুড়িয়ে আনে। প্লেটে করে সাজিয়ে রাখে টেবিলে। ডালশুদ্ধ ফুল এনে রাখে ফুলদানিতে। জল পাল্টে দেয় নিজেই। আমাকে কিছু বলতে হয় না।
একদিন সে যাবার সময়ে বলে গেল, কাকু, আজ বিকেলে আসতে একটু দেরি হবে।
রোজ বিকেলে শ্রাবণী আসত চারটে বাজলেই–সেদিন এল ছটায়। ঘর মুছতে মুছতে হাসি হাসি মুখে নিজেই বললে, দাদার কাছে গেছিলুম, কাকু। দাদা বললে, আজকে থেকে যা। তোমার কষ্ট হবে বলে চলে এলুম।
আমি বললাম, বেশ করেছিস। দাদার কাছে গেছিলিস কেন? বেড়াতে?
না। টাকা আনতে।
টাকা আনতে কেন?
পাঁচ-ছদিন খাওয়া হয়নি যে।
সে কী! পাঁচ-ছদিন খাসনি?
না।
টাকা পেয়েছিস?
না।
আজ তাহলে খাবি কী?
হাসল শ্রাবণী। ঘর মুছতে লাগল মাথা নীচু করে।
আমি একটু চুপ করে থেকে বললাম, আমাকে বলিসনি কেন? না খেয়ে থাকতে কষ্ট হয় না?
শ্রাবণী কথা বলল না।
আমি মানিব্যাগ খুলে দশটা টাকা দিয়ে বললাম, আবার দরকার হলে বলবি।
শ্রাবণী আর বলে নি। দাদার কাছ থেকেই নাকি টাকা এনেছিল। চার-পাঁচটা ছোট ভাইবোন আর মাকে নিয়ে কখনো একবেলা কখনো দু-বেলাই না খেয়ে থেকেছে। দাদা সেই কারণেই একা থাকে। বাবা নেই। শ্রাবণীর বয়স বড়জোর বারো।
এর দিন কয়েক পরেই ট্যাক্সি ড্রাইভার বলবন্ত সিং খুন হল আমাদের পাড়াতেই। ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাসের ধারে–নোংরা জলের নালার একটু দূরে।
বেলেঘাটা সি-আই-টি বিল্ডিংস তুমি দেখছ। বাইপাসটা গেছে তার গা ঘেঁষে। কিছুদিন আগেও এই বিল্ডিং ছিল কলকাতার পুব অঞ্চলের শেষপ্রান্ত–তারপরেই চব্বিশ পরগনা। ধু-ধু মাঠ আর ভেড়ি। এখন সেখানে সল্ট লেক স্টেডিয়াম তৈরি হচ্ছে, ফ্ল্যাটবাড়ির পর ফ্ল্যাটবাড়ি উঠছে। চিরনিদ্রিত সুদীর্ঘ অজগর সাপের মতো ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাস এই দুইয়ের মাঝ দিয়ে যেন জড়শয়নে শুয়ে রয়েছে। স্থির, অবিচল, ধুলোয় লুণ্ঠিত। রাত্রিদিন তার ওপর দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে ছুটে যাচ্ছে। চাকা, হেঁটে যাচ্ছে চরণ। অহর্নিশ দুঃস্বপ্নের মতো বিচিত্র শব্দ আবর্তিত হয়েই চলেছে। চরণের আর চাকার স্পর্শে হৃদয় পাঠ করার বিদ্যে যদি এই মহাপথের জানা থাকত, তাহলে বলতে পারত কে বাড়ি যাচ্ছে, কে এয়ারপোর্টে যাচ্ছে, কে দক্ষিণের বালিগঞ্জ-পার্কসার্কাসে যাচ্ছে, কে জিরোতে যাচ্ছে, কে শ্মশানে যাচ্ছে। জানে না বলেই ধরতে পারেনি গভীর রাতে বলবন্ত সিং ট্যাক্সি চালিয়ে এসেছিল তার বুকের ওপর দিয়ে নিয়তির নির্দেশে দেহপিঞ্জর ত্যাগের লিখনকে সত্য করে তুলতে।
মৃগাঙ্ক, গল্প লিখতে বসে তুমি অনুপুঙ্খ বর্ণনা দাও সারস্বত উদ্দেশ্যে। আমি দেব কেবল প্রতিবেদন। সি-আই-টি বিল্ডিংয়ের শেষপ্রান্তে যেখানে খাল বুজিয়ে ওপর দিয়ে সড়ক নির্মিত হয়েছে, সেই জায়গাটা ছাড়িয়ে ধাপা লক পাম্পিং স্টেশনের পাশ দিয়ে দক্ষিণে একটু গেছিলে মনে আছে? দুর্গন্ধে প্রাণ আইঢাই করে উঠেছিল, নাকে রুমাল চাপা দিয়েছিলে? এখান থেকেই সড়কটা সোজা গিয়ে একটু বাঁয়ে বেঁকে চলে গেছে ধাপা-বানতলার আবর্জনা স্থূপের দিকে। সি-এম-ডি-এর স্বপ্ন একদিন এই রাস্তা আড়াইশো ফুট চওড়া হবে, মাঝখানে সবুজ মধ্যপটি থাকবে, ছটি ছরকমের পথ থাকবে এই আড়াইশো ফুটের ওপর, সুভাষ সরোবরের ধারে কাদাপাড়া টিলার মতো টিলা উদ্যানও গড়ে উঠবে, পুরো সড়কটাই আলো ঝলমলে থাকবে।
আপাতত, এ রাস্তায় হাঁটলে অথবা গাড়ি চালালে পদে পদে গরু মোষের সঙ্গে ধাক্কা লাগে, পায়ের তলায় সাপ কিলবিল করে উঠে নেমে যায় দু-পাশের ভেড়ির জলে, রাত্রে গাড়ি চালাতে গিয়ে বুক ঢিপ ঢিপ করে অন্ধকারে। হেঁটে যাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। উঁহু-হুঁহু দীর্ঘশ্বাস। সুখ দুঃখ, জরা-যৌবন, হাসি-কান্না, জন্ম-মৃত্যু, ধনী-দরিদ্র সমস্তই ওই নিশ্বাস ধুলোর স্রোতের মতো উড়ে যায় সুদীর্ঘ নিস্তব্ধ এই সড়কের ওপর দিয়ে।
কলকাতা পুলিশের সজাগ দৃষ্টি থাকে এই দিকে। এই সেদিন পর্যন্ত পুলিশ-চৌকি ছিল বিল্ডিংয়ের মোড়ে। তখন পার্টিতে পার্টিতে বোমাবাজি হত, দিবালোকে মানুষ খুন হত–পুলিশ প্রহরীর তর্জনি শাসনে তা কমে আসে। পুলিশ চৌকিও উঠে যায়। কিন্তু রাতের আঁধারে কালো জিপ টহল দিয়ে যায় জোরালো হেডলাইট জ্বালিয়ে। কেননা, পুরোনো বিল্ডিংয়ের এককোণে গড়ে ওঠা নতুন বিল্ডিংয়ে গভীর রাতে নাকি ট্যাক্সি ঢোকে কলকাতার দিক থেকে কিছুক্ষণ পরে সড়ক বেয়ে চলে যায় সল্ট লেক বা গড়িয়ার দিকে। পুরো সড়কটাই এখন বেআইনি কারবারের সড়ক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নোংরা জলের খালের পাশে কালো জিপটার হেডলাইটে হঠাৎ দেখা গেছিল দুমড়ে মুচড়ে পড়ে থাকা একটা দেহ। কালো পিচের রাস্তা থেকে একটু দুরে–ঘাস জমির ওপর। ঘাড়টা অস্বাভাবিকভাবে বেঁকে রয়েছে পেছনে।
দাঁড়িয়েছিল কালো জিপ। রাতের প্রহরীরা নেমে গিয়ে পেয়েছিল বলবন্ত সিংকে। পকেট থেকে ড্রাইভিং লাইসেন্স উদ্ধার করতেই পাওয়া গিয়েছিল তার পরিচয়। ট্যাক্সিটা কিন্তু দেখা যায়নি। ঘাস-জমির ওপর চাকার দাগ ছিল।
হেডলাইট আর অনেকগুলো টর্চবাতির আলোয় দেখা গেছিল চোখ ঠেলে বেরিয়ে এসেছে বলবন্ত সিংয়ের। লড়েছে প্রাণপণে–টেরিন শার্ট ছিঁড়ে ঝুলছে দুপাশে। রঙিন সুতির মাফলারটা মুখ আর নাকের ওপর দিয়ে প্রচণ্ড শক্তিতে টেনে তিনটে গিঁট দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়েছে পেছনে। গলার ওপর আঙুলের ছাপ। নিষ্ঠুরভাবে শ্বাসরোধ করা হয়েছে সব দিক দিয়েই।
বেলেঘাটা থানার বড়বাবুর সঙ্গে আমার হৃদয়ের সম্পর্ক আছে। কি জানি কেন ভদ্রলোক আমাকে ভালোবাসেন। কারণে অকারণে বাড়ি আসেন, পকেটভর্তি চুরুট বের করে আমাকে খেতে দেন, নস্যির ডিবেও বাড়িয়ে দেন। শীর্ণকায় এবং দীর্ঘকায় এই ভদ্রলোকই বলতে গেলে আমাকে চুরুট আর নস্যিতে রপ্ত করে ছেড়েছেন। অট্টহেসে বলেন, দিনে অন্তত একবার…চার্চিল… চার্চিল…ক্যালকাটার চার্চিল মশায়…চুরুট আর নস্যি দুটোতেই মজা পেতেন–দুটো দিয়েই ব্রেন সাফ রাখতেন।
এঁর নাম ধরণী ঘোষাল। কৃষ্ণকায় হাস্যমুখ সদাশয় আড্ডাবাজ পুরুষ। উনিই আমাকে দেখালেন বলবন্ত সিংয়ের লাশটা। শুনলাম, পকেটে গোটা পঞ্চাশ টাকা ছিল–দিনের শেষে ওই রকম রোজগারই হত রোজ। টাকা নেই। ট্যাক্সিও নেই। ওয়েস্টার্ন কান্ট্রির মতো ট্যাক্সি ছিনতাই আরম্ভ হয়েছে দিল্লির পর কলকাতাতেও। কিন্তু ট্যাক্সি ড্রাইভারকে খুন করতে গেল কেন? ফেলে পালালেই তো হত।
অটোপ্সি রিপোর্ট দেখলাম। ডেথ বাই স্ট্রাংগুলেশন। শ্বাসতন্ত্র এক্কেবারেই জখম। নাক আর মুখের পেছনে সাড়ে চার ইঞ্চি লম্বা দলসদৃশ ফ্যারিংক্স বা ভয়েস বক্সের ওপর প্রচণ্ড চাপ পড়েছে। কঠিন কার্টিলেজ দিয়ে গড়া ফ্যারিংক্স গাত্র সব সময়ে ভোলা থাকে–কিন্তু প্রচণ্ড চাপ দিয়ে তা থেঁতলে দেওয়া হয়েছে।
বলবন্ত সিংয়ের অনামিকায় আংটি পরার কোনও দাগ দেখলাম না। কিন্তু ঘড়ি পরার দাগ আছে বাম মণিবন্ধে। ঘড়ি পাওয়া যায়নি।
ধরণীবাবু জানালেন, ট্যাক্সি ড্রাইভারদের অ্যাসোসিয়েশন ওয়ান ডে স্ট্রাইক করতে চলেছে। হত্যাকারীকে ধরতে না পারলে আরো জল গড়াবে। অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ক্ষমতাবান ব্যক্তি–মেম্বার অফ পার্লামেন্ট। চাকরি নিয়ে না টানাটানি করে। কলকাতা নামক মনুষ্য অরণ্যে গাড়ি চাপা পড়ে আর অনাহারেই রোজ কতজন অক্কা পাচ্ছে–কেউ মাথা ঘামায় না। একটা ট্যাক্সি ড্রাইভার
হয় জীবনসংগ্রাম থেকে ছাড়ান পেল–তা নিয়ে এত হই-চই করার কি আছে?
শুনতে-শুনতে শ্রাবণীর মুখটা মনে পড়ে গেছিল। সত্যিই তো, চার-পাঁচদিন না খেয়ে হাসিমুখে আমার খিদমৎ খেটে গেছে বাচ্চা মেয়েটা–কেউ তো খবর রাখেনি।
নিন, নিন, খান, হাতে একটা চুরুট গুঁজে দিয়ে বলেছিলেন ধরণী ঘোষাল, ব্রেনটাকে একটু ঝাঁকুনি দিয়ে দেখুন না হোমিওসাইড স্কোয়াডকে হেলপ করতে পারেন কিনা। লাখ লাখ লোকের মধ্যে থেকে কিলার খুঁজে বার করতে গিয়ে শালা নিজেই না কিলড হয়ে যাই।
বলতে বলতেই এসেছিল টেলিফোন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমিই ধরণী ঘোষাল… তরণী এবার ডুবল বলে…পাওয়া গেছে ট্যাক্সিটা?…অ্যাবাচ্ছ?…আমহার্স্ট স্ট্রিট থানার সামনে?…ফুয়েল মিটারের ইন্ডিকেটর E-য়ের দাগে?…নো ক্লু?..গুড।
ঠকাস করে রিসিভার নামিয়ে রেখে ধরণী ঘোষাল জানালেন, বড় জবর পরিহাস করে গেছে হত্যাকারী। খালি ট্যাক্সি রেখে গেছে থানার সামনেই–বুকের পাটা তো কম নয়। পুলিশকে চ্যালেঞ্জ।
আমি বলেছিলাম, তা নয়। চ্যালেঞ্জের ব্যাপারই নয়। থানার সামনে ট্যাক্সি ফেলে যাওয়ার দরকার হলে কাছাকাছি থানাগুলো ছেড়ে গিয়ে আমহার্স্ট স্ট্রিট থানা পর্যন্ত যাওয়া কেন? আসলে তেল ফুরিয়ে গেছিল। জিগ্যেস করেছিলাম, গাড়ির মুখটা কোন দিকে ছিল বলেছে? ধরণীবাবু বললেন, উত্তর দিকে। রাজা রামমোহন রায়ের বাড়ির দিকে। কিন্তু ইন্দ্রনাথবাবু, সন অভ সোয়াইনটাকে এখন কোথায় পাই বলুন তো?
সন নয়, বলুন সন্স। একজন হত্যাকারী নয়–একাধিক। দুজন তো বটেই, তিনজন হওয়াও বিচিত্র নয়। বলবন্ত সিং শক্তিশালী যুবক। লড়েওছে প্রাণপণে। কিন্তু পারেনি অতজনের সঙ্গে।
তাচ্ছিল্যের সঙ্গে ধরণীবাবু বলেন, অবভিয়াসলি।
আমি বললাম, বলবন্ত সিংয়ের ডেরায় হানা দিয়েছেন?
এই যাব বলেই তো আপনাকে পাকড়াও করে নিয়ে এলাম। চলুন।
ভবানীপুরে বলবন্ত সিংয়ের আস্তানায় উল্লেখযোগ্য কিছুই পাওয়া যায়নি। ব্যাচেলার। একা থাকত একটা ছোট্ট ঘরে। মদের খালি এবং ভর্তি বোতল আর ফিল্মস্টারদের ছবিতে বোঝাই ঘর। দেওয়ালে সাঁটা বিশেষ একটা নায়িকার বুকের ওপর কলম দিয়ে আঁকা হরতন-তিরবিদ্ধ।
স্যাডিস্ট, একদৃষ্টে সেদিকে চেয়ে আছি দেখে, নাক কুঁচকে বলেছিলেন ধরণী ঘোষাল, আপনি নন–বলন্ত সিং।
আমি ওঁকে নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পাশেই টায়ারের দোকানে ঢুকেছিলাম। টেলিফোন যন্ত্রটা দেখিয়ে জানতে বলেছিলাম, বলবন্ত সিংয়ের নামে টেলিফোন আসত কিনা। শিখ দোকানদার খালিস্তানি মেজাজ দেখিয়ে বলেছিল, আসত বইকি–এখনো আসে। দিল চৌচির করার মতো সব টেলিফোন।
দিল চৌচির করার মতো টেলিফোনই আশা করছিলাম। খুঁটিয়ে জিগ্যেস করতেই খবরটা পেয়ে গেলাম। একটি নারীকণ্ঠ প্রায় ডেকে দিতে বলত বলবন্ত সিংকে। বলবন্তও তাকে ফোন করত। তার ঠিকানা? আবার উগ্র হয়ে উঠেছিল খালিস্তানি টেম্পার। আমি ধীরে-সুস্থেই ঠিকানা উদ্ধারের পথ বাতলে দিয়েছিলাম। উল্টোপাল্টা টেলিফোনের বিল আসার জন্যে অনেকেই আজকাল খাতায় লিখে রাখে রোজ কোন নম্বরে টেলিফোন করা হল। সেরকম খাতা নেই কি দোকানে? সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে পড়েছিল খাতাখানা। উগ্র শিখ আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিল, তিনদিন আগে বলবন্ত সিংয়ের ফোন করা নাম্বারটা। একই নাম্বার দেখলাম আগেও লেখা রয়েছে খাতায়।
ওইখান দাঁড়িয়েই ফোন করলাম ওয়ান নাইন সেভেনে। ডাইরেক্টরী এনকোয়ারি। পেয়ে গেলাম আলিপুরের একটা ঠিকানা।
গিয়েছিলাম সেখানে। বাড়িটা এক বিলেত ফেরত ব্যারিস্টারের। এখন অবশ্য ব্যারিস্টার সম্মান আর কাউকে দেওয়া হয় না–সবাই অ্যাডভোকেট। তাহির আমেদ কিন্তু মার্বেল প্রস্তর ফলকে এখনো সেই ঘোষণাই করে চলেছেন।
ভদ্রলোক মাঝবয়সি৷ পুলিশ দেখেই পাইপ নামিয়ে বললেন, খবরটা পেলেন কী করে?
আকাশ থেকে পড়লেন ধরণী ঘোষাল, কীসের খবর?
সাকিনা দুদিন হল পালিয়েছে–পুলিশকে জানাইনি কেলেঙ্কারির ভয়ে, বাট হাউ…
সাকিনা তার একমাত্র মেয়ে। পঞ্চদশী। স্কুলগার্ল। ঘর তার দোতলায়। পেছনের বারান্দা থেকে নেমে যাওয়া যায় একতলার বাগানে-সেখানে থেকে দরজা খুলে দুদিন আগে রাত্রে পালিয়েছে সাকিনা। মায়ের হিরে-জহরতও নিয়ে গেছে। প্রায় লাখ টাকার জুয়েল। বলা বাহুল্য, বেশির ভাগই কালো টাকায় কেনা। তাই চেপে গেছিলেন তাহির আমেদ।
সাকিনার পড়ার টেবিলে নিজের একটা ছবি ছিল কাঁচের তলায়। এককোণে ছোট করে একটা টেলিফোন নাম্বার লেখা–খালিস্তানী শিখের টায়ারের দোকানের টেলিফোন নাম্বার।
সাকিনা দেখতেও বিশেষ সেই নায়িকার মতো–যার ছবির বুকের হরতন আঁকা দেখে এসেছি বলবন্ত সিংয়ের ঘরে।
প্রেমের সম্পর্ক ছিল দুজনের মধ্যে। সাকিনা জহরত নিয়ে পালিয়ে গেছে তাহলে বলবন্ত সিংয়ের কাছেই।
তক্ষুনি গেলাম টায়ারের দোকানে। বলবন্ত সিং কি সাদি-টাদি করব বলেছিল ইদানীং? বলছিল বইকি। টাকার পাহাড়ে নাকি বসবে শিগগিরই–ট্যাক্সি চালাতে আর হবে না–টায়ারের দোকান দেবে। ক্যাপিটাল? কুছপরোয়া নেহি–ওভি হো জায়গা।
কিন্তু বলবন্ত সিংয়ের একখানা মাত্র ঘরে তালা ঝোলে না কেন? আমরা তো ভেজানো দরজা খুলেই ভেতরে ঢুকেছিলাম। তালা কোথায়?
আশপাশের ঘরের বাসিন্দাদের জিগ্যেস করে জানা গেল, ব্যাচেলার বলবন্ত ওই রকমই কাছাখোলা। এই তো দিন কয়েক আগেই ভোররাতে বন্ধুবান্ধব নিয়ে এসেছিল। কেউ উঠে অবশ্য দেখেনি, বলবন্ত তাদের মধ্যে ছিল কিনা। ভোরবেলা দেখা গেল দরজা দু-হাট করে খোলা–বলবন্ত নেই, বন্ধু-টন্ধুও নেই। নিশ্চয় চাবি দিতে ভুলে গেছে।
তালাটা পাওয়া গেল ঘরের মধ্যে। যা খুঁজছিলাম, সেটা কিন্তু পাওয়া গেল না–জহরতের বাক্সটা। যে রাতে বন্ধুদের নিয়ে বলবন্ত এসেছিল বলে প্রতিবেশীদের বিশ্বাস, সে রাতেই খুন হয়েছিল বলবন্ত। পকেট থেকে চাবি নিয়ে বন্ধুরা এখানেই এসেছিল জহরতের বাক্স সরাতে।
হত্যাকারীরা তাহলে বলবন্তের বন্ধু। বাড়ির ঠিকানা জানত। কিন্তু ট্যাক্সি নিয়ে উত্তর কলকাতার দিকে যাচ্ছিল কেন? সটান ভবানীপুরে এল না কেন?
খুনটার মোটিভ তাহলে ট্যাক্সি ছিনতাই নয়–জহরত লুঠ। শুনে নিশ্চিন্ত হলেন ধরণী ঘোষাল–ট্যাক্সি ড্রাইভারদের হামলা এবার রোখা যাবে।
আমার মনটা কিন্তু খচখচ করতে লাগল। বলবন্তর বন্ধুরা অত রাতে বেলেঘাটাতেই বা এল কেন, খুন-টুন করে ভবানীপুরের দিকে না গিয়ে আমহার্স্ট স্ট্রিট থানার সামনেই বা গেল কেন?
ধরণী ঘোষালকে নিয়ে এলাম আমহার্স্ট স্ট্রিট থানায়। দেখলাম ট্যাক্সিখানা। পেছনের ট্রাঙ্ক খুলে দেখলাম, থরে থরে সাজানো টায়ার। অনেকগুলো মোটর সাইকেলের টিউবও রয়েছে ভেতরে। টায়ার আর টিউব, দুটো থেকেই বেরোচ্ছে দিশি মদের গন্ধ। চোলাই মদ। টিউবে ভরে টায়ারের মধ্যে লুকিয়ে নিয়ে যাওয়া হত। সবকটা টিউবই খালি। অর্থাৎ ট্যাক্সি করে মাল পাচার করে ফিরছিল বলবন্ত সিং। কোথায় ফিরছিল?
ধরণী ঘোষালকে নিয়ে চলে এলাম বেলেঘাটায়। চোলাই মদের ডিপো এখানে একটা নয়–একাধিক। ডোবায় পোঁতা থাকে বোতল, জালা। ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাসের ধারে ধারে ধাপা-বানতলা পর্যন্ত চলছে এই ব্যবসা। দিনদুপুরেও দূর থেকে দেখা যায় ঝোঁপের মধ্যে জলা-জায়গায় ধোঁয়া উঠছে। ধরণী ঘোষাল দেখলাম আমার চাইতেও বেশি খবর রাখেন। মার্কামারা কয়েকটি আড়তে হানা দিলেন সবার আগে। অভয় দিতে এক জায়গায় বললে, বলবন্ত সিং খুন হয় যে রাতে, সেইদিন একগাড়ি মাল নিয়ে গেছিল। সঙ্গে ছিল তিনজন পাঞ্জাবি দোস্ত। শিখ।
ধরণী ঘোষাল উল্লসিত হলেও আমি হইনি। এত বড় শহরে তিনজন শিখ খুনেকে খুঁজে বার করা সম্ভব নয় কোনওমতেই। কিন্তু তাই বলে তো হাল ছেড়ে দেওয়াও যায় না। একগাড়ি মাল ডেলিভারী দিয়ে বলবন্ত বন্ধুদের নিয়ে আবার আসছিল নিশ্চয় আর একগাড়ি মাল নিতে–অন্তত বন্ধুরা তাই বুঝিয়েছিল বলবন্তকে। তারপর বচসা হয়েছে–খুন হয়েছে বলবন্ত। কিন্তু কলহটা কি নিয়ে? সাকিনাকে নিয়ে নয়তো? উপপত্নীর ভাগ তো দোস্তরাই চায়। সাকিনা তাহলে কোথায়? ট্যাক্সি পাওয়া গেছে উত্তরমুখো অবস্থায়। বলবন্তকে সরিয়ে দোস্তরা প্রথমেই সাকিনা সন্ধানেই যাচ্ছিল নিশ্চয়–ভেবেছিল রূপ আর রূপো এক জায়গাতেই পাওয়া যাবে। তেল ফুরিয়ে যাওয়ায় ফিরে এসেছে বলবন্তের ঘরে। জহরত পেয়েছে কিনা জানা যাচ্ছে না–কিন্তু সাকিনাকে পেয়েছে কি?
বলবন্তর যা চরিত্র, তা থেকে বোঝা যায় উত্তর কলকাতার একটা নিষিদ্ধ পল্লীতে তার যাতায়াত থাকা স্বাভাবিক। সোনাগাছিতে। চোরাই মদের কারবারটাও সেখানে চলে ভালো। ট্যাক্সি নিশ্চয় যাচ্ছিল সেই দিকেই। বলবন্ত নিজের ঘরে তোলেনি সাকিনাকে হয়তো রেখে এসেছে নিষিদ্ধ পল্লীরই কোনও নিশ্চিন্ত ডেরায়।
গেলাম সোনাগাছিতে। হেদিয়ে পড়েছিলেন ধরণী ঘোষাল। কিন্তু ঘনঘন নস্যি নিচ্ছিলেন আর দিচ্ছিলেন আমাকে। চার্চিল…চার্চিল স্বগতোক্তি শুনে যাচ্ছিলাম সমানে। মৃগাঙ্ক, তুমি সোনাগাছি কখনো যাওনি আমি জানি। কিন্তু আমার লাইনটাই খারাপ। সব খবরই রাখতে হয়। বারবনিতাদেরও ক্যাটেগরি আছে। রূপ আর পশার অনুযায়ী এক-এক বাড়িতে এক-এক দলের নিবাস। নতুনদের তোলা হয় আবার বিশেষ বিশেষ জায়গায়। বাঙালি, হিন্দুস্থানী, মুসলিম, চাইনিজদের এলাকা আলাদা আলাদা। নিয়মিত খদ্দেররা মোটামুটি খবর রাখে দালালদের দৌলতে–দালালরাও সব খবর ভাঙে না। পুলিশের ভয়ে। কিন্তু রামকেষ্ট আমার হাতের লোক। কোনওকালে তার একটা উপকার করে ফেলেছিলাম–আজও সেই উপকার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্যে সে এক পায়ে খাড়া। ধরণী ঘোষালকে জিপে বসিয়ে এই রামকেষ্টকেই খুঁজে বার করলাম। কথা ফুরোনোর আগেই সে শুধু সাকিনার ডেসক্রিপশন শুনে বলে দিলে, মালটা কদিন আগেই এসেছে বটে কিন্তু বাজারে নামেনি এখনো। প্রাইভেট মাল। প্রাইভেটদের এলাকায় আছে বহাল তবিয়তে। সোনাগাছির অলিখিত নিয়ম অনুযায়ী সেখানে কাউকে নিয়ে যাওয়া যাবে না।
কিন্তু রামকেষ্ট তো আমাকে চেনে। সোনাগাছির সততা সম্বন্ধে আমাকে সমঝে দেওয়ার পর নিয়ে গেল সাকিনার ঘরে। পঞ্চদশী মেয়েটা যেন আগুন দিয়ে গড়া। হেলেনের জন্য ট্রয়, পদ্মিনীর জন্যে চিতোর ধ্বংসের পর সাকিনার জন্যেও কলকাতা ধ্বংস হয়ে গেলে আশ্চর্য হব না। বলবন্ত তো গেলই–এবার যাবে তার হত্যাকারীরা।
আমাকে দেখেই ভুরু কুঁচকেছিল সাকিনা। রামকেষ্ট অভয় দেওয়ার পর ভুরু সরল হয়েছিল। বলবন্ত যে আর নেই, প্রথমে তা ভাঙি না। শুধু দুটো প্রশ্ন করেছিলাম–জহরতের বাক্সটা কোথায়?
বলবন্তর কাছে, বলেছিল সাকিনা। অত দামি বাক্স এ অঞ্চলে রাখতে চায়নি। কিন্তু আজ এলেই বলবে বাক্স ফিরিয়ে আনতে।
দ্বিতীয় প্রশ্নটা করতেই বললে, হা, হা, চিনব না কেন? আমারই দেওয়া তো।
দ্বিতীয় প্রশ্নটা কি যদি আঁচ করতে পারো, মৃগাঙ্ক, তাহলে বুঝব তুমি বড় গোয়েন্দা-লেখক। আর যদি না পারো, ধৈর্য ধরো।
তখন সন্ধে হয়েছে। সোনাগাছির মদের আড্ডায় ভিড় শুরু হয়েছে। রামকেষ্টকে দিয়ে দোকানদারকে ম্যানেজ করিয়ে কাউন্টারের পেছনে সাকিনাকে বসিয়ে রাখলাম বোরখা পরিয়ে। সাকিনা এসেছিল–বলবন্ত আর ফিরবে না শুনে রাগে ফুঁসতে ফুসতে এসেছিল। মদ খেতে আসবে শুনে এক কথাতেই রাজি হয়ে গেছিল।
ভেবেছিলাম একত্রে হবে না–অনেক রাত অপেক্ষা করতে হবে। সোনাগাছিতে মদের কারবারে এবং মেয়েদের কারবারে যাদের যাতায়াত নিয়মিত, কিছুক্ষণের জন্যেও এখানে তাদের আসতেই হয় গলা ভিজিয়ে নেওয়ার জন্যে। জহরতের বাক্স পেয়েও যারা জহরতের মালকিনকে পায়নি, সাকিনার সন্ধানে তারা আসবেই আসবে। সাকিনার সন্ধানে না হলেও টাকা ওড়াতে, ফুর্তি করতে আসবেই। এখানে বসে মদ যারা খায় না, বোতল বগলে করে নিয়ে যায় তারা। মোট কথা, আসতেই হবে। অপরাধীদের চরিত্রের এদিকটা আমার ভালোভাবেই জানা।
মৃগাঙ্ক, ভাগ্য সহায় হয় উদ্যোগীদের। বরাবর তাই দেখেছি। সেই সন্ধ্যাতেও তাই দেখলাম। তিনজন শিখ পাঞ্জাবি ঢুকল ঘরে। চনমনে চোখ। বেপরোয়া ভাবভঙ্গি।
চোখের ইশারা করল সাকিনা। বোরখার আড়ালে দেখলাম চোখ জ্বলছে তার।
ধরণী ঘোষাল তৈরি ছিলেন। তিনজনকেই তুললেন আগে থেকে এনে রাখা ভ্যানে।
তিনজনেই কবুল করেছিল বলবন্ত হত্যার অপরাধ। ওরা ছিল চারবন্ধু। মদ সাপ্লাই ওদের মেন বিজনেস। ট্যাক্সি রেখেছিল বলবন্ত সেই কারণেই। কিন্তু একদিন সাকিনাকে প্যাসেঞ্জার তুলে তাকে গেঁথে ফেলেছিল ছিপে। বাড়ি থেকে বার করে জহরতের বাক্সও তুলেছিল বাড়িতে। মতলব ছিল বোম্বেতে পিঠটান দেওয়ার–সাকিনাকে নিয়েই। ফিল্ম হিরোইন বানাতে। কিন্তু তিন দোস্ত বাগড়া দিয়েছিল মদের কারবার লাটে উঠবে দেখে। দেখতে চেয়েছিল সাকিনাকে। দেখায়নি বলবন্ত। বেলেঘাটায় ওই জন্যেই ওকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। হয় সাকিনা আর জহরতের ভাগ দাও নইলে জানে মরো। লড়ে গেছিল বলবন্ত–কিন্তু…
তিনজনের একজনের দিকে আমি একদৃষ্টে চেয়েছিলাম। অনেকক্ষণ থেকেই। মাথায় সে ছোটখাটো, শিখদের মতো লম্বা চওড়া নয়। কথাও বলছে না। চুপচাপ।
ধরণী ঘোষালকে আড়ালে ডেকে বলতেই তাকে ছাড়া বাকি দুজনকে সরিয়ে নিয়ে গেছিলেন তিনি ঘর থেকে।
ঘরে তখন সে আর আমি।
আমি চোখে চোখে চেয়ে বলেছিলাম, তুমি বাঙালি?
চমকে উঠেছিল সে।
এ পথে এলে কেন?
কর্কশ গলায় বলেছিল সে, পেটের জ্বালায়।
কিন্তু এখন তো ইন্ডিয়ান পিনাল কোডের ৩০২ ধারা অনুযায়ী, ফাঁসি হবে তোমাদের। ৩৯০ ও ৪০২ ধারা অনুযায়ী রবারি আর ডেকয়টি চার্জেও ফেঁসে যাবে।
নীরবে চেয়ে রইল সে। ভয় পেয়েছে।
দাড়ি গোঁফ রেখেছ কেউ যাতে চিনতে না পারে–কেন? আরও খারাপ কাজ করেছ? কথা নেই।
বিয়ে করেছ?
হ্যাঁ।
বউ আছে?
হ্যাঁ।
ছেলেমেয়ে?
আছে।
এদের ভাসিয়ে দিয়ে যেতে তো হবে এবার।
ভাসিয়ে দিয়েছি অনেকদিন।
বাড়ি ছাড়া? হ্যাঁ।
কেন?
খেতে দিতে পারি না।
এখন তারা খেতে পাচ্ছে?
মাঝে মাঝে টাকা পাঠাই–মুখ আর দেখাই না।
কোথায় থাকে তারা?
জবাব নেই।
তাদের জন্য মন কাঁদে না? দেখতে ইচ্ছে যায় না?
পকেট থেকে একটা ফটো বার করল সে। কোণ দুমড়ানো মলিন। বললে, এইটাই দেখি রোজ।
দেখি।
ইতস্তত করে বাড়িয়ে দিল সে।
আমি দেখলাম এবং চমকে উঠলাম। ছজনের পরিবারের একজনকে আমি চিনি। শ্রাবণী।
মৃগাঙ্ক, তাই আমি পালিয়ে এসেছি। খেতে না পাওয়া মেয়েটাকে এবার আমি বাপহারাও করলাম জন্মের মতো। তাকে টাকা দিয়েছি, খাবারের বন্দোবস্ত করে এসেছি–কিন্তু শুধু আমিই জানি–ইহজীবনে সে আর বাবাকে ফিরে পাবে না।
সাকিনাকে ফিরিয়ে দিয়েছি তার বাবার কাছে। সে ঘড়িটা চিনিয়ে না দিলে, বলবন্ত সিংয়ের হত্যাকারীকে ধরতে পারতাম না। ধরণী ঘোষালরা একদম মাথা খাটান না–এইটাই ওঁদের বড় দোষ। বলবন্ত সিংয়ের কব্জিতে ঘড়ি পরার দাগ ছিল। কিন্তু ঘড়িটা নিয়ে একদম মাথা ঘামাননি। টাকা পয়সাসমেত হত্যাকারীরা সেই ঘড়িটাও তো খুলে নিয়ে গেছিল। একজন না একজন হাতেও নিশ্চয় পরেছিল–নিশ্চয় দামি বলেই নিয়ে যাওয়ার লোভ হয়েছিল। সাকিনাই চিনিয়ে দেয় ঘড়িটা। ক্যাসিয়ে কোয়ার্জ ঘড়ি-মাস, তারিখ, বার, অ্যালার্ম–সব আছে সেই ঘড়িতে। এই একটিমাত্র সূত্র সন্ধানেই সাকিনার সঙ্গে দেখা করেছিলাম এবং দ্বিতীয় প্রশ্নটা করেছিলাম।
যাক সেকথা, শ্রাবণীকে পিতৃহীন করার অপরাধ বুকে নিয়ে পালিয়ে এসেছি এই পাহাড়-বনের নির্জনতায়। বিবেককে জিগ্যেস করছি বারবার, সমাজের ভালো করতে গিয়ে নির্দোষদের সর্বনাশ করার কোনও অধিকার কি আছে আমার? শ্রাবণী তো নিষ্পপ–কেন তার এত বড় ক্ষতি আমি করলাম? খ্যাতি? যশ? কৃতিত্বের অহঙ্কার? মরীচিৎকার পেছনে আর কতদিন ছুটে চলব, মৃগাঙ্ক, বলতে পারো?
* রোমাঞ্চ পত্রিকায় প্রকাশিত।
স্যার আর্থার কোনান ডয়ালের গল্প নিয়ে গোয়েন্দা ধাঁধা
ইঞ্জিনিয়ারের বুড়ো আঙুল। শার্লক হোমস
ওয়াটসনের তখন মরবার সময় নেই। ঘর সংসার নিয়ে ব্যস্ত। সদ্য বিয়ে হয়েছে। একদিকে বউ, আরেক দিকে রুগি। দু-দিক সামলাতে গিয়ে ব্যাচেলর বন্ধু শার্লক হোমসকে পর্যন্ত ভুলতে বসেছে।
ঠিক এই সময়ে একদিন ভোরবেলা ঘুম চোখে নীচে নেমে আসতে হল ওয়াটসনকে। অদ্ভুত একটা রুগি এসে বসে আছে বসবার ঘরে। লোকটা পেশায় হাইড্রলিক ইঞ্জিনিয়ার। বুড়ো আঙুলটা সদ্য কাটা গেছে। রক্তে জবজবে রুমাল জড়ানো।
ব্যান্ডেজ করার পর ইঞ্জিনিয়ার বললে, আমাকে এখুনি পুলিশের কাছে যেতে হবে। কেসটা সিরিয়াস।
ওয়াটসন এই সুযোগে শার্লক হোমসের ওকালতি করে বসল। শুনে লাফিয়ে উঠল আঙুলকাটা ইঞ্জিনিয়ার। পুলিশের চাইতে হোমসের ওপর তার আস্থা বেশি।
সুতরাং সেই সকালেই সটান বেকার স্ট্রিটে এসে পৌঁছল ওয়াটসন। হোমস যথারীতি বসে আছে আরাম কেদারায়। মুখে-পাইপ, ঘরে তামাকের ধোঁয়া। পেট খালি। হাতে খবরের কাগজ।
ইঞ্জিনিয়ারের অবস্থা তখন শোচনীয়। বিপুল রক্তপাত আর ক্লান্তিতে কথা বলার শক্তিও নেই। হোমস্ ব্র্যান্ডি খাইয়ে দিতে একটু চাঙ্গা হল ভদ্রলোক। ইজিচেয়ারে আরাম করে শুয়ে শুরু করল অতি ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার অত্যাশ্চর্য কাহিনি।
নাম তার ভিক্টর হেথার্লি। হাইড্রলিক ইঞ্জিনিয়ার। আপিস সাজিয়ে বসেও সুবিধে করে উঠতে পারছিল না। এমন সময়ে গতকাল একটা অদ্ভুত লোক এসে দেখা করল তার সঙ্গে।
লোকটার নাম কর্নেল স্টার্ক। ভীষণ ঢ্যাঙা আর পাকানো চেহারা। গালের চামড়া যেন হাড়ের ওপর সেলাই করা। নাকটা খাঁড়ার মতো। চোখ ঝকঝকে, চলন-বলন চটপটে। কথার মধ্যে জার্মান টান।
শকুনের মতো তীক্ষ্ণ চোখে হেথার্লিকে বিঁধে ফেলল কর্নেল। ঝট করে লাফিয়ে গিয়ে দেখে এল দরজায় কেউ আড়ি পাতছে কিনা। তারপর শপথ করিয়ে নিল হেথার্লিকে দিয়ে কোনও কথা যেন কেউ জানতে না পারে। যেহেতু হেথার্লি অনাথ আর আইবুড়ো–তাই তার কাছেই এসেছে কর্নেল। কেন না অনাথ আর আইবুড়ো লোকেরা পেটে কথা রাখতে জানে। কাজটা অবশ্য সামান্য ঘণ্টা কয়েকের মতো। দক্ষিণাটা অসামান্য। পঞ্চাশ গিনি নগদ।
শুনেই হেথার্লির টনক নড়ল। পঞ্চাশ গিনি চাট্টিখানি কথা নয়। কিন্তু কাজটা কী?
কর্নেল তখন ফিসফাস করে বলল, তার একটা হাইড্রলিক মেশিন আছে। মেশিনটার কোথায় যেন একটি গলদ হয়েছে। হেথার্লিকে গিয়ে তা বার করে দিতে হবে।
কিন্তু একাজ এত চুপিসাড়ে করার দরকারটা কী? কর্নেল সেঁতো হাসি হেসে বুঝিয়ে দিল কারণটা। রিডিংয়ের কাছে খানিকটা জমি কিনেছিল সে। তারপর একদিন দেখল, জমির তলায় সাজিমাটির স্তর হয়েছে যা কিনা সোনার চেয়েও দামি। তার চাইতেও বড় কথা–স্তরটা বেশি করে ছড়িয়ে পড়েছে পাশের দুই ভদ্রলোকের জমিতে। তারাও জানে না তাদের জমিতে সোনার চেয়েও দামি জিনিস পড়ে আছে। জানলে চড়চড় করে দাম উঠে যাবে জমিগুলোর। কিন্তু জলের দরে ও জমি কিনতে চায় কর্নেল। তাই আগে নিজের জমি থেকে সাজিমাটি তুলে দু-পয়সা জমিয়ে নিয়ে সেই টাকা দিয়ে কিনবে পাশের জমিগুলো। এত গোপনতা সেই কারণেই। নিজের জমিতে মেশিন চলছে–এ খবর একবার প্রকাশ পেলে পাশের জমিওলা আর তো জমি বেচতে চাইবে না। সুতরাং হেথার্লি যেন সন্ধের দিকে রিডিং স্টেশনে চুপিসাড়ে হাজির থাকে। কর্নেল এসে তাকে নিয়ে যাবে তার খামারবাড়িতে।
সব শুনে শুধু, একটা প্রশ্নই করেছিল হেথর্লি, সাজিমাটি তো মাটি খুঁড়ে বার করতে হয়– কিন্তু হাইড্রলিক মেশিনের দরকার তো চাপাচাপির জন্যে।
ও সব আপনি বুঝবেন না। আমাদেরও চাপ দেওয়া দরকার আছে বলে হেথার্লিকে যেন তোপের মুখে উড়িয়ে দিল কর্নেল।
অত কৌতূহলে দরকারটা কী? পঞ্চাশ গিনি পেলেই হল। সুতরাং যথাসময়ে রিডিং স্টেশনে হাজির হল হেথার্লি। স্টেশনের বাইরে কর্নেল দাঁড়িয়েছিল একটা এক-ঘোড়া গাড়ি নিয়ে। ঘোড়াটা বেশ তেজালো বাদামি রঙের, গায়ে ধূলোবালি, ঘামের চিহ্নমাত্র নেই।
গাড়ির মধ্যে হেথার্লিকে উঠিয়ে নিয়ে কোচোয়ানকে চলতে হুকুম দিল কর্নেল। দরজা-জানলা বন্ধ থাকায় হেথার্লি দেখতে পেল না কোন পথে চলেছে গাড়ি। তবে ওইরকম বেগে ঘণ্টাখানেক একনাগাড়ে ছুটে চলা মানে মাইল বারো পথ যেতে হয়েছিল নিশ্চয়। পাহাড়ি পথ হলে টের পাওয়া যেত। রাস্তাটা এবড়োখেবড়ো কিন্তু চড়াই উত্রাই পেরোতে হয়নি।
একঘণ্টা পরে একটা বাগানের মধ্যে গাড়ি ঢুকল। হেথার্লিকে নামিয়ে বেরিয়ে গেল গাড়িটা। একজন জার্মান মহিলা আলো হাতে সভয়ে দরজা খুলে কী যেন বলল কর্নেলকে। তারপর বেরিয়ে এল একজন মোটা ইংরেজ। কর্নেলের ম্যানেজার। মেয়েটাকে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে কর্নেল আর ম্যানেজার হেথার্লিকে নিয়ে এল হাইড্রলিক মেশিনের ঠিক তলায় একটা ছোট্ট খুপরি ঘরে।
ঘরটার তলায় লোহার প্লেট–ওপরে লোহার প্লেট। চারদিকে কাঠের দেওয়াল। মেশিন চললেই ওপরের লোহা নেমে এসে মিশে যায় নীচের লোহার সঙ্গে।
হেথার্লি সামান্য একটু ঘটাং-ঘটাং করেই বুঝে ফেলল রবারের ঢাকনি দিয়ে প্রেসার বেরিয়ে যাচ্ছে। তাই সেরকম চাপ উঠছে না অত বড় মেশিনেও।
তারপরেই তেলের বাতি হাতে একা ফিরে এল খুপরি ঘরে। মনটা খুঁতখুঁত করছিল মেশিনের সাইজ দেখে। এত বড় মেশিন দিয়ে সাজিমাটি চাপ দেওয়ার কথাটা যে মিথ্যে, তা ধরে ফেলল লোহার পাত দুটোয় হাত বুলোতেই। অদ্ভুত কতকগুলো ধাতুর গুড়ো লেগে সেখানে।
ঠিক এই সময়ে পেছনে পায়ের শব্দ শোনা গেল। কর্নেল জ্বলন্ত চোখে দেখছে হেথার্লিকে। তারপরেই আর সময় পাওয়া গেল না। চক্ষের নিমেষে বেরিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল কর্নেল।
মেশিনের চাপ-ঘরে বন্দি হল হেথার্লি। পরক্ষণেই কানে ভেসে এল সোঁ-সোঁ শব্দ। মেশিন চালিয়ে দিয়েছে কর্নেল। ওপরের লোহার প্লেট নীচে নেমে আসছে হেথার্লিকে চিঁড়েচ্যাপটা করতে। আচম্বিতে পাশের কাঠের দেওয়ালে খুলে গেল আর একটা দরজা। সেই জার্মান মহিলাটা ওকে টেনে নিয়ে এল বাইরে। প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে তেলের বাতি গুঁড়ো হওয়ার এবং ধাতুতে-ধাতুতে ঠোকাঠুকির আওয়াজ শোনা গেল মেশিন ঘরের ভেতর থেকে।
মেয়েটা হেথার্লিকে বললে তিনতলার জানলা থেকে লাফ দিয়ে পড়তে। কিন্তু কর্নেল ততক্ষণে ছুটে এসেছে কৃপাণ হাতে। দরজা আটকে দাঁড়াল মেয়েটা। ঠেলে ফেলে দিয়ে ছুটে এল কর্নেল। হেথার্লি তখন চৌকাঠ ধরে বাইরে ঝুলছে। কৃপাণের কোপে বুড়ো আঙুলটা রয়ে গেল ঘরের মধ্যে।
তারপর আর কিছু মনে নেই হেথার্লির। জ্ঞান হলে দেখল কোথায় সেই বাগানবাড়ি? ও শুয়ে আছে স্টেশনের ধারে একটা ঝোঁপের মধ্যে। রক্তপাতে প্রাণটা গলায় এসে ঠেকেছে।
শার্লক হোমস্ তক্ষুনি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড থেকে লোকজন নিয়ে রওনা হল রিডিং স্টেশনে। সঙ্গে হেথার্লি আর ওয়াটসন। আর একটা ম্যাপ। রিডিং স্টেশনকে ঘিরে দশ মাইল মত জায়গা নিয়ে একটা বৃত্ত টানা হয়েছে ম্যাপের ওপর। বাগানবাড়িটা এই বৃত্তের মধ্যেই নিশ্চয় পড়বে। কিন্তু কোথায়? ট্রেনে বসেই আরম্ভ হল জল্পনাকল্পনা।
ওয়াটসন, ইন্সপেক্টর সার্জেন্ট আর ইঞ্জিনিয়ার–এই চারজনে দেখিয়ে দিলে স্টেশনের উত্তর, দক্ষিণ, পুব, পশ্চিম দিক। কিন্তু সবাইকে বোকা বানিয়ে শার্লক হোমস্ আঙুল টিপে ধরল বৃত্তের ঠিক মাঝখানে রিডিং স্টেশনের ওপর।
আশ্চর্য! ট্রেন রিডিং স্টেশনে পৌঁছতে-না-পৌঁছতেই দেখা গেল ছাতার মতো ধোঁয়ার কুণ্ডলী। স্টেশনের পাশেই একটা গাছপালা ঘেরা বাগানবাড়িতে আগুন জ্বলছে। হেথার্লির বুড়ো আঙুল সেই বাড়িতেই পাওয়া গেল। একজোড়া ছোট পায়ের ছাপ, আরেক জোড়া ভারী পায়ের ছাপ। অচেতন হেথার্লিকে এই দুজন বয়ে নিয়ে ফেলে গেছে স্টেশনের ধারে। তারপর পালিয়েছে বাড়ি ছেড়ে। মেশিন ঘরে কেবল পাওয়া গেল টিন আর নিকেলের গুঁড়ো।
এবার আসুন রহস্য সমাধানে।
এক নম্বর রহস্য–শার্লক হোমস জানল কী করে রিডিং স্টেশনের ধারেই ওদের বাড়ি?
দুনম্বর রহস্য–কে আগুন লাগাল বাড়িতে?
তিন নম্বর রহস্য–হাইড্রলিক মেশিন কী কাজে লাগান হত?
চার নম্বর রহস্য–অচেতন হেথার্লিকে কারা বয়ে নিয়ে এসেছিল স্টেশনের ধারে?
.
গোয়েন্দা ধাঁধার সমাধান
এক নম্বর সমাধান–হেথার্লিকে নিয়ে ঘোড়ার গাড়িটা ছমাইল গিয়ে আবার ফিরে এসেছিল। বারো মাইল দূর থেকে যদি আসতে হত, তাহলে ঘোড়াটার গায়ে ধুলোবালি ঘাম থাকত। কিন্তু হেথার্লি দেখেছিল ঘোড়াটা একেবারে ঝকঝকে তাজা।
দু-নম্বর সমাধান–হেথার্লি নিজেই। তেলের বাতিটা ফেলে এসেছিল মেশিন ঘরে। সে ঘরে দেওয়ালগুলো কাঠের। বাতি ভেঙে যেতেই কাঠে আগুন লেগে গেছিল।
তিন নম্বর সমাধান–টিন আর নিকেলের গুঁড়ো দেখেই হেথার্লি টের পেয়েছিল মেকি টাকার কারখানা খুলে বসেছে কর্নেল।
চার নম্বর সমাধান–ছোট পা একজন মহিলার, ভারী পা ভারী লোকের। অর্থাৎ জার্মান মেয়েটা মোটা ইংরেজকে নিয়ে হেথার্লিকে পাঁজাকোলা করে তুলে এনেছিল নিরাপদ জায়গায়। বাড়িতে আগুন লাগার পর পালানো ছাড়া আর পথ ছিল না। ইংরেজের প্রাণটা একটু নরম ছিল বলেই হেথার্লিকে আর প্রাণে মারেনি।
* সাপ্তাহিক অমৃত পত্রিকায় প্রকাশিত। ১৩৮১।
স্যার আর্থার কোনান ডয়ালের গল্প নিয়ে গোয়েন্দা ধাঁধা
বউ উধাও। শার্লক হোমস
গোয়েন্দা হওয়ার ঝকমারি অনেক। বিশেষ করে আইবুড়ো গোয়েন্দার। বউ হারালেও বউকে খুঁজে আনতে হয়-বউয়ের মর্যাদা না বুঝেও।
বেচারা শার্লক হোমস-কেও এই জোয়াল কাঁধে বইতে হয়েছে বেশ কয়েকবার। স্ক্যান্ডিনেভিয়ার কেলেঙ্কারির কথা কে না জানে। আরেকবার প্রায় একই ঘটনা ঘটল লর্ড সাইমনের বিয়ের পর।
কী বিশ্রী ব্যাপার! টি-টি পড়ে গেল সারা লন্ডন শহরে। তারপরেই অবশ্য দরদে বুক উথলে উঠল যখন লেডি সাইমনের জামাকাপড় পাওয়া গেল একটা লেকে। আহারে! বিয়ের পরেই বিপত্নীক।
ঘটনাটা গোড়া থেকে না বললে জমবে না। লর্ড সাইমন ইংল্যান্ডের সেইসব জমিদার-তনয় যাদের বংশের নামের ডাকেই গগন ফাটে, কিন্তু তালপুকুরে ঘটি ডোবে না। মাঝখানে খুব হিড়িক উঠেছিল আমেরিকার টাকাওলা মেয়েদের পটিয়ে বিয়ে করে ফেলা এবং মোটা বরপণ নিয়ে নতুন করে কাপ্তেনি করা।
লর্ড সাইমন তার ব্যতিক্রম নন। লন্ডনের কাগজে কাগজে এই নিয়ে ঝালমশলা মুড়ির মত জিভে জল ঝরানো খবর ছাপা হল অনেকবার। কনের বাবার নাকি টাকা গুণে শেষ করা যায় ্না –খনির মালিক তো। মেয়েটারও কেবল ডানা দুটো নেই বাদবাকি অবিকল পরির মতোই। কিন্তু এইসব দেখে কোনওক্রমে ভোলো উচিত হয়নি লর্ড সাইমনের ইত্যাদি ইত্যাদি।
ফালতু কথায় কান না দিয়ে ঝটপট বিয়েটা সেরে ফেললেন লর্ড মহাশয়। বয়স তার কম। হুকুম করার জন্যেই জন্মেছেন হুকুমমাফিক কাজ করিয়ে নিতেও জানেন। বিয়েটাও একটা হুকুম। সুতরাং বউ বেচারিকেও আশা করেছিলেন সেবাদাসীর মতো খাটাবেন–দরকার মতো মোচড় মেরে টাকাও বার করে নেবেন।
কিন্তু কী আশ্চর্য! কী আশ্চর্য! বিয়ে সেরে বাড়ি পৌঁছতে না পৌঁছতেই বাতাসে মিলিয়ে গেল বউ! লর্ড সাইমন মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। ঘরভরতি লোক তখন একপেট খিদে নিয়ে বসে আছে খাওয়ার টেবিলে কনেবউ এসে বসলেই মুরগির ঠ্যাং চিবোবে–এমন সময়ে খবর এল কনে উধাও।
সঙ্গে-সঙ্গে পুলিশ এসে গেল। পুলিশ মানে ইন্সপেক্টর লেসট্রেড। যার চেহারা খর্বকায় নেউলের মতো। বেজায় চটপটে। বেজায় ধুরন্ধর। বেজায় প্র্যাকটিক্যাল। অনুমান ফনুমানের ধার ধারে না। সে এসে দেখলে ফ্লোরা মিলার বলে একটা নাচুনে মেয়ে এসে বাড়িতে হামলা জুড়েছিল। লর্ড সাইমনকে নাকি এত সহজে সে হাতছাড়া করতে রাজি নয়। ফুর্তি করার সময়ে মনে ছিল না? ফ্লোরাকে নাকি ঘাড় ধরে বার করে দেওয়া হয় বাড়ি থেকে। তারপর সেই ফ্লোরার সঙ্গেই নাকি লেডি সাইমনকে বাগানে পাশাপাশি হাঁটতে দেখা গেছে। সুতরাং কেসটা জলবৎ তরলম। অর্থাৎ ফ্লোরাই গায়েব করেছে লেডি সাইমনকে। মেয়েরা ভারী হিংসুটে হয়। হবুবর পালালে বাঘিনী হতেও আপত্তি নেই। সুতরাং পাকড়াও ফ্লোরা মিলারকে।
প্রমাণ? লেসট্রেড অত কাঁচা ছেলে নয়। তাও জুটিয়ে ফেলল সার্পেন্টাইন লেকের জল থেকে। লেডি সাইমনের পরিত্যক্ত জামাকাপড় পাওয়া গেলেও অবশ্য লাশটা পাওয়া গেল না। তাই বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া দেওয়ার জন্যে প্রতিবারের মতো এবারও শখের গোয়েন্দার পায়ে তেল দেওয়ার জন্যে বেকার স্ট্রিটের আইবুড়ো মন্দিরে হাজির হল সরকারি গোয়েন্দা।
শার্লক হোমস তখন সবে বিদেয় করেছে লর্ড সাইমনকে। কেসটা গোড়া থেকে শেষপর্যন্ত শুনে নিয়ে মনে-মনে সাজিয়েও ফেলেছে। সামান্য দু-চারটে প্রশ্ন অবশ্য করেছিল। লর্ড সাইমন তার জবাবে বলেছেন, ক্লারা, মানে তার সদ্য উধাও বউয়ের মাথাটা বিয়ের আগে থেকেই একটু বেসামাল ছিল বলে মনে হয়। নইলে ফ্লোরার ভয়ে এভাবে কেউ পালায়? ফ্লোরার সঙ্গে লটঘট ছিল কিনা? তা হ্যাঁ, একটু-আধটু ছিল বইকি। বিয়ের আগে কার না থাকে? তাই বলে বাড়ি বয়ে বিয়ে ভণ্ডুল করতে আসবে? এত বড় স্পর্ধা? ক্লারাকেও বলিহারি যাই। বিয়ে করতে গেল হাসতে-হাসতে। বরকে নিয়ে ফিরে এল মুখখানা তোলা হাঁড়ির মতো করে। গির্জের মধ্যে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে যাওয়ার সময়ে হাতের ফুলের তোড়াটা পড়ে গেল মেঝেতে। একজন গেঁইয়া টাইপের লোক তুলে দিল হাতে। তারপরেই বাড়ি ফিরে এসে ওর বাপের বাড়ির ঝি-কে ডেকে কী যে বলল ভগবান জানেন। একটা কথা শুধু কানে এসেছিল। কথাটা আমেরিকার চাষাড়ে লোকদের মধ্যেই চালু। কথাটার সাদা মানে হল, আগের জিনিসের ওপর দাবি নিয়ে তা দখল করা।
ঝি-য়ের সঙ্গে গজর-গজর করার পরেই হাওয়া হয়ে গেল ক্লারা। ব্যাপারটা সিরিয়াস। লর্ড সাইমনের ইজ্জৎ বলে একটা কথা আছে।
সব শুনে নিয়ে লর্ডকে বাড়ি ফেরত পাঠাল হোমস। তারপরেই ধূর্ত হাসি হেসে ঘরে ঢুকল লেসট্রেড।
সোল্লাসে বলল হোমস, আসা হোক! আসা হোক! কিন্তু কোটের হাতা ভিজে কেন বৎস?
সার্পেন্টইনে জাল ফেলেছিলাম যে।
জাল! সার্পেন্টাইনে। কেন? চোখ কপালে উঠে গেল হোমসের।
লেডী সাইমনের লাশ তোলার জন্যে। হোমসের অজ্ঞতা দেখে অনুকম্পার সঙ্গেই বলল লেসট্রেড। সেইসঙ্গে বললে লেডির জামাকাপড় পাওয়ার বৃত্তান্ত। এমনকী ফ্লোরা মিলার যে এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত তার প্রমাণ পর্যন্ত নাকি পাওয়া গেছে লেডির পোশাকের পকেটে।
অতি তুচ্ছ প্রমাণ। একটুকরো ছেঁড়া কাগজ। তার ওপর পেনসিল দিয়ে লেখা?
একটু সামলে নিয়ে দেখা করো আমার সঙ্গে।
–এফ, এইচ এম।
মোক্ষম প্রমাণ। ফ্লোরা মিলারকে ঘানি ঘুরিয়ে ছাড়বে লেসট্রেড এই একটা প্রমাণের জোরে।
ভীষণ উৎসুক হয়ে কাগজটা হাত পেতে নিল হোমস। দেখতে-দেখতে চোখেমুখে ফুটে উঠল প্রচণ্ড কৌতুক। অট্টহাসি হেসে বললে, সাবাস!
কিন্তু একী! আপনি উলটোদিকে দেখছেন কেন? আঁতকে উঠল লেসট্রেড।
উলটো কোথায়? ওইটাই তো সোজা দিক হে! হোটেলের বিলের ভেঁড়া টুকরো তো! পেছনের হিসেবটাই আসল।
ও হিসেব আমিও দেখেছি। চৌঠা আগস্টের তারিখ আর ঘরভাড়ার জন্যে ৮ সিলিং দেওয়া হয়েছে জেনে আমার লাভ? রেটটা যদিও চড়া–
আরেক দফা অট্টহাসি হেসে হোমস বললে, বৎস লেসট্রেড, শুধু একটা কথাই শুনে যাও। লেডি সাইমন বলে কেউ নেই, কোনওকালেই ছিল না!
বিমূঢ় লেসট্রেড বিদেয় হতেই সুট করে বেরিয়ে পড়ল শার্লক হোমস। ওয়াটসন বেচারি বসে রইল একা-একা। কিছুক্ষণ পরেই হোটেল থেকে লোকজন এসে পাঁচজনের খাবার সাজিয়ে দিয়ে গেল টেবিলে। ওয়াটসন বুঝল না কেন এই রাজসিক আয়োজন। তারও অনেকক্ষণ পরে
হোমস ফিরে এসে বললে, যাক, খাবার এসে গেছে। তারাও এলেন বলে।
কারা?
লর্ড সাইমন এবং আরও দুজন।
বলতে না বলতেই ঘরে ঢুকলেন সাইমন। চোখমুখ লাল। ভীষণ উত্তেজিত, বিচলিত এবং হতচকিত।
কী বলছেন মশায়? টেবিল চাপড়াতে-চাপড়াতে বললেন লর্ড। আপনি ঠিক জেনে বলছেন তো?
ঠিকই বলছি।
কিন্তু এ যে সাংঘাতিক অপমান, ঠকাঠক-ঠকাঠক শব্দে টেবিলে আঙুল বাজাতে লাগলেন লর্ড। পরক্ষণেই তড়াক করে লাফিয়ে দাঁড়িয়ে উঠে কটমট করে চেয়ে রইলেন দরজার দিকে।
দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন একজন ডানাকাটা পরি। পাশে একজন ছোটখাটো চেহারার চটপটে লোক।
পরিচয় করিয়ে দিল শার্লক হোমস, মিস্টার অ্যান্ড মিসেস ফ্রান্সিস হে মুলটন!
ক্লারা! বজ্রকণ্ঠে হুঙ্কার ছাড়লেন লর্ড।
ডানাকাটা পরিটি এগিয়ে এসে মিষ্টি হেসে বললে, রবার্ট, খামোকা রাগ করো না। ফ্রান্সিসের সঙ্গে অনেক আগেই গোপনে বিয়ে হয়ে গেছিল আমার। বাবা জানতেন না। ফ্রান্সিস গরিব ছিল বলে জানাইনি। কিন্তু ও পণ করেছিল আরও বড় খনির মালিক হয়ে এসে তবে আমাকে ঘরে নিয়ে যাবে। কিন্তু বছর খানেক পরেই খবরের কাগজে ওর নাম দেখলাম–খনি দুর্ঘটনায় মারা গেছে। তারপরেও অনেকদিন বসে থাকার পরেও যখন ও এল না, বাবার জেদে আমার দেহটা তোমাকে দেব ঠিক করলাম–মনটা নয়। তুমি বলো, আমি ঠিক করেছি না বেঠিক করেছি?
আমি চললাম কাঠের পুতুলের মতো পা বাড়ালেন লর্ড।
কোথায় যাবেন? খেয়েদেয়ে তারপর যাবেন। বলল হোমস।
এরপরেও খাওয়া নামবে গলা দিয়ে? বলে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে উধাও হলেন লর্ড সাইমন।
বেচারা! নাকের ডগা দিয়ে ফস্কে গেল রাজকন্যা এবং আধখানা রাজত্ব। কিন্তু রহস্য সমাধানের সূত্রগুলো এখনও আপনার সামনে থেকে পালাতে পারেনি। সামনেই আছে। বলুন দিকি কী?
.
গোয়েন্দা ধাঁধার সমাধান
হাসতে-হাসতে বিয়ে করতে গেল ক্লারা, ফিরে এল মুখখানা বাংলা পাঁচ করে। কী ঘটেছিল মাঝখানে? না, হাত থেকে ফুলের তোড়া পড়ে গিয়েছিল গিঞ্জের সিঁড়িতে তুলে দিয়েছিল একজন গেঁইয়া চেহারার লোক। তারপরেই গেঁইয়া ভাষায় ঝি-কে বললে ক্লারা আগের জিনিসের দাবি নিয়ে তা দখল করতে হবে। কী সেই জিনিস? না একটা চিরকুট পাওয়া গেল ক্লারার পরিত্যক্ত পকেটে তাতে অমুক ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করতে বলা হয়েছে ক্লারাকে। চিরকুটটা ক্লারার পকেটে এল কখন? গির্জের মধ্যে ফুলের তোড়া হাতে তুলে দেওয়ার সময়ে নয় তো? গেঁইয়া চেহারার সেই লোকটার নামের আদ্যক্ষর এফ এইচ এম? সে চৌঠা আগস্ট লন্ডনের একটা দামি হোটেলে উঠেছিল। সেখানকার ঘরভাড়া দৈনিক ৮ সিলিং। পুরো ব্যাপারটাতেই পূর্ব-প্রণয়ীর গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে না?
খোঁজ..খোঁজ…খোঁজ। লন্ডনে এমন খানদানি হোটেল বলতে তো মাত্র আটটা। তার একটিতে এক ভদ্রলোক উঠেছিলেন চৌঠা আগস্ট–নামের আদ্যক্ষর এফ এইচ এম–অর্থাৎ ফ্রান্সিস হে মুলটন।
পরিষ্কার হয়ে গেল হেঁয়ালি। ক্লারা-র ঝি ক্লারার বিয়ের জামাকাপড় পুঁটলি পাকিয়ে ফেলে দিয়ে এসেছিল সার্পেন্টাইনে–পুলিশকে ধোঁকা দেওয়ার জন্যে ক্লারাকে অন্য পোশাকে পাচার করে দিয়েছিল বাড়ির বাইরে।
* সাপ্তাহিক অমৃত পত্রিকায় প্রকাশিত। ১৩৮১।
ইফেল টাওয়ার বিক্রি হয়ে গেল
জোচ্চোরদের জগতে কাউন্ট ভিক্টর লাসটিগ একটা বিস্ময়। একটানা বিশ বছর ধরে সে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরিয়েছে দু-দুটো মহাদেশের বাঘা-বাঘা পুলিশ অফিসারদের। আশ্চর্য তার প্রতিভা। তার বৈষ্ণব-বিনয় কুঁদে রাষ্টদূতকেও লজ্জা দেয়; তার অভিনয় দক্ষতা শ্রেষ্ঠ অভিনেতাকেও তটস্থ করে। তার বুকের পাটা বনের বাঘকেও হার মানায়।
কাউন্ট ভিকটর লাসটিগ কখনও কারও নকল করেনি। তার মৌলিক কুকীর্তির শ্রেষ্ঠ নজির হল প্যারিসের ইফেল টাওয়ার বিক্রি। এতবড় প্রতারণা জোচ্চুরির ইতিহাসে বিরল।
ইফেল টাওয়ার বিক্রির পুরো ফন্দিটা লাসটিগের মাথায় এসেছিল খবরের কাগজ পড়তে পড়তে।
লাসটিগের হাতে তখন কোনও কাজ নেই। সাতদিনও হয়নি নোট-নকলের ম্যাজিক বাক্স বিক্রি করে এক হঠাৎ বড়লোককে পথে বসিয়ে প্যারিসে পালিয়ে এসেছিল লাসটিগ। হাতে মেলাই টাকা। অফুরন্ত সময়। কাজের মধ্যে শুধু ফুটপাতের কাফেতে বসে ভারমুথ খাওয়া আর হাই তুলতে তুলতে কাগজ পড়া। সঙ্গে রয়েছে পাপকাজের দোসর ড্যাপার ড্যান কলিনস। বাইরের লোকের কাছে তার পরিচয় অবশ্য কাউন্ট ভিকটর লাসটিগের প্রাইভেট সেক্রেটারি হিসেবে।
লাসটিগের কুঁড়েমি দেখে কলিনস যখন তিতিবিরক্ত, ঠিক তখুনি খবরের কাগজটা ভজ করে এগিয়ে দিল কাউন্ট।
বলল, শিকার পাওয়া গেছে। কে টোপ গিলবে, এখুনি তা বলতে পারব না। তবে তার ধান্দা জেনো পুরোনো জং-ধরা লোহা কেনাবেচা। শাঁসালো পার্টি। দুপয়সা আছে। তক্কেতক্কে রয়েছে নতুন দাঁও পেটবার তালে। নাও, পড়ো।
বলে, একটা বিশেষ প্রবন্ধ দেখিয়ে দিল লাসটিগ। তাতে লেখা আছে, ইফেল টাওয়ারের যা ঝরঝরে অবস্থা, তাতে শুধু মেরামতি কাজেই হাজার ফ্ৰা খরচ হবে। তাই গভর্নমেন্ট ভাবছে, খামোকা ঠাট বজায় না রেখে ওটাকে ভেঙে ফেললেই ল্যাটা চুকে যায়। খরচও অনেক কম হয়।
চোখ কপালে তুলে ড্যাপার ড্যান বলল,–অসম্ভব। এ কাজ আমাদের দ্বারা হবে না। তোমার মাথা খারাপ হয়েছে?
মোটেই অসম্ভব নয়। শক্ত কাজটা খবরের কাগজওয়ালারা আমাদের হয়ে সেরে দিয়েছে। এখন দরকার শুধু সরকারি শিলমোহর আর চিঠির কাগজ। তা নিয়ে ভেবো না। আমার এক বন্ধু আছে, চাইলেই পাঠিয়ে দেবে। এবার গা তোলো, কাজে নামা যাক।
দিনকয়েক পরে প্যারিসের পাঁচজন কালোয়ারের কাছে সরকারি চিঠি পৌঁছে গেল। চিঠি লিখছেন এমন এক ডেপুটি ডিরেক্টর-জেনারেল ইফেল টাওয়ার যার এখতিয়ারে পড়ে। পাঁচজনকেই তিনি নেমন্তন্ন করেছেন সরকারি চুক্তি সম্পর্কে কথাবার্তা বলার জন্যে। সময় ও শুক্রবার। বেলা তিনটে। স্থান ও ক্রিন হোটেলে ডেপুটির স্যুট।
যথাসময়ে এল পাঁচজনে। লাসটিগ বললে, সিয়েরা মন দিয়ে শুনুন। প্রধানমন্ত্রী আর প্রেসিডেন্ট ছাড়া এ গোপন খবর আর কেউ জানে না।
এই পর্যন্ত বলে নাটকীয় ভাবে একটু বিরতি দেওয়া হল। চাট্টিখানি ব্যাপার নয়ত। ক্লাইম্যাক্স সৃষ্টি না করলে কদর পাওয়া যাবে না। সবার কৌতূহল যখন তুঙ্গে, তখন থেমে-থেমে বলল– গভর্নমেন্ট ঠিক করেছে, ইফেল টাওয়ার ভেঙে ফেলবে।
আবার থামল লাসটিগ। তারপর বলল, মন খারাপ হওয়ার মত খবরই বটে। কিন্তু ভেঙে ফেলা ছাড়া আর পথও নেই। টাওয়ার মেরামতের খরচ তো কম নয়। কাগজে তো দেখেছেনই। ইফেল টাওয়ার তৈরি হয়েছিল ১৮৮৯ সালে প্যারিস প্রদর্শনীর আকর্ষণ হিসেবে। তখন কিন্তু শহরের বুকের ওপর বারো মাস টাওয়ার খাড়া রাখবার কোনও প্ল্যান ছিল না। রুচি যাদের সূক্ষ্ম, তাঁরা তো গোড়া থেকেই রাগারাগি করে এসেছেন টাওয়ারের ছিরিছাঁদ দেখে। প্যারিসের মত শহরে এ টাওয়ার একেবারেই বেমানান। আপনারাই বলুন মানায় কিনা।
কাউন্টের পাঁচ মক্কেলের অতশত রুচিবোধ না থাকলেও মুনাফা লোভ ছিল বিলক্ষণ। কাজেই পাঁচজনেই একবাক্যে রায় দিল, অবিলম্বে ইফেল টাওয়ারকে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া উচিত।
লাসটিগ তখন পাঁচ মক্কেলকে নিয়ে টাওয়ার পরিদর্শনে বেরুল। বুঝিয়ে দিলে, যে টাওয়ার তৈরি করতে সত্তর লক্ষ ফ্রাঁ লাগে, তার ভাঙা লোহা বেচলেও কম মুনাফা হয় না। ভাঙা লোহার মোট ওজন দাঁড়াবে সাত হাজার টন। ঝানু ব্যবসাদারের মত কড়ি বরগার মোট সংখ্যা, প্রতিটির চুলচেরা মাপ, এমনকী ওজন পর্যন্ত বলে গেল গড়গড়িয়ে। সবশেষে বলল, ক্রেতারা যেন আগামী বুধবারের মধ্যে শিলমোহর করা টেন্ডার হোটলের ঠিকানায় পৌঁছে দেয়। একথাও যেন মনে থাকে, বিষয়টা গভর্নমেন্ট সিক্রেট। অত্যন্ত গোপনীয়। পাঁচকান না হয়।
আসল শিকার কে হবে, সেটা অবশ্য আগেই আঁচ করে নিয়েছিল লাসটিগ। নাম তার আঁদ্রে পয়সন। চাষার ছেলে। সমাজে পাত্তা পায় না। তাই মরিয়া হয়ে পণ করেছে, ঝটপট আরও টাকা কামিয়ে নাক উঁচুদের মুন্ডু ঘুরিয়ে দিয়ে সমাজে গাট হয়ে বসতে হবে।
টেন্ডার বুধবারের আগেই এসে গেল। বেস্পতিবার ড্যাপার ড্যান আঁদ্রে পয়সনকে গিয়ে বলে এল, তিনিই সবচাইতে বেশি দাম হেঁকেছেন। সুতরাং এক সপ্তাহের মধ্যেই টাকা জোগাড় করে ফেলল আঁদ্রে পয়সন। আবার গেল ড্যাপার ড্যান। খবর দিল, লাসটিগের হোটেল সুটে আর একটা মিটিং হবে এই নিয়ে। ফিরে এসে বলল লাসটিগকে শিকার ভড়কেছে মনে হচ্ছে। জিগ্যেস করছিল, সরকারি ব্যাপারে দপ্তর ছেড়ে হোটেলে কেন?
শুনে মোটেই ভড়কালো না ফিচেল শিরোমণি লাসটিগ। বলল, বেশ তো, আমরা যে সত্যি সত্যিই সরকারি অফিসার, সেটা প্রমাণ করে দিলেই তো মনে আর ধাঁধা থাকে না। সে ভার আমার।
যথাসময়ে এল শাঁসালো পার্টি। সোল্লাসে বলল লাসটিগ, মঁসিয়ে পয়সন, অভিনন্দন নিন। আসুন, আপনার সৌভাগ্যলক্ষ্মীর সম্মানে আগে এক গেলাস মদ খাওয়া যাক।
কনট্রাক্টটা আগে সই করলে হয় না? আমতা-আমতা করল পয়সন।
তাও তো বটে। আগে কাজ, পরে মদ্যপান, বলে কলিনস-এর দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল লাসটিগ, তুমি আপিসে যাও। তিনটের সময়ে আমি আসছি।
কলিনস চৌকাঠ পেরোতে না পেরোতেই মুখের চেহারা পালটে গেল লাসটিগের। উবে গেল অফিসারি দাপট। কঁচুমাচু মুখে বলল–আপনাকে ডেকেছি একটা রফা করার জন্যে। সরকারি অফিসারদের হাঁড়ির হাল কেনা জানে বলুন। ঠাটঠমক বজায় রাখতেই মাইনের টাকা ফুটকড়াই হয়ে যায়। তাই রেওয়াজ দাঁড়িয়ে গেছে চুক্তি সই করার আগে অফিসারদের
ঘুষ দিতে হয়? ফস করে বলে ফেলল পয়সন।
মঁসিয়ে দেখছি দারুণ ঠোঁটকাটা!
সেইজন্যেই বুঝি আপিসে না ডেকে বারবার হোটেলে ডাকাচ্ছেন?
যা বলেন, কাষ্ঠহাসি হাসল লাসটিগ।
হঠাৎ নিজেকে কী-হনু মনে হল পয়সনের। ঘুষখোর জাঁদরেল অফিসারের তুলনায় নিজেকে কেউকেটা ঠাউরে নিল। বিজ্ঞের হাসি হেসে বললে, দেখুন মঁসিয়ে, আমাকে গেঁইয়া ভাববেন না। এসব কাজে আমি পোক্ত। বলে, এক পকেট থেকে বার করল সার্টিফাই করা একটা চেক। আর এক পকেট থেকে নোটঠাসা মানিব্যাগ। স্মিতমুখে আবার মদের গেলাস এগিয়ে ধরল লাসটিগ। একঘণ্টার মধ্যেই পয়সনের চেক ভাঙিয়ে লাসটিগ কেটে পড়ল অস্ট্রিয়ায়।
মাসখানেক ভিয়েনার সেরা হোটেলে খুব ফুর্তি করল দুই জোচ্চোর–লাসটিগ আর কলিনস। সেইসঙ্গে তন্নতন্ন করে পড়ল প্যারিসের সবকটা দৈনিক। একমাস পর লাসটিগ বলল, ওহে কলিনস, বোকাপাঁঠা পয়সন তো দেখছি পুলিশের ছায়াও মাড়াল না। বুঝেছি, কেন। লজ্জা হয়েছে। আহাম্মকি চেপে যেতে চাইছে, পুলিশকে জানানো মানেই তেঁড়া পিটে নিজের বোকামো জাহির করা। এদিকে ইফেল টাওয়ারের দখলও নিল না। তাই ভাবছি, আরেকবার টাওয়ার বেচলে কেমন হয়?
সত্যি সত্যিই আবার মোটা দামে ইফেল টাওয়ার বেচে দিল লাসটিগ।
তৃতীয়বার বেচবার জন্যে খদ্দের খুঁজছে, এমন সময় দুনম্বর শিকার এমন হায়-হায় করে উঠল যে পিঠটান দেওয়া ছাড়া পথ রইল না কাউন্ট ভন লাসটিগের।
*মাসিক গোয়েন্দা পত্রিকায় প্রকাশিত। শারদীয় সংখ্যা, ১৩৭৯।
এক বোতল কাশাকা
সারা বিকেল তুমুল বৃষ্টি পড়েছিল রিও-ডি-জেনেরিও-তে। খুনটা হয়েছিল সেই রাতেই এবং তখনও জলের দাগ বুকে নিয়ে চিকচিক্ করছিল গোটা শহরটা। বেলাভূমি বরাবর অন্তহীন আলোর মালাটি আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল নিস্তরঙ্গ শান্ত জলরাশির কালো কুচকুচে পটভূমিকায়। বন্দর অঞ্চল থেকে বেরিয়ে এসেছিল আরও একটা আলোর রেখা। আঁকাবাঁকা পথে না গিয়ে রেখাটা সিধে চলে গিয়েছিল শহরের বুক পর্যন্ত। আলোর ধারায় ঝকমক করছিল রাস্তাগুলো। কাদাজল ছিটিয়ে ছিটিয়ে ছুটে চলেছিল বড় বড় সব গাড়ি।
সুন্দর সুন্দর সব হোটেল, কারুকাজকরা বড় বড় বাড়ি আর কাঁচের দেওয়ালওলা প্রকোষ্ঠগুলোর খোলা জানালায় পাওয়া যাচ্ছিল আনন্দের উষ্ণতা; হালকা হাসির ঠুনকো আওয়াজ, ম্যারিমবা আর ম্যারাকাস-এর শব্দ, বেহালার তারে উখিত সঙ্গীত আর কক্টেল গেলাসের রিনিঝিনি আওয়াজ–সবই ভেসে আসছিল বাতায়নপথে। এ সময়ে এই রকমটি শোনাই তো স্বাভাবিক। স্বপ্ন দেখতে দেখতে হঠাৎ সুপ্তিভঙ্গ হওয়ায় জেগে উঠেছিল সারা শহরটা। নর এবং নারী, চটপটে তাদের প্রকৃতি, বিপুল তাদের অর্থ–প্রত্যেকেই এই ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে যেন আর একবার উপলব্ধি করছিল আনন্দের প্রতি, ফুর্তির প্রতি তাদের আতীব্র আকর্ষণ। নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের মতোই তীব্র সে অনুভূতি।
শ্যাম্পেনের বুদবুদ আর মহার্ঘ সুগন্ধির বায়ুবহ সৌরভের আবেশে আবিষ্ট কেউই সে রাতে ক্ষণেকের জন্যেও ভাবেনি অপরূপ সুন্দর কোপকাবানার বালুকাবেলার কাছাকাছি পাহাড়ের সানুদেশের নিরানন্দ কুঁড়েঘরের শহরটির কথা। অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই নজরে আসেছিল না; মাঝে মাঝে এই নিরন্ধ্র তমিস্রার মধ্যে জেগেছিল কয়েকটা আলোর শুধু কম্পমান বিন্দু-মোমবাতির শিখা। আর ছিল নিস্তব্ধতা। শুধু শোনা যাচ্ছিল টুপ টুপ করে জল পড়ার আওয়াজ–মর্চে ধরা টিনের চাল থেকে বিন্দু বিন্দু জল ঝরে পড়ছিল ধরিত্রীর বুকে। এছাড়া সবকিছুই হারিয়ে গিয়েছিল নৈঃশব্দ্যের অতলে।
আচম্বিতে একটা কুঁড়েঘর থেকে ভেসে এল ক্রুদ্ধ চাপা কণ্ঠস্বর এবং পরক্ষণেই একটা আর্ত চিৎকার। আর তার পরেই সব চুপ। অসহ্য থমথমে নীরবতা। কুঁড়েঘরের ভেতরকার মোমবাতিগুলো নিভে গেল একে একে। এক মুহূর্ত পরেই সুট করে একটা মুর্তি বেরিয়ে এল ভেতর থেকে–চটপট পা চালিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল অন্ধকারের মধ্যে। নিম্নমানের জীবনধারা প্রবাহিত সমাজের এই দরিদ্র অংশটিতে কেউই কারও খবর রাখত না এবং এখানে খুনজখম ছিল নেহাতই একটা ব্যক্তিগত ব্যাপার। কাজে কাজেই পরের দিন সকাল না হওয়া পর্যন্ত অনাবিষ্কৃত রয়ে গেল রোগা একহারা মেয়েটির লাশ। এবং তার পরেই খবর চলে গেল পুলিশের দপ্তরে।
যে কুঁড়ের নীচে খুনটি হয়েছে বিস্তর লোক তার চারধারে ভিড় করে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। সবার আগে আমার চোখে পড়ল কয়েকটা ছেঁড়া পোশাক পরা ছেলেমেয়ে। বাচ্চাগুলো এদিক সেদিক দৌড়ে ভিড়ের মধ্যে দিয়ে পথ করে নিয়ে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করছিল। জনতার এই জমাট প্রাচীর নাড়ায় কার সাধ্য। শেষকালে যখন চিৎকার করে উঠলাম ও পুলিশকে এগোতে দাও, তখনই চটপট পথ করে দিলে ওরা এবং কয়েকজনকে টুক করে সরে পড়তেও দেখলাম। কারণটা আমার অজানা নয়। সম্প্রতি এ অঞ্চলে পর পর কয়েকটা চুরি হয়ে গেছে রাতের অন্ধকারে। কিন্তু এসব ব্যাপার নিয়ে পুলিশকে যতখানি মাথা ঘামাতে হয়েছে, তার চেয়েও যে বেশিমাত্রায় তৎপর হতে হবে এ কেস নিয়ে ওদের কারোরই জানতে বাকি নেই।
ঠেলেঠুলে এগিয়ে গেলাম সামনের দিকে। টানের চোটে খুলে গেল কোটের সামনের বোতাম। পাহাড়ের ঢালু গা বেয়ে অতখানি ওঠার ফলে রীতিমতো ঘেমেও গিয়েছিলাম। তাই মুছে নিলাম কপালের ঘাম। এতখানি হেঁটে আসার ফলে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। নোংরা পরিবেশের মধ্যে এসে পড়ে একটু মুষড়েও পড়েছিলাম। কিন্তু খুন যখন হয়েছে তখন খুনিকে আমাদের খুঁজে বার করতেই হবে।
আধপোড়া সিগারেটটার দিকে একবার তাকিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললাম আমি। তার পরেই মাথা নীচু করতে হল একটু নীচু বরগার আক্রমণ থেকে মাথা সামলানোর জন্যে। নোংরা নীচু কুঁড়েঘরটার অন্ধকারের মধ্যে থেকে ঠেলে বেরিয়ে এসেছিল বরগাটা।
শুনতে পেলাম বাইরে সিগারেটটার প্রান্তভাগ নিয়ে ছেলেমেয়েগুলো মহাবাগবিতণ্ডা জুড়েছে এবং হাতাহাতি শুরু করে দিয়েছে। রিও ফোর্সে আঠারো বছর রয়েছি আমি পুলিশ চিফ-এর পদে। কাজেকাজেই রুগিকে পরীক্ষা করার সময়ে ডাক্তারের মনে যে ধরনের আগ্রহের সঞ্চার হয়, ঠিক সেই ধরনের পুলিশ চিফ সুলভ আগ্রহ দুই চোখে নিয়ে তাকালাম ঘরটার চারপাশে। এর আগেও এরকম ধরনের কয়েকশো চালাঘরে হানা দিতে হয়েছিল আমাকে। সে সবের থেকে কোনও প্রভেদ দেখতে পেলাম না এ ঘরটায়। একই রকমের নড়বড়ে আসবাবপত্র, হাড়জিরজিরে টেবিল, গোটা দুই ঝপ-করে-ভেঙেপড়া চেয়ার এবং এক কোণে রাশীকৃত নোংরা কম্বল। সূর্যকিরণের প্রসাদবঞ্চিত হওয়ায় একই রকমের উৎকট গন্ধ আর মেঝের ওপর ধুলোর পুরু স্তর। কুঁড়ে ঘরের এই শহরে সবকটা চালাঘরেই যেমনটি দেখতে পাওয়া যায়, অর্থাৎ টিনের চাদর আর ধাতুর প্যানেল দিয়ে তৈরি বাঁধা-ছক-দেওয়াল আর ছাদ–এ ঘরের বৈশিষ্ট্যও দেখলাম তাই। হরেক রকমের এই জিনিসগুলো অবশ্য সবই চোরাই মাল–এক সময়ে যা ব্যবহৃত হত বিজ্ঞাপনের সাইনবোর্ড হিসেবে।
সেদিন সকালে অন্যান্য সবকটা চালাঘর থেকে এই ঘরটিকে একেবারে আলাদা করে ফেলেছিল যে জিনিসটি তা হল একটা দেহ। মেঝের ওপর হাত-পা ছড়িয়ে পড়েছিল দেহটা। স্ত্রীলোকের লাশ। মুখ থুবড়ে পড়েছিল সে দুই হাত দুদিকে ছড়িয়ে দিয়ে।
ঝুঁকে পড়ে চিৎ করে শুইয়ে দিলাম ওর দেহ। এক সময়ে সুন্দরী ছিল সে। কিন্তু এখন যার মুখের দিকে তাকালাম তাকে মাঝবয়েসি স্ত্রীলোক ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। বহু বছর ধরে জীবনকে জোড়াতালি দিয়ে চালিয়ে নেওয়ার নিদর্শন ফুটে ছিল তার নিষ্প্রাণ মুখের পরতে পরতে। বলিরেখা গম্ভীর হয়ে বসে গিয়েছিল তার চামড়ায়।
বিস্রস্ত কঁচাপাকা চুল এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল বিস্ফারিত চোখের ওপর। জবরদস্তির কোনও চিহ্ন দেখতে পেলাম না কোথাও। অথচ সমস্ত চালাঘরটা আর্তসুরে বলতে চাইছিল–খুন! খুন!
নতজানু হয়ে বসেছিলাম এতক্ষণ। এবার উঠে দাঁড়ালাম। দরজার কাছে ভিড় করে দাঁড়িয়েছিল যারা, তাকালাম তাদের দিকে। ভিড়ের মধ্যে যে সব মুখ আমি দেখতে পেলাম, বহুদিন ধরে তাদের খোঁজ করছিল আমাদের দপ্তর। কিন্তু এখন সে সময় নয়। পরে এদের নিয়ে পড়া যাবে-খন।
প্রশ্ন করতে শুরু করলাম। বেশি প্রশ্ন নয়। কেননা আমি জানতাম এদের কাছ থেকে বিশেষ সাহায্য আমি পাব না। আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তা–এই দুইয়ের তাড়নায় ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে ওরা কেউই চায় না অপরকে ফাঁসিয়ে দিতে। তাছাড়া পাশের চালাঘরের লোক কতটা খবর রাখে, তা তো কেউই জানে না। ওরা নাকি কাউকেই দেখেনি এবং অস্বাভাবিক কিছু শোনেও নি। কিছু দেখলে বা শুনতে পেলে তখুনি পুলিশকে না জানিয়ে কি তারা বসে থাকে হাত-পা গুটিয়ে?
মনে মনেই বলি, তাই বটে আইনকে অক্ষরে অক্ষরে তোমরা মেনে চলো কিনা। পুলিশকে সাহায্য করতেও কসুর করো না। কিন্তু তবুও যদিও বা কোনওদিন পাকড়াও করতে পারি খুনিকে–জানি তোমাদের এককণা সাহায্যও থাকবে না তার মধ্যে।
ভিড়ের মধ্যে সামনে এগিয়ে গিয়ে এমনই একটা প্রশ্ন করলাম যার উত্তরে সত্য না বললেই নয়।
জিজ্ঞেস করলাম–নিহত স্ত্রীলোকটি কে? একজন উত্তর দিলে–এলসা।
পুরো নাম কী?
পুরো নাম কোনওদিনই আমাদের বলেনি ও।
পেট চলত কী করে? ভিক্ষে করে।
আর কোনওপথে টাকা রোজগার করতো কি?
আমরা অন্তত জানি না।
বিয়ে করেছে?
যদিও বা করে থাকে, কোনওদিন দেখিনি ওর স্বামীকে।
ওর সঙ্গে আর কেউ থাকত এখানে?
দেখিনি কোনওদিন।
তোমাদের মধ্যে কেউ কিছু জানে কি?
সিনর মার্টিনেলি, আপনি তো জানেনই এর চেয়ে বেশি আর কিছু জানলে কতখানি খুশি হতাম আমরা।
সেই একঘেয়ে পুরোনো গল্প। পেছন ফিরে আবার গেলাম চালাঘরটার ভেতরে। ওদের কাছ থেকে আর কোনও খবর জানার সম্ভাবনা নেই। সম্ভবত, বেশি কিছু জানেও না ওরা। খুনখারাপি করাটা চালাঘরবাসীদের আওতার মধ্যে পড়লেও জিনিসটা ওরা ফ্যামিলির চৌহদ্দির বাইরে সরিয়ে রাখাই পছন্দ করে।
পুলিশের ডাক্তার জানত নিছক পয়েন্ট নিয়ে লেখা খুব সংক্ষিপ্ত রিপোর্টই পছন্দ করি আমি। ফিরে এসে দেখি লাশ পরীক্ষাপর্ব সাঙ্গ করে ফেললে সে। আমাকে দেখেই বলল–মাথায় চোট লাগছিল। খুলি চুরমার হয়ে গেছে। মারা গেছে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর বয়স মেয়েটার। পুষ্টিকর খাবার না খেতে পাওয়ায় চেহারা হয়েছে অস্থিসার। ঘণ্টা দশেক হল মারা গেছে।
তার মানে দাঁড়াচ্ছে–এই যে গত রাতে দশটা নাগাদ খুন হয়েছে এলসা। ঠিক এই সময়টায় স্ত্রীকে নিয়ে আমি বাড়ির কাছাকাছি একটা সিনেমা হাউসে মিকিমাউজ-এর ছবি দেখতে দেখতে মনের আনন্দে হাসছিলাম। আবার ঠিক সেই সময়টাতেই কোপাকাবানায় শুরু হয়েছিল প্রথম ফ্লোর-শো এবং ঝলমলে আলোয় আনন্দে ফুর্তিতে উচ্ছল হয়ে উঠেছিল রিও-র একটা অংশ।
ডাক্তারকে শুধোলাম–এই কী সব? আর কিছু নেই?
ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়িয়ে যায় ডাক্তার দরজার কাছে। বলে–আর একটা খবর। আকণ্ঠ মদ গিলেছিল মেয়েটা।
মদ গিলেছিল! চিন্তার আনাগোনা শুরু হয় মস্তিষ্কের কোষগুলোয়। ইন্টারেস্টিং পয়েন্ট। পয়সার লোভে নিশ্চয় একাজ কেউ করেনি। কেননা, পকেট হাতড়ে কয়েকটা ক্রুজিরোজও পাওয়া গেল না। তাছাড়া, নিজের পয়সায় সাধারণত কেউ মদ্য পান করে না। আর একবার চোখ বুলিয়ে দেখা যাক কী পাওয়া যায় আশেপাশে।
আর একবার তল্লাসি চালিয়ে নতুন তথ্য বলতে বিশেষ কিছুই পাওয়া গেল না শুধু একটা খালি বোতল ছাড়া। মেঝের ওপর গড়াগড়ি যাচ্ছিল বোতলটা। তর্জনীটা বোতলের মুখে আঁকশির মতো আটকে দিয়ে তুলে ধরলাম নাকের কাছে। তখনও কাশাকার বিশ্রি অস্বস্তিকর গন্ধ পাচ্ছিলাম বোতলের মধ্যে। কাশাকা এক রকমের সস্তা মদ। আখ থেকে এখানকার লোকেরা চোলাই করে নেয় কাশাকা। বিশেষ করে এই কাশাকাটি যে সবচেয়ে সস্তা আর সবচেয়ে মারাত্মক, সে বিষয়ে আমার কোনও সন্দেহই ছিল না। সামান্য কয়েকটা ক্রুজিরোজ-এর বিনিময়ে ধীরে ধীরে নিভিয়ে দিতে পারে তা যত কিছু যন্ত্রণা-চিন্তা-উদ্বেগ-ক্লেশ।
সন্তর্পণে বোতলটাকে কাগজ দিয়ে মুড়ে শেষবারের মতো চোখ বুলিয়ে নিলাম চারধারে। তারপর অ্যাসিস্ট্যান্টদের ডেকে হুকুম দিলাম লাশটাকে স্ট্রেচারে করে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দিতে। পাহাড়ের পাশেই দাঁড়িয়েছিল অ্যাম্বুলেন্স।
ভিড় ঠেলে এগুচ্ছি, আস্তে আস্তে পা ফেলে নেমে আসছি ঢালু পথ বেয়ে এমন সময় শ্লেষতীক্ষ্ণ সুরে কে যেন পেছন থেকে বলে উঠল–গুড মর্নিং, সিনর মার্টিনেলি।
কণ্ঠস্বরের অধিকারী যদি জানত যে আমার দুজন সহকারী ওইদিনই আবার ফিরে আসবে শহরে–হোল্ড-আপ চার্জের বলে তাকে গ্রেপ্তার করতে–তাহলে এতখানি চ্যাংড়ামি করতে সে যেত না।
.
এ ধরনের খুনের তদন্তের একটা বিরাট অংশই হচ্ছে নিরানন্দ কর্মসূচীর একঘেয়েমি। পুলিশ হেড কোয়ার্টারে ফিরে আসার পরেই শুরু হল এই চক্রবৎ কর্মসূচীর পুনরাবর্তন।
লাশটা আনার পর আঙুলের ছাপ নিয়ে সনাক্ত করা হয়েছিল। এলসা কোয়েলহার বয়স সাতচল্লিশ। রেসিফি শহরের উত্তরাঞ্চল তার আদি নিবাস। বহু বছর ধরে ভিক্ষুক-বৃত্তি আর যাযাবর বৃত্তির অভিযোগের রেকর্ড পাওয়া গেল এলসার। তার সর্বশেষ জেলখাটার মেয়াদ ছিল দশ দিনের এবং সে মেয়াদ শেষ হয়েছে তার মৃত্যুর মাত্র কয়েকদিন আগে।
কাশাকা বোতলের ল্যাবরেটরি রিপোর্ট তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। আঙুলের ছাপ মৃত মেয়েটারই। নীল কাঁচের সরু হয়ে ওঠা ঘাড়ের কাছে একটা ধ্যাবড়া তালুর ছাপ পাওয়া গিয়েছিল। ব্যস আর কিছু না।
বেশ কিছুদিন একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম তালুর ছাপটার দিকে। হৃদয় রেখা আর আয়ু রেখাদুটো নিবিড় হয়ে নেমে এসেছিল বোতলের তলার দিকে। একটু আবেগের সঞ্চার হয় আমার মনে। ভাবি, হাতের এই রেখা দেখে কোনওও হস্তরেখাবিদ কী বলতে পারত আগে থেকেই নির্ধারিত হয়ে ছিল এলসার ললাটলিপি? কিন্তু দিবাস্বপ্নর অথবা অনুধ্যান করার সময় এটা নয়।
ভাবলাম, কী করা যায় এবার? আচ্ছা, এলসার তো পেশা ছিল ভিক্ষে করা। পৃথিবীর যে-কোনও বড় শহরে আছে এই বিপুল অথচ একান্ত ঘনিষ্ঠ সমাজটার উৎপাত। আমার সুযোগ খুবই ক্ষীণ ও সমপেশার কাউকে পাকড়াও করে আলাপ করা ছাড়া আপাতত আর কোনও উপায় আমি দেখি না।
.
নগরবাসী ভিখিরিরা সাধারণত মামুলি শ্রেণির বদমাশ হয়। খুনটুন করা এদের ইতিহাসে বড় একটা দেখা যায় না। শুধু তাই নয় নিজের পেশার কেউ যে খুন হয় এটাও কেউ চায় না।
ল্যাটিন ভিখিরি জানে খুনিরা অনায়াসেই খুন করতে পারে তাকে। কেননা, দু-একটা ভিখিরিকে নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো সময় সাধারণত সমাজের নেই। কাজেকাজেই এলসার সহকর্মীরা যখন দেখলে যে ওর হত্যাকারীকে খুঁজে বার করার সমস্যা নিয়ে বেজায় দুশ্চিন্তায় পড়েছি আমি এবং এমনভাবে সেই খুনিটার সন্ধান করছি যেন একটা নামকরা লোককে খুন করে বসেছে সে, তখন ওরা আমায় সাহায্য করতে শুরু করল। ওদের কথার মধ্যে থেকেই এল অভীপ্সিত সাহায্য। এলসা সম্বন্ধে যা কিছু জানত সব বলল ওরা। এক সময়ে একটা রাঞ্চের পরিচারিকা ছিল সে। তখন তার যৌবন ছিল, রূপ ছিল, তারপর তাকে ব্যাভিচারের পথে নামিয়ে আনে রাঞ্চের মালিকের ছেলে এবং বাসনা পরিতৃপ্তির পর তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে যায় ভাঙাচোরা লোহার টুকরোর একটা স্কুপের ওপর।
বন্ধুবান্ধব? প্রত্যেকেই ভালোবাসত ওকে। বিশেষ কোনও বন্ধু? আর্নেস্টো নামে একটা ভিখিরির সঙ্গে কিছুদিন ছিল এলসা। কিন্তু পরে ওদের মধ্যে ঝগড়া হয়ে যায়।
ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। ভিখিরিদের মধ্যে ভালোবাসা, থ্যাবড়া চালাঘরের ভেতরে মদের বেঁকে কোদল, মাথার ওপর আচম্বিতে চোট.., এইভাবেই হয়তো ঘটেছে ব্যাপারটা।
কিন্তু আর্নেস্টো কোথায়? ভিখিরিরা তা জানে না। গত দিনদুয়েক ওকে দেখা যায়নি। কিন্তু সে নাকি রিও-র ব্রডওয়ে সিনেলাডিয়া ডিস্ট্রিক্ট-এর থিয়েটারের ভিড়ে কাজ করতো।
একজন ভিখিরি আমার সঙ্গে ফিরে এল পুলিশ হেডকোয়োর্টারে। জুয়াচোর বদমাশদের গ্যালারিতে আর্নেস্টোর ফোটোগ্রাফ দেখেই চিনতে পারল সে। সঙ্গে সঙ্গে হুলিয়া বেরিয়ে গেল তাকে গ্রেপ্তার করে আনার। কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করা দরকার তাকে। আর, তারপরেই শুরু হল আমাদের ডিপার্টমেন্টের সেই কাজটি, যে কাজ সব গোয়েন্দাদের জীবনের একটা বিরাট অংশ জুড়ে থাকে এবং তা হচ্ছে প্রতীক্ষা–নিছক প্রতীক্ষা।
.
তিনদিন পরে নিয়ে আসা হল আর্নেস্টোকে।
ওর খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখের কোনাগুলো লাল, আর নোংরা চেহারার সঙ্গে পুলিশের ফটোগ্রাফের সাদৃশ্য বার করাই মহামুশকিলের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল। জেলখানার মধ্যে দাড়ি-গোঁফ কামানোর পর এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করার পর তোলা হয়েছিল ফোটোগ্রাফটি। সনাক্তকরণে একটু প্রাথমিক অসুবিধা দেখা গেলেও লোকটা আর্নেস্টোই বটে।
মানুষটি ছোটখাটো কৃশকায়। নার্ভাস চোখে মিটমিট করেও বার বার তাকাতে লাগল আমার পালিশকরা টেবিল আর অফিসের পুরোনো দেওয়ালের দিকে।
মেয়েটাকে চেনো? টেবিলের ওপর থেকে এলসার ছবি ঠেলে দিয়ে শুধোলাম আমি।
এক পলক ছবিটার দিকে তাকালে আর্নেস্টো।
তারপর জবাব দিলে মদে-ভাঙা গলায়–নিশ্চয়। আমরা–আমরা খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। হলদে-হলদে দাঁত বার করে নার্ভাসভাবে একটু হাসবার চেষ্টা করল ও।
এলসা যে মারা গেছে, এ খবর তুমি পেয়েছ কি? প্রশ্নটা তিরের মতো ছুঁড়ে দিলাম ওকে লক্ষ্য করে।
বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে ওঠে আর্নেস্টোর চোখ।
মরবার আগে তোমার সঙ্গে তার একচোট হাতাহাতি হয়েছিল–খুন হওয়ার একটু আগেই, তাই নয় কি?
চুপ করে রইল আর্নেস্টো। অথবা মৃত্যুসংবাদ পেয়ে কথা বলার শক্তিও হারিয়ে ফেলল
সে।
কী জন্যে এ কাজ করলে আর্নেস্টো?
আমি? দিব্যি কেটে বলছি, আমি ওকে খুন করিনি… কাশির ধমকে মাঝপথেই আটকে গেল বাকি কথাটা এবং তখনই দেখা গেল সে যক্ষ্মারোগগ্রস্ত।
সামলে না নেওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম আমি। তারপর আবার শুরু করলাম–ঠিক আছে, ঠিক আছে, এবার আমি শুনতে চাই সব কিছু, গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত। এলসাকে তুমি কতদিন থেকে চিনতে? ঝগড়াই বা করলে কেন? সমস্ত বলো। বুঝেছ?
সাগ্রহে মাথা নেড়ে সায় দিলে আর্নেস্টো। কাহিনিটা চটপট বলে ফেলার খুব ইচ্ছে দেখা গেল ওর মধ্যে। চার কি পাঁচ বছর হল এলসার সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে তার। গত দু-বছর ওরা একসঙ্গে বাস করে এসেছে। কিন্তু ইদানীং ওর বিশ্বস্ততা সম্পর্কে সন্দেহ দানা বেঁধে উঠেছিল আর্নেস্টোর মনে। হপ্তা তিনেক আগে পুলিশের জালে ধরা পড়ে আর্নেস্টো। তারপর জেলের মধ্যেই কাটাতে হয়েছে কয়েকটা দিন।
জেল থেকে বেরিয়েই এলসার খোঁজ করতে লাগল ও। কিন্তু কোথাও পাওয়া গেল না ওকে। ও ভেবেছিল, নিশ্চয় অন্য কোনও ভিখিরির সঙ্গে সটকান দিয়েছে এলসা। তারপর কিন্তু এলসাকে আবার দেখতে পায় আর্নেস্টো। কিন্তু ওর অভিযোগ অস্বীকার করে এলসা। দারুণ ঝগড়া হয় দুজনের মধ্যে। তার বেশি কিছু নয়। এলসাকে খুন করেনি আর্নেস্টো।
শুধোলাম–সোমবার রাতে কোথায় ছিলে তুমি? ওই রাতেই খুন হয়েছে এলসা।
ঠোঁট চেটে নিলে আর্নেস্টো। বলল–বন্দর অঞ্চলে ছিলাম। সারারাত সেইখানেই ঘুমিয়েছি আমি।
কেউ দেখেছিল তোমাকে? প্রমাণ করতে পারো তোমার কথা?
না, পারব বলে মনে হয় না আমার।
সে রাতে তাহলে এলসার ধারে কাছে যাওনি তুমি?
দিব্যি গেলে বলছি যাইনি।
ঠিক তো?
বেঠিক কিছু বলিনি সিনর মার্টিনেলি। ওই রাতে ওকে আমি দেখিইনি। একাজও আমি করিনি।
আর্নেস্টোকে সেলের মধ্যে নিয়ে যাওয়ার হুকুম দেওয়া ছাড়া করণীয় আর কিছুই ছিল না। কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস হয়ে গিয়েছিল, এই সেই লোক যাকে আমি খুঁজছি। ভিখিরিরা সবসময়ে জটলা পাকিয়ে বাস করে। সে রাতে যদি বন্দর অঞ্চলেই থাকত আর্নেস্টো, তাহলে সমশ্রেণির কেউ না কেউ ওকে ঠিকই দেখতে পেত। এবং সেক্ষেত্রে নিজে থেকেই ওর অ্যালিবি আমাকে জানিয়ে দিত আর্নেস্টো।
আর্নেস্টোই হত্যাকারী। কিন্তু কী করে তা প্রমাণ করা যায়? সন্দেহের অভিযোগ কাউকে যে ফাঁসিতে ঝোলানো যায় না, এ তথ্য আর্নেস্টো জানে। আদালতে হাজির করলে এই মস্ত সুবিধেটাই পেয়ে যাবে সে।
এর পর কিছুদিন ধরে অনেকভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অনেক প্রশ্ন করেছিলাম আর্নেস্টোকে। যতই ওকে চাপ দিতে থাকি, ততই মনে হতে লাগল ও যেন বুঝতে পারছে যে অকাট্য কোনও প্রমাণ হাতে না নিয়ে স্রেফ সন্দেহের বশে জেরা করে চলেছি ওকে। এক এক দফা সওয়ালজবাব হয়ে যাবার পরে ক্রমে ক্রমে অত্যন্ত অসভ্য হয়ে উঠতে লাগল আর্নেস্টো এবং দফায় দফায় আমিও ভেঙে পড়তে লাগলাম, রেণু রেণু হয়ে যেতে থাকে আমার মনোবল।
খুনের প্রায় দিন-দশেক পরে এক রাত্রে আর একবার শুরু করলাম আমার নিষ্ফল প্রচেষ্টা। শেষকালে যখন বুঝলাম আমার সমস্ত উদ্যমই নিরর্থক এবং কোনও মতেই পরিস্থিতির এতটুকু উন্নতিসাধন সম্ভব নয়, তখন কোটটাকে খামচে তুলে নিয়ে সিধে রওনা হলাম বাড়িমুখো। রীতিমতো নিরুৎসাহ হয়ে পড়েছিলাম আমি। শরীর-মন ভরে উঠেছিল অপরিসীম অবসাদে।
আমার ছোট্ট ফ্ল্যাটের দরজায় চৌকাঠ পেরোনোর আগেই লক্ষ্য করলাম পালটে গেছে সমস্ত আবহাওয়া রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছিল ভালো ভালো খাবার রাঁধার সুগন্ধ। দরজা খুলতেই ময়দা মাখা দু-হাত বাড়িয়ে সাদরে অভ্যর্থনা জানালে আমার স্ত্রী। হাতের তালুতে চারু অধরোষ্ঠের চুম্বন তুলে নিয়ে আমার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে খুশি-উচ্ছল স্বরে বলে উঠল–দু-এক মিনিটের মধ্যেই সব তৈরি হয়ে যাবে।
আমার খুব খিদে পায়নি। আর্নেস্টোর ইস্পাত-কঠিন আত্মপ্রত্যয়ের কথা ভাবতে ভাবতে জবাব দিলাম আমি।
হেসে উঠল আমরা স্ত্রী, বলল–টেবিলে খাবার এসে পৌঁছোনোর আগে পর্যন্ত চিরকালই ওই কথাই বলেছ তুমি।
একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়লাম। দেখলাম, এক বোতল মদ তুলে নিয়ে একটা কেকের মিশ্রণের ওপর খানিকটা মদ ও ঢালছে। ঢালা শেষ হলে বোতলটা নামিয়ে রাখল ও। দেখলাম ওর ময়দা-মাখা তালুর পরিষ্কার ছাপ উঠে এসেছে বোতলটার ঘাড়ের কাছে।…হৃদয়রেখা আর আয়ুরেখা দুটি ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠে এসেছে ওপরে বোতলের মুখের দিকে।
আর একবার তাকালাম ছাপটার দিকে এবং তার পরেই বিদ্যুৎচমকের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল সবকিছু।
কোটটাকে ঝপ করে তুলে নিয়ে এমনভাবে বিকট চিৎকার করে উঠেছিলাম যা শুনলে মনে হত যেন একটা উন্মাদ তারস্বরে সম্বোধন করছে তার বউকে।
এখুনি ফিরে আসছি, বলেই বোঁ করে উধাও হয়ে গেলাম রান্নাঘর থেকে।
পিছু পিছু এল না আমার স্ত্রী। এমনকী ডিনার ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার অনুযোগ নিয়ে উন্মাও প্রকাশ করল না। বহুদিন ধরে ঘর করতে হয়েছে তাকে গোয়েন্দার সঙ্গে–তাই এসব তার গা-সওয়া।
আমি তিরবেগে ফিরে চললাম অফিসে। সেটার প্রমাণ রয়েছে সেইখানেই।
ঠোঁটের কোনে উপহাসের হাসি ঝুলিয়ে এল আর্নেস্টো। কিন্তু আমার চোখের দৃষ্টি দেখেই এ হাসি মিলোতে বিশেষ দেরি লাগল না।
শান্তস্বরে বললাম–খুনের চার্জ আনছি আমি তোমার বিরুদ্ধে।
বলে, টেবিলের ড্রয়ার থেকে বার করলাম কাশাকার বোতলটা–যে বোতলটা দিয়ে পরপারে পাঠানো হয়েছে এলসাকে।
বোতলটা দেখামাত্র আর্নেস্টো বুঝলে তার বরাত মন্দ। আমতা-আমতা করতে থাকে ও।, না, আমি ইচ্ছা করে করিনি ও কাজ। ভুল হয়ে গিয়েছিল।
আর একটা শব্দও সহ্য করার মতো মনের অবস্থা আমার ছিল না। এক ধমকে ওকে চুপ করিয়ে দিয়ে বললাম–হ্যাঁ, ভুলই বটে, তোমারই ভুল। বোতলটাকে ওখানে ফেলে যাওয়াটাই হয়েছে। মহাভুল। বোতলের ওপর তালুর ছাপটা দেখে প্রথমে আমরা ভেবেছিলাম ও ছাপ এলসার।
জিনিসটা আরও লক্ষ্য করা উচিত ছিল আমার। তালুর লম্বা লম্বা রেখাগুলো নীচের দিকে নামতে নামতে কাছাকাছি চলে এসেছে। তার মানে এই যে, বোতলটা যার হাতে ছিল, সে মদ ঢালবার জন্যে বোতল ধরেনি, ধরেছিল উল্টোভাবে হাতিয়ার হিসেবে, ঠিক এইভাবে।
মুগুর ভঁজার মতো বোতলটাকে এক পা ঘোরাতেই সে রাতের স্মৃতি হু-হুঁ করে ভাসিয়ে দিল আর্নেস্টোর মনের দুকূল। শুরু হল দয়াভিক্ষার পালা। এলসার সঙ্গে মদ্যপান করার সময়ে নাকি কথা কাটাকাটি শুরু হয় ওর সঙ্গে আর্নেস্টোর। ঝগড়ার বিষয় সেই একই–এলসার ওপর সন্দেহ। তখনই, বোতল দিয়ে ওর মাথায় দড়াম করে এক ঘা বসিয়ে দিয়ে পালিয়ে যাই আমি–স্বীকার করলে আর্নেস্টো।
আর্নেস্টার তালুর ছাপের সঙ্গে বোতলের ছাপ মিলিয়ে দেখলাম। না দেখলেও চলত। কিন্তু নিয়মের খাতিরে এটুকু করতে হল। দেখলাম, অবিকল মিলে গেল দুটি ছাপ।
কেসের পরিসমাপ্তি শুনে কিন্তু অবাক হয়ে গিয়েছিল আর্নেস্টো। বিচারপতির মুখে যাবজ্জীবন কারাবাসের দন্ডাজ্ঞা শুনেও কিন্তু যতখানি বিচলিত হওয়া উচিত ছিল, তার অর্ধেকও হয়নি আর্নেস্টো। কারণ কী জানেন? ওকে আমি বলেছিলাম, এলসা কোনওদিনই বিশ্বাসঘাতকতা করেনি তার সঙ্গে। আর্নেস্টো জেল খেটে বেরিয়ে আসার পর এলসাকে খুঁজতে গিয়ে তাকে পায়নি। কেননা, এলসাও তো তখন ভিক্ষুকবৃত্তির অপরাধে শ্রীঘরে চালান হয়েছে । আর্নেসেটা ভেবেছিল এলসা বুঝি কোনও প্রেমিকের সঙ্গে ফুর্তি লুটতে গেছে–আসলে সে তখন ছিল পুলিশেরই হেফাজতে।
চার বছর পরে আজ আমার শুধু বয়সই বাড়েনি, রিও-ডি-জেনেরিও-র সি আই ডি-র চিফ হিসেবে নতুন খেতাবও পেয়েছি। কিন্তু আজও আমি মনে করতে পারি সেই রাতটির কথা যখন বাড়ি ফিরে আসার পর দেখেছিলাম ডিনার সাজিয়ে বসে রয়েছে আমার স্ত্রী। খাবার যে এত সুস্বাদু হতে পারে, তা আগে জানতাম না। স্ত্রীর পাকা হাতের কেক তৈরির সূত্ৰ-কাহিনি যখন বললাম, তখন তো হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ল ও। হাসিমুখে গিন্নি সেদিন বলেছিল–অফিসে যে সময়টা কাটাও, তার চাইতে বেশি সময় যদি আমার রান্নাঘরে খরচ করো, তাহলে হয়তো দেখা যাবে আরও অনেক কেস সমাধান করতে পারছ তুমি।
* আলফোনসো মার্তিনেল্লি (ব্রাজিল) রচিত কাহিনি অবলম্বনে।
কদাকার কেস
সল্টলেক স্টেডিয়ামের সামনে দিয়ে যে নতুন রাস্তাটা সোজা উত্তর দিকে চলে গেছে, সেই রাস্তা বরাবর করুণাময়ী স্টেট পর্যন্ত গেলে মাঝে অনেকগুলো সারকেল পড়ে চার রাস্তার মোড়ে।
থারড সারকেলটায় রোজ বিকেলবেলা একা গিয়ে বসে ইন্দ্রনাথ। বৃদ্ধ বায়ুসেবীরা এদিকে ততটা ভিড় করেন না। চারদিকে ফাঁকা মাঠ। এখানে ওখানে দু-একটা বাড়ি তৈরি হচ্ছে। আর বছরকয়েকের মধ্যে এখানে আর এভাবে হু-হুঁ করে বাতাস বইবে না, জায়গাটা আর এরকম নির্জন থাকবে না।
শুধু একজন এসে রোজ বসে ইন্দ্রনাথের অদুরে। চাপাগলায় প্রায় ফিসফিসানি স্বরে এক লাইনের একটা গানই গায় প্রতিদিন। উদাস চোখে নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে হঠাৎ ফিসফিস করে তান ধরে আপন মনে।
তারা আসছে…তারা আসছে…রোজ রাতে তারা আসছে…আসছে…আসছে…আসছে।
শেষের দিকের আসছে শব্দ তিনটে যেন খাদের মধ্যে নামতে নামতে হারিয়ে যায় গলার মধ্যে।
গায়কের বয়স বেশি নয়। বড় জোর পঁচিশ। চেহারা সাধারণ, পোশাকও সাধারণ। উচ্চতা মাঝারি। গায়ের রং না ময়লা, না ফরসা। চোখমুখের মধ্যে এমন কোনও বৈশিষ্ট্য নেই যে মনে দাগ কেটে যায়।
দাগ কেটে যায় শুধু তার ওই চাপাগলার গানটা। একই গান। একই সুর। কিছুক্ষণ অন্তর একইভাবে গাওয়া। সন্ধে ঘনিয়ে এলে একইভাবে আস্তে-আস্তে হাঁটতে-হাঁটতে আর গাইতে গাইতে চলে যায় দূরের নতুন ফ্ল্যাট বাড়িগুলোর দিকে। নিস্তব্ধ সন্ধ্যায় হু-হুঁ বাতাস বয়ে আনে অদ্ভুত শব্দগুলো চাপা হাহাকারের মতো?
তারা আসছে…তারা আসছে..রোজ রাতে তারা আসছে…আসছে…আসছে… আসছে।
একদিন উঠে গিয়ে তার পাশে বসল ইন্দ্রনাথ। সে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালে ইন্দ্রনাথের দিকে। চোখের চাহনি সুস্থ মানুষের চাহনির মতো নয়। পাগল। সন্দেহ নেই।
নরম গলায় বললে ইন্দ্রনাথ, গানটার মানে কী?
মানে শুনতে হলে একটা কেস শুনতে হবে খুবই কদাকার কেস, আস্তে-আস্তে থেমে থেমে বললে সে।
আমি শুনব। বললে ইন্দ্রনাথ।
তখন সে বলল কদাকার কেসের কদর্য কাহিনি। এবং তা লোমহর্ষকও বটে!
.
ললিতা ঘাড় বেঁকিয়ে বললে, রমেশ, এখন কী করবে?
গ্রানাইট কঠিন চোখে রমেশ বললে, তুমি যা চাও, তাই হবে।
তুমি খ্রিস্টান, আমি হিন্দু। তোমার বাবা বড়লোক, আমার বাবা গরিব মাস্টার। তা সত্ত্বেও বিয়ে করবে?
এখনও সন্দেহ আছে?
কিন্তু আমি তো তোমাকে বলেছি, আমার বিয়েতে শাঁখ বাজবে, উলুধ্বনি হবে, নিজের হাতে সিঁদুর টেনে দেবে সিঁথিতে। কিন্তু তোমার বাবা
চায় বিয়ে হবে গির্জেতে।
যদি আমি তা না করি।
আইনের পথে যাবে বাবা। সম্পত্তিচ্যুত হব, বাড়ির দরজা চিরকালের মতো বন্ধ হয়ে যাবে। কাগজে কাগজে লিগ্যাল নোটিশ ছাপা হবে।
তা সত্ত্বেও চাও হিন্দুমতে হোক বিয়ে?
তোমার এই সেন্টিমেন্ট বাবার সম্পত্তির চেয়ে অনেক বেশি দামি আমার কাছে।
রমেশ, আর এক বছর কাটিয়ে দিলেই মাস্টারস ডিগ্রি পেয়ে যাব দুজনে।
একটা ডিগ্রির লোভে আমাদের জীবন থেকে একটা বছরকেও আমি হারাতে চাই না, ললিতা।
বেশ, তবে তাই হোক।
হ্যাঁ। ঠিক তাই হবে। তোমার কোনও ইচ্ছেই অপূর্ণ রাখব না আমি।
অদৃষ্টের অট্টহাসি শোনা গিয়েছিল তখন অন্তরালে–শুনতে পায়নি দুজনের কেউই।
.
রমেশ, বিয়ে তো হল। পথের ফকির হলে। কলেজ ছাড়লাম। পকেটে মাত্র পাঁচশো টাকা। এবার?
শুরু হোক অদৃষ্টের সঙ্গে পাঞ্জা কষা। ব্যাচেলরস ডিগ্রিটা যখন আছে, টিচারের চাকরি একটা পাবেই।
রমেশ, আমার বাবা সারা জীবন মাস্টারি করেছে। সংসারের অভাব কোনওদিনই ঘোচাতে পারেনি। ও লাইনে আমি যাব না।
তবে কী করবে?
কেরানির কাজ।
পেয়ে গেছ মনে হচ্ছে?
এই তো অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার। এবার বল, তুমি কী করবে?
ব্যাবসা।
চাকরি করবে না?
জীবনেও না। বাবার এত টাকা ব্যাবসা করে। আমিও যাব সেই পথে।
মাত্র পাঁচশো টাকা পুঁজি নিয়ে?
ওর চাইতেও বড় পুঁজি যে আমার আছে, তা তো তুমি জানো ললিতা?
জানি, জানি, জানি। পুরুষের সব চাইতে বড় পুঁজি তার সাহস, তার উদ্যম–তা তোমার আছে। আর আছে ব্যক্তিত্ব, আছে স্মার্টনেস–তুমি পারবে, রমেশ, তুমি পারবে, কিন্তু ব্যাবসাটা কীসের?
পাইকারি বাজার থেকে মাল কিনে বাড়ি-বাড়ি ডেলিভারি দেব। টেন পারসেন্ট প্রফিটই যথেষ্ট। পাঁচশো টাকা পুঁজি নিয়ে–
এর বেশি হয় না। বেশ, আমি রইলাম চাকরি নিয়ে তুমি ভাগ্য ফেরাও বাণিজ্য করে। দেখা যাক কী আছে অদৃষ্টে।
আবার অট্টহেসে উঠেছিল অদৃষ্ট। এবারও তা শুনতে পায়নি দুজনের কেউই।
.
রমেশ, সত্যিই অসম্ভবকে সম্ভব করে তুললে। দু-বছরেই ডেলিভারি ভ্যান!
নিজেই চালাব। অর্ডার সাপ্লাই বিজনেসে ভ্যানটা খুবই দরকার।
বলেছিলাম না তোমাকে, উদ্যোগী পুরুষেরই সহায় হয় ভাগ্য।
অদৃষ্টকে তো তৈরি করে নেওয়া যায় পুরুষকার দিয়ে, তাই নয় কি ললিতা?
আবার বিপুল রবে অট্টহেসে উঠেছিল অদৃষ্ট–না, শুনতে পায়নি কেউই।
রমেশ, আজ আমাদের পঞ্চম বিবাহ বার্ষিকী।
আর আজকের দিনেই উদ্বোধন হবে আমার নতুন ব্যাবসার বিলডিং আর ব্রিজ কনস্ট্রাকসন।
হিন্দি ফিল্মের কাহিনির মতো অলীক মনে হচ্ছে। তাই না রমেশ? মাত্র পাঁচশো টাকা পুঁজি নিয়ে পাঁচ বছরেই সল্টলেকে বাড়ি, গাড়ি—
এইবার তোমার শেষ সাধটা পূর্ণ করা দরকার, ললিতা। এবার আর না বলতে পারবে না।
আসলে সাধটা তোমার নিজেরই। বাবা হওয়ার ইচ্ছে হয়েছে বললেই হয়।
কার না হয়, ললিতা? যে আসবে, সে ছেলেই তোক কি মেয়েই হোক–তার চোখ যদি তোমার মতো সুন্দর না হয়–
আর তার হাইট যদি তোমার মতো ছফুট না হয়—
সর্বনাশ ললিতা, ছফুট হাইটের মেয়ের বর জুটবে না যে।
রমেশ, যে পৌরুষ দিয়ে এই বিপুল সম্পত্তি অর্জন করেছ, সেই পৌরুষ দিয়েই তুমি আমাকে ছেলেই উপহার দেবে–মেয়ে নয়।
অট্টহেসে উঠেছিল দীর্ঘদেহী, অত্যন্ত সুপুরুষ, প্রখর ব্যক্তিত্বের অধিকারী রমেশ। তাই সম্ভবত শুনতে পায়নি অদৃষ্টের অট্টহাসি!
.
অত ভেঙে পড়লে কি চলে রমেশ?
যে পুরুষ বউকে সন্তান উপহার দিতে পারে না, তার ভেঙে পড়াই তো স্বাভাবিক, ললিতা।
ইউরোপ আমেরিকার ডাক্তাররা তোমার শরীরের হরমোন ঘাটতি মিটিয়ে দিতে পারবে। চল, সেখানেই যাই। আমিও যাব।
কিছু হবে কি?
চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করাই পুরুষের ধর্ম। তুমি না পুরুষ?
আমি?
রমেশ, তোমার ওই হতাশ হাসি আমার বুক ভেঙে দিচ্ছে–দেখাই যাক না অদৃষ্টে কী আছে?
অদৃষ্ট স্বয়ং তা জানতেন বইকি। তাই এবার আর তিনি অট্টহাস্য করলেন না। কেবল মুচকি হাসলেন।
তাবড়-বড় ডাক্তারদের দোরে ঘুরে মুখ চুন করে ফিরে এলে স্বামী-স্ত্রী। রমেশের ঔরসে ললিতার মা হওয়ার সম্ভবনা নেই একেবারেই।
.
লিলিতা, একটা কথা বলব?
অমনভাবে বলছ কেন? না ঘুমিয়ে চোখমুখের অবস্থাটা কী করেছ আয়নায় গিয়ে দেখে এসো।
আগে কথাটা বলি–
তোমার কোনও কথা এখন শুনতে চাই না। এতবড় কারবারের দিকে একেবারেই নজর দিচ্ছ না। আকাশপাতাল চিন্তা করে সমস্যার সমাধান তো হবে না। অদৃষ্টে যা আছে, তা মেনে নেওয়াই ভালো।
অদৃষ্ট?…হ্যাঁ, অদৃষ্টই বটে! এই প্রথম অদৃষ্টের কাছে হার মানলাম আমি। কিন্তু সমস্যার সমাধান একটা আছে।
কী শুনি?
রাগ করবে না তো?
কোন কালে করেছি?
ললিতা…ব্যাপারটা ডেলিকেট…মানে, আমার কোনও আপত্তি নেই…তোমার সবচেয়ে বড় সাধপূরণ করার জন্যে আমি সবকিছুই মেনে নিতে পারি। আমি বলছিলাম…আমি বলছিলাম…
বল না? অত কিন্তু কিন্তু করছ কেন?
তুমি…তুমি…
কী হল? ফ্যাকাশে মেরে গেলে যে?
তুমি…আর কাউকে দিয়ে…মানে, এরকম নজির তো সমাজে আছে…
ছিঃ! রমেশ! ছিঃ! এত নোংরা সমাধানটা তোমার মাথায় এল কী করে?
নোংরা!
কদর্য! অত্যন্ত কদর্য! ভবিষ্যতে আর এ নিয়ে কোনও কথা আমাকে বলবে না।
শোন ললিতা, এখন তোমার বয়স ঊনচল্লিশ–এখনও সময় আছে।
চল্লিশ থেকেই শুরু হোক তোমার নতুন জীবন আমাদের দুজনের ছোট্ট সংসারে নাই বা এল তৃতীয় জন? সেই হোক আমাদের–
কিন্তু–
আর কোনও কথা নয়। কারবারের মধ্যে ডুবে যাও—
তোমার শেষ সাধটা–
শিকেয় তোলা থাক।যাও, দয়া করে নিজে গাড়ি ড্রাইভ আর কোরো না। দু-দুটো অ্যাকসিডেন্ট থেকে বেঁচ্ছে। যার মাথার ঠিক নেই–তার হাতে স্টিয়ারিং যেন না থাকে–
আমার কথাটা—
আবার ওই কদর্য কথা?
.
মেমসাব।
কী হয়েছে, রামলোচন? অমন করছ কেন? সাব কোথায়?
হাসপাতালে?
আবার অ্যাকসিডেন্ট? কে ড্রাইভ করছিল?
সাব নিজেই। আমাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে—
চল যাই।
মেমসাব।
অমন করে চেয়ে আছ কেন? কী হয়েছে, রামলোচন? কী হয়েছে? বল কী হয়েছে?
সাব আর বেঁচে নেই।
চল্লিশেই জীবন ফুরিয়ে গেল জীবনযুদ্ধে জয়ী রমেশের নতুন করে নতুন জীবন শুরু করার আগেই।
কৌতূহলী অদৃষ্ট কি সরে গেলেন?
তাই কি হয়? ললিতার অদৃষ্ট লিখন ফলিয়ে যেতে হবে না?
.
সেক্রেটারিবাবু এসেছেন মেমসাব।
ভেতরে নিয়ে এসো।আসুন মিঃ চৌধুরী। সিরিয়াস ব্যাপার নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই–অফিসে সেটা সম্ভব নয়। এই একবছর বিজনেস চালিয়েছি আপনার সাহায্য নিয়েই নইলে পারতাম না।
এটা আপনার বিনয়, মিসেস দত্ত। মিস্টার দত্তর চাইতে আপনি কোনও অংশে কম যান না, তা হাতেনাতে দেখিয়ে দিয়েছেন।
কিন্তু এখন আমি ক্লান্ত। খুব একা। আপনি রমেশের বন্ধু। আমারও। তাই আপনার কাছেই মন খুলে কথা বলা যায়। আপনি জানেন নিশ্চয়, রমেশের মৃত্যুর পর আমার কাছে বিয়ের অফার পাঠিয়েছিল অনেকে?
জানি। আবার বিয়ের বয়স তো আপনার পেরিয়ে যায়নি। যৌবনকেও, এক্সকিউজ মি ফর মাই ফ্র্যাঙ্কনেস, আপনি টিকিয়ে রেখেছেন। নিঃসঙ্গতা একটা অভিশাপ তা সত্ত্বেও ফিরিয়ে দিয়েছেন সবাইকে।
কারণ, একলা থাকাটাই আমার সয়ে গেছে। রমেশের জায়গায় আর কারও আসার দরকার নেই। যাক সে কথা, আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছি একটা বড় রকমের সিদ্ধান্ত জানানোর জন্য।
বলুন।
আমি কারবার বেচে দেব। আপনি খদ্দের দেখুন।
সেকী! চালু কারবার, এত গুডউইল–
ভালো দর এখনই পাওয়া যাবে। অনেক ভেবে এই ডিসিশন নিয়েছি আমি। এর আর নড়চড় হবে না। আপনি ব্যবস্থা করুন।
বেশ তাই হোক।
.
মিসেস দত্ত, বিজনেস তো বিক্রি করে দিলেন, বাড়িটাকে দুভাগ করছেন কেন?
ভাড়াটে বসাব বলে।
ভাড়াটে! টাকার অভাব তো আপনার নেই।
মিঃ চৌধুরী, আপনি সেদিন বলে গেছিলেন না নিঃসঙ্গতা একটা অভিশাপ? হাড়ে হাড়ে তা ফিল করছি। আপনি বন্ধু মানুষ। সবই জানেন। কফি পার্টি, কিটি ক্লাব, মিক্সড ক্লাব, সোস্যাল সারভিস, লাইব্রেরি-বই–কোনও কিছুই আমার এই ফাঁকা জীবনটাকে ভরিয়ে তুলতে পারছে না। বিজ্ঞাপন লাইনেও কিছুদিন মন ঠেলে দিলাম–মন ভরল না। তাই–
ভাড়াটে বসাবেন। কিন্তু যেচে উৎপাতকে ডেকে আনা হবে না?
বিজ্ঞাপনের জবাব এসেছে অনেক। উৎপাতের ভয়ে কাউকে বেছে নিতে পারছি না। আপনার পরামর্শ চাই সেই কারণেই। কীরকম ভাড়াটে হলে উৎপাত থাকবে না, অথচ নিঃসঙ্গতা ঘুচবে– বলতে পারেন?
নিতান্তই যদি ভাড়াটে বসাতে চান কথাবার্তা বলে নিঃসঙ্গতা ঘুচোনোর জন্যে, তাহলে বলব রিটায়ারড ফ্যামিলি রাখুন। এমন ফ্যামিলি যাদের ছেলেপুলে নেই।
ঠিক বলেছেন। এরকম একটা ফ্যামিলি নিজেই এসেছিল সেদিন। মিস্টার অ্যান্ড মিসেস মালকানি। ননবেঙ্গলি কিন্তু অত্যন্ত ভদ্র। নিঃসন্তান।
মালকানি। মিসেস কি খুব মোটা? দেখতে শুনতে মোটেই ভালো নয়।
আপনি চেনেন?
খুব ভালোভাবে চিনি। সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের বড় অফিসার ছিলেন। আমাদের অনেক অর্ডার পাইয়ে দিয়েছেন। কিন্তু–
কীসের কিন্তু—
ওঁর স্ত্রী সম্বন্ধে অনেক রকম কথা শুনেছি তো!
কীরকম কথা বলুন তো?
মিসেস মালকানির ছেলেপুলে না হওয়ার কারণটা আপনাদের ক্ষেত্রে যা হয়েছে, ঠিক তার উলটো। কিছু মনে করবেন না খোলাখুলি কথা বলছি বলে।
না, না, বলুন আপনি। সবই জানা দরকার।
তাহলে আরও কিছু জানিয়ে রাখি। যেহেতু রাবেয়া মালকানির গর্ভে কোনওদিনই সন্তান আসবে না তাই…
বলুন?
তাই উনি একটু উচ্ছঙ্খল প্রকৃতির। মানে…
থাক, কারওর চাহিদা বেশি থাকে। রাবেয়া যে পন্থায় সুখে থাকতে চায়, তাতে আমার অসুখী হওয়ার কোনও কারণ নেই। মিঃ মালকানি লোক কীরকম?
অত্যন্ত অনেস্ট। ক্লাব নিয়েই সময় কাটিয়ে দেন। নিষ্কলঙ্ক চরিত্র।
তাহলে এই ফ্যামিলিকেই ভাড়া দেব। আপনার হেল্প পাব তো?
চিরকাল পাবেন।
.
কিন্তু এমন সব ঘটনা ঘটতে লাগল মালকানি দম্পতিকে বাড়ি ভাড়া দেওয়ার পর থেকে যে বিশেষ সেই ঘটনাগুলো মস্ত প্রহেলিকা হয়ে দাঁড়াল রমেশের প্রিয় বন্ধু বিপুল চৌধুরীর কাছে।
ললিতা যে বড় একা, এই কথা শোনার পর থেকেই বিপুল চৌধুরী প্রায় আসত তার কাছে। কোম্পানির মালিক এখন অন্য ব্যক্তি, কিন্তু ললিতার সঙ্গে বন্ধুত্বে ছেদ পড়েনি। সময় পেলেই সন্ধে নাগাদ এসে চা-কফি খেত আর গল্প করত।
একদিন বললে ললিতা, মিঃ চৌধুরী, আপনি ভূত মানেন?
হেসে বললে বিপুল চৌধুরী, একেবারেই না।
কিন্তু আমি ইদানীং প্রায় রাতে ছায়ার মতো কাকে যেন ঘুরতে দেখি আমার ঘরে। আলো জ্বাললেই আর তাকে দেখতে পাই না। দরজাও দেখি বন্ধ রয়েছে ভেতর থেকে।
আপনার মনের ভুল। এক কাজ করতে পারেন।
কী?
আপনার মেড সারভেন্টটার কী যেন নাম?
মেরী। কেন বলুন তো?
ওকে এনে ঘরে শোয়াতে পারেন। হাসছেন কেন?
মেরীর চরিত্রটা আপনি জানেন না বলে। সন্ধের পর ওর ঘরে নাগর আসে–থাকে তো সারভেন্ট কোয়ার্টারে। সব্বাই জানে।
রাত্রে?
প্রায় সারা রাত চলে এই কাণ্ড। হাড় জ্বালিয়ে খেল আমার। মালকানিদের ওই যে ছোকরা চাকরটা আছে। দেখেছেন তো?
মাসুদ?
হ্যাঁ। মেরীর নাগর।
আপনি কিছু বলেন না?
বলে কোনও লাভ নেই। কারণ, রাবেয়া সম্বন্ধে আপনি যা বলেছিলেন, তা অক্ষরে-অক্ষরে সত্যি। তবে রুচিটা যে এত নীচে নামতে পারে, সেটাই ভাবা যায় না। মাসুদ শুধু মেরীর নয়…রাবেয়ারও।
বলছেন কি!
এ বাড়ির সব্বাই জানে। মিঃ মালকানিই বোধহয় জানেন না।
জানেন নিশ্চয়। কিছু করার নেই বলেই ক্লাব নিয়ে পড়ে থাকেন। আচ্ছা, একটা কথা জিগ্যেস করব?
আপনি যে ছায়ামূর্তিকে মাঝে-মাঝে ঘরের মধ্যে দেখেন, তাকে দেখতে কীরকম বলুন তো?
স্পষ্ট দেখতে পাই না। তবে খুব মোটা।
অনেকটা রাবেয়ার মতো দেখতে কী?
রাবেয়ার মতো..তা…হ্যাঁ…প্রায়ই তাই। কিন্তু রাবেয়া আসবে কী করে বন্ধ ঘরে?
আসে ওর সূক্ষ্ম শরীর!
সূক্ষ্ম শরীর! কী বলছেন বুঝছি না।
রাবেয়া মালকানির এই অলৌকিক ক্ষমতাটার কথা আগে আপনাকে বলিনি বিশ্বাস করবেন বলে। কোনও ভাড়াবাড়িতেই টিকতে পারেনি এই কারণেই। সূক্ষ্ম শরীরে রাত্রে অন্যের ঘরে গিয়ে সেক্স দেখা ওর একটা অত্যন্ত কদর্য অভ্যেস।
অসম্ভব।
এ ক্ষমতা অনেকেরই আছে, মিসেস দত্ত। রাবেয়ারও আছে। কিন্তু আপনি একা থাকেন, আপনার ঘরে রাত্রে ঘুরঘুর করে কেন সূক্ষ্ম শরীরে–এটাই একটা রহস্য।
নিন, নিন, কফি খানসারাদিন খেটে মাথা গরম হয়েছে আপনার।
সেইদিন রাত্রেই খুন হয়ে গেল ললিতা।
.
ভোরবেলা দুধের লাইন দিয়ে বোতল নিয়ে এসে ললিতাকে ডেকে তোলা মণিরামের বিশ বছরের অভ্যেস। সেদিন হাঁকডাক দরজায় ধাক্কা মেরেও কোনও সাড়াশব্দ না পেয়ে ঠেলে খুলেছিল পাল্লা।
পরক্ষণেই তার বিকট চিৎকারে চমকে উঠেছিল বাড়ির সকলে। ছুটতে ছুটতে এসে দেখেছিল, খাটে পড়ে ললিতার নগ্ন দেহ। ব্রা পড়ে আছে মেঝেতে। ব্লাউজটা ঠেসে ঢোকানো মুখে। সায়ার দড়ি দিয়ে হাত আর পা বাঁধা।
ঘর লণ্ডভণ্ড। দেরাজ তছনছ। স্টিল আলমারি খোলা–ভেতরকার সিক্রেট চেম্বার থেকে জড়োয়া গয়নার বাক্স উধাও। এমনকী ললিতার কান থেকে হিরের দুল আর টেবিল থেকে সোনার হাতঘড়িও নিপাত্তা।
পুলিশ এল। ঘণ্টাচারেক লাগল সবাইকে জেরা করতে, হারানো জিনিসপত্রের ফর্দ বানাতে, মৃতদেহের ফটো নিতে, নানা জায়গায় পাউডার ছড়িয়ে আঙুলের ছাপ তুলতে এবং কিছু বস্তু ফোরেনসিক পরীক্ষার জন্যে বাছাই করতে। সবশেষে মৃতদেহ মুড়ে পাঠিয়ে দেওয়া হল পোস্টমর্টেম করার জন্যে।
জেরার ফলে তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু জানা গেল না। মণিরাম আর মাসুদ দুজনেই একসঙ্গে রোজ ভোরবেলা দুধের লাইন দেয়। সেদিন মণিরাম একাই দুধ এনেছে। তার চিৎকার শুনে মিঃ মালকানি দৌড়ে এসেছেন। একটু পরে এসেছেন রাবেয়া। রাত একটায় ক্লাব থেকে ফিরেছিলেন মিস্টার মালকানি। বাড়ি ফিরেই অঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। ঘুম ভাঙে মণিরামের চিৎকারে। রাবেয়া তখন ছিল রান্নাঘরে। মাসুদ যে সেদিন দুধ আনতে যায়নি, একথা জানা গেল মণিরামের কাছেই। তার আগে পর্যন্ত রাবেয়া মালকানি কেন বলল না মাসুদ দুধ এনে দেয়নি রোজ সকালের মতো– ভেবে পেল না অফিসার। সে যে বাড়িতেই নেই, একথাটাও প্রকাশ পেল পুলিশ অফিসার যখন তাকে ডেকে পাঠাল জেরা করার জন্যে। মেরীকে জেরা করে জানা গেল সে গেছিল নাইট শোতে সিনেমা দেখতে।
মাসুদকে আর পাওয়া যায়নি। পাওয়া যায়নি জহরতের বাক্স।
একটা রহস্যই কেবল ধাঁধা হয়ে রইল অফিসারের কাছে। জহরতের বাক্স যে গোপন চেম্বারে থাকত, সেটা খোলবার বিশেষ তালাটার সংখ্যাগুলো ললিতা ছাড়া কেউ জানত না। তা সত্ত্বেও তালা খুলল কে?
ললিতা নিজে নয়তো? ফোরেনসিক রিপোর্টেও প্রকাশ পেল, মৃত্যুর আগে সহবাস করেছিল। ললিতা। কার সঙ্গে?
তারপর তার হাত-পা সায়ার দড়ি দিয়ে বেঁধে, মুখে ব্লাউজ ঢুকিয়ে, মারা হয়েছে গলা টিপে। মাসুদের হাতে জহরতের বাক্স তুলে দেওয়ার পরই কি মৃত্যু এসেছিল এইভাবে?
বিপুল চৌধুরী সবই জানল যথাসময়ে। বুঝলও অনেক কিছু। কিন্তু মুখ খুলল না।
কাহিনি শেষ করে আবার চাপাগলায় ফিসফিস করে সেই গানটা গেয়ে উঠল পাগলটা, তারা আসছে…তারা আসছে..রোজ রাতে তারা আসছে..আসছে..আসছে…। …রাতের অন্ধকারে হুহু হাওয়ায় বুকফাটা হাহাকারের মতো শব্দগুলো ভেসে গেল বাতাসে।
ইন্দ্রনাথ বললে, জহরতের বাক্সর তালা খোলার সিক্রেট নাম্বার জেনেছিল রাবেয়া সূক্ষ্ম শরীরে রোজ রাতে ঘরে আসত ওই জন্যেই।
ঠিক কথা। বললে পাগলটা।
মাসুদের কাছে রাবেয়াই জানিয়ে দিয়েছিল সিক্রেট নাম্বারটা।
তাও ঠিক।
ললিতাকে আগে খুন করেছিল মাসুদ–পরে ধর্ষণ করেছিল ব্যাপারটাকে কদর্যভাবে সাজানোর জন্যে। ফোরেনসিক রিপোর্টেও নিশ্চয় তা প্রকাশ পেয়েছে।
পেয়েছিল। খুনিকে ধরতে না পেরে অফিসার তা চেপে গেছিল।
কিন্তু মাসুদ, কারা আসছে রোজ রাতে তোমার কাছে…তা তো বললে না?
রাবেয়ার সূক্ষ্ম শরীর–এখনও সে চায় আমাকে। জহরতের বখরা পেয়েও খুশি নয়।
আর একজন?
লিলিতার প্রেতাত্মা।
কেন?
চোখে চোখ চাইল মাসুদ। অন্ধকারেও জ্বলজ্বল করছে দুই চোখ।
কেন? কেন? কেন? আমি নিজেই জানি না কেন? কী চায় সে? জহরত ফেরত চায় না– তবে? রাবেয়া যা চায়, তাই কি? চোখেমুখে তাই কি অমন মিনতি ফুটিয়ে তোলে? কিন্তু কেন? কেন? কেন? সব তো শেষ হয়ে গেছে–আবার কেন চাই সেই কদাকার–
উঠে দাঁড়াল মাসুদ। আস্তে-আস্তে দূর হতে দূরে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল তার মূর্তি। চাপাগলায় গানটা কিন্তু লেগে রইল ইন্দ্রনাথের কানে।
তারা আসছে…তারা আসছে…রোজ রাতে তারা আসছে…আসছে…আসছে…।
*পরিবর্তন পত্রিকায় প্রকাশিত (শারদীয় সংখ্যা)।
কনে হল বিধবা
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শেষবারের মতো নিজেকে দেখল মণিকা। বিধবার বেশে কোনও ত্রুটি নেই। অথচ এই সেদিন বেনারসী পরে শিবমন্দিরে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল সে। আশা ছিল এই আয়নার সামনে বেনারসী পরেই স্বামীর পাশে দেখবে নিজেকে। কিন্তু…।
মণিকার চোখ শুকনো কেন? জবাব দিল মণিকার মন। বলল–মণিকা তো বেঁচে নেই।
আলমারি থেকে টাকার বাণ্ডিলটা বার করে আনল মণিকা। পাঁচ ভাগ করে রাখল সুটকেসের ওপর। প্রতিটি ভাগে রইল সমান পরিমাণ টাকা। একদৃষ্টে অনেকক্ষণ চেয়ে রইল পাঁচ থাক টাকার দিকে। বুকের তুফানের ছায়াও পড়ল না চোখের তারায়। কী করে পড়বে? মণিকা তো বেঁচে নেই!
কেবল পাঁচ থাক টাকার প্রতিফলন পাঁচ-পাঁচটি ধিকিধিকি প্রতিজ্ঞাস্বরূপ জ্বলতে লাগল ওর বিশাল দুই চোখে।
বউমা, মণিকার শাশুড়ি ঘরে এলেন। বউমা, আমার কথা রাখো। যেও না।
না, মা, যেতে আমাকে হবেই।
শাশুড়ি আর পীড়াপীড়ি করলেন না। একশো টাকার নোটের একটা তাড়া মণিকাকে দিয়ে বললেন–তপনের সারাজীবনের সঞ্চয়। নাও। মনে রেখো আমার শেষ কথাটা–যেদিন মন চাইবে, সেদিনই ফিরে আসবে।
সুটকেস খুলল মণিকা। পাঁচ থাক টাকা একসঙ্গে করল। শাশুড়ির দেওয়া টাকা রাখল তার ওপর। সুটকে বন্ধ করে বলল–মা, চললাম।
শাশুড়ি এবার কেঁদে ফেললেন।
.
রাস্তায় নেমে এল মণিকা। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে সেই ফুটফুটে মেয়েটা। সবুজ ফ্রক উড়ছে জোর হাওয়ায়। বেণীর ডগাটা অস্থিরভাবে কামড়াচ্ছে ছোট ছোট দাঁত দিয়ে।
মণিকাকে দেখেই দৌড়ে এল কাছে–মাসিমা, চলে যাচ্ছেন?
হ্যাঁরে।
আমি সঙ্গে যাব?
আয়।
স্টেশন বেশি দূরে নয়; বড় জংশন; ইলেকট্রিক ট্রেন হরবখৎ যাচ্ছে আসছে। প্ল্যাটফর্মে কিছুক্ষণ দাঁড়াতেই এল কলকাতাগামী ট্রেন। ফুটফুটে মেয়েটার গাল টিপে দিয়ে একটা ফাস্ট-ক্লাস কামরায় উঠে পড়ল মণিকা।
উল্টোদিকের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে তখন যদি কেউ মণিকার গতিবিধি নজরে রাখত, তাহলে একটা অদ্ভুত ব্যাপার চোখে পড়ত। দেখত, মণিকা কামরার একদিকের দরজা দিয়ে ভেতরে উঠল বটে–কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আর একদিনের দরজা দিয়ে নেমে পড়ল রেল লাইনের খোয়র ওপর। সেখান থেকে প্ল্যাটফর্মে উঠে ওভারব্রিজ পেরিয়ে মিশে গেল ভিড়ের মধ্যে।
.
চোদ্দোতলা ফ্ল্যাটবাড়ি; একতলায় মেঝে মুছছিল প্রসাদী। প্রসাদী এ বাড়ির ঝাড়ুদারও বটে, দারোয়ানও বটে। কো-অপারেটিভ হাউসিং স্কিমে তৈরি ফ্ল্যাটবাড়ির সবাইকেই সমান যত্ন করার দায়িত্ব তার।
হলঘরের মোজেক মেঝে মুছছে প্রসাদী। ঘরে আর কেউ নেই। তাই গান ধরেছে গলা ছেড়ে। পুরু লেন্সের সুতো বাঁধা চশমাটা মাঝে মাঝে পিছলে নেমে আসছে নাকের ডগায়। সেই অবস্থাতেই মেরে স্বপ্নেকী রাণীকে ডাকছে তারস্বরে।
আচমকা স্তব্ধ হল রাসভ কণ্ঠ। কারণ, প্রসাদীর অদূরে ভোজবাজীর মতো এসে দাঁড়িয়েছে একটি নারীমূর্তি। আগুনের মতো রূপ তার। অঙ্গ ঘিরে বেনারসীর বাহারে সে-রূপ যেন দাবাগ্নির মতো লেলিহান।
মেয়েটি একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে প্রসাদীর দিকে। মুখে কথাটি নেই। কিন্তু বিশাল দুটি চোখে যেন কিসের অনুনয়।
প্রসাদী তার কর্তব্য করল–কাকে খুঁজছেন?
ব্যারিস্টান বারীন বাগচিকে।
উনি তো এখন থাকেন না। কখন থাকেন?
সন্ধের পর। আর সকালের দিকে।
কামরা নম্বর?
পঁয়তাল্লিশ। দশতলার বি ব্লক।
ফোন আছে?
হ্যাঁ।
কত নম্বর?
নম্বর জানতে বারীন বাগচির চিঠির খুপরির সামনে গেল প্রসাদী। তারপর নম্বর বলতে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখল, মেয়েটি নেই।
.
সেইদিনই সন্ধ্যের পর বারীন বাগচির টেলিফোনে ভেসে এল নারীকণ্ঠ।
আপনি ব্যারিস্টার বাগচি?
দ্যাটস মি।
মেয়েটি আর কোনও জবাব দিল না। রিসিভার রাখার শব্দ ভেসে এল।
ভুরু কুঁচকে সিগার কামড়ে ধরল বারীন বাগচি। ব্যাপারটা যেন কেমনতর। এই মেয়েটিই কি আজ দুপুরে তার খবরাখবর নিয়ে গেছে প্রসাদীর কাছে?
পরের দিন সকালবেলা আবার টেলিফোন ভেসে এল সেই নারীকণ্ঠ।
বারীন বাগচি?
স্পিকিং।
টুকরো হাসি–আপনার সঙ্গে আলাপ করতে চাই।
কেন?
আলাপ হলেই বুঝবেন।
আজকে আসুন। ফ্ল্যাটে একটা টি-পার্টি দিচ্ছি। সন্ধ্যে ৭টা। আলাপ করার উপযুক্ত সময়।
থ্যাকংস। লাইন কেটে গেল।
.
সারাদিন রহস্যময়ীর কথাগুলো পাক খেল বারীন বাগচির ব্যাচেলার মগজে। রোমান্স? মন্দ কি!
সন্ধে নাগাদ ফ্ল্যাটে যখন টি-এর ফাঁকে ফাঁকে দু-চারটে গেলাসের রঙিন পানীয় বিলি হচ্ছে। ঠিক তখনি একটি আশ্চর্য সুন্দরী মেয়ের দিকে বারীনের দৃষ্টি আকর্ষণ করল তার বন্ধু সঞ্চয়।
বলল–বারীন, মেয়েটাকে কখনো দেখেছি বলে তো মনে হচ্ছে না। তোর নতুন বান্ধবী নাকি? সমানে তোর দিকেই তাকিয়ে আছে।
চকিতে তাকাল বারীন। দেখল, দরজার ঠিক পাশটিতে দাঁড়িয়ে যেন মূর্তিমতী প্রদীপশিখা। মানুষ এত রূপবতীও হয়?
মন্ত্রমুগ্ধের মতো পায়ে পায়ে মেয়েটির সামনে গিয়ে দাঁড়াল বারীন। হাতের মদের গ্লাস হাতেই রইল। চোখে চোখ লেগে রইল চুম্বকের মতো।
আপনি?
মেয়েটি হাসল। বারীন দেখল, মোনালিসা যেন মূর্ত হল হাসির মধ্যে।
বারীন বলল–আপনি ফোন করেছিলেন?
জবাব দিল না অপরূপা। বিশাল নয়নের চাহনি ফিরল চওড়া বারান্দার দিকে। বারান্দায় আলো-আঁধারি, জাপানি ফানুস আর ক্যাকটাস।
বুঝল বারীন। পায়ে পায়ে গিয়ে দাঁড়াল ব্যালকনিতে। একপাশে সেই মেয়েটি। আর একপাশে সঞ্জয়।
জাপানি ফানুসের রামধনু-রশ্মির মধ্যে পরীর মতো চেয়ে আছে মেয়েটি।
বারীন বিস্মিত। বিস্মিত সঞ্জয়ও। বিস্ময়ের মাঝেই হাতের গ্লাস ঠোঁটের কাছে তুলেছিল বারীন। কিন্তু ঠোঁটের সঙ্গে পানীয়র মিলন হওয়ার আগেই হাত থেকে গ্লাসটা টেনে নিল মেয়েটি। নিয়ে গেলাস উপুড় করে ধরল পাশের ক্যাকটাসের টবে।
বলল সঞ্জয়কে–চা আনবেন?
সঞ্জয় বেরিয়ে গেল।
মেয়েটি বলল–হ্যাঁ, আমিই ফোন করেছিলাম। আমিই দেখা করতে এসেছিলাম। আমার নাম মণিকা। আমি বড় একা।
বারীন কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
মণিকা কাশ্মিরী শালটা গা থেকে খুলে মেলে ধরল বারান্দার বাইরে। হাওয়ায় বেশ টান। ঝড়ের টান। হাত থেকে শালটা খসে গিয়ে আটকে গেল হাততিনেক দূরে ঝুলন্ত রেডিও এরিয়ালের কঞ্চিতে।
মণিকা বললে–এনে দেবেন? চোখে অনুনয়।
বারীন ব্যালকনির রেলিং টপকে দাঁড়াল সরু কার্নিশের ওপর। অবাক চাহনি তখনো মণিকার বিশাল চোখের ওপর। তারপর এক হাতে রেলিং ধরে ঘুরে দাঁড়িয়ে যেই আর এক হাত বাড়িয়েছে শালের দিকে, অমনি দু-হাতে তাকে প্রচণ্ড ধাক্কা মারল মণিকা।
রেলিং থেকে হাত খসে গেল বারীনের। দশতলার ব্যালকনি কার্নিশ থেকে দেহটা পাকস্লট খেয়ে আছড়ে পড়ল একতলার লনে।
চেঁচিয়েছিল বারীন, কিন্তু কেউ শুনতে পায়নি। ঘরে তখন জাজ মিউজিকের ধুম পড়েছে।
মণিকা এ-দরজা সে-দরজা দিয়ে উধাও হয়ে গেল। কাশ্মীরী শালটা হাওয়ার টানে এরিয়েল থেকে উড়ে গিয়ে ভেসে গেল নীচতলার একটা বাড়ির ছাদে।
চায়ের ট্রে নিয়ে সঞ্জয় এসে দেখল ব্যালকনি শূন্য।
.
দিনকয়েক পরে।
মঘা দত্ত ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে যেতেই রামদাস ঝাড়ন ফেলে আলমারি খুলে বার করল হুইস্কির বোতল। মঘা দত্তর হুইস্কির বোতল। বিপত্নীক মঘার এই এক বদভ্যেস। ফ্ল্যাটে বসে মদ গেলা চাই।
রামদাস তার ফাইফরমাশ খাটে। ঘরদোর সাফ করে। রান্না-বান্নাও করে দেয়। বাবুর দেখাদেখি তারও ইদানীং সখ হয়েছে হুইস্কি গেলার। তাও চুরি করে। মঘা দত্ত বেরিয়ে গেলেই রোজ খাওয়া চাই এক ঢোক। তারপর অবশ্য বেসিন থেকে জল ঢালতে হয় বোতলে। কেননা মঘা ভারি হুঁশিয়ার। হুইস্কির বোতলে রোজ কলম দিয়ে দাগ দিয়ে রাখে। লুকিয়ে-চুরিয়ে রামদাস তবুও হুইস্কি খায়। খেয়ে জল ঢেলে দাগে দাগ মিলিয়ে রাখে।
সেদিনও এক ঢোক গিলল রামদাস। জল মেশালো। বোতলটা আলমারিতে ফিরিয়ে দেওয়ার আগেই দারুণ চমকে উঠল।
খোলা দরজায় দাঁড়িয়ে এক পরমাসুন্দরী। বিশাল চাহনি রামদাসের ওপর।
বোতলটা তাড়াতাড়ি পেছনে লুকালো রামদাস। বলল–কাকে চাই?
মঘা দত্ত।
নেই।
কখন থাকবেন?
সন্ধের পর।
তোমার নাম?
রামদাস।
বাবুর দেখাশোনা করো?
আজ্ঞে।
বাবুর সময় কাটে কী করে?
আজ্ঞে, সিনেমা দেখে, আড্ডা মেরে, বই পড়ে—
খুব সিনেমা দেখেন?
থিয়েটারও।
ও।
আজ্ঞে, বাবু এলে কি বলব?
হাসল মেয়েটি–পেনসিল আছে? কাগজ আছে। আনো, চিঠি লিখব।
বোতল সামলাতে সামলাতে কাগজ-পেনসিল আনতে পাশের ঘরে গেল রামদাস, ফিরে এসে দেখল মেয়েটি নেই।
.
মঘা দত্ত ফ্ল্যাটে ফিরেই লেটারবক্সে একটা খাম পেল। ভেতরে সবুজ কাগজে দু-লাইন চিঠি আর একটা থিয়েটারের বক্স-টিকিট।
সবুজ কাগজে ল্যাভেন্ডারের সৌরভ। চিঠির দু-লাইনে রোমান্সে ইঙ্গিত।
প্রিয়,
আলাপ করতে চাই। আসছেন তো?
মাথা ঝিমঝিম করে উঠল মেঘা দত্তর। এমন সময়ে রামদাস এল। সেই পরমাসুন্দরীর আবির্ভাব-বৃত্তান্ত রসিয়ে রসিয়ে বলল।
মঘা দত্তর স্থাণুর মতো বসে রইল খাটের ওপর।
.
থিয়েটার-হল।
বক্সে ঢুকে মঘা দেখল, কেউ নেই। এদিকে থিয়েটার শুরু হল বলে। তবে কি ঠাট্টা করল কেউ?
থিয়েটার শুরু হল। আস্তে আস্তে কমে এল মঘার ছটফটানি। মন যখন থিয়েটারের মঞ্চে, ঠিক তখনি বক্সের ছায়ামায়ায় এসে দাঁড়াল সেই মেয়েটি। নাম তার মণিকা।
দাঁড়িয়ে রইল অনেকক্ষণ। অনিমেষে চেয়ে রইল মঘার পানে। ভাবলেশহীন চাহনি। তারপর এসে বসল পাশে।
মঘা যেন আইসক্রিমের মতোই গলে গেল। মেয়েটা চেয়ে আছে মঞ্চের দিকে। নিশ্চল তনু।
বলল–আমার নাম মণিকা।
অঃ।
আপনার সঙ্গে অনেক কথা আছে।
অ্যাঁ।
এখানে বলব না।
হোটেলে?
না, আপনার বাড়িতে।
তাই নাকি? এ যে আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়া। কবে?
কাল। আর কেউ থাকুক আমি চাই না। একটু থেমে, শুধু আপনি আর আমি।
মঘার যেটুকু বাকি ছিল, এবার তাও গেল।
.
মঘা দত্তর ফ্ল্যাটের ধুলো ঝেড়েছে মঘা। সাজিয়েছে। রজনীগন্ধার স্টিক আর বেল-জুইয়ের গন্ধে ঘরে কেমন ফুলশয্যার আমেজ এনেছে।
মঘা নিজেও সেজেছে। বুকে খুশির তুফান।
তুফান ছুটে যেত যদি সেইমুহূর্তে মঘা দত্তর তৃতীয় নয়ন খুলে যেত। এবং সেই তৃতীয় নয়নে ভেসে উঠত সেই শহরেরই একটি দামি হোটেলের কক্ষ।
দেখা যেত, খাটের ওপর একটা গোটা হুইস্কির বোতল নিয়ে বসে মণিকা। এক হাতে একটা ইঞ্জেকশন দেবার সিরিঞ্জ। সিরিঞ্জভর্তি সাদা আরক। চুঁচটা ছিপি ফুঁড়ে বোতলের ভেতর ঢুকিয়ে দিল মণিকা। সাদা আরকটা মিশিয়ে দিল হুইস্কির সঙ্গে।
মঘার ফ্ল্যাটে মণিকা এল ব্যাগের মধ্যে আরকমিশানো বোতল নিয়ে। মঘার প্রথম উচ্ছ্বাস কমতেই ভিজে গলায় বলল–আমি জানি আপনি কী ভালোবাসেন।
কী?
হুইস্কি।
মঘা কাষ্ঠহাসি হাসল।
মণিকা বলল–হুইস্কি আমি খাই না। ভারমুথ ছাড়া কিছু ছুঁই না। কিন্তু আপনি যা ভালোবাসেন তাই দিয়েই শুরু হোক আমাদের প্রথম পরিচয়। ব্যাগ থেকে বেরুলো হুইস্কির বোতল। বিলিতি স্কচ। একশো টাকা এক বোতল। নিন, দু-গেলাস ঢালুন।
মঘার চোখ শামুকের চোখের মতো উদ্ধত হল। মাথায় টাইফুনের ছোঁয়া লাগল। ত্বরিতপদে উঠে গেল বোতল হাতে। ফটাৎ করে খুলল ছিপি। পর দু-গ্লাস খাঁটি (!) স্কচ ঢেলে সোডা পাঞ্চ করে রাখল মণিকার সামনে।
মণিকা আকাঁপা আঙুলে একটা গ্লাস তুলে নিল। আকাঁপা চোখে মঘার পানে চাইল। গ্লাসে গ্লাস ঠেকিয়ে বলল–চিয়ার্স।
গ্লাস শূন্য করে দিল মঘা। মণিকা গ্লাস হাতে রাখল। বলল–আর এক গ্লাস খান। তারপর কথা।
মঘা উঠে গেল গ্লাস ভরতে। সঙ্গে-সঙ্গে রজনীগন্ধার ফুলদানীতে হাতের গ্লাস উপুড় করে ধরল মণিকা।
মঘা ফিরে এসে দেখল শূন্য গ্লাস কোলে নিয়ে বসে মণিকা। বিলোল আঁখিতে কালো ইশারা।
পুরো গ্লাসটা এক ঢোকেই শেষ করল মঘা। মাথার মধ্যে মৃত্যুর ঐক্যতান শুরু হল সেই মুহূর্ত থেকে।
প্রথমে মঘা বোঝেনি। মনে হয়েছিল স্কচের নেশা। তারপর মাথার খোঁচা যখন চোখেও এসে পৌঁছোল, তখন ভাবল জবর স্কচ তো! দু-পেগেই এফেক্ট! তারপর চোখ ঘোলাটে হয়ে এল। বিশ্বসংসার ঝাপসা হয়ে এল। মেঝের ওপর সটান আছড়ে পড়ল মঘা।
মণিকা উঠে দাঁড়াল। মঘার দিকে তাকালো না। গেলাসদুটো নিয়ে বেসিনে ধুয়ে তুলে রাখল। আরকমিশানো হুইস্কির বোতল বেসিনে উপুড় করে ঢেলে দিল। খালি বোতলটা রাখল ব্যাগের মধ্যে।
মঘা তখন পুঁকছে। একটা চেয়ার টেনে নিয়ে পাশে বসল মণিকা। চেয়ে চেয়ে দেখল, মঘা মরছে; ভয়ানক কষ্ট পাচ্ছে।
বলল–শুনতে পাচ্ছেন?
কাতরে উঠল মঘা।
মণিকা বলল–স্কচে আমি বিষ মিশিয়ে আপনাকে খাইয়েছি। এখুনি মরবেন। আর দেরি নেই। মরবার আগে নিশ্চয় জানতে ইচ্ছে করছে, কেন আপনাকে মারলাম। তাই বলছি। শুনুন, কেন-র উত্তর একবছর আগে একটা শিবমন্দিরের সামনে রয়েছে। নতুন বউ নিয়ে শিবকে প্রণাম করতে গিয়েছিল একজন। মন্দির থেকে বেরোতে না বেরোতেই বিধবা হয়েছিল কনে বউ।
এই পর্যন্ত বলে থামল মণিকা। শোনবার মতো কেউ আর ছিল না ঘরে।
অনেক রাতে রামদাস এসে দেখেছিল মেঝের ওপর মরে কাঠ হয়ে শুয়ে তার বাবু।
.
অন্য একটি শহরতলী।
স্কুল। সবে ছুটি হয়েছে। বাচ্চা মেয়েটার হাত ধরে তার মা রওনা হয়েছে বাড়ির দিকে। মেয়েটি বার বার ফিরে তাকাচ্ছে পেছনে।
কোয়ার্টার এসে গেছে। সামনে খানিকটা সবুজ লন। তারপর দোতলা বাড়ি। হালফ্যাসানি। বোগানভালিয়ার থোকা আর রংবেরঙের ফুল দিয়ে সাজানো চত্বর।
ফটক দিয়ে ঢোকবার সময়ে আবার পেছন ফিরে তাকালো মেয়েটি। স্কুলের উষাদির মতো দেখতে মেয়েটা এখনো আসছে। বেশ দেখতে।
ফটকের সামনে এসে দাঁড়ালো পিছু নেওয়া মেয়েটি; নাম তার মণিকা।
বেশিক্ষণ দাঁড়াতে হল না। খেলতে বেরিয়েছে বাচ্চা মেয়েটি। রঙিন প্লাস্টিকের বল নিয়ে ছুটোছুটি করছে সবুজ লনে। একবার ফটক দিয়ে রাস্তায় ঠিকরে গেল বলটা। ধরে ফেলল মণিকা। হাসিমুখে তাকিয়ে রইল বাচ্চা মেয়েটির দিকে। কাছে ডাকল হাত নেড়ে।
ভয় পেল না ছোট্ট মেয়েটি। স্কুলের উষাদির মতোই তো দেখতে। কী সুন্দর হাসি। স্কুল থেকেই তো পেছন পেছন এসেছে।
কাছে গেল মেয়েটা। মণিকা বলটা ফিরিয়ে দিয়ে বলল–কী নাম তোমার?
ঝুমি।
বাঃ, কী সুন্দর নাম। আমার নাম উষাদি তোমাদের স্কুলে পড়াই।
তোমার নামও উষাদি?
হ্যাঁ গো। তোমার মায়ের নাম কী? শ্রীমতী বনমালা লাহিড়ী। সাবাস। তোমার মামার বাড়ি কোথায়?
অনেকদূর।
কোথায়?
আগরতলায়।
তোমার মামা আছেন?
হ্যাঁ।
আগরতলায় থাকেন?
হ্যাঁ।
কী নাম জানো?
পন্টু মামা।
দাদু আছেন?
হ্যাঁ।
আগরতলায় থাকেন?
হ্যাঁ।
এইসময়ে দোতলার জানলা দিয়ে ডাক দিল ঝুমির মা–ঝুমি, ভেতরে এসো। বল নিয়ে এক দৌড়ে ভেতরে চলে গেল ঝুমি।
.
মণিকা প্লেনে আগরতলা গেল। সেখান থেকে একটা টেলিগ্রাম পাঠালো ঝুমির মা শ্রীমতী বনমালা লাহিড়ীকে।
টেলিগ্রাম হাতে পেয়ে শ্রীমতী বনমালা লাহিড়ী দেখল, ভাই লিখছে বাবার শেষ অবস্থা; এখুনি না এলেই নয়।
কাজেই পরের প্লেনেই আগরতলা রওনা হল ঝুমির মা। ঝুমির বাবার কাছে রেখে গেল ঝুমিকে। ঘরসংসার দেখার জন্যে ঠিকে ঝি, রাঁধুনি তো আছেই। কোনও অসুবিধে হবে না। ঝুমির বাবা অফিস গেলে ঠিকে ঝি-ই সারাদিন বাড়ি আগলাবে-খন।
সেইদিন রাত্রে ঝড় উঠল। দরজার কড়া নড়ল। ঝুমির বাবা ঝুমিকে নিয়ে একতলায় বসেছিল। উঠে এসে দরজা খুলে দিল।
মণিকা ভেতরে ঢুকল। হাওয়ায় উড়ছে ওর কপালের চুল। বুকের আঁচল। ঝুমির বাবা শান্তনু লাহিড়ী বিস্মিত হলেন অপরূপ মহিলার সহজ আচরণে।
মণিকা বলল–ঝুমি কই?
ওই তো।
স্বচ্ছন্দ পায়ে ঝুমির পাশে গিয়ে বসে পড়ল মণিকা। বলল–আমি ঝুমিদের উষাদি। ওদের স্কুলে পড়াই। তাই না ঝুমি? ঝুমি ঘাড় নেড়ে সায় দিল। এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম। ভাবলাম, যাই দেখে যাই।
শান্তনু লাহিড়ী বললে–ভালোই করেছেন। ওর মা গেল বাপের বাড়ি। একা আমি সামলাতে পারছিলাম না।
হেসে উঠল মণিকা-খাওয়া হয়েছে?
না। কিন্তু–
মণিকা ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে–কোনও কথা নয়। আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। খাইয়ে-দাইয়ে ঝুমিকে ঘুম পাড়িয়ে বাড়ি যাব-খন। একটু থেমে মোনালিসা হাসি হেসে–এ কাজ আমি ভালোবাসি।
শান্তনু লাহিড়ী অপ্রস্তুত হলেন। খানিকটা স্বস্তির নিঃশ্বাসও ফেললেন।
রান্নাবান্না করাই ছিল। এটা-সেটা গল্প করতে করতে গ্যাসের উনুনে সব গরম করে নিল মণিকা। এর ফাঁকে পাঁউরুটি কাটা বড় ছরি নিয়ে দরজার পাশের টেলিফোনের তারটা কেটে রাখল। বাপবেটিকে খাওয়াল। নিজে কিছু দাঁতে কাটল না। ঝুমিকে ভুলিয়ে ভালিয়ে দোতলায় নিয়ে গিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিল। নীচে নেমে এসে দেখল হলঘরের টেবিলে তখনও বসে শান্তনু লাহিড়ী। মুখে পাইপ। চোখে বিস্ময়।
চলে যাচ্ছেন?
হ্যাঁ। আমার কাজ ফুরিয়েছে।
নিস্তব্ধ রাত। বাইরে ঝিঁঝি ডাকছে। শান্তনু লাহিড়ীর রক্তে দোলা লাগল মণিকার বিশাল চোখজোড়ার আয়ত চাহনি দেখে।
পাইপ সরিয়ে শুধু বলল–আপনার মতো মেয়ে আমি দেখিনি।
তাই নাকি? বলে মণিকা হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে শান্তনু লাহিড়ীর পেছনে গেল। ব্যাগ থেকে ছোট্ট পিস্তল বার করল। নলচেটী মুঠোয় ধরে কুঁদো দিয়ে ব্রহ্মতালুতে খুব জোরে চোট মারল। অজ্ঞান হয়ে গেল শান্তনু লাহিড়ী।
ব্যাগ থেকে নাইলন দড়ি বার করল মণিকা। পিছমোড়া করে বাঁধল শান্তনুকে। মুখের মধ্যে বেশ খানিকটা তুলো ঠেসে দিল। তারপর চওড়া স্টিকিং প্লাস্টারের পটি দিয়ে মুখ আটকে দিল।
টানতে টানতে শান্তনুকে নিয়ে এল ছোট্ট রান্নাঘরে। স্টিকিং প্লাস্টারের পটি দিয়ে প্রতিটি বন্ধ জানলার ফাঁক বন্ধ করল। তারপর একটা টুল নিয়ে বসল শান্তনুর পাশে। ব্যাগ থেকে স্মেলিং সল্টের শিশি নিয়ে ধরল নাকের কাছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝাঁঝালো গন্ধে জ্ঞান ফিরে এল শান্তনু লাহিড়ীর। চেঁচাতে পারল না–মুখ বন্ধ। হাত-পা নাড়তে পারল না–দড়ি দিয়ে বাঁধা।
মণিকা বলল–একটু পরেই মারা যাবেন আপনি। আমার নাম উষা নয়। আমি ঝুমির স্কুলে পড়াই না। মিথ্যে টেলিগ্রাম করে আমিই সরিয়েছি ঝুমির মাকে আপনাকে নিজের হাতে মারব বলে। কেন জানেন? একবছর আগে একটা শিবমন্দিরের সামনে একজন গুলি খেয়ে মরেছিল। মনে আছে? নতুন বর। আমি তার নতুন বউ। বিধবা।
শান্তনু লাহিড়ীর চোখের সামনে ভেসে উঠল সেই দৃশ্য। তিনতলা বাড়ির চিলেকোঠায় বসে ওরা তাসের জুয়ো খেলছিল। মেসবাড়ি। জুয়োর সঙ্গে মদের ব্যবস্থাও রয়েছে। আর রয়েছে শান্তনুর দোনলা বন্দুকটা। ফাঁড়িতে দেখতে চেয়েছিল বন্দুকের চেহারা। নইলে নাকি লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাবে। তাই বন্দুক নিয়ে আসা। ফড়ির কাজ শেষ। এখন বন্ধু-বান্ধব নিয়ে একটু ফুর্তিতে মত্ত।
চিলেকোঠায় ওরা পাঁচজন ছিল। বারীন, মঘা, শান্তনু, ভৈরব আর কালিদাস। পাঁচজনের কর্মস্থল পাঁচদিকে। দৈবাৎ পাঁচ বন্ধু মিলেছে। তাই এই ফুর্তির আয়োজন।
কে জানত ফুর্তির শেষে এ-ট্র্যাজেডি থাকবে। কেননা, একদান খেলে উঠে জানলায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ভৈরব। হাতে ছিল শান্তনুর দোনলা বন্দুক। নিছক খেয়ালবশেই তাগ করছিল রাস্তার ও পাশে শিবমন্দিরের চুড়োর ত্রিশূলটা। খেলাচ্ছলেই মন্দির দিকে নজর রেখে নলচে নামিয়ে আনছিল চুড়ো বরাবর নীচের দিকে। ত্রিশূলের পর গম্বুজের পলস্তারা। তারপর মন্দিরের চত্বর। ঠিক এই সময়ে মন্দির থেকে বেরিয়ে এসেছিল নবপরিণী একটি দম্পতি। ভৈরবের নলচের সামনেই এসে পড়ল নতুন ব্রিটি। মাছির সঙ্গে একরেখায় যখন বরের হৃৎপিণ্ড, ঠিক তখুনি শান্তনুর চোখে পড়েছিল জানলায় বন্দুক বাগিয়ে কাকে যেন তাগ করছে ভৈরব। সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠে দৌড়ে গিয়েছিল শান্তনু। কেননা সে ছাড়া আর কেউ জানত না বন্দুকে গুলিভরা আছে।
আচমকা শান্তনুর চেঁচানিতে এবং তারপরেই শান্তনুর হেঁচকা টানেতে চমকে গিয়েছিল ভৈরব। এমনই বরাত, সঙ্গে সঙ্গে গুলি বেরিয়ে গিয়েছিল বন্দুক থেকে। এফেঁড়-ওফোঁড় করে দিয়েছিল নতুন বরের হৃৎপিণ্ড।
ওরা আর দাঁড়ায়নি। ফুর্তির ট্র্যাজেডি মাথায় নিয়ে চো-চাঁ চম্পট দিয়েছিল পাঁচ বন্ধু। কে মারা গেল, তা নিয়ে আর মাথা ঘামায়নি।
মণিকার চোখে জল। বলছিল–আমারও স্বপ্ন ছিল, সংসার করব। এ স্বপ্ন হঠাৎ দেখিনি। ছেলেবেলায় কল্প ছিল আমার খেলার সাথী। সেই কল্প বড় হল। কিশোর হল। তরুণ হল। আমি কিশোরী হলাম। তরুণী হলাম। মন দেওয়ার পালাও গড়ে উঠেছে ধাপে ধাপে। স্বপ্নও দেখেছি তিল তিল করে। সে স্বপ্ন মুহূর্তের মধ্যে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছেন আপনারা–আপনারা পাঁচ বন্ধুতে। কল্প মারা গেল। আমি বেঁচে মরে রইলাম শুধু প্রতিহিংসার জন্যে। এক বছরে অনেক টাকা খরচ করেছি, অনেক কাঠখড় পুড়িয়েছি। তবে বার করেছি আপনাদের পাঁচজনের নাম আর ধাম। বারীন আর মঘা কল্পর কাছে পৌঁছে গেছে। আপনি এখুনি যাবেন। ভৈরব আর কালিদাসও যাবে কয়েকদিনের মধ্যে।
বলে, মণিকা উঠে দাঁড়াল। গ্যাসের চাবি পুরো খুলে দিল। বাইরে এসে বন্ধ করল পাল্লাদুটো। স্টিকিং প্লাস্টারের পটি দিয়ে টিপে টিপে বন্ধ করল পাল্লার ফাঁক।
যথাসময়ে পুলিশ এসেছিল। ঝুমি বার বার বলেছিল, উষাদি এসেছিল স্কুল থেকে। তারপর বাবা মরে গেছে।
পুলিশ স্কুলে গিয়ে উষাদিকে গ্রেপ্তার করেছিল। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই ফোন এল ফাঁড়িতে। একটা নারীকণ্ঠ বললে–উষা দেবী নির্দোষ। ওঁর নাম নিয়ে আমিই খুন করেছি শান্তনু লাহিড়ীকে।
.
পেট্রল পাম্পের পাবলিক ফোন থেকে থানায় ফোন করেছিল মণিকা। রিসিভার রেখেই দৌড়ে এসে উঠেছিল গাঢ় রক্ত-রঙের ক্যাডিলাক গাড়িটায়। ড্রাইভ করেছিল নিজেই। ঘণ্টাতিনেক একটানা গাড়ি চালিয়ে পৌঁছেছিল একটা মোটর মেরামতি কারখানায়। জি. টি. রোডের ওপর গাড়ি দাঁড় করিয়ে হেঁটে হেঁটে পৌঁছেছিল গ্যারেজে।
বেশ বড় কারখানা। ভাঙা-আধভাঙা গাড়ি দাঁড় করানো এলোমেলোভাবে। এঁকেবেঁকে আপিসের দিকে এগুলো মণিকা। তেলকালিমাখা একজন মেক্যানিককে বললে ভৈরবকে ডেকে দিতে।
মণিকা দাঁড়িয়ে রইল। জায়গাটা বেশ নির্জন। মাথার ওপর কাক উড়ছে। আশেপাশে মানুষ নেই। ভাঙা গাড়ির ভিড়ে মণিকাকে দেখা যাচ্ছে না।
মণিকা হ্যান্ডব্যাগ খুলে ক্ষুদে পিস্তলটা বার করল। তুষার শুভ্র ওড়না দিয়ে ঢেকে রাখল ডান হাত আর হাতে ধরা পিস্তল।
নলচে ফেরানো রইল আপিসের দিকে। ওই পথেই আসবে ভৈরব। ওই তো আসছে। মাথাজোড়া টাক। গাট্টাগোট্টা চেহারা। এ কারখানার মালিক। একাই আসছে।
মণিকা পিস্তল তাগ করল। ট্রিগার টিপতে যাবে–
এমন সময়ে ভৈরবের পেছনে একটা সোরগোল শোনা গেল। পাহাড়প্রমাণ লোহালক্করের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর, দুজন কনস্টেবল এবং একজন তেলচুকচুকে ভদ্রলোক। চেঁচাচ্ছেন ভদ্রলোক–ওই যে…ওই দেখুন…জোচ্চের কোথাকার…অ্যারেস্ট করুন… মেরামতের নাম করে আমার গাড়ি নিয়ে ভাড়া খাটাচ্ছে একবছর ধরে…গাড়ি দিচ্ছে না…চোর… গুন্ডা..বদমাশ…
মণিকা থমকে গেল। ভৈরব ঘুরে দাঁড়িয়েছে। কনস্টেবল দুজন এসে দাঁড়িয়েছে দুপাশে তারপর পুরো দলটা এগিয়ে চলল বড় রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশভ্যানের দিকে।
মণিকা আর দাঁড়াল না। ফিরে এল ক্যাডিলাকে। সিটে বসে হ্যান্ডব্যাগ থেকে বার করল একটা কাগজ। তাতে লেখা এই কটি নাম :
বারীন
মঘা
শান্তনু
ভৈরব
কালিদাস
বারীন, মঘা আর শান্তনুর নাম তিনটে পেনসিল দিয়ে কাটা। মণিকা জিজ্ঞাসা চিহ্ন বসালো ভৈরব-এর নামের পাশে।
সত্যিই তো! ভৈরব যে এখন হাজতে!
কালিদাস রায় চিত্রশিল্পী। জীবনধর্মী চিত্রাঙ্কনে পারদর্শী। তাই তার নিভৃত স্টুডিওতে মডেলের আনাগোনা চলে সকাল সন্ধ্যায়।
কালিদাস রায় ব্যাচেলার। সুপুরুষ। ধনী। তাই তার মক্কেল হতে রাজি হয় এমন অনেক কন্যা যাদের রূপ আছে, হয়তো রূপাও আছে।
কাজেই সেদিন সন্ধ্যায় কলিংবেল টিপে যে মেয়েটি কালিদাসের স্টুডিওতে পা দিল, তার প্রস্তাব শুনে বিস্মিত হল না কালিদাস। মেয়েটি কাজ চায়। মডেল হতে চায়। ফি খুব কম। ঘন্টায় পাঁচ টাকা।
কালিদাস আপাদমস্তক দেখল মেয়েটির। দেখে রাজি হল। কারণ, এ মেয়ে কেবল রূপসী নয়, রূপকে কীভাবে মেলে ধরতে হয়, তা জানে। উৎসাহের বশে কালিদাস সঙ্গে সঙ্গে তাকে সিটিং দিল। ইজেলে কাগজ আটকে পেনসিলের লম্বা লম্বা টানে ফুটিয়ে তুলল অপরূপার রূপরেখা।
মোহিনী হেসে বিদায় নিল মেয়েটি। নাম তার মণিকা। বলে গেল সে আবার আসবে। কাল সন্ধ্যায় সে হবে ব্যাধের বউ। কালিদাসের ইচ্ছে তাই।
নীচে নেমে এল মণিকা। চাতাল ঘুরে যেই লন পেরোতে যাচ্ছে, এমন সময়ে পাশ দিয়ে হন হন করে বেরিয়ে গেল একটি মূর্তি।
পুরুষ মূর্তি। এক পলকেই মণিকা তাকে চিনেছিল। তাই আর পেছনে না ফিরে সিধে ফটক পেরিয়ে পড়েছিল রাস্তায়।
পুরুষটিও থমকে দাঁড়িয়েছিল। পেছন ফিরে তাকিয়েছিল অপসৃয়মান তন্বীর দিকে। সন্দিগ্ধ চোখে। মেয়েটাকে এত চেনা চেনা ঠেকছে কেন?
সেই মুহূর্তে মনে পড়েনি। পড়লে অনেকগুলি বন্ধুকৃত্য একসাথেই সারতে পারত। কেননা, যুবা পুরুষের নাম সঞ্জয়। বারীন বাগচির বন্ধু। যে বারীন এই সেদিন নিহত হয়েছে, মণিকার হাতে।
এই সঞ্জয়কে দিয়েই চা আনতে পাঠিয়েছিল মণিকা বারীনের মদের গেলাস ক্যাকটাসের টবে উপুড় করে দিয়ে।
.
পরের দিন সন্ধ্যায় কালিদাসের ফ্ল্যাটে এল মণিকা। একটিমাত্র বাঘের চামড়া পাতলা কোমর জড়িয়ে বুকের ওপর দিয়ে ঝুলে রইল কাঁধের ওপর। আর এক কাঁধে তিরভরা তূণ। হাতে ধনুক। ছিলায় তির। ছিলা টান করে ধরা কান পর্যন্ত।
এই পোজে বিভিন্ন কোণ ধরে অনেকগুলি স্কেচ আঁকলো কালিদাস। প্রতিটি স্কেচের মধ্যেই অনুভব করল কামনার স্বাদ। মেয়েটার অনাবৃত কাঁধ, উরু এবং পিঠ ওকে টানতে লাগল চুম্বকের মতো। পাগলের মতো পরের পর স্কেচ এঁকে চলল ও। ক্লান্তি নেই ওর পেনসিল টানার। ক্লান্তি নেই মণিকার অঙ্গেও। সুবর্ণ সুযোগ হেলায় হারানো চলবে না।
এবার ফ্রন্ট পোজে দাঁড়াল মণিকা। তিরের মুখ সিধে ফেরানো কালিদাসের দিকে। কালিদাসের চোখ পর্যায়ক্রমে ঘুরছে ইজেল আর মণিকার ওপর।
এমন সময় সাঁই করে কালিদাসের পাঁজর ছুঁয়ে তির বেরিয়ে গেল–খটাং করে আটকে গেল ওদিকের দেওয়ালে টাঙানো ছবির ফ্রেমে।
ভীষণ চমকে উঠেছিল কালিদাস। আর মণিকা কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়েছিল পাশের টুলের ওপর–আর পারছি না…বড় হাত-পা কাঁপছে।
তবে থাক, সামলে নিয়ে বলল কালিদাস। কাল হবে-খন।
না। ফ্যাকাসে মুখ মণিকার। আজকের মুড কালকে নাও থাকতে পারে। যত রাতই হোক, ছবি শেষ করুন। একটু ব্রান্ডি দেবেন?
একটু কেন, বেশি করেই ব্র্যান্ডি ঢালল কালিদাস। নিজের রক্তেও আগুন ছোটালো ব্র্যান্ডির প্রসাদে। মণিকাকে দুটো আদরের কথা বলার চেষ্টাও করেছিল। কিন্তু তার আগেই একটা কাণ্ড ঘটল।
জানলার সামনে দাঁড়িয়েছিল মণিকা। দেখল, একতলার লন পেরিয়ে সঞ্জয় আসছে। আসছে কালিদাসের ফ্ল্যাটেই।
মণিকা বলল–আমি যে এখানে আছি, তা আপনার কোনো বন্ধু-বান্ধবকে জানাতে চাই না। আপনার হেল্প চাই।
একশোবার।
আমি বাথরুমে যাচ্ছি। আপনার বন্ধুটি চলে গেলে আমাকে ডাকবেন।
যথাসময়ে সঞ্জয় এল। ইজেল আঁকা মণিকার ছবি দেখে ভুরু কুঁচকে ভাবল অনেকক্ষণ। গত সন্ধ্যায় ছবিটায় রং চড়িয়েছিল কালিদাস। মণিকা যেন মূর্ত হয়ে উঠেছিল সে ছবিতে। এ ছবিটাও চিনি-চিনি মনে হল সঞ্জয়ের। কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ল না প্রথম দেখার ঘটনাটা।
ইচ্ছে ছিল কালিদাসের সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা মারার। কিন্তু কালিদাস যেন তাকে তাড়াতে পারলেই বাঁচে, এমনি ভাব দেখালো। বিস্মিত হল সঞ্জয়। হয়তো ইজেলের ছবিটা নিয়েই ব্যস্ত শিল্পীবন্ধু, এই ভেবেই আর দাঁড়ালো না সঞ্জয়। মডেলের মেয়েটি কে, এ প্রশ্ন বলি-বলি করেও বলতে পারল না কালিদাসের ঠোঁটে চাবি-দেওয়া ভাব দেখে।
ভাবিত মনে বাড়ি ফিরল সঞ্জয়। মেয়েটা কে? কার ছবি আঁকছে কালিদাস? কেন এত চেনা-চেনা লাগছে ছবিটা? একেই তো গতকাল সন্ধ্যায় কালিদাসের বাড়ি থেকে বেরোতে দেখা গিয়েছিল? চোখে চোখ পড়েছিল, মেয়েটি চোখ ফিরিয়ে নিয়ে পাশ কাটিয়ে গিয়েছিল–আর ফিরেও তাকায়নি। কিন্তু সঞ্জয়ের কেন জানি মনে হয়েছিল, ফিরে তাকায়নি পাছে সঞ্জয় তাকে চিনে ফেলে তাই। ধরা দিতে চায় না মেয়েটা। কিন্তু কেন? কালিদাস এত রাতে তার ছবি আঁকছে তন্ময় হয়ে কেন? স্কেচ দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে মডেলের ছবি। তার মানে, মডেল ঘরের মধ্যেই ছিল। সঞ্জয়কে দেখেই লুকিয়েছে। অথবা কালিদাস লুকিয়ে রেখেছে। কেন এই লুকোচুরি? কে এই রহস্যময়ী? কার প্রভাবে কালিদাসের মতো প্রিয় বন্ধুও এত দূরে সরে যেতে পারে?
ভাবতে ভাবতে মাথা গরম হয়ে গেল সঞ্জয়ের। গলাও শুকিয়ে কাঠ। তাই কুঁজো থেকে গেলাসে জল গড়িয়ে গলায় ঢালল। ঢেলে, গেলাসের তলানিটা অভ্যেসমতো উপুড় করে ধরল পাশে রাখা ক্যাকটাসের টবে।
উপুড় করেই থমকে গেল। স্মৃতির বিদ্যুৎ ঝলসে উঠেছে মাথার মধ্যে। আবার গেলাসটা উপুড় করল সঞ্জয়। আবার! আবার!
এবার মনে পড়েছে। ঠিক এমনি করেই ক্যাকটাসের টবে মদের গেলাস উপুড় করে ধরেছিল অজানা এক সুন্দরী, বারীন বাগচির ফ্ল্যাটে। দিয়ে সঞ্জয়কে বলেছিল চা আনতে। সঞ্জয় চা নিয়ে ফিরে এসে দেখেছিল বারান্দা শূন্য। বহু নীচে পড়ে রক্তাক্ত একটা মাংসপিণ্ড–বারীন বাগচি!
আকাশের বিজলী মানবীরূপে দেখা দিলে যে রূপ হয়, মেয়েটির অঙ্গে সেই রূপ দেখেছিল সঞ্জয়। তাই ভোলা যায়নি। কালিদাস এই মেয়েরই ছবি আঁকছে তন্ময় হয়ে। অন্য ছাঁদে চুল বাঁধার জন্যে চিনি-চিনি করে চিনতে পারেনি সঞ্জয়।
বারীন বাগচির রহস্যজনক আত্মহত্যার (?) পূর্ব মুহূর্তে যে মোহিনীকে দেখা গিয়েছিল–এই সেই কন্যা। বারীনের মৃত্যুর কারণ সে, হয়তো বা হত্যাকারিণীও। কিন্তু কালিদাসের সঙ্গে জুটল কেন মেয়েটা? এত গোপনীয়তাই বা কেন?
হঠাৎ একটা কুৎসিত চিন্তা হুল ফোঁটালো সঞ্জয়ের মগজে। ছিটকে গিয়ে রিসিভার তুলল ও। ডায়াল করল কালিদাসের নাম্বার। কিন্তু ফোন বেজেই গেল। কেউ ধরল না।
কালিদাস কি ঘুমোচ্ছে?
সঞ্জয়ের মাথায় সেই কুৎসিত চিন্তাটা তখনো সমানে হুল ফুটিয়ে চলেছে। কাজেই কিছুক্ষণের মধ্যেই অত রাতেও তাকে দেখা গেল কালিদাসের ফ্ল্যাটের সামনে।
দরজা ভেজানো ছিল। ভেতরে আলো জ্বলছিল। ইজেলের পায়ার কাছে মুখ থুবড়ে পড়েছিল কালিদাস।
একটা তির পিঠের মধ্যে ঢুকে আধখানা বেরিয়েছিল বুক দিয়ে।
পরের দিন।
জেলখানার সামনে এসে ব্রক কষল একটা রক্তরক্তের ক্যাডিলাক। নেমে দাঁড়াল পরমাসুন্দরী একটি তরুণী।
জেল সুপার অবাক হলেন তরুণীকে দেখে। মেয়েটি নাকি ভৈরব সাহার সহোদরা। দাদা হাজতবাস করছে শুনে দেখা করতে এসেছে।
সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র। জেলখানার নিয়মকানুন ছার সে মুখের কাছে। কাজেই অচিরেই গরাদের এপাশে এসে দাঁড়াল মণিকা। ওপাশে ভৈরব।
চোখে চোখ রেখে মণিকা বলল–চিনতে পারছেন?
না।
আপনাকে মুক্তি দিতে এসেছি।
বলে, আঁচল ঢাকা পিস্তল থেকে পর পর তিনবার গুলি করল মণিকা। ভৈরব মুক্তি পেল ধরাধাম থেকে।
সেই সঙ্গে মণিকাও। চতুর্থ গুলিটা দিয়ে নিজের মগজ ফুটো করে দিয়ে সে রওনা হল পরপারে স্বামীর কাছে।
* রহস্য পত্রিকায় প্রকাশিত। শারদীয় সংখ্যা, ১৩৭৮
কাঞ্চনপুর-রহস্য
হত্যা সম্বন্ধে সাধারণের আগ্রহ প্রায়ই দেখা যায় ভ্রমাত্মক অথবা আমার মতে, ভ্রান্তির সম্ভাবনা বিশিষ্ট। উদাহরণ স্বরূপ সেই সামন্তঘটিত কাহিনিটাই ধরা যাক। সতের বছর আগে ঘটনাটা ঘটেছিল এবং এখনও সে ঘটনা প্রত্যেকের কাছে যেন গতদিনের স্মৃতি–এখনও জনসাধারণ সে কাহিনি নিয়ে গভীর আগ্রহে আলোচনা করে। তবুও যে-কোন দিক দিয়ে বিচার করাই যাক না কেন, কোনও মতেই এটাকে প্রথম শ্রেণির হত্যাপর্যায়ে ফেলা যায় না। ব্যাপারটা ঘটেছিল এই রকম?
ইন্ডিয়ান কেমিক্যালস কোম্পানির স্বত্ত্বাধিকারী মিঃ কে. ডি. সামন্ত জীবন-সঙ্গিনীরূপে পেয়েছিলেন একজন অতি খিটখিটে এবং বদমেজাজী মহিলাকে। কাজেই তাঁর অন্তরের যে গভীর অনুরাগ স্ত্রীর প্রাপ্য ছিল–সেই অনুরাগের সবটুকুই দিলেন তার সুন্দরী টাইপিস্ট মিস সান্যালকে। আর তারপর তিনি মিসেস সামন্তকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করলেন এবং দেহটিকে খণ্ড খণ্ড করে কেটে কয়লার গাদার নীচে সমাধিস্ত করলেন। প্রাথমিক হলেও এই অবধি ব্যাপারটা করলেন তিনি সুন্দরভাবে; আর এরপর যদি মূর্খ মিস্টার সামন্ত আর কুটোটি না নেড়ে চুপচাপ থাকতেন, তাহলে সুখেই সারা জীবনটা কাটিয়ে ইহলোক ত্যাগ করতেন। কিন্তু কিসের তাগিদে জানি না নির্বোধের মতো তিনি বাড়ি থেকে উধাও হলেন–প্রেমিকার সঙ্গে ছদ্মবেশে সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ যাত্রা করলেন। এই কাজটি যদি তিনি না করতেন, তাহলে আমি বিনা দ্বিধায় এই হত্যাটিকে অতুলনীয় আখ্যা দিতে বিলম্ব করতাম না। পরিণামে কি হল? বেতারের সুযোগ নিয়ে ভারতীয় পুলিশ তাকে জাহাজেই গ্রেপ্তার করলে। এই হত্যা-ঘটিত বিষয়ে এইটুকুই হল সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক–কিন্তু জনসাধারণ এখনও পর্যন্ত এই অপ্রাসঙ্গিকটুকু নিয়েই করছে মাতামাতি। একজন বিখ্যাত চিত্রসমালোচক যখন কোনও চিত্র সম্বন্ধে একটি প্রথম শ্রেণির সমালোচনা করেন, তখন অল্পজনেই তা পড়ে। কিন্তু যেই কোনও সবজান্তা সংবাদদাতা খবর দেয় যে চিত্রশিল্পী ক্যানভাস সাজানোর সময়ে শেক্সপীয়ারের সনেট আবৃত্তি করতে থাকেন অথবা একাহারী হয়ে এই সব বিখ্যাত চিত্র সৃষ্টি করেন–তখনই সমস্ত জগৎ একবাক্যে স্বীকার করে যে, তিনি বড় দরের শিল্পীই বটে।
যা অপ্রয়োজনীয়, তা আর কিছু করতে না পারলেও অকৃত্রিম সত্যটুকুকে চিরকালই অস্পষ্ট করে তোলে। জনতা যদি মিথ্যার পেছনে ধাওয়া করে, তাহলে সত্য তো অবহেলিত হবেই। সুতরাং বুদ্ধিভ্রষ্ট মিঃ সামন্তর জটিল কার্যকলাপ যখন সংবাদপত্র প্রায় ভরিয়ে রেখে দিয়েছে, সেই সময়ে অত্যাশ্চর্য আলিপুর-হত্যা-রহস্যকে স্থান দেওয়া হল কাগজে চক্ষুর অগোচরে ক্ষুদ্র এক কোণে। বাস্তবিকই, খুঁটিনাটি তথ্যগুলি থেকে এমন ভাবে আমাদের বঞ্চিত করা হয়েছিল যে, এই স্মৃতিতে তা গেঁথে নেই; ঘটনাটা প্রায় এই : আলিপুরের ছোটখাটো একটি ফ্ল্যাটের দোতলায় একজন যুবক একটি অভিনেত্রীর সঙ্গে কথা বলছে, অভিনেত্রীর বয়সের সীমারেখা, যতদুর আমার মনে পড়ছে, তিরিশ কি চল্লিশের মধ্যে হবে এবং বিগতযৌবনা হওয়ার পরিণামস্বরূপ চিত্রজগতেও খ্যাতি বিলীন হয়েছে অনেকদিন। কথাবার্তার মাঝখানে আচম্বিতে শোনা গেল একটা ফায়ারিংয়ের শব্দ–খুব কাছ থেকেই। যুবকটি ফ্ল্যাট থেকে ছিটকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল এবং বাড়ির সদর দরজায় দেখতে পেল একটি মৃত পুরুষকে তার আপন পিতা–গুলি তাঁর বক্ষে বিদ্ধ হয়েছে। উল্লেখযোগ্য যে, পিতাও এক সময়ে অভিনেতা ছিলেন এবং ওপরতলার অভিনেত্রীটি তার পুরোনো বান্ধবী। কিন্তু তারপরেই আসছে হত্যার অভিনব এবং আশ্চর্য অংশটুকু। মৃতের পাশে অথবা মৃতের হাতে কিংবা মৃতের কোটের পকেটে–আমার ঠিক মনে পড়ছে না কোনওখানে–ভারি তারের তৈরি একটা অস্ত্র পাওয়া গেল–জঘন্য এবং অত্যন্ত সাংঘাতিক এক মারণাস্ত্র, নিখুঁত নৈপুণ্যে অতি অদ্ভুতভাবে গঠন করা হয়েছে সেই বিচিত্র অস্ত্রটি। তখন রাত্রি, কিন্তু প্রতিপদের শুভ্র চন্দ্রকিরণে চতুর্দিক আলোকিত। যুবকটি বললে, একজনকে সে দৌড়ে গিয়ে পাঁচিল টপকে পালাতে দেখেছে।
কিন্তু লক্ষ্য করুন পয়েন্টটি? মৃত অভিনেতা তাঁরই পুরোনো বান্ধবীর ফ্ল্যাটের নীচে লুকিয়ে ছিলেন, অন্তরালে থেকে অপেক্ষা করছিলেন, হাতে ছিল তার সেই নির্মম অস্ত্রটি। তিনি কোনও শত্রুর মুখোমুখি হওয়ার প্রত্যাশায় ছিলেন। যাকে খুন করবার অভিপ্রায় না থাকলেও যার মারাত্মক অনিষ্টের অভিপ্রায় নিয়ে প্রস্তুত হয়েছিলেন।
কে সেই শত্রু? মৃত ব্যক্তির বর্বর ও সুচিন্তিত অভিপ্রায়ের চেয়েও দ্রুতগামী ওই বুলেটটি কার দ্বারা নিক্ষিপ্ত?
খুব সম্ভব আমরা কোনওদিন তা জানতে পারব না, যে হত্যা প্রথম শ্রেণির পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার উপযুক্ত ছিল, যে হত্যা বুদ্ধিমত্তা ও দক্ষতার দিক দিয়ে তুমুল আলোড়নের সৃষ্টি করতে পারত, সেই হত্যাই বিস্মৃতির গর্ভে তলিয়ে যেতে বাধ্য হল–মূর্খ জনতা ততধিক মূর্খ সামন্ত আর তার প্রেমিকাকে নিয়ে সৃষ্টি করলে বছরব্যাপী আলোচনার।
স্বভাবতই এই ধরনের অবহেলার জন্য যুদ্ধ অনেকাংশে দায়ী। সেই আতঙ্কভরা দিনগুলিতে মানুষের মাথায় শুধু একটি চিন্তাই জাগ্রত ছিল–বাদবাকি সব হয়েছিল উপেক্ষিত। সুতরাং ঢাকুরিয়া লেকে যত্ন করে বস্তায় জড়ানো মৃত মহিলাটির বিকৃত দেহটির ওপর খুব অল্পই মনোযোগ দেওয়া হল এবং বেশি বাগাড়ম্বর না করে একটি লোককে ফাঁসিতে দেওয়া হল ঝুলিয়ে। এ কেসে দু-একটি চিত্তাকর্ষক পয়েন্ট প্রত্যেকেরই দৃষ্টি গেল এড়িয়ে।
আর, তারপর শোনা গেল ভবানীপুরে এক আশ্চর্য হত্যা-কাহিনি। একটি সম্ভ্রান্ত পরিবার একটা বড় বাড়িতে নতুন ভাড়া এলেন। তখনও তাঁদের সমস্ত মালপত্র খোলা হয়নি–একরাত্রে গৃহকর্তাকে কে খুন করে কয়েকটি জিনিস নিয়ে সরে পড়ল। লুণ্ঠন সামগ্রীর মধ্যে ছিল কী? একজোড়া বুট জুতো, খুব জোর, পনের টাকার বেশি দাম হওয়া উচিত না। আর একটি ঘড়ি–সেটার দামও পঁচিশ টাকার ওদিকে নয়। এক্ষেত্রেও হত্যাকারীকে গ্রেপ্তার করে বিনাবাক্যব্যয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া হল। আর বলতে বাধ্য হচ্ছি, তার গতিবিধির যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাখ্যা ছিল। কিন্তু যুদ্ধপূর্ব অথবা যুদ্ধকালীন যাবতীয় কেসের মধ্যে সর্বাপেক্ষা চমকপ্রদ যে কেসটি লোকচক্ষুর অন্তরালে হারিয়ে গেছিল, সেটি হল কাঞ্চনপুর-রহস্য। অশ্রুতপূর্ব এই কাহিনি শোনাবার আগে প্রথমেই আমি কাহিনির ঘটনাস্থান ও পাত্রপাত্রীর নাম পরিবর্তনের অবাধ অনুমতি পাঠকের কাছ থেকে চেয়ে রাখছি। কারণ, এই কাহিনি সম্পর্কিত ব্যক্তিরা কোথায় বর্তমান আছেন, তা জানি না, জীবিত কি মৃত, তাও জানি না। সুতরাং পূর্ব থেকেই সাবধানতা অবলম্বন করা যুক্তিযুক্ত মনে করে এইটুকু অধিকার আমি চেয়ে নিলাম। সংবাদপত্রে যখন এই কাহিনির ছোট্ট একটি শিরোনামা প্রকাশিত হল, তখন অতি ব্যস্ত জগতের নজরই পড়ল না সেদিকে। সংবাদপত্র মারফৎ উজবেক শিল্পীদের নৃত্যকলা প্রদর্শন বা নিখিল ভারত উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত সম্মিলন বা ওই জাতীয় কিছু বৈচিত্র্যময় সংবাদ পরিবেশিত হত কিনা মনে নেই, হলেও জনগণ তখন সে সংবাদ রাখার চেয়ে ট্যাঙ্কার, ভি-টু অথবা প্যারাসুট বাহিনীর খবরটাই জেনে রাখা উচিত বলে মনে করত।
কাঞ্চনপুরের রহস্যের সূত্রপাত হয় এইভাবে। প্রথমেই ধরে নেওয়া যাক যে কলকাতা শহরের উপকণ্ঠে অতি মনোহর ক্ষুদ্র একটি কলোনি আছে–মনে করা যাক, সেই সুসজ্জিত কলোনিটার নাম কাঞ্চনপুর। ক্ষুদ্র হলেও প্রয়োজনীয় কিছুরই অভাব সেখানে রাখা হয়নি। থানা, বাজার, পোস্টাফিস ইত্যাদি যাবতীয় সুবিধাই সেখানে সহজ লভ্য। শহরের উপকণ্ঠে থাকায় যাতায়াতেও কোনও অসুবিধা নেই–ট্রাম, বাস এবং ট্রেন, এই ত্রিবিধ যানই যাতায়াতের পথকে সুগম করে তুলেছে। এ হেন কাঞ্চনপুরে চৌরাস্তা থেকে স্টেশনের বিপরীত দিকের পথটায় মিনিট তিনেক হেঁটে গেলে লাল পয়েন্টিং করা যে দোতলা বাড়িটা দেখতে পাওয়া যায়, সেখানে বাস করতেন জগদীশ সরকার এবং তাঁর স্ত্রী। প্রাচীন দুর্গফটকের মতো লোহার বড় বড় কীলক মারা সদর দরজার ওপরেই একটা চকচকে আমার প্লেটে লেখা আছে, Taxidermist : Skeletons Articulated মৃত জন্তুজানোয়ারের চামড়া অবিকৃত রেখে ভেতরে শুষ্ক জিনিস ঠেসে কৃত্রিম জীবন্ত-দর্শন জানোয়ার তৈরির আর্টকেই Taxidermy বলে। এর বাংলা প্রতিশব্দ আমার জানা নেই। জগদীশ সরকার শুধু যে এই শিল্পতেই দক্ষ ছিলেন তা নয়, তিনি বিভিন্ন অস্থির জোড়া লাগিয়ে কঙ্কাল নির্মাণেও সমান পারদর্শী ছিলেন। তার বাড়ির পেছনে ছিল ছোট্ট একফালি বাগান–এই বাগানের একপ্রান্তে জগদীশ সরকার নির্মাণ করেছিলেন ছোট্ট কারখানাটি তাঁর যন্ত্রপাতি থাকত এইখানেই। নিভৃতে প্রতিবেশীদের সাদা-অনুসন্ধিৎসু চক্ষুর অন্তরালে তিনি তাঁর শিল্প নিয়েই দিনের পর দিন যেতেন কাটিয়ে।
যতদূর জানা গেছে, এই অস্থি সংযোজনকারী ট্যাক্সিডারমিস্ট ভদ্রলোকটি নিতান্ত নিরীহ এবং নম্র স্বভাবের মানুষ ছিলেন। প্রতিবেশীরা এই ছোটখাটো মানুষটিকে পছন্দ করতেন। পাশের বাড়ির সরকারি চাকুরে অময়বাবু, মোড়ের স্টেশনারি দোকানের স্বত্ত্বাধিকারী হরিহরবাবু এবং আরও দুজন ভদ্রলোক সুখেন্দু দাস আর রবিপ্রসাদ মুখার্জি–এঁরা সবাই জগদীশ সরকারের বৈঠকখানায় বহু বিকেল দাবা খেলে, চা পান করে এবং গল্প করে কাটিয়ে গেছেন। যুদ্ধপূর্ব শান্তির দিনে বহুবার এই কজন নিরীহ ভদ্রলোক ইডেন গার্ডেনে বেরিয়েছেন এবং গঙ্গার ঘাটে সূর্যাস্ত দেখেছেন।
তাঁদের কেউই খুব বেশি কথা বলতে ভালোবাসেন না এবং একমাত্র বিকাল ছাড়া কখনই একত্রে বাজে সময় নষ্ট করা পছন্দ করতেন না। বৈঠকখানায় তারা নীরবে বসে দাবা খেলতেন, দু-একটি কথা বলতেন আর না হয় শান্ত দৃষ্টি মেলে দেওয়ালে প্রলম্বিত সোনালিফ্রেমে বাঁধান রবীন্দ্রনাথের ছবিটা দেখতেন। অথবা বড় টেবিলটার ওপর রক্ষিত দুটি লালাভ প্রায়-জীবন্ত কুকুরের মধ্যস্থিত অদ্ভুত দর্শন ঘড়ির দোদুল্যমান পেণ্ডুলামটি নির্নিমেষ চোখে লক্ষ্য করতেন। জগদীশবাবু এই শান্ত পরিবেশের কেন্দ্রস্থল ছিলেন–তার স্মিত বদন এবং সৌম্যমূর্তি দিয়ে এই কজনের মনকে তিনি একেবারেই জয় করে নিয়েছিলেন। জগদীশবাবুর স্ত্রী ছিলেন যেমন কটুভাষিণী, তেমনই তীব্র-স্বভাবা। এই শান্তি-চক্রের পাঁচজন সভ্যই তাকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলতেন। প্রতিবেশিনীরাও জগদীশ-গিন্নি সম্বন্ধে ছিলেন শঙ্কিত। নির্বিরোধী জগদীশবাবুর জীবন তিনি বিষিয়ে তুলেছিলেন। লৌহকীলক মারা মজবুত দরজা ভেদ করেও তীক্ষ্ণ বামা-কন্ঠ প্রতিবেশীদের সচকিত করে তুলত–একবার শুরু হলে যে পর্যন্ত না দম ফুরিয়ে আসত, জগদীশবাবুর প্রতি কণ্ঠনিঃসৃত সেই বিষেণচাঁদগার আর থামতে চাইত না; আর বেচারি জগদীশবাবু ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বাইরে বেরিয়ে আসতেন–কেননা রসনার চেয়েও কার্যকরী আরও কিছুর আশঙ্কা তিনি করতেন।
কুখ্যাত এই মহিলাটি ছিলেন শ্যামবর্ণা, মধ্যমাকৃতি, কুঞ্চিতকেশী। নিমফুল খেলে মুখের ভাব যেরকম হয়, তার মুখে সর্বদাই সেই ভাব থাকত ফুটে। তিনি হাঁটতেন দ্রুতগতিতে, কিন্তু বেশ একটু খুঁড়িয়ে। তাঁর অন্তরের তেজ ছিল প্রচুর–প্রতিবেশীদের কাছে তিনি ছিলেন একটি মূর্তিমান উৎপাত আর হতভাগ্য জগদীশবাবুর কাছে তিনি ছিলেন উৎপাতের চেয়েও ভয়ঙ্কর।
রণ-দামামা বেজে ওঠার পর ইডেন গার্ডেনে ও গঙ্গার ধারে এই কজন শান্ত-পরিবেশ-প্রিয় ভদ্রলোকের বৈকালিক ভ্রমণটা প্রায় বন্ধ হবার উপক্রম হল এবং তাঁদের নিবিড় স্বাচ্ছন্দ্যানুভূতিরও ব্যাঘাত ঘটল প্রচুর। তা সত্ত্বেও এই শান্তি-চক্রের বৈকালিক অধিবেশন পুরোপুরি ভাবে স্থগিত রইল না এবং এক সন্ধ্যায় জগদীশবাবু ঘোষণা করলেন যে তাঁর স্ত্রী এলাহাবাদে আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে গেছেন এবং খুব সম্ভবত বেশ কিছু সময়ের জন্য আর ফিরবেন না।
ওখানেও হাওয়া পরিবর্তনের জন্য খুব বেশি লোক না গেলেও, অময়বাবু বললেন, আমার একবার যথেষ্ট উপকার হয়েছিল।
অপর কয়েকজন কিছু বললেন না। কিন্তু অন্তরের সঙ্গে জগদীশবাবু জানালেন অভিনন্দন। তাঁদের মধ্যে একজন পরে মন্তব্য করেছিলেন যে জগদীশবাবুর স্ত্রীর পক্ষে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান হচ্ছে বৈতরণীর ওপারে এবং সকলেই তাতে একমত হয়েছিলেন। তখন তারা কেউই জানতেন না যে প্রস্তাবিত চিকিৎসার সকল সুবিধাই সে সময় জগদীশগিন্নি উপভোগ করছিলেন।
যতদূর মনে পড়ছে, জগদীশ-গিন্নির এক ভগ্নি, অন্নপূর্ণা মিত্রের আবির্ভাবের পর থেকেই জগদীশবাবু চিন্তিত হয়ে পড়লেন। এই মহিলাটি ছিলেন তাঁর ভগ্নির মতো প্রায় একই রকম বদমেজাজী এবং সন্দিগ্ধমনা। একটি অভিজাত পরিবারের নার্স হয়ে কয়েক বছর তিনি ব্রহ্মদেশে বাস করছিলেন। তারপর পরিবারটি কলকাতায় ফিরে এলে, তিনিও সেই সঙ্গে কলকাতায় চলে এলেন। প্রথমে এই মহিলাটি তাঁর ভগ্নিকে খান দু-তিন চিঠি লিখেছিলেন, কোনও উত্তর পাননি। এইখানেই তাঁর কীরকম খটকা লাগল, কেননা জগদীশ-গিন্নি পত্র-লেখিকা হিসাবে বড় নিয়মিত ছিলেন এবং প্রতি পত্রই তার স্বামী সম্বন্ধে নোংরা কথায় পরিপূর্ণ থাকত। সুতরাং কলকাতায় প্রত্যাবর্তনের পরের সন্ধ্যাতেই অন্নপূর্ণা মিত্র সশরীরে এসে হাজির হলেন বোনের মুখে প্রকৃত সত্যটুকু জানতে। জগদীশবাবু চিঠিগুলো যে সরিয়ে ফেলেছেন, এ বিষয়ে তার আর কোনও সন্দেহই ছিল না। প্রায়ই বিড় বিড় করে তাঁকে বলতে শোনা যেত, হতভাগা জানোয়ার; মজা আমি দেখাব তোমায়! আর তাই কাঞ্চনপুরে এসে হাজির হলেন অন্নপূর্ণা মিত্র–এসেই কারখানা থেকে টেনে বের করলেন জগদীশবাবুকে। মহিলাটিকে দেখবামাত্র বেজায় দমে গেলেন জগদীশবাবু। চিঠিগুলো তিনি পড়েছিলেন। কিন্তু কলকাতায় ফিরে আসাটা এমন আকস্মিক যে আগে থেকে খবর না পাওয়ায় তিনি প্রস্তুত হয়ে উঠতে পারেননি। যাই হোক, মিস্ মিত্র এ সম্বন্ধে একটি কথাও বললেন না। জগদীশবাবু ভেবেছিলেন, তাঁর স্ত্রীর এই বোনটি অন্তত আরও দশ-কুড়ি বছর সুদূর ব্রহ্মদেশে বাস করতে থাকবেন- ইতিমধ্যে নাম পরিবর্তন করে বছর খানেকের মধ্যে তিনিও সরে পড়বেন। আর তাই আচম্বিত মিস মিত্রকে সামনে দেখে তিনি গেলেন দারুণ দমে।
অন্নপূর্ণা মিত্র সোজা কাজের কথা পাড়লেন।
কমলা কোথায়? জিজ্ঞেস করলেন তিনি। ওপর তলায়? ঘণ্টা বাজানোর পর, দরজায় কড়া নাড়ার পর তার তো নেমে আসা উচিত ছিল।
না। জগদীশবাবু বললেন। তার গোপন রহস্য নিয়ে তিনি যে গোলকধাঁধার সৃষ্টি করছেন, তার কথা চিন্তা করে তিনি স্বস্তি বোধ করলেন; এই গোলকধাঁধাঁর ঠিক কেন্দ্রস্থলে তিনি সম্পূর্ণ নিরাপদ? না, সে ওপরতলায় নেই সে বাড়ি নেই।
ও তাই নাকি? বাড়িতে নেই? তাহলে নিশ্চয় কোনও বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করতে গেছে? কখন ফিরবে বলে মনে হয় আপনার?
সত্য কথা বলতে কি অন্নপূর্ণা, সে আর ফিরবে বলে আমি আশা করি না। আমাকে সে ছেড়ে গেছে–তিন মাস আগে সে চলে গেছে।
এই কথা আমায় বলতে চান আপনি! আপনাকে ছেড়ে গেছে। তার সঙ্গে কী ব্যবহারটা তাহলে করেছিলেন? কোথায় গেছে সে?
বিশ্বাস কর অন্নপূর্ণা, আমি জানি না। একদিন সন্ধ্যায় আমাদের মধ্যে একটু ঝগড়া-ঝগড়ি হল, কিন্তু তা নিয়ে আমি বেশি কিছু ভাবিনি। কিন্তু সে বললে যে যথেষ্ট হয়েছে, বলে কয়েকটি জিনিস গোছ-গাছ করে ব্যাগে পুরে বেরিয়ে গেল। আমি পিছু পিছু অনেকটা ছুটে গেলাম, বার বার মিনতি করে বললাম ফিরে আসতে–কিন্তু সে একবারও ঘাড় ফিরিয়ে তাকালে না–সোজা স্টেশনের দিকে চলে গেল। আর সেই দিন থেকে তাকে আর দেখিও নি, তার কথাও শুনিনি। আর যত চিঠি এসেছে, সব আমি পোস্ট-অফিসে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছি।
ভগ্নিপতির দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন অন্নপূর্ণা মিত্র। দোষটা কার, কমলার না জগদীশবাবুর–এই নিয়ে কিছুক্ষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন, সবশেষে ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে গেলেন বাড়ি থেকে। আর জগদীশবাবু ফিরে গেলেন কারখানায়। কয়েকটি ময়ূর ঠাসা বাকি ছিল, সেইগুলো সেরে ফেলতে! আবার তিনি সুস্থ বোধ করতে লাগলেন। কিছুক্ষণের জন্য তার বুকের স্পন্দন কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছিল–আশঙ্কা করেছিলেন তাঁর গোলকধাঁধার রহস্য বুঝি গেল ফাঁস হয়ে। কিন্তু তারপরে আবার ফিরে এল তাঁর চিত্তের শান্তি।
এর পর সব কিছু মোটামুটি মানিয়ে যেত, যদি না চৌমাথার কাছে অন্নপূর্ণা মিত্রের সঙ্গে রেবা রায়ের মুখোমুখি সাক্ষাৎ হত। রেবা রায় সরকারি চাকুরে অময়বাবুর স্ত্রী। ইতিপূর্বে জগদীশবাবুর বাড়িতে দুজনের আলাপ হয়েছিল–কাজেই দেখামাত্র দুজনেই দুজনকে চিনতে পারলেন। কয়েকটি বাজে কথার পর মিস্ মিত্রকে রেবা রায় জিগ্যেস করলেন যে কলকাতায় ফেরবার পর ইতিমধ্যে তার বোনের সঙ্গে তিনি সাক্ষাৎ করেছেন কিনা।
সে যে কোথায় তাই যখন জানি না, তখন কী করে আমার সঙ্গে তার দেখা হতে পারে? বেশ কিছুটা উন্মা প্রকাশ করে মিস মিত্র উত্তর দিলেন।
কী মুসকিল, আপনি তাহলে জগদীশবাবুর সঙ্গে দেখা করেননি?
এই মুহূর্তে আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করে আসছি।
কিন্তু তিনি তাহলে নিশ্চয় এলাহাবাদের ঠিকানাটা ভুলে যেতে পারেন না?
আর এইভাবে বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে গড়িয়ে গেল কথাবার্তার গতি এবং মিস মিত্র পরিষ্কার জানতে পারলেন যে জগদীশবাবু তার বন্ধু-বান্ধবদের কাছে বলেছেন যে তার স্ত্রী অনেক দিনের জন্য এলাহাবাদে আত্মীয়-স্বজনের কাছে বেড়াতে গেছেন। প্রথমত মিত্র-ভগ্নিদ্বয়ের কোনও আত্মীয়ই এলাহাবাদে থাকত না–তাদের আদিবাস ছিল ময়মনসিংহে, আর দ্বিতীয়ত, জগদীশবাবু তাঁকে বলেছেন, কমলা ক্রুদ্ধ হয়ে বাড়ি ছেড়ে কোথায় বেরিয়ে গেছেন তা তিনি জানেন না। প্রথমে মিস মিত্র ভাবলেন এখুনি ফিরে গিয়ে ভগ্নিপতিকে এক হাত নেবেন–তারপর তিনি মত পরিবর্তন করলেন। দেরি হয়ে যাচ্ছিল, কাজেই তৎক্ষণাৎ আর দেখা না করে তিনি কলকাতাতেই ফিরে গেলেন,–সারাপথে কি ভাবে জগদীশবাবুকে শায়েস্তা করবেন, সেই কথাই লাগলেন ভাবতে।
পরের হপ্তায় আবার তিনি আবির্ভূত হলেন কাঞ্চনপুরে। কাঁচা মিথ্যা কথনের অপরাধে তিনি জগদীশবাবুকে অভিযুক্ত করলেন তাঁর সামনে ধরে দিলেন দুটি বিভিন্ন কাহিনি। আর, আবার আগের মতো জগদীশবাবুর বুকটা ঢিপ ঢিপ করতে লাগল। ভয়ানক আতঙ্কে হাত-পা প্রায় অবশ হয়ে আসার উপক্রম হল। কিন্তু তার সংযম নিতান্ত অল্প ছিল না।
সত্যিই, তিনি বললেন, আমি তোমায় কোনও মিথ্যেই বলিনি অন্নপূর্ণা। ঠিক যা ঘটেছে তোমায় বলেছি। কিন্তু এখানকার লোকদের জন্যে এলাহাবাদের ওই কাল্পনিক গল্পটা আমায় বানাতে হয়েছিল। এ বিষয় নিয়ে প্রত্যেকে আলোচনা করুক, এ ইচ্ছা আমার ছিল না–বিশেষ করে কমলার ফিরে আসার সম্ভাবনা যখন রয়েছে–আমার তো মনে হয় আর কিছুদিনের মধ্যেই সে ফিরে আসবে।
সন্দেহপূর্ণ চোখে মুহূর্তের জন্য মিস্ মিত্র জগদীশবাবুকে এক দৃষ্টে লক্ষ্য করলেন আর তারপরেই দ্রুতপদে উঠে গেলেন দোতলায়। কিন্তু অচিরেই তিনি নেমে এলেন।
কমলার ড্রয়ার আমি দেখে এলাম। এমন ভাবে তিনি কথা শুরু করলেন যেন জগদীশবাবুকে যুদ্ধে আহ্বান করছেন। অনেকগুলো জিনিস পাওয়া যাচ্ছে না। চুণীর লকেট বসান নেকলেশটা নেই, কৃষ্ণার দেওয়া হীরার আংটিটাও দেখতে পেলাম না, কানপাশা, চুড়ি আর তাগাও দেখতে পেলাম না।
কমলা চলে যাবার পর আমি ওর সব কটা ড্রয়ারই বাইরের দিকে খুলে ঝুলতে দেখেছি। নিশ্বাস ফেললেন জগদীশবাবু। আমার বিশ্বাস, সে যাবার সময়ে সব গয়নাই নিয়ে গেছে।
এটা স্বীকার করতেই হবে যে জগদীশবাবু প্রতিটি ছোটখাটো বিষয়ের ওপর তীক্ষ্ণ নজর রেখেছিলেন–এ গুণটি বোধহয় তাঁর শিল্প-দক্ষতা থেকেই জন্মেছিল। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে যাবার সময়ে স্ত্রী যাবতীয় অলঙ্কার ফেলে চলে গেছে–এ গল্প কেউই বিশ্বাস করবে না। আর কাজেকাজেই যাবতীয় অলঙ্কার-সম্পত্তি গেল অদৃশ্য হয়ে।
প্রকৃত পক্ষে, এ ক্ষেত্রে কি যে আর করা উচিত, তা মিস্ মিত্র আর ভেবে উঠতে পারলেন না। দুটি বিভিন্ন রকমের কাহিনি বলার তাৎপর্য জগদীশবাবু এমন সুন্দরভাবে যুক্তির সাহায্যে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, সে যুক্তি তিনিও না মেনে পারেননি। সুতরাং জগদীশবাবু যে যে-কোনও কৃমি-কীট মনুষ্যের চেয়েও জঘন্য–এই পরম সত্যটুকুই তাকে জানিয়ে দিয়ে তিনি দড়াম করে দরজা বন্ধ করে প্রস্থান করলেন। পুনরায় দ্রুত-স্পন্দিত বক্ষ নিয়ে জগদীশবাবু ফিরে গেলেন তাঁর কারখানায়। গোলকধাঁধা তখনও নিরাপদ, রহস্য তার অনাবিষ্কৃত৷ দ্বিতীয়বার আবার যখন মিস্ মিত্রের অগ্নি-মূর্তির সম্মুখীন তিনি হলেন, প্রথমটা তাঁর হৃৎপিণ্ডটা বড় বেশি রকম লাফালাফি করছিল–কিন্তু এখন বুঝলেন এ আতঙ্ক সম্পূর্ণ আকার বিহীন। তার কোনও বিপদ আর নেই। আমাদের মতো তিনিও তখন ভাবলেন সামন্ত ঘটিত মামলার বিবরণটি। সামন্ত দৌড়োদৌড়ি করছিলেন বলেই ধ্বংস হয়ে গেলেন। যদি সামন্ত চঞ্চল না হয়ে এক স্থানে জেঁকে বসে থাকতেন, তাহলে তার কেশাগ্র স্পর্শ করবার সাহস কারও হত না এবং কয়লার গাদার নীচে সমাধিও কোনওদিন হত না আবিষ্কৃত। জগদীশবাবু অবশ্য মনে মনে চিন্তা করতে লাগলেন যে সন্দিগ্ধমনা যে কোনও ব্যক্তি আসুক তার গৃহে, খুঁজে দেখুক প্রতিটি কোণ, চোর-কুঠরি এবং কয়লার গাদা। বাগানের প্রতিটি ফুলগাছের মাটি খনন করুক, প্রতিটি দেওয়াল ভেঙে তন্নতন্ন করে দেখুক। এই কথাই ভাবতে-ভাবতে তিনি তুলে নিলেন ঘোর কৃষ্ণবর্ণ একটি দাঁড়কাক। সকালের দিকে এ অর্ডারটি এসেছিল–সমস্ত মন নিবিষ্ট করে তিনি কৃষ্ণ-প্রাণীটিকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে রইলেন।
ভগ্নীর অসাধারণ অন্তর্ধান রহস্যের সংবাদ বহন করে মিস মিত্র ফিরে এলেন কলকাতায় আর ক্রমাগত চিন্তা করতে লাগলেন। আগাগোড়া বিষয়টা বারংবার তোলপাড় করেও তিনি চিন্তার কোনও কূল-কিনারা পেলেন না। তিনি জানতেন না যে এরকম ভাবে নানা কারণে বহু নারী এবং পুরুষ উধাও হয়ে যায় প্রতি বছরে–কেউই তাদের সন্ধান পায় না, যে পর্যন্ত না দৈব এসে কল-কাঠি নেড়ে দিচ্ছে। কিন্তু কী জানি কেন, মিস্ অন্নপূর্ণা মিত্রের কাছে এই ব্যাপারটি মনে হল একটি রীতিমতো অলুক্ষুণে, বিস্ময়-জনক, অতুলনীয় এবং ভয়াবহ ঘটনা। অনবরত এই বিষয় নিয়ে ভেবে ভেবে তিনি মাথা গুলিয়ে ফেললেন, তবুও স্বল্প-বা জগদীশ সরকার যে গোলকধাঁধার সৃষ্টি করেছেন, তার প্রবেশ পথেরই হদিশ পেলেন না খুঁজে। অবশ্য ভগ্নিপতি সম্বন্ধে মিস্ মিত্রের কোনও সন্দেহ ছিল না। কেননা তার ব্যবহার এবং কথাবার্তা খুবই সরল, স্পষ্ট এবং অতীব বোধগম্য। তিনি একজন কৃমি-কীট–এই সংবাদ তাকে জানিয়ে দিয়েছেন–কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি অবশ্যই সত্য কথাই বলেছেন। কিন্তু মিস্ মিত্র তার একমাত্র বোনটিকে ভালোবাসতেন। এবং কমলা সরকার কোথায় গেছেন এবং তাঁর কী হয়েছে–এই সংবাদ জানার জন্যে তিনি আকুল হয়ে উঠলেন। আর তাই সর্বশেষে তিনি পুলিশের সমীপে এই ঘটনাটি হাজির করলেন।
অন্তর্হিত মহিলার যতটুকু বর্ণনা সম্ভব, মিস্ মিত্র স্মৃতি থেকে উদ্ধার করে তা দিতে কসুর করলেন না; কিন্তু এই কেসের ভারপ্রাপ্ত কর্মচারীটি মিস্ মিত্রের দৃষ্টি একটি বিষয়ে আকর্ষণ করলেন–যেহেতু তিনি তাঁর ভগ্নীকে বহু বছর যাবৎ দেখেননি, অতএব এ ক্ষেত্রে জগদীশ সরকারের পরামর্শ অপরিহার্য। সুতরাং পুনরায় শিল্পকর্ম থেকে টেনে আনা হল ট্যাক্সিডারমিসট ভদ্রলোককে। মিস্ মিত্রের আনা সংবাদটুকু এবং তার দেওয়া কমলা সরকারের দৈহিক বর্ণনার ওপর ভদ্রলোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হল। তিনি আর একবার তার ছোট্ট জটিলতাবিহীন গল্পটি বললেন, বিশ্রী কানাঘুষো এড়াবার জন্যে প্রতিবেশিদের কাছে কেন মিথ্যা বলেছেন–সে কথারও উল্লেখ করলেন এবং সর্বশেষে মিস্ মিত্র বর্ণিত কমলা সরকারের ফটোগ্রাফে নিজেরও দু-একটি খুঁটিনাটি পরিবর্তন সংযোজন করে দিলেন। তারপর তিনি কনস্টেবলটিকে দুটি ফটোগ্রাফ দিলেন। ফটো দুটির মধ্যে যে যে স্থানে সাদৃশ্য চোখ এড়ায় না, সেগুলিও তর্জনী নির্দেশ করে দেখিয়ে দিলেন এবং তারপর প্রসন্ন-বদনে স্মিতহাস্যে তাকে দিলেন বিদায়।
পুলিশের জোর তদন্ত চলল–Missing Squad ফটোগ্রাফ দুটি নিয়ে সম্ভব অসম্ভব সব জাতীয় স্ত্রীলোকের সঙ্গেই দেখতে লাগল মিলিয়ে। কিন্তু তা হতোস্মি! মিস্ মিত্র যে তিমিরে ছিলেন, সেই তিমিরেই রইলেন। তখন তিনি নিজেও নিজের প্রচেষ্টা আর অর্থ নিয়োগ করে অনুসন্ধানকে ব্যাপকতর করে তুললেন; প্রায় প্রতিটি সংবাদপত্রেই ফটো সহ নিরুদ্দেশ বিজ্ঞাপন ছাপা হল–কোনও সাড়া পাওয়া গেল না। দিনের পর দিন কেটে যেতে লাগল আর ততই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন মিস অন্নপূর্ণা মিত্র। সবশেষে পুলিশের সঙ্গে এবং আরও কয়েক জনের সঙ্গে পরামর্শ করে দেওয়াল-বিজ্ঞাপন ছাপালেন এবং কাঞ্চনপুর ও শহরের সর্বত্র দিলেন ছড়িয়ে। শহরের বাইরেও কিছু গেল। বাড়ির দেওয়ালে, গাছের গুঁড়িতে, পার্কের বেঞ্চে–সর্বত্র দেওয়াল প্রলম্বিত শ্রীমতী কমলা সরকারের ফটোগ্রাফ বহু পথচারীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে লাগল–এ সেই ফটোগ্রাফ যেটি জগদীশবাবু নিজে নগর-রক্ষীবাহিনীর হাতে দিয়েছেন তুলে, সেই সাথে তার দেওয়া বিশদ দৈহিক বর্ণনাও হয়েছে মুদ্রিত বর্ণনার মধ্যস্থানে লেখা আছে বেশ একটু খুঁড়িয়ে চলেন–এই কয়টি শব্দ মোটা মোটা হরফে ছাপা। প্লাকার্ডের ফল কিছু দেখা গেল না–কিছুই চাঞ্চল্যকর সংবাদও এল না। শেষবারের মতো তাঁকে কাঞ্চনপুর স্টেশনের দিকে যেতে দেখা গেছে–এই বিবৃতিও সরকারি গোয়েন্দার কাছে খুব আশাজনক সূত্র বলে মনে হল না। এ ব্যাপারে কোনও ইঙ্গিতও সংবাদপত্রে হল না প্রকাশিত; আর তারপর ধীরে ধীরে আমরা আবার নিজস্ব সংবাদদাতা পরিবেশিত সম্মুখ-রণাঙ্গনের চাঞ্চল্যকর বিবরণে হয়ে গেলাম মগ্ন। একটি মুখরা স্ত্রীলোকের গতিবিধি নিয়ে আলোচনা করবার মতো অবকাশ আমাদের আর কারুরই রইল না–কাঞ্চনপুর কলোনিও তাঁর কথা বিস্মৃত হয়ে এল ধীরে ধীরে।
আর তারপর হল এই রহস্যের উপসংহার এবং সেটা নিছক দৈবঘটিত ছাড়া আর কিছুই নয়। কাঞ্চনপুর কলোনির একপ্রান্তে অবস্থিত একটি দ্বিতল ভবনের দোতলায় ততোধিক নির্জন এক কক্ষে অলস মধ্যাহ্নে পদচারণা করছিলেন শ্রীকান্ত মিত্র–একজন মেডিক্যাল স্টুডেন্ট। হাতে বিশেষ কোনও কাজ ছিল না এবং পড়াতেও বিশেষ মন বসছিল না। কাজেই উদাসীন এবং অলস ভঙ্গিমায় তিনি জানলা দিয়ে রাস্তার ওপারে দোকানের সাইনবোর্ডটি লক্ষ্য করলেন, রাস্তার মোড়ে দুটি ছোট মেয়েকে দেখলেন বেণী দুলিয়ে স্কুলে যেতে। তারপর দেখলেন এক স্থূলাঙ্গী মহিলা বহুকষ্টে রিক্সা থেকে নেমে প্রবেশ করলেন পার্শ্ববর্তী দোকানে। তখন তিনি শো-কেসের মূল্যবান হস্তীদন্ত নির্মিত নটরাজের মূর্তির শিল্পকৌশল দেখলেন, এবং ভাবলেন যে এরকম একটি মূর্তি কিনে তার পড়ার টেবিলে সদ্যক্রীত মড়ার মাথার খুলি ওপর রেখে দিলে কীরকম দেখাবে; আর তারপর তার ভ্রাম্যমান দৃষ্টি ঘুরতে ঘুরতে এসে স্থির হল পথপার্শ্বের একটি গাছের মোটা গুঁড়ির ওপর; গুঁড়িটির ওপরে দুটিমাত্র শাখা ঠিক ইংরাজি Y-এর মতো উর্ধে উঠে গেছে। এই দুটি শাখার সংযোগস্থলে দেখতে পেলেন একটি নিরুদ্দেশ বিজ্ঞাপন এবং কমলা সরকারের দৈহিক বর্ণনা।
বেশ একটু খুঁড়িয়ে চলেন।
শ্রীকান্ত মিত্রের শ্বাস-প্রশ্বাস মুহূর্তের জন্য রুদ্ধ হয়ে গেল। জানলার একটি গরাদ চেপে ধরে সিধে হয়ে দাঁড়িয়ে তিনি আর একবার ওই বিস্ময়কর শব্দগুলি পড়লেন। আর তারপর তিনি সোজা হাজির হলেন কাঞ্চনপুর পুলিশ ফাঁড়িতে।
ব্যাপারটা এই : কমলা সরকারকে শেষবার দেখা যাওয়ার তিন হপ্তা পরে শ্রীকান্ত মিত্র জগদীশ সরকারের কাছ থেকে কিনেছিলেন একটি স্ত্রী-নরকঙ্কাল। উরুর একটি হাড়ের গঠন বিকৃত থাকার ফলে তিনি কঙ্কালটি খুব সুবিধা দরেই পেয়েছিলেন। আর এখন তাঁর আচম্বিতে মনে হল যে কঙ্কালের ভূতপূর্ব অধিকারিণী একসময়ে নিশ্চয় বেশ একটু খুঁড়িয়ে চলতেন।
মামলা চলার সময়ে সোমদেব চৌধুরি তাঁর সুনাম বজায় রাখলেন। জমকালো বাগ্মীতার সাহায্যে তিনি জগদীশ সরকারের পক্ষ সমর্থন করলেন। আমি আদালতে ছিলাম–সে সময়ে প্রায় আদালতে যাওয়া আমার অন্যান্য কাজের অন্যতম ছিল এবং কয়েদির পক্ষাবলম্বন করে তিনি প্রথমেই বাকপটুতায় যে নিদর্শন দেখিয়েছিলেন, তা আমি কোনওদিন ভুলব না। ধীরে-ধীরে তিনি উঠে দাঁড়ালেন এবং সমস্ত আদালত-গৃহের চতুর্দিকে বুলিয়ে নিলেন তাঁর মসৃণ চক্ষু। সর্বশেষে তার গাম্ভীর্যময় প্রশান্ত দৃষ্টি স্থির হল জুরির ওপর। অনেকক্ষণ বাদে কথা শুরু করলেন তিনি। মৃদু, স্পষ্ট ও সতর্ক তাঁর স্বর, প্রত্যেকটি শব্দ উচ্চারণ করবার পূর্বে যেন মনে মনে গুঞ্জন করে নিয়ে তবে বলছেন।
ভদ্রমহোদয়গণ, তিনি শুরু করলেন, একজন অত্যন্ত মহান্ পুরুষ এবং অত্যন্ত জ্ঞানবান পুরুষ এবং অত্যন্ত সৎ পুরুষ একবার বলেছিলেন যে, সম্ভাবনাই হল জীবনের পথপ্রদর্শক। এটা যে একটি রীতিমতো অর্থব্যঞ্জক বাক্য, এ সম্বন্ধে, আমার বিশ্বাস, আপনারা নিশ্চয় আমার সঙ্গে একমত হবেন। বিশুদ্ধ গাণিতিক পরিধি একবার আমরা অতিক্রম করে এলে যা পাই–তার মধ্যে অতি অল্পই থাকে নিশ্চিত। ধরা যাক, লগ্নী করার মতো যথেষ্ট অর্থ আমাদের আছে : প্রথমে পরিকল্পনাটিকে আমরা সর্বপ্রকার দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করি এবং তারপর একটি সম্ভাবনাময় বিষয় সম্বন্ধে মনস্থির করে ফেলি। নতুবা ভাগ্যের হাতে ক্রীড়নক হওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না। দায়িত্বপূর্ণ পদে কোনও ব্যক্তিকে অধিষ্ঠিত করার আগে আমরা তাঁর সততা এবং বুদ্ধির তীক্ষ্ণতার কার্যকরী সম্ভাবনা সম্বন্ধে চিন্তা করে নিই। আবার সম্ভাবনাই আমাদের পথ দেখিয়ে মীমাংসার দিকে, চিত্ত সঙ্কল্পের দিকে নিয়ে যেতে পারে। একজনের সম্বন্ধে আর একজন কখনই নিশ্চিত ও অভ্রান্ত সিদ্ধান্তে আসতে পারে না : সম্ভাবনার ওপর বারংবার আমাদের নির্ভর করে এগিয়ে যেতে হয়।
কিন্তু প্রত্যেক নিয়মের আছে ব্যতিক্রম। যে নিয়ম আমরা এইমাত্র বর্ণনা করলাম, এরও ব্যতিক্রম আছে। এই মুহূর্তে আপনারা সেই ব্যতিক্রমের সম্মুখীন হচ্ছেন ভয়াবহরূপে। আপনারা হয়তো মনে করতে পারেন–আমি বলছি না যে আপনারা মনে করেন–হয়তো মনে করতে পারেন, কাঠগড়ায় দণ্ডায়মান ওই জগদীশ সরকার দ্বারা তাঁর স্ত্রী কমলা সরকারকে খুন করার সকল সম্ভাবনা থাকা বিচিত্র নয়।
এই স্থানে হল ক্ষণের বিরতি। তারপর?
আপনারা যদি তাই মনে করেন, তবে কাঠগড়াস্থিত আসামিকে মুক্তি দেওয়া আপনাদের এখন অলঙ্ঘনীয় কর্তব্য। একটি মাত্র রায় আপনারা প্রকাশ করতে পারেন এবং সে রায় হল–নির্দোষ।
এই মুহূর্ত পর্যন্ত সোমদেব চৌধুরী যেভাবে তার বক্তৃতা শুরু করেছিলেন, ঠিক একই প্রকার শীতল, কিন্তু স্পষ্ট উচ্চারণ করলেন রক্ষা করে–থেমে থেমে, এবং প্রতিটি শব্দ ঠোঁটের আগায় আসার আগে শব্দটির গুরুত্ব মনে মনে বিবেচনা করে নিচ্ছিলেন। আচম্বিতে তাঁর কণ্ঠস্বর উদারা-মুদারা ছাড়িয়ে তারায় উঠে গেল, প্রতিটি শব্দ প্রত্যেকের অন্তরে যেন গেঁথে যেতে লাগল–সমস্ত আদালত-কক্ষটি গম্ করে উঠল তার তীক্ষ্ণ এবং গম্ভীর কণ্ঠস্বরে। দ্রুতবেগে একটির পর একটি শব্দ বেরিয়ে আসতে লাগল তার মুখ থেকে?
মনে রাখবেন, এটা সম্ভাবনার আদালত নয়। এখানে সম্ভাবনার কোনও স্থান নেই, সে তর্কের কোনও অবকাশ এখানে নেই। এই স্থান নিশ্চিত সত্য নিয়ে আদান প্রদান করে–এই স্থানের নাম আদালত। যতক্ষণ না আপনারা নিশ্চিত হচ্ছেন যে আমার মক্কেল দোষী এবং দুয়ে দুয়ে যোগ করলে চার হয়–এই নিশ্চিত সত্যটুকুর মতো নিশ্চিত যে পর্যন্ত আপনারা না হতে পারছেন, ততক্ষণ আপনারা ওঁকে মুক্ত করে রাখবেন।
আবার, এবং তবুও আবার আমি বলছি–এটা আদালত, নিশ্চিত সত্যের স্থান। আমাদের সাধারণ জীবনযাত্রায়, আমরা প্রায় দেখি, সম্ভাবনাই আমাদের পথপ্রদর্শক। কখনও কখনও আমরা ভুল করি, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সে ভ্রম সংশোধন করতে পারি। ক্ষতিযুক্ত লগ্নীকরণকে সামলে নেওয়া যায় লাভযুক্ত লগ্নীকরণ দিয়ে; অসৎ ভৃত্য সরিয়ে সেস্থানে সৎ ভৃত্য আনা চলে। কিন্তু এক্ষেত্রে –যেখানে হাতের দাঁড়িপাল্লায় একদিকে রেখেছেন জীবন, অপর দিকে মৃত্যু–সেখানে ভ্রান্তির কোনও অবকাশ নেই, কেননা, এ ভ্রান্তি হবে অসংশোধনীয়। মৃত পুরুষকে জীবন দান করে আপনারা জীবিত করতে পারবেন না। এই লোকটি সম্ভবত হত্যাকারী, অতএব এ দোষী, এই কথা কখনই আপনাদের বলা চলে না। এ ধরনের রায় প্রকাশ করার আগে, এই লোকটি হত্যাকারী এই কথা বলার মতো নিশ্চয়তা আপনাদের থাকা উচিত। আর ওকথা আপনারা বলতেই পারবেন না–কেন পারবেন না, তা আমি বলছি।
তারপর সোমদেব চৌধুরী একটির পর একটি প্রমাণ নিয়ে বিশদ ব্যাখ্যা করতে লাগলেন। বিশেষজ্ঞের রিপোর্টে প্রকাশ, ঊরুর হাড়ে যে বিকৃত-গঠন দেখা গেছে, তার ফলে নরকঙ্কালটির পক্ষে বিজ্ঞাপন–বর্ণিত ভাবে অবিকল ওই রকম খুঁড়িয়ে চলা উচিত–আর এই বিশেষ ভাবে খোঁড়ানোটাই হল কমলা সরকারের একমাত্র বৈশিষ্ট্য। কিন্তু বাদীপক্ষ বিবিধ যুক্তিতর্কের সাহায্যে ডাক্তারদের স্বীকার করতে বাধ্য করেছে যে এ ধরনের বিকৃত গঠন অস্বাভাবিক হলেও অদ্বিতীয় নয়। শুধু বলা চলে এটা অসাধারণ। কিন্তু আবার খুব অসাধারণ নয়। শেষকালে, একজন ডাক্তার স্বীকার করলেন যে তাঁর তিরিশ বছর হসপিটাল এবং প্রাইভেট প্র্যাকটিশকালে, ঊরুর বিকৃত-গঠন অস্থির কেস তিনি মাত্র পাঁচবার শুনেছেন। সোমদেব চৌধুরী ছোট্ট একটি স্বস্তির শ্বাস ফেললেন; তিনি যেন অন্তর দিয়ে অনুভব করলেন যে এরপর বিচারকের রায় কি হবে।
জুরির কাছে এই সব খুঁটিনাটি তথ্য তিনি পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিলেন। যতক্ষণ না অপরাধ সম্পর্কিত অন্যান্য বস্তু, দেহ অথবা দেহের সনাক্তকরণযোগ্য কোনও অংশ প্রমাণরূপে উপস্থাপিত না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত কাউকে যে মিথ্যা অপবাদ দেওয়া অনুচিত–এই যুক্তিটির ওপর বারংবার জোর দিতে লাগলেন। বিষ্ণুপুরের সেই কাহিনীটা তিনি বললেন, হত্যাপরাধে তিনটি লোকের ফাঁসি হয়ে যাবার দু-বছর পর কীভাবে নিহত ব্যক্তি শিশ দিতে দিতে গ্রামে ঢুকেছিল। ভদ্রমহোদয়গণ, তিনি বললেন, সবশেষে আমি যা জানি, এবং আপনারাও যা জানেন, তা হল এই যে, যে কোনও মুহূর্তে কমলা সরকার প্রাকুটি করে এই আদালত-কক্ষ প্রবেশ করতে পারেন। (কয়েকটা শ্রোতা ঘাড় ফিরিয়ে দরজার দিকে বারকয়েক লক্ষ্য করল) আমি নির্ভীকভাবে শুধু এই কথাই বলব যে তিনি মৃত, এই ধরনের কোনও অনুমান করা আমাদের কোনওমতেই উচিত নয়।
জগদীশবাবুর আত্মপক্ষ সমর্থন অবশ্য খুবই সংক্ষিপ্ত। যে কঙ্কালটি তিনি শ্রীকান্ত মিত্রের কাছে বিক্রয় করেছেন, সেটি গত তিন বছর যাবৎ বিভিন্ন অস্থি সংযোজন করে ধীরে-ধীরে তৈরি করেছিলেন। দুটি হাতে যে হুবহু মিল নেই, এদিকেও তিনি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। আর, বাস্তবিকই এই ছোট্ট বৈষম্যটুকুও তাঁর চোখ এড়িয়ে যায়নি।
সিদ্ধান্ত প্রকাশ করার আগে জুরিবর্গ আধঘণ্টা ধরে নিজেরা আলোচনা করলেন। তারপর ঘোষিত হল, জগদীশ সরকার নির্দোষ।
কিছুদিন বাদে শুনেছিলাম জগদীশবাবু দিল্লিতে চলে গেছেন, সেখানেই তাঁর শিল্পনৈপুণ্য এবং নব বিবাহিতা নম্র স্বভাবা একটি বন্ধু নিয়ে সুখে আছেন। একজন পুরোনো বন্ধুর সাথে তার দেখা হয়েছিল। কথায় কথায় সৌম্যমুর্তি জগদীশবাবু স্নিগ্ধ স্বরে বলেছিলেন, আমার বিচক্ষণ আইনজ্ঞটি আমায় একথাও বলেছিলেন যে, বেচারী কমলার মৃত্যু হয়েছে, একথা অনুমান করে নিলেও আমায় আর কোনও ক্ষতির সম্ভাবনা নেই। প্রসন্নভাবে তিনি হেসে এরপর অন্য বিষয়ের অবতারণা করেছিলেন।
সর্বশেষে একথা আমি বলে রাখতে চাই যে, আমার এ বর্ণনা হয়তো আংশিক কাহিনি হয়ে দাঁড়াতে পারে। সোমদেব চৌধুরীর অপূর্ব বাগ্মীতা স্মরণ করে যতটুকু আমি বলতে পারি, তা হল এই যে জগদীশবাবু নির্দোষ। খুব সম্ভব তাঁর কাহিনি সম্পূর্ণ সত্য। কমলা সরকারও বহাল তবিয়তেই জীবিত আছেন, বিষ্ণুপুরের মতো তিনিও হয়তো একদিন সাদা নিমফুল ভক্ষিত মুখ নিয়ে ফিরে আসতে পারেন। আমার এ কাহিনিতে যদি কিছু সংশয়ছায়া কারও ওপর আমি ফেলে থাকি, তখন তা হয়তো শূন্যে বিলীন হয়ে যেতে পারে।
যুক্তির পথে দেখলে কাঞ্চনপুর-রহস্য তাহলে মীমাংসিত রহস্য। নিশ্চয় তাই। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে?
* রোমাঞ্চ পত্রিকায় প্রকাশিত। ফাল্গুন, ১৩৬৩।
মৃত্যুঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়ের গল্প নিয়ে গোয়েন্দা ধাঁধা
কুরুক্ষেত্র। প্রতুল লাহিড়ী
স্থান–নির্জন কক্ষ । কাল–রাত্রি
(বিছানার ওপর তাকিয়া ঠেস দিয়ে বসে বৃদ্ধ পিতামহ ভীষ্ম; মুখখানা চিন্তাচ্ছন্ন। কৃষ বসে অদুরে একখানা চেয়ারে। সেক্রেটারিয়েট টেবিলে ছড়ানো কাগজপত্র।)
কৃষ্ণ : বেশ, তাহলে ধ্বংসই চলুক।
ভীষ্ম : পাঁচখানা তরবারির বিরুদ্ধে একশোটা তরবারি ঝলসে উঠবে…
কৃষ্ণ : এটা তরবারির যুদ্ধ হবে না, ঠাকুরদা।
ভীষ্ম? তবে কীসের যুদ্ধ হবে?
কৃষ্ণ : এটা বিজ্ঞানের যুগ…
ভীষ্ম : (অসহ্য বিস্ময়ে) বিজ্ঞানের যুগ আবার কী হে? চার যুগের নামই তো জানি, সত্য ত্রেতা দ্বাপর কলি, এটা আবার কীসের ফ্যাকড়া?
কৃষ্ণ : (হাসলেন) বিজ্ঞানের যুগের সঙ্গে কারুর চালাকি খাটবে না। খাপের তরবারি খাপেই থাকবে, হাতের লাঠি থাকবে হাতে, তির-ধনুক পিঠেই ঝুলবে, মাঝ থেকে যোদ্ধার অকস্মাৎ পঞ্চত্ব প্রাপ্তি ঘটবে, অর্থাৎ হাত দুটো উড়ে যাবে দক্ষিণে, পা দুটো উড়ে যাবে উত্তরে, ধড়টার কোনও অস্তিত্বই থাকবে না।
ভীষ্ম : কিন্তু তা কী করে সম্ভব?
কৃষ্ণ : (দৃঢ়কণ্ঠে) বুদ্ধি, ঠাকুরদা, বুদ্ধি, স্রেফ কৃষ্ণের ক্ষুরধার বুদ্ধি…
ভীষ্ম : বুদ্ধিটা কি তোমার বৈজ্ঞানিক যুগেরই স্বধর্ম?
কৃষ্ণ ও আমার বুদ্ধি আমারই স্বধর্ম, বৈজ্ঞানিক যুগের নয়। যুদ্ধের নামে লোকধ্বংসের জন্য বৈজ্ঞানিকরা সৃষ্টি করবে এরোপ্লেন, মাস্টার্ড গ্যাস, বিমান বিধ্বংসী কামান, হাউইজার, শ্ল্যাপনেল, ইউবোট আর আমি…
.
নাটকটা অজয়ের লেখা।
ধনঞ্জয় মিত্রের প্রথম পক্ষের ছেলে অজয়। বৈজ্ঞানিক এক্সপেরিমেন্টের বাতিক আছে। এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে প্রাণীহত্যা করে জেল পর্যন্ত খেটেছে। দীর্ঘদিন স্বদেশ ছাড়া। বোম্বাইবাসী। রহস্যময় চরিত্র।
বৃদ্ধ ধনঞ্জয় মিত্র প্রথমে তার দেড় কোটি টাকার সম্পত্তি এই অজয়ের নামেই উইল করেছিলেন। তারপর অজয়ের কীর্তিকাহিনি যৎকিঞ্চিৎ শুনেই উইল পালটানোর মনস্থ করলেন। অমনি তাঁর এটর্নি মাধবচরণ মারা গেলেন বিষপ্রয়োগে। কিন্তু কেউ ধরতে পারল না, বিষটা কী ধরনের, শরীরেই বা ঢুকল কী করে। অজয় তখন বোম্বাইতে।
মুলতুবি রইল উইল পালটানো। দিন কয়েক পরে এটর্নি সারদাচরণকে ডেকে পাঠালেন বৃদ্ধ ধনঞ্জয় মিত্র। সারদাচরণ মাধবচরণের ছেলে। বাপ-বেটা দুজনেই এটর্নি।
দ্বিতীয় পক্ষের দুই ছেলে বিজয় আর সুজয়কেও ডাকলেন ধনঞ্জয় মিত্র।
বিজয়কে ধমক দিয়ে বললেন ধনঞ্জয় মিত্র, তুমি যদি সেই অভিনেত্রীটিকে বিয়ে করার সঙ্কল্প ত্যাগ করো, তবেই সম্পত্তি পাবে। নইলে–
আপনার সম্পত্তি চাই না। বিজয় বললে সোজা গলায়।
ঠিক এমনি সময়ে একটা চিঠি এল ভৃত্যের হাতে। খাম ছিঁড়ে পড়লেন ধনঞ্জয় মিত্র। জবাব লিখে তক্ষুনি দিলেন ভৃত্যকে–ডাকবাক্সে ফেলে দেওয়ার জন্যে।
বিজয়কে বললেন, গলাটা শুকিয়ে গেছে। সোডা আর গ্লাস দাও।
গেলাসে সোজা ঢেলে দিল বিজয়। তার কয়েক মিনিট পরেই অপমৃত্যু ঘটল ধনঞ্জয় মিত্রের। শরীরে দেখা দিল বিষক্রিয়া।
গ্রেপ্তার হল বিজয়।
কিছুদিন পরেই বোম্বাই থেকে ফিরে এল অজয়।
কোর্টে দাঁড়িয়ে সে বললে, বিজয় খুনি নয়। ওঁকে ছেড়ে দিন।
ছাড়া পেল বিজয়। কিন্তু অজয় সুনজরে দেখল না তাকে। বরং চেষ্টা করল তার প্রেয়সী অরূপা দেবীকে ফুসলে আনার। এই সেই অভিনেত্রী যার জন্যে সম্পত্তিও ত্যাগ করতে চেয়েছিল বিজয়।
টাকার লোভে মেয়েরা সব পারে। অরূপা দেবীকেও একদিন দেখা গেল অজয়ের বাড়িতে। অজয়ের নিমন্ত্রণ সে রেখেছে। অজয় নাটক লেখে। সেই নাটকের গান্ধারী রোলটা তাকেই করতে হবে। বাড়ির মধ্যেই একখানা ঘরে বসবাস শুরু করে দিল অরূপা দেবী। মনোমালিন্য হয়ে গেল বিজয়ের সঙ্গে।
অজয় কিন্তু কল্পনাও করতে পারল না, নেপথ্যে থেকে কলকাঠি নাড়ছে প্রতুল লাহিড়ী। সে-ই পাঠিয়েছে অরূপা দেবীকে, সরিয়েছে বিজয়কে মনে আঘাত দিয়ে।
এমন সময়ে একখানা চিঠি এল অজয়ের নামে। প্রতুল লাহিড়ী হস্তগত করল চিঠিখানা। লিখেছেন সারদাচরণ। শুধু দুটি শব্দ–পঞ্চাশ হাজারেও নয়।
পরদিন সকালে দেশসুদ্ধ লোক জেনে গেল আর একটা অপমৃত্যুর চাঞ্চল্যকর সংবাদ। সারদাচরণও মারা গেছেন রহস্যজনকভাবে বিষপ্রয়োগে।
পুলিশ দপ্তরে খবর এল। অজয় টেলিফোন করে জানিয়েছে সারদাচরণের মৃত্যুর আগে নাকি বিজয়কে সেখানেও দেখা গিয়েছে।
পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজতে লাগল বিজয়কে।
প্রতুল লাহিড়ী অরূপা দেবীকে পরামর্শ দিলে বিজয়কে নিয়ে গা-ঢাকা দিতে। কেঁদুটির এক কুঁড়ে ঘরে পালিয়ে গেল দুজনে। অজয়ের নাটকটা পড়বার জন্যে সঙ্গে করে নিয়ে গেল অরূপা দেবী।
নাট্যকার হওয়ার শখ তখন মাথায় উঠেছে অজয়ের। জেল পালানো একটি মেয়ে এসে উঠেছে তার বাড়িতে। নাম তার উজালী। বোম্বাইতে বিয়ে করেছিল। মারাত্মক একটা বিযের সন্ধান এই উজালীর কাছেই সে জেনেছিল। বিষটা আসে একটা ফুল থেকে। ফুলটার নাম টামুই..
অরূপা দেবীকে অজয় বিয়ে করতে চায় জানতে পেরে বাঘিনী মূর্তি ধারণ করল উজালী। অজয়ের কুকীর্তি সে ফঁস করে দেবেই। মাধবচরণ, ধনঞ্জয় মিত্র এবং সারদাচরণকে দূর থেকেও খুন করার গুপ্ত রহস্য আর কেউ না জানলেও সে জানে…
কেঁদুটি থেকে ট্যাক্সি নিয়ে ফিরে এল অরূপা দেবী। হাতে নাটকের পাণ্ডুলিপি। চোখ বড়-বড়।
প্রতুলবাবু, প্রতুলবাবু, খুনগুলো হচ্ছে কী করে ধরে ফেলেছিল। বিষ…বিষ…ফুলের বিষ।
জানি। বলল প্রতুল। টামুই ফুলের বিষ। কিন্তু প্রয়োগ হচ্ছে কী করে? চিঠির মধ্যে দিয়ে বললে বিশু। অজয়ের বাড়িতে ছদ্মবেশে হেঁসেল সামলেছে অ্যাদ্দিন। আড়ি পেতে সাংঘাতিক চক্রান্তটা শুনেছে সে। এক্ষুনি কেঁদুটিতে লোক পাঠাতে হবে। বিজয়কে চিঠি লিখেছে অজয়। সে চিঠির জবাব দিলেই মারা পড়বে বিজয়।
কিন্তু কীভাবে?
উজালীকে বলল অজয়, চল আমরা পালাই বোম্বাইতে। খতম করে যাই বিজয়কে। পুলিশ তাকে খুঁজেছে খুনের অপরাধে। হঠাৎ মারা গেলে বুঝবে আত্মহত্যা করে জ্বালা জুড়িয়েছে।
বলে, মারাত্মক চিঠিখানা লিখে ফেলে দিয়ে এল ডাক বাক্সে।
ফিরে এসে গুলি করল উজালীকে।
পুলিশ এসে দেখল বিষ খেয়েছে অজয়। টামুই ফুলের বিষ। মারা গেল বিশ মিনিট পরে।
অরূপা দেবীর হাত থেকে নাটকের পাণ্ডুলিপিটা টেনে নিয়ে পড়ল প্রতুল লাহিড়ী।
.
কৃষ্ণ। আর আমি আর আমি ধ্বংস করব বিপুল কৌরব কুল–সামান্য একখানা চিঠির সাহায্যে।
ভীষ্ম–চিঠির সাহায্যে।
কৃষ্ণ। হ্যাঁ। আমি লিখব যাকে সে জবাব দেবে–ব্যস। আয়োজনের কোনও ঘটা নেই আধ ঘণ্টার ভেতর মৃত্যু এসে ধীরে ধীরে গ্রাস করবে। কেউ জানবে না কেউ বুঝবে না ডাক্তারের বিশ্লেষণ শক্তি হবে পরাহত। বৈজ্ঞানিকের তীক্ষ্ণ বুদ্ধি পরাজয়ের কালিমায় কালো হয়ে উঠবে।
ভীষ্ম। ব্যাপারটা বুঝিয়ে না বললে তোমার কথার একটা বর্ণও যে আমার মাথায় ঢুকছে, কৃষ্ণ!
কৃষ্ণ! মাথায় ঢুকবে না, ঠাকুরদা। ফুলে কীট আছে শুনেছেন তো? এ সেই ফুল আর এ-সেই কীট..
লাফিয়ে উঠে বললেন ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর আনন্দমোহন, ব্যস ব্যস আর পড়তে হবে, বুঝেছি।
খাতা বন্ধ করে বলল প্রতুল লাহিড়ী, হ্যাঁ, শুধু একখানা ডাক টিকিট!
কী বুঝলেন?
.
গোয়েন্দা ধাঁধার সমাধান
চিঠি লিখে খামে মুড়ে ডাক টিকিট লাগানোর সময়ে শতকরা নিরানব্বই জন মানুষ জিভের ডগায় ডাকটিকিট বুলিয়ে নেন হাতের কাছে জল বা জলশোষক স্পঞ্জ থাকে না বলে।
অজয় ডাকটিকিটের পেছনে টামুই ফুলের বিষ মাখিয়ে রাখত। যাকে খুন করতে হবে তাকে চিঠি লিখে জবাব চাইত এবং ঝটিতি জবাব পাওয়ার আশায় নিজের ঠিকানা লেখা আর একটা খাম আর বিষ মাখানো ডাকটিকিট সঙ্গে দিত।
ধনঞ্জয় মিত্র উইল পালটাবেন শুনেই মাধবচরণকে সরিয়ে দিয়েছিল এইভাবেই হাতে খানিকটা সময় নেওয়ার মতলবে। তারপরে একই কায়দায় চিঠি লিখল ধনঞ্জয় মিত্রকে। উইল পালটাবার জন্যে তিনি সবাইকে ডাকলেন এবং সবার সামনেই সেই চিঠির জবাব দিয়ে বিদায় নিলেন ধরাধাম থেকে।
মারা গেলেন সারদাচরণ একই পন্থায়। তিনি বোধহয় কিছুটা আঁচ করেছিলেন। অজয় তাঁকে পঞ্চাশ হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে মুখ বন্ধ করতে চেয়েছিল। ওটা অছিলা। উদ্দেশ্য জবাব নেওয়া। পঞ্চাশ হাজারেও নয় লিখে মৃত্যুমুখে ঢলে পড়লেন ভদ্রলোক।
এই হল কৃষ্ণের বৈজ্ঞানিক কুরুক্ষেত্র।
* সাপ্তাহিক অমৃত পত্রিকায় প্রকাশিত। ২৯শে ফাল্গুন, ১৩৮১।
গন্ধর্বলোক
ঈশানীর চিঠি ঈশান কোণের মেঘের মতোই আমার ছুটির দফারফা করে ছাড়ল। নামডাক ।এমনিতে হয়নি। বোম্বাইয়ের রূপোলি পর্দার তারকা-রানি আমি। কাজেই আবেগ বস্তুটার মাত্রা আমার মধ্যে একটু বেশিই। স্নায়ুর ওপরেই আমাকে বাঁচতে হয়। জানি, সব চিত্রতারকাদের মতোই চল্লিশ ছুঁয়ে আমাকেও গ্যাসট্রিক আলসারে ভুগতে হবে–স্নায়ুর ওপর অত্যাধিক চাপ দেওয়ার শাস্তি পেতে হবে। শিলাদকুমারও এই নিয়ে ঠাট্টা করে আমাকে।
বছরে পাঁচ-ছটা বড় বড় ছবিতে আমাকে নায়িকা হতেই হয়। দ্বিতীয় ছবির শুটিং শেষ হবার পর শিলাদকুমার ফিরল কাম্বোডিয়া থেকে। দুজনেই বেশ কাহিল। কেননা, সাতমাস একটানা কাম্বোডিয়ার ছবির কাজ করেছে শিলাদ। তাই প্রস্তাব করেছিল, আর একবার হানিমুনে বেরোনো যাক।
শিলাদের কথা শুনে হাসি পেয়েছিল বইকি। আর একবার হানিমুন, কথাটার কোনও মানে নেই আমার কাছে। কোনও হানিমুনই হয়নি আমাদের। বিয়ে হলে তো হবে। বিয়ে করার সময় পেলাম কখন? ফিল্মদুনিয়ার গন্ধর্বলোকে বিয়ে করার সময় কটা ভাগ্যবানের হয়?
সে যাই হোক, মধুচন্দ্রিমা যাপনের প্রস্তাব লুফে নিয়েছিলাম।
বাইরে বেরোনো নিরাপদ নয়। ভক্তদের জ্বালায় প্রাণ ওষ্ঠাগত হবে। তাই যেমন-তেমন ঘরে শুয়ে রইলাম। বাইরে বাজতে লাগল টেলিফোন। নীচে খটাখট শব্দে ব্যস্ত রইল অফিস টাইপরাইটার। ফ্যান-ক্লাব কর্মীরা ফুরসত পেল না চিঠির বস্তা থেকে মুখ তোলবার। ডিটেকটিভরাও রোজকারমতে টহল দিয়ে ফিরতে লাগল বাড়ি আর বাগানের প্রতিটি বর্গ ইঞ্চিতে।
আমি আর শিলাদ এয়ারকন্ডিশনড ঘরে শুয়ে বিভোর হয়ে রইলাম পরস্পরকে নিয়ে। এক-এক রাতে এক-এক ফুলশয্যার রোমান্সে মশগুল হয়ে রইলাম দুজনে দুজনকে নিয়ে। ব্রেকফাস্ট আসত সূর্য যখন মধ্যগগনে। আমি ক্রিম খেতে ভালোবাসি বলে শিলাদকুমার কত ঠাট্টাই না করত। বলত, দুদিনেই অ্যায়সা মোটা হবে যে ছবির কাজ আর জুটবে না। আমি শুনতাম না। ক্রিম আমার ভীষণ ভালো লাগে। এতদিনেও যখন মুটিয়ে যাইনি–তখন আর যাবোও না।
সেদিনও ব্রেকফাস্ট এলে ক্রিম খাচ্ছি। খেতে খেতে আমার চিঠির তাড়া থেকে একটা খাম বেছে নিলাম। খুলতেই দেখলাম ঈশানীর চিঠি।
শ্রীযুক্তা মদালসা দেবী
মান্যবরেষু,
আমি আর পারছি না। আপনার হয়ে জাল অটোগ্রাফ দিতে দিতে হাঁপিয়ে উঠেছি। রেহাই পাবার জন্য চুল হেঁটে ফেলাম। তবুও মুক্তি নেই। আপনার ভক্তের দল এখনও রাস্তায় দেখলেই আমার পেছনে ছোটে। মনে করে আমিই মদালসা। বলে, কেন চুল ছাঁটলাম। অমন লম্বা চুল হেঁটে কেন ববছাঁট করলাম। মদালসা দেবী, আমি সত্যিই আর পারছি না। সারাটা জীবন নকল মদালসা দেবী হয়ে কাটাবার বিড়ম্বনা আর সইতে পারছি না।
বিনীতা
ঈশানী দত্ত
চিঠি পড়েই মাথা গরম হয়ে গেল। চিঠির বক্তব্যর জন্য নয়। এ চিঠি আমার কাছে এল কী করে? সেক্রেটারিদের পইপই করে বলে দিয়েছি, ভক্তবিটেলদের কোনওরকম স্তুতিপত্র যেন আমার সামনে না পৌঁছোয়। ফ্যান-ক্লাব খুলেছি কি এমনি-এমনি? খোশামুদে চিঠি প্রথম প্রথম ভালোই লাগত। ভাবতেও অবাক লাগে, এসব চিঠির জবাবও দিতাম। কিন্তু হাউইয়ের মতো খ্যাতির আকাশে উঠে পড়ার পর স্তুতিপত্র দেখলেই মেজাজ খিঁচড়ে যায়।
একেই বলে খ্যাতির বিড়ম্বনা। খ্যাতি যখন থাকে না, তখন খ্যাতির পেছনে দৌড়াই। খ্যাতি যখন আসে, তখন খ্যাতিকে এড়িয়ে চলি। শিলাদকুমার অবশ্য এর ব্যতিক্রম। গোড়া থেকেই এ কারো ধার ধারেনি। গন্ধর্বলোকে হিরো রূপেই ওর প্রবেশ; প্রস্থানও ঘটবে হিরোর মতো।
তাই সেক্রেটারিদের ওপর ঢালাও হুকুম আছে, সব চিঠিই খুলে দেখবে। ব্যক্তিগত চিঠি আসবে, আমার সামনে-বাদবাকি সব যাবে ফ্যান-ক্লাবে। বাঁধা ছকের টাইপকরা চিঠিতে জবাব যাবে। এমনকী আমার সইকরা যে ফটোগ্রাফ পাঠানো হবে, তার সইটিও নিজে করব না–ওরাই আমার হয়ে করে দেবে।
মোট কথা, কোনও ধরনের ফ্যান-লেটার যেন আমার ত্রিসীমায় আসে। এই হল আমার অর্ডার। তা সত্ত্বেও ঈশানীর চিঠি আমার কাছে পৌঁছোয় কী করে?
বিরক্তি নিশ্চয় কণ্ঠেও প্রকাশ পেয়েছিল। কেননা, কাগজ পড়তে পড়তে মুখ তুলল শিলাদ–হল কী?
ফ্যান লেটার। হাজারবার বলেছি এসব চিঠি যেন আমার কাছে না পৌঁছোয়।
বলে, চিঠিটা ছুঁড়ে দিলাম ওর বিছানায়। এক হাতে তুলে নিল শিলাদ। ভারী সুন্দর হাতটা সিল্কের চাদরের পটভূমিকায় নতুন করে দেখলাম। হাত দেখে মানুষের চরিত্র ধরা যায়। অন্তত আমার তাই বিশ্বাস। তা না হলে যার চেহারা অমন অসুরের মতো, তার মন অমন মিষ্টি, অমন নরম, অমন শিল্পীসুলভ হবে কেন? ওর হাতে সে চিহ্ন আছে।
চিঠিটা পড়ল শিলাদ। পড়ে হেসে ফেলল–ঈশানী দত্ত! বেশ নাম। চিঠিটাও। ভক্তের চিঠি তো এরকম হয় না। ইন্টারেস্টিং! বলে, অপাঙ্গে তাকাল। চিঠিটার মধ্যে রহস্য আছে।
রহস্য! রহস্য আবার কি? এ চিঠি এখানে পৌঁছোল কী করে, এ ছাড়া আর কোনও রহস্য তো দেখছি না।
হাতের লেখাটা যে তোমার হাতের লেখার মতো। রহস্য সেইটাই।
কথাটা সত্যি। ঈশানী দত্তর হাতের লেখা অবিকল আমার হাতের লেখার মতোই।
সেকেন্ড কয়েকের মধ্যেই মতলবটা মাথায় এল আমার। খাট থেকে নামতে নামতে বললাম–চললাম।
কোথায়?
ঈশানীকে দেখতে।
কিন্তু এ যে হানিমুনের সময়! এই দ্যাখো কাগজেও তাই লিখেছে। এখন কি বাইরে বেরোয়?
নকল মদালসারও তো হানিমুনের ইচ্ছা যায়। বলে মুচকি হাসলাম আমি। বিধাতারও তখন হেসেছিলেন–অলক্ষ্যে।
বেশ তো, খাবার নেমতন্ন করো, বর্তে যাবে, শিলাদ বলেছিল।
উঁহু। থার্ডক্লাস যে-কোনও একটা হোটেলে শুধু দুজনে দেখা করব, কথা বলব। এই হল আমার আজকের অ্যাডভেঞ্চার।
সেই ব্যবস্থাই হল। প্যারাডাইজ হোটেল। বিকেল চারটে। ঘর বুক করার পর ঈশানী দত্তর প্যারেলের ঠিকানায় খবর পাঠালাম–আমি আসছি।
.
স্নান সেরে নখরঞ্জন করে চুল আঁচড়ে যখন আমার হেয়ার-ড্রেসারের চেম্বার থেকে বেরোলাম, তখন আমাকে নায়িকা-শ্রেষ্ঠা মদালসা বলে চেনা মুশকিল। প্রসাধন এবং কেশবিন্যাস আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতোই।
প্যারাডাইজ হোটেলের সিঁড়ির ধাপে পা দিয়ে হঠাৎ মনটা অন্যরকম হয়ে গেল। নকল মদালসাকে দেখে লাভ কী? খামোকা এনার্জি নষ্ট..ধাপ থেকে পা নামিয়ে ফিরতে যাচ্ছি, মনে পড়ল শিলাদকুমারের মুখ…ঠাট্টা…টিটকিরি…ভক্তের ভয়ে পলায়ন? নাঃ, ফেরা হল না। সোজা গেলাম অফিসরুমে। নাকের ডগায় চশমা এঁটে বুড়ো ম্যানেজার এমন ভাবে তাকাল আমার পানে যেন আমি মেয়েটা তেমন সুবিধের নয়। দুই চোখে বেশ সন্দেহ…বারান্দা দিয়ে এগোতে এগোতে বিড়বিড় করে কিঞ্চিৎ জ্ঞানদানও করা হল। এ হোটেল নামী হোটেল, কুঅভিসন্ধি নিয়ে এখানে কেউ আসে না। হোটেলের দুর্নাম মালিক একদম সইতে পারে না। বলতে-বলতে বুক করা কামরার সামনে পৌঁছোলাম। দরজা ভেজানো ছিল। ঠেলে ঢুকলাম। প্রায়ান্ধকার। একটা টেবিল। দূরপ্রান্তে গোটাতিনেক চেয়ার। কে যেন সেখানে বসে রয়েছে।
পেছন ফিরে দেখলাম বুড়ো নেই। বললাম–অন্ধকারে কি মুখ দেখা যায়? বলেই খট করে সুইচ টিপলাম। আলোয় ভরে উঠল ছোট্ট ঘরটা।
অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম নকল মদালসার দিকে। চেয়ারে বসা মেয়েটি যেন আর একটা আমি।
তফাত শুধু পোশাক। আমি যা পরেছি, তা দামি না হলেও পরিচ্ছন্ন। কিন্তু নকল আমি যা পরেছে, তা রীতিমতো নোংরা। যেমন ব্লাউজের ছিরি, তেমনি শাড়ির অবস্থা। ঘাড় পর্যন্ত ছাঁটা চুল। তা সত্ত্বেও আমার সঙ্গে তার মুখের আদলের হেরফের ঘটেনি। থুতনি সুডৌল। টানা টানা
চোখ। কামনার দুটি ডিপো। আমার ভক্তরা যে যে দেহশ্রীর জন্য আমাকে নিয়ে পাগল, সবই দেখলাম রয়েছে নকল আমির মধ্যে।
ঈশানী নির্ভয়ে তাকিয়েছিল। নিঃশঙ্ক চোখ। বলল–বসুন। কণ্ঠস্বর আমার মতোই। ঈষৎ ঘষা, ঈষৎ ধরা, ঈষৎ তীক্ষ্ণ। শুনেছি, পুরুষের রক্তস্রোত নাকি উদ্দাম হয় আমার এই কণ্ঠস্বরে। নকল আমি বহু চেষ্টায় এ স্বরও নকল করেছে।
আমি অভিনেত্রী। বিস্ময় চোখমুখ থেকে সরিয়ে রাখলাম। ঈশানী কিন্তু দেখলাম, মোটেই ঘাবড়ায়নি। মদালসার সামনে এসে বহু বাঘা রিপোর্টারও কেঁপে ওঠে। কিন্তু ঈশানী দত্ত বিন্দুমাত্র নার্ভাস হয়নি।
নৈঃশব্দ্য আমি ভাঙলাম। গৌরচন্দ্রিকার ধার দিয়েও গেলাম না। বললাম।–কি মনে করে?
কিছুই মনে করে নয়। বলল ঈশানী আমারই গলায়। আগে বসুন। অতদূরে নয়–আমার পাশে। ঈশানী যেন হুকুম করছে। যেহেতু তাকে আর আমাকে দেখতে যমজ বোনের মতো, অতএব আমার ওপর তার যেন একটা অধিকার জন্মে গিয়েছে। কত লম্বা আপনি?
প্রশ্নটা আকস্মিক। সুরটাও যেন কেমন-কেমন। কিন্তু গায়ে মাখলাম না। বললাম–সাড়ে পাঁচ।
আমারও তাই। ম্যাগাজিনেও তাই দেখেছিলাম। বাজিয়ে নিলাম।
কেন? বাজিয়ে নেবার দরকার কি? কিছু একটা বলা দরকার, তাই বললাম।
কোলের ওপর রাখা কালো হ্যান্ডব্যাগটা খুলল ঈশানী। একটা কালো রঙের সাইলেন্সার ফিট করা রিভলভার বার করে বলল–একটু পরেই আপনাকে খুন করব, তাই জেনে নিলাম। মরবার আগে কিছু বলার থাকলে বলতে পারেন।
নিস্তব্ধ ঘরে ঈশানীর কথা ফুরোলো। আবেগ নেই, উত্তাপ নেই, ঘৃণা নেই, দ্বেষ নেই। শুধু একটা ঘোষণা–আমাকে মরতে হবে। শুটিংয়ের সময়ে এরকম সংলাপ শুনলে মনে হত নাটকীয় মুহূর্ত তৈরি হচ্ছে। কিন্তু ঈশানীর কণ্ঠে নাটক নেই।
বিক্ষিপ্ত মনটাকে জড়ো করবার চেষ্টা করলাম। পারলাম না। শুধু মনে হল, অফিস ঘরের বুড়ো ম্যানেজার একটু আগেই হোটেলের সুনাম নিয়ে লম্বা-চওড়া বচন ঝেড়েছে; মনে পড়ল রাস্তার মোড়ে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ড্রাইভার, এয়ারকন্ডিশনড ঘরে আমার প্রতীক্ষায় বসে আছে শিলাদকুমার। ইচ্ছে হল খামচে নিই রিভলভারটা। ফিল্ম হলে তাই করতাম। কিন্তু এটা বাস্তব। সব শেষ হতে চলেছে।
ধরা গলায় বললাম–কী করেছি আমি? কেন খুন করবে?
জবাব দিল না ঈশানী। রিভলভারটা দোলাতে দোলাতে শুধু চেয়ে রইল।
রাগ হয়ে গেল–ফঁদটা ভালোই।
ফাঁদ আপনার। আপনিই আমাকে ডেকেছেন।
কথাটা সত্যি। অ্যাডভেঞ্চারের লোভে নিজের ফঁদ নিজেই পেতেছি। চোখ ফেটে জল এল। কিন্তু কাঁদতে পারলাম না। শুধু বললাম ছেলেমানুষের মতো–কিন্তু কী অপরাধ করেছি আমি?
এ প্রশ্নের জন্য তৈরি ছিল ঈশানী। বল্লমের মতোই জবাবটা ছুঁড়ে দিল আমাকে লক্ষ্য করে–অপরাধ! শেষ নেই অপরাধের। প্রথম অপরাধ, হুবহু আমার চেহারা নিয়ে কেন এসেছিলেন পৃথিবীতে? দ্বিতীয় অপরাধ, এসেই ছিলেন যদি ফিল্মস্টার হতে গেলেন কেন? কেন আমার জীবন বিষিয়ে তুলেছেন? নিশ্চিন্ত মনে আমি কোথাও বেরোতে পারি না। বেরোলেই মদালসা মনে করে আমায় তাড়া করে, ছিঁড়ে খায়। কেন? কী অপরাধে? বছরের পর বছর কেন এই নির্যাতন? আপনার হয়ে মিথ্যে অটোগ্রাফ দিতে দিতে হাত ব্যথা হয়ে যায়, জানোয়ার লোকগুলোর জ্বালায় অলিগলি দিয়ে মুখ ঢেকে পালিয়ে বেড়াই। কেন? কী অপরাধে? আজ সুযোগ এসেছে শোধ তুলবার, এই অত্যাচার বন্ধ করবার। শুধু তাই নয়, এবার আমার পালা। বহু বছর মদালসার ছায়া হয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছি, এবার হবো আসল মদালসা। হাঃ হাঃ, হাঃ।
পাগল? না। স্থির সংকল্পে বজ্রকঠিন মুখ। দীর্ঘ ক্লেশের শেষ হতে চলেছে। তাই আনন্দ জ্বলজ্বলে আনন। দুই চোখে কেবল ঘৃণা, অপরিসীম ঘৃণা।
ফিসফিস করে শুধু বললাম–আসল মদালসা হবে? আমাকে মেরে? পারবে না।
পারব না? কেন?
দেখতে আমার মতো হলেও সত্যি সত্যিই তো তুমি নও। আমার চালচলনই আলাদা। সে জিনিস রপ্ত করা মুখের কথা নয়। যেমন ধরো, এ হোটেল থেকে কতদুরে ঠিক কোনখানে গাড়ি পার্ক করেছি, তা তোমার জানা নেই।
বারান্দা থেকে তাও দেখেছি। মোড়ের কাছে বাস-স্টপেজের সামনেই গাড়ি পার্ক করেছেন।
ড্রাইভারের নাম? কী বলে ডাকবে?
কমলবাহাদুর। ডাকব শুধু কমল বলে।
যাবে কোথায়? কমলবাহাদুরকে বলবে কী?
ব্লু-টেম্পল, অবিকল আমার গলায় বলল ঈশানী।
কমল ধরে ফেলবে। এখান থেকে বেরিয়েই যে গাড়ি বাড়ি ফিরছি না, কমল তা জানে। আজ বিকেলে অনেক প্রোগ্রাম নিয়ে তবে রাস্তায় বেরিয়েছি।
বলব, কমল, আর পারি না। প্রোগ্রাম বাতিল। চলো ব্লু-টেম্পল। ছুটির সময়ে যতটা পারি জিরিয়ে নিই।
শুনতে-শুনতে বেশ বুঝলাম কমলবাহাদুরের ক্ষমতা নেই একথা শোনার পর নকল মনিবানিকে চেনে। গলার খোঁচগুলো পর্যন্ত নকল করেছে ঈশানী। বলবার কায়দায় কোনও ফারাক নেই। শুধু পোশাক পাল্টে নিলেই হল। আমার পোশাক ও পরবে–নিজের পোশক আমাকে পরাবে। কমলবাহাদুর কেন, স্বয়ং শিলাদকুমারও চিনতে পারে কিনা সন্দেহ।
উপায় নেই। কোনও উপায় নেই। আমার জীবনে গোপনতা নেই। আমি যে গন্ধর্বলোকের অপ্সরী। আমার চালচলন, খাওয়া-দাওয়া, কথাবার্তা, হাবভাব–সবকিছুই পাবলিক প্রপার্টি। ভক্ত জনগণ মুখস্থ করে রেখেছে আমার অষ্টপ্রহরের পাঁচালী। ঈশানী আমাকে নিয়ে লেখা প্রবন্ধ পড়েছে, আমার অভিনয় করা ফিল্ম দেখেছে, আমার সঙ্গে ফিল্ম সমালোচকের সাক্ষাৎকার মুখস্থ করেছে; ফলে আমার সব কিছুই তার নখদর্পণে। যে-কোনও মুহূর্তে আমার জায়গায় সে দাঁড়ানোর সব পর্বই তার কণ্ঠস্থ। কী ভয়ানক!
অভিশপ্ত গন্ধর্বলোকের পরী আমি। এই তো আমার জীবন। আমার কথা বলার রেকর্ডে আমার ভক্তবৃন্দ বারংবার শুনেছে। ঈশানীও শুনেছে। ভক্তিতে গদগদ হয়ে নয়–আমার সর্বনাশ কামনায়। রেকর্ডের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে রপ্ত করেছে মদালসার সেই বিখ্যাত কথা বলার ভঙ্গি।
ঠান্ডা গলায় বললাম–বিয়ে করেছ নিশ্চয়। স্বামী তো তোমায় ছাড়বে না।
স্বামী আমায় নেয় না।
আশ্চর্য মিল! আমার স্বামীও আমাকে নেয়নি।
ছেলেপুলে?
অবাক চাহনি মেলে তাকায় ঈশানী–সে কী! ভুলে গেলেন? আমাদের তো ছেলেপুলে নেই?
চমকে উঠেছিলাম কথা বলার ধরনে। প্রথমে ভেবেছিলাম, আমাদের বলতে ঈশানী আর স্বামীর কথা বলা হচ্ছে। পরক্ষণেই বুঝলাম, তা নয় ঈশানী আর আমি আমাদের বলতে এই দুজনে। বছরের পর বছর এইভাবেই ভেবে এসেছে ঈশানী। মজ্জায় তার এই চিন্তাই পাকা আসন পেতে বসেছে। মদালসা মানেই ঈশানী–ঈশানী মানেই মদালসা। লোকে তার পিছু নিয়েছে মদালসা ভেবে-চিন্তাটা আরও কায়েমী হয়েছে। দীর্ঘকাল ধরে মদালসার অভিনয় করতে করতে ঈশানী নিজেও কখন মদালসা হয়ে গিয়েছে। সত্যিই তো আমি সন্তানহীনা। এখন প্রয়োজন কেবল পট পরিবর্তনের। আসল মদালসা নিহত হবে নকল মদালসার বেশে। আর, নকল মদালসা গিয়ে বসবে আসল মদালসার সিংহাসনে।
সফল হবে এক উন্মাদ ছন্নছাড়ার অপ্রকৃতিস্থ স্বপ্ন। তিল তিল করে খ্যাতির যে সৌধ আমি গড়ে তুলেছি, বহু বছরের সাধনায় যে বৈভব, যশ, প্রতিপত্তি অর্জন করেছি, কালো রিভলভারের একটিমাত্র গুলিতে তা চলে যাবে নোংরা পোশাকের ওই মেয়েমানুষটার দখলে। আর, খ্যাতিহীন হোটেলের প্রায়ন্ধকার ঘরে যথাসময় আবিষ্কৃত হবে নামগোত্রহীন একটি লাশ!
ঈশানী চেয়েছিল আমার পানে। চোখ তুলতেই বলল–একটা কথা জানার ছিল। শিলাদকুমার লোকটা কীরকম?
কনকনে বরফ-খণ্ডের মতো কথাটা কানের পর্দায় গিয়ে আঘাত হানল। সঙ্গে সঙ্গে ভাবনার স্রোত বইল অন্যদিকে। জানি শিলাদ কি বলবে। আমাকে নিকেশ করে ঈশানী আমার বেশে ব্লু-টেম্পলে ফিরলেই শিলাদ শুধোবে–কিগো পরী, ঈশানীকে দেখলে?
ঈশানী নতুন ঢং শুরু করবে। বলবে, চুলটা হঠাৎ ছাঁটতে হল। শুনে শিলাদ সাদাসাদা ঝকঝকে দাঁত বার করে অট্টহাসি হাসবে। কাছে টেনে নেবে ঈশানীকে।
লুঠ হয়ে যাবে শিলাদকুমার! আমার জীবনের সবচাইতে দামি, সবচাইতে আদরের, সবচাইতে গোপনীয় মণিকোঠায় ধুলো পায়ে তাণ্ডব নৃত্য শুরু করবে শয়তানী ঈশানী। হীরে জহরতকেও ছড়িয়ে রাখি, কিন্তু সন্তর্পণে সরিয়ে রাখি যে মানুষটিকে–সেই শিলাদকুমারকে কেড়ে নিয়ে যাবে ঈশানী–কিন্তু কেউ কোনওদিন জানতেও পারবে না! শিলাদের নিঃশ্বাসে উত্তপ্ত হবে ঈশানী, শিলাদের আদরে বিহ্বল হবে শয়তানি!
ভাবতে ভাবতেই লক্ষ লক্ষ অগ্নিশিখা যেন উদ্দাম নৃত্যে আগুন ধরিয়ে দিল শিরায় শিরায়, মগজের প্রতি স্নায়ুকোষে। যা হবার নয়, তাই হতে চলেছে–অসম্ভব সম্ভব হতে চলেছে। সেই মুহূর্তে দুর্বিসহ এই সম্ভাবনা নিঃশেষে মুছে নিয়ে গেল আমার সমস্ত ভয়, আতঙ্ক, আশঙ্কা। ইচ্ছে হল…প্রচণ্ড ইচ্ছে হল চুলোয় যাক রিভলভারের তপ্ত বুলেট…ইচ্ছে হল লাফিয়ে গিয়ে ঝাঁপিড়ে পড়ি কুচক্রী ঈশানীর ওপর…আঁচড়ে কামড়ে চড়িয়ে পিটিয়ে কেড়ে নিই নিকষ হাতিয়ার…খামচে খুবলে ছিঁড়ে মেরে বিচুর্ণ করি ওর আকাশ-কুসুম আশার…কিন্তু না.মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে..শয়তানী বুদ্ধি দিয়েই কজায় আনতে হবে।
অকস্মাৎ পরিকল্পনাটার আবির্ভাব ঘটেছিল মগজে। মস্তিষ্কের সেই মুহূর্তের উর্বরতায় পরে বিস্মিত হয়েছিলাম। মিথ্যে…একটা ডাহা মিথ্যেকে বলতে হবে সত্যির মতো করে…পারব না? নিশ্চয় পারব..আমি যে অভিনেত্রী…মিথ্যের বেসাতিতে বড় কারবারী!
ঈশানী, আবেগের পুঞ্জ মেঘ গলার মধ্যে সঞ্চয় করে বললাম–ঈশানী, শিলাদকুমারের সব কথাই তোমাকে বলতে পারি। যা জানি–সব। তারপর তুমি আমাকে খুনও করতে পারো। কিন্তু আমার ভাগ্যে যা লেখা, তা রোধ করার ক্ষমতা আমার নেই। ঈশানী, তোমারও নেই।
বলে থামলাম। সেকেন্ড কয়েক শব্দহীন সাসপেন্স সৃষ্টি করলাম। তারপর একই সুরে কথার খেই টেনে বললাম–ঈশানী, আমার পরিণতি রোধ করবার ক্ষমতা তোমারও নেই। নিয়তির লিখন, ঈশানী, নিয়তির লিখন। একথা কেউ জানে না, কাউকে বলিনি। কাগজে কোথাও বেরোয়নি। জানো আমার শেষ কোথায়? কী অবস্থায়?
উৎকণ্ঠা। নৈঃশব্দ্য। ঈশানীর নির্নিমেষ চাহনি।
আর মাত্র ছমাস। ছমাস পরেই আমাকে যেতে হবে অ্যাসাইলামে..রাঁচির পাগলাগারদে… দুরারোগ্য ব্যাধিতে দিনে দিনে পাকিয়ে যাচ্ছি আমি…এত খাই কিন্তু গায়ে মাংস লাগে না (ব্রেকফাস্টে ক্রিম খাওয়া নিয়ে শিলাদকুমারের রঙ্গ পরিহাস আমার মিথ্যেকে অনেকটা সত্যির বনেদ জোগাল)… আর মাত্র ছমাস, ছমাস বাইরে থাকার অনুমতি দিয়েছে ডাক্তার…এই ছমাস শেষ বিশ্রাম নিচ্ছি। ব্লু-টেম্পলে..কাগজে কে না সে খবর পড়েছে…কিন্তু এ বিশ্রাম যে শেষ বিশ্রাম তা কেউ জানে না…জানে না শিলাদকুমার আমাকে শেষ সঙ্গসুখ দিচ্ছে বহু অর্থের বিনিময়ে…
এইখান থেকেই আমার অভিনয় প্রাণবন্ত হল। শিলাদকুমার যে দেহ মনে একটা অসুর ছাড়া কিছু নয়–এ সত্য বলতে বলতে আমি কেঁদে ফেললাম। শিলাদকুমার যে বহু অভিনেত্রীর শয্যায় অংশ নিয়েছে, এ ঈর্ষা আমার অন্তর সেই মুহূর্তে বিষিয়ে তুলল। শিলাদকুমারের সাত মাস কাম্বোডিয়া প্রবাস যে অনেক গোপন রঙ্গের মুখরোচক ইতিহাস, এ কল্পনা চোখের জল আরও বৃদ্ধি করল। ফলে, অশ্রু যেন বন্যার মতো উপচে পড়ল দু-গাল বেয়ে। রমণীমোহন শিলাদকুমার তুমি আমার যৌবন-সুধার শেষ বিন্দুটিও লুঠে নিতে এসেছ…তারপর যাবে নতুন ফুলে, নতুন মধুর লোভে। এ ফুল যাবে ঝরে…ছমাস পরে রাঁচির পাগলাগারদে শুরু হবে অনিশ্চিত জীবন। ডাক্তাররা? চেষ্টার ত্রুটি করেনি। কিন্তু শেষ ঘনিয়ে এসেছে…কেউ জানে না…জানি শুধু আমি আর শিলাদকুমার…
শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার আমার ভাগ্যে একাধিকবার জুটেছে। কিন্তু সেদিনের অভিনয় বুঝি সব রেকর্ডকেও ম্লান করে দিয়েছিল। তিল তিল করে আমার দীপ নিভে যাওয়ার কাহিনির শেষে আমি অঝোর ধারে কাঁদতে লাগলাম।
ঘর নিস্তব্দ। আমার উচ্ছ্বাস এবার নীরব অশ্রুধারায় পর্যবসিত। দুহাতে মুখ ঢেকে বেশ কিছুক্ষণ ডুকরে কাঁদলাম। মনের চোখ দিয়ে দেখলাম, কালো রিভলভারের মিশমিশে নলটা আমার ব্রহ্মরন্ধ্রে তাগ করেছে…অন্তিম নির্ঘোষের প্রত্যাশায় কাঠ হয়ে রইলাম কিছুক্ষণ।
কিন্তু কোনও শব্দ নেই। নিস্তব্ধ ঘরে কেবল আমার ফোঁপানি যেন শ্মশানপুরীর হাহাকার সৃষ্টি করে চলেছে। দু-হাত নামিয়ে মাথা তুললাম। অবাক হয়ে গেলাম ঈশানীকে দেখে।
ঈশানী কাঁদছে। চেয়ারের পেছনে মাথা হেলিয়ে দিয়ে কাঁদছে। রিভলভারের নলচে নির্মমভাবে চেপে ধরেছে চিবুকের নীচে।
আপনিও…আপনিও… ফুঁপিয়ে উঠল ও।
ঈশানী! আমার আর্ত চিৎকারে আমি নিজেই চমকে উঠেছিলাম। ঈশানী! না..না…! বলতে-বলতে ছিটকে গিয়েছিলাম চেয়ার ছেড়ে। এক, ঝটকায় ওর শিথিল মুঠি থেকে কেড়ে নিয়েছিলাম রিভলভার। ঈশানী হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল আমার ওপর। দু-হাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে সেকি কান্না!
সেকেন্ডকয়েক গেল ওকে সামলাতে। অবশ্য রিভলভার হাতছাড়া করলাম না। সিধে হয়ে বসল ঈশানী। কান্নার ফাঁকে ফাঁকে যা বলল, তা সত্যিই মর্মন্তুদ।
দৈব সহায় না হলে এরকম কাকতালীয় বড় একটা ঘটে না। কী করে যে এ কাণ্ড, ঘটল, তা এখনও ভাবলে আমার অবাক লাগে। আমার অজান্তেই ওর এমন একটা টন্টনে জায়গা ছুঁয়ে ফেলেছিলাম যে নিমেষে ভেঙে পড়েছিল ঈশানী। হয়তো ঈশানীর করাল ব্যক্তিত্বের প্রভাব সাময়িকভাবেও আমাকে আচ্ছন্ন করেছিল। অলৌকিক ঘটনাও ঘটে। নইলে ওর মনের গোপন ক্ষতে এভাবে আমার হাত গিয়ে পড়বে কেন?
অদ্ভুত কাকতালীয়। ঈশানী নিজেই এই একই ব্যাধিতে ভুগছে। যেদিন ও আমাকে চিঠি লিখে, তার আগের দিন ডাক্তার ওকে যে প্রেসক্রিপশন লিখেছে, তারও অর্থ ছমাস পরে পাগলাগারদে গিয়ে মগজ পরীক্ষা করা। এই ছমাস খোলা বাতাসে ঘুরেও যদি ঈশানীর দুরারোগ্য ব্যাধির উপশম না ঘটে, তাহলে পথ ওই একটাই!
ঈশানী তাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল। বছরের পর বছর নকল মদালসা থেকে একলাফে আসল মদালসা হবার প্ল্যানটা তখনি মগজে এসেছিল। এছাড়া বাঁচবার আর পথ নেই। প্রেসক্রিপশনের লিখনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখানোর জন্যেই ও আমাকে মেরে আমার জীবনে প্রবেশ করতে চেয়েছিল। কিন্তু ভাগ্যের কি পরিহাস! আমিও সেই ব্যাধিতে আক্রান্ত? আমারও সেই শোচনীয় পরিণতি?
কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলে উঠেছিল ঈশানীর। আমি আমার রুমাল দিয়ে ওর চোখ মুছিয়ে দিলাম। ও উঠে দাঁড়িয়ে ধরা গলায় বলল–জানি না আর দেখা হবে কিনা। পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলাম। অভাবের যন্ত্রণা আর সইতে পারছিলাম না। কিন্তু নিয়তির চাইতে বড় আর কিছু নেই।
সেই মুহূর্তে আমার মনটা কীরকম হয়ে গেল। যে মেয়েমানুষটা কিছুক্ষণ আগেই কসাইয়ের মতো আমার হৃদ্যন্ত্র স্তব্ধ করার পণ করেছিল, সহসা তার অসহায় চাহনি নিঃসীম অনুকম্পায় ভরিয়ে তুলল আমার অন্তর। আমি আর একটি কথাও বললাম না। হ্যান্ডব্যাগ থেকে ফাউন্টেন পেন আর চেকবই বার করে দশ হাজার টাকার একটা বেয়ারার চেক লিখে দিলাম ঈশানীকে।
ও চেক নিয়ে আমার আগেই বিদায় নিল। সজল চোখে শেষবার আমার পানে তাকিয়ে ধীরে ধীরে নেমে গেল সিঁড়ি বেয়ে। নোংরা শাড়ি ব্লাউজের আড়ালে ছমাসের পরমায়ু নিয়ে প্রেতচ্ছায়ার মতো অদৃশ্য হল নকল মদালসা–আমার তারকা জীবনের দুষ্টগ্রহ!
.
শিলাদকুমার সব শুনে অট্টহাসিতে ঘর কাঁপয়ে তুলল।
–এরকম সুপারফাইন ব্ল্যাকমেলিং এর আগে কখনো ঘটেছে বলে শুনিনি। ওগো কন্যে, তোমার কপাল ভালো, ঈশানী এখনো ফিল্মে নামেনি। নামলে কী কাণ্ড ঘটত বলো তো? তুমি আর এ তুমি হতে না।
কথাটা একদম উড়িয়ে দিতে পারি না। কেননা ঈশানীর রিভলভারটা ব্লু-টেম্পলে এনেছিলাম। খুলেওছিলাম। কার্তুজের খুপরিতে একটা কার্তুজও পাইনি।
* রহস্য পত্রিকায় প্রকাশিত।
আগাথা ক্রিস্টি-র গল্প নিয়ে গোয়েন্দা ধাঁধা
গ্র্যান্ড মেট্রোপলিটনের মোতির মালা। হারকুল পয়রট।
হেস্টিংস বললে, পয়রট, চলো ব্রাইটনে গিয়ে মাথা ঠান্ডা করে আসি।
সঙ্গে-সঙ্গে রাজি হল হারকুল পয়রট। এলাম ব্রাইটন। কিন্তু মস্তিষ্কের ব্যায়াম থেকে রেহাই পেলাম না। ঘটনাটা ঘটল সেই রাতেই।
পয়রট তো বলেই ফেলল, হেস্টিংস, ইচ্ছে যাচ্ছে কিছু হিরে-জহরত ছিনতাই করে নিই এই তালে। থামের পাশে ওই মোটা মেয়েটাকে দেখেছ? গয়নার সচল দোকান তাই না?
ওঁর নাম মিসেস ওপালসেন, বলল হেস্টিংস।
চেনো?
সামান্য। স্বামী শেয়ার মার্কেটের দালাল। তেলের হিড়িকে আঙুল ফুলে কলাগাছ।
খাওয়াদাওয়ার পর লাউঞ্জে দেখা হয়ে গেল ওপালসেন দম্পতির সঙ্গে। একগাল হেসে মিসেস তার বক্ষশোভা দেখালেন পয়রটকে। মানে, মূল্যবান কণ্ঠহারটি। তাতেও আশ মিটল না। হারকুল পয়রটকে তার মোতির মালা না দেখালেই নয়। ছুটলেন শোওয়ার ঘরে মহামূল্যবান নেই নেকলেস আনতে।
স্বামীদেবতা গম্ভীর চালে বললেন, মালার মতো মালা মশাই। দেখে চোখ ঠিকরে যাবে। দামটা অবশ্য চড়া–
কথা আটকে গেল এক ছোকরা খানসামার আবির্ভাবে। মেমসাহেব তলব করেছেন কর্তাকে।
দৌড়লেন ধনকুবের ওপালসেন। দশ মিনিট আর পাত্তা নেই।
ভুরু কুঁচকে বলল হেস্টিংস, আরে গেল যা! এঁরা কি আর আসবেন না?
পয়রট বললেন–না। একটা গোলমাল হয়েছে।
তুমি জানলে কী করে?
এইমাত্র হন্তদন্ত হয়ে অফিসঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন হোটেল ম্যানেজার। লিফটম্যান গুজগুজ করছে ওয়েটারদের সঙ্গে তিনবার ঘণ্টা বাজল লিফটের কিন্তু খেয়াল নেই লিফটম্যানের। ওয়েটারদেরও মন নেই খদ্দেরদের দিকে। ওয়েটাররা যখন খদ্দেরদের কথাও ভুলে যায়, তখন জানবে–দেখো, পুলিশ এসে গেল। সত্যি সত্যিই দুজন পুলিশ ঢুকল হোটেলে। তারপরেই দৌড়ে এল একজন হোটেল কর্মচারী।
স্যার, আপনারা দয়া করে মিস্টার ওপালসেনের ঘরে পায়ের ধুলো দেবেন?
নিশ্চয়, নিশ্চয়। পয়রট যেন এক পায়ে খাড়া ছিল এতক্ষণ।
মিসেস ওপালসেনের ঘরে ঢুকে দেখলাম দেখবার মতো এক দৃশ্য। গয়নামোড়া গৃহিণী ইজিচেয়ারে চিৎপটাং হয়ে শুয়ে কাঁদছেন হাপুসনয়নে। জলের ধারায় ধুয়ে যাচ্ছে মুখের পাউডার। পেছনে হাত দিয়ে রাঙামুখে পায়চারি করছেন কর্তা। পুলিশ-অফিসার নোটবই খুলে জেরা করছেন আর লিখছেন। একজন পরিচারিকা বলির পাঁঠার মতো কাঁপছে সামনে। আর একজন রাগে ফুলছে পাশে দাঁড়িয়ে।
ব্যাপার অতি গুরুতর। মহামূল্যবান মোতির মালা চুরি হয়ে গেছে। খেতে যাওয়ার আগেও গিন্নি দেখেছিলেন মালাটা। গয়নার বাক্সে চাবি দিয়ে রেখে গেছিলেন টেবিলের ড্রয়ারে। গয়নার বাক্সের চাবিটা অবশ্য মামুলি। যে কেউ খুলতে পারে। ড্রয়ারেও চাবি থাকে না। কেননা, বলির পাঁঠার মত কাঁপছে, ওই যে মেয়েটা, ও সবসময় থাকে ঘরে। ওর নাম সিলেসটিন। ফরাসি মেয়ে। গিন্নির সেবাদাসী। কর্তার হুকুমমতো সে ঘর থেকে বেরোয় না। এমনকি হোটেলের ঝি (রাগে ফুলছে যে মেয়েটা) যখন ঘরে ঢোকে, তখনও সিলেসটিন থাকে ঘরে। তা সত্ত্বেও এইটুকু সময়ের মধ্যে কে যে নিল মোতির মালা বোঝা যাচ্ছে না।
সিলেসটিন দৌড়ে এল পয়রটের সামনে। সে কী কান্না। পয়রট জাতে ফরাসি (পয়রট বলে, মোটেই না আমি বেলজিয়ান), সুতরাং সিলেসটিকে বাঁচাতেই হবে। গোলমুখো ওই ঝি মাগিই হাতসাফাই করেছে মালাটা।
হোটেলের ঝি তেড়ে উঠল। সার্চ করা হোক এখুনি। কিন্তু সার্চ করেও মোতির মালা পাওয়া গেল না কারও কাছে।
সিলেসটিন বললে, দু-বার আমি পাশের ঘরে গেছিলাম। ওইটাই আমার ঘর। একবার তুলো আনতে। আর কেবার কঁচি আনতে।
পয়রট ঘড়ি বের করে বললে, যাও তো একবার। দেখি কতক্ষণ লাগে।
দু-বার গেল সিলেসটিন। প্রথমবার লাগল বারো সেকেন্ড। দ্বিতীয়বার পনেরো সেকেন্ড।
পয়রট নিজে এবার ঘড়ি ধরে ড্রয়ার খুলল, গয়নার বাক্স বার করল। চাবি খুলল ডালা খুলে ফের বন্ধ করল, চাবি বন্ধ করল, ড্রয়ার খুলে রেখে দিল। সবশুদ্ধ লাগল ছেচল্লিশ সেকেন্ড। তার মানে, হোটেলের ঝি মোতির মালা নেয়নি। সিলেসটিনই চুরনী। সত্যি সত্যিই সিলেসটিনের বিছানার তলা থেকে পাওয়া গেল মালাটা।
পুলিশ ধরে নিয়ে গেল তাকে।
পয়রট দেখল, টেবিলের পাশে একটা খিল আঁটা দরজা। ওদিক থেকেও আঁটা খিল। গেল সেই ঘরে। ফাঁকা ঘর। দরজার পাশেই একটা ধূলিধূসরিত টেবিল। ধুলোর ওপর একটা চৌকো ছাপ।
বেরিয়ে এল পয়রট। হোটেলের ঝিকে নিয়ে গেল মিস্টার ওপালসেনের ঘরে। গিন্নির ঘরের উলটোদিকে তার ঘর। পকেট থেকে একটা কার্ড বার করে বলল, এরকম একটা কার্ড দেখেছ কোথাও?
না তো। কার্ডটা উলটেপালটে দেখে বলল হোটেল-ঝি।
খানসামাকে ডাক। খানসামা আসতেই কার্ডটা বাড়িয়ে ধরল পয়রট। উলটেপালটে দেখে কার্ড ফিরিয়ে দিয়ে ঘাড় নাড়ল খানসামানা, এ কার্ড সে আগে দেখেনি।
বেরিয়ে এল পয়রট। দুই চোখ বেশ উজ্জ্বল। বলল হেস্টিংসকে, আমি লন্ডন যাচ্ছি। হারকুল পয়রটকে এত সহজে ধোঁকা দেওয়া যায় না। মালা-চোর এবার ধরা পড়বে।
মালা তো পাওয়া গেছে, বলল হেস্টিংস।
দূর। ওটা নকল মালা। বলে গায়ের কোটটা হেস্টিংসের হাতে ধরিয়ে দিল পয়রট। বলল, কোটের হাতায় সাদা গুঁড়োটা বুরুশ দিয়ে ঝেড়ে রেখো তো।
কীসের গুঁড়ো?
ফ্রেঞ্চ চক। ড্রয়ারে ছিল–কোটে লেগে গেছে।
পরের দিন সন্ধেবেলা ফিরে এল হারকুল পয়রট।
সত্যিই ফিরে এসেছে আসল মুক্তোর মালা। খাঁচায় ঢুকেছে হোটেল-ঝি আর খানসামা।
কিন্তু কীভাবে?
.
গোয়েন্দা ধাঁধার সমাধান
খানসামা বন্ধ ঘরের দরজার পাশে দাঁড়িয়েছিল নকল চাবি হাতে। খিল খুলে রেখেছিল। সিলেসটিন প্রথমবার তুলে আনতে গেল নিজের ঘরে। ড্রয়ার টেনে গয়নার বাক্স বের করল হোটেল-ঝি। খিল খুলে চালান করল পাশের ঘরে। ফিরে এল সিলেসটিন। আবার গেল কাঁচি আনতে। আবার দরজা খুলল হোটেল-ঝি। খানসামা ততক্ষণে বাক্স খুলে মালা নিয়ে নিয়েছে। খালি বাক্সটা নিয়ে ড্রয়ারে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল হোটেল-ঝি।
নকল মুক্তোর মালাটা সকালবেলা বিছানা ঝাড়বার সময়ে সিলেসটিনের গদির তলায় লুকিয়ে রেখেছিল হোটেল-ঝি।
পয়রট দেখল খালি ঘরে ধুলো জমা টেবিলে একটা চৌকো ছাপ। গয়নার বাক্সটাও চৌকো এবং একই মাপের। বুঝে ফেলল হোটেল-ঝির সঙ্গে এ ঘরের খানসামা হাত মিলিয়েছে। তাই আগে থেকেই ফ্রেঞ্চ চক মাখিয়ে রাখা হয়েছিল ড্রয়ারে যাতে টানাটানিতে আওয়াজ না হয়।
সাদা কার্ডটা বিশেষ মশলা মাখানো আঙুলের ছাপ নেওয়ার কার্ড। ঝি আর খানসামার আঙুলের ছাপ কার্ডের ওপর ধরে নিয়ে পয়রট গেল লন্ডনে। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড পুরোনো ফাইল দেখে বললো, এরা দুজনেই দাগি হিরে চোর। এখন ফেরারি।
গ্রেপ্তার হল দেবা আর দেবী। খানসামার পকেটে পাওয়া গেল আসল মুক্তোর মালা।
ফ্রেঞ্চ চক আর ধুলোর ছাপ হেস্টিংসও দেখেছিল কিন্তু বুদ্ধির খেলায় হেরে গেল পয়রটের কাছে।
* সাপ্তাহিক অমৃত পত্রিকায় প্রকাশিত।
ঘড়ি বিবি
বিয়ের আগে ওর নাম ছিল রাবেয়া। বিয়ের পর নাম দিলাম রেবা।
আমি যা ছিলাম, তাই রয়ে গেলাম। মিন্টু পাইন। সুবর্ণ বণিক।
সিকিখানা কলকাতার মালিক বলতে পারেন আমাকে। বাপ-ঠাকুরদার আমলে আরও প্রপার্টি ছিল। এখনো মোহর আছে, হিরে-জহরত আছে। থাকে ব্যাঙ্কের লকারে। টাকা ফিক্সড ডিপোজিটে। সুদ যা পাই, তা শুনলে চোখ কপালে উঠে যাবে আপনার। সেই সঙ্গে বাড়ি ভাড়ার অঙ্ক যদি শোনেন, হিংসে হবেই।
তাই থাকি সাদাসিধেভাবে। সোনার বেনেদের ওপর হিংসে অনেকেরই। সপ্তগ্রামী বেনে তো। কবে কোনওকালে ব্যবসা-বাণিজ্য করে আমার পূর্বপুরুষরা দেদার টাকা জমিয়েছিলেন, সুদে-আসলে তা বাড়তে-বাড়তে এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে, সারা জীবন লাটসাহেবি করে কাটালেও আমার পরের সাতপুরুষ বসে খেয়ে যেতে পারবে।
আমি কিন্তু কোনওরকম নষ্টামির মধ্যে যাইনি। বাবা এবং মা অকালেই স্বর্গধামে রওনা হওয়ার সময়েও আমি ব্যাচেলর। কিন্তু সাতগেঁইয়া স্টাইলে রক্ষিতা-ফক্ষিতাও রাখিনি। আমার একমাত্র নেশা সন্ধে নাগাদ একটা ধনে পরিমাণ আফিং দুধ দিয়ে খাওয়া। আর কেবল দেশ দেখে বেড়ানো। পৃথিবীটাকে বারকয়েক পাক দিয়ে এসেছি।
ফ্র্যাঙ্কলি সব কথা বললাম। এরপর আমার এই আশ্চর্য কাহিনি বিশ্বাস করা না করা আপনার অভিরুচি।
মুর্শিদাবাদের হাজারদুয়ারী দেখে বেরিয়ে আসার সময় গাছতলায় একটি পরমাসুন্দরীকে একদিন বসে বসে কাঁদতে দেখে চমকে উঠেছিলাম। আমি সাতগেঁইয়া। আত্মীয়-স্বজনের মধ্যেই ডাকসাইটে সুন্দরীদের দেখেছি ছোটবেলা থেকেই। রূপটুপ তাই কোনওকালেই আমাকে টলাতে পারে না। কিন্তু হাজারদুয়ারির বাইরে সেই অনিন্দ্যসুন্দরীকে দেখে আপনা থেকেই পা থেমে গেল আমার।
বয়স তার বড়জোর বিশ। কসমেটিকসের ভড়কি একদম নেই চোখে-মুখে। সবটাই ভগবানের দেওয়া। অমন কালো চোখ আমরা সাতগেঁইয়া মহলেও কখনো দেখিনি। অমন ঘন কালো কেঁকড়া চুল, দুধে আলতায় গোলা গায়ের রং আর নিখুঁত গড়ন-পেটন সারা পৃথিবী ঘুরে এসেও দেখিনি।
গাছতলায় একলা বসে এমন ভুবনমোহিনীকে কাঁদতে দেখে আমার মন চঞ্চল হয়েছিল। পাশে তার একটিমাত্র বোঁচকা। পরনে সাদা জমিনের লালপাড়ের সাদামাটা শাড়ি। শাড়ির খুঁট দিয়ে চোখের জল মুছছে আর কেঁদেই চলেছে সে।
কাছে গেলাম। বৃত্তান্ত শুনলাম। আমিও পরম রূপবান। বিশ্বাস না হয়, এসে দেখে গেলেই পারেন। দুধ আফিংয়ের দৌলতে আর টাকা টনিকের কল্যাণে সাতগেঁইয়া চেহারা দেখলে মনে হবে নিশ্চয় ধুতি-পাঞ্জাবি পরা কোনও নবাবপুর বুঝি। যদিও সাদাসিধেভাবে থাকি কিন্তু চেহারায় জুলুষ ঢাকা যায় না।
মেয়েটা চোখ মুছে আমাকে দেখেই প্রেমে পড়েছিল। তাই সব কথা খুলে বলেছিল। বাড়ি তার পুব-বাংলায়। বাপ-মাকে খেয়েছে অকালে। এক চাচা তাকে বর্ডার পার করে নিয়ে আসে। তারপর সোনার গয়না ভর্তি পুঁটলিটা সঙ্গে নিয়ে তাকে গাছতলায় বসিয়ে সরে পড়েছে। রেখে গেছে। কেবল এই বোঁচকাটা।
আমি মেয়েটাকে নিয়ে এলাম কলকাতায়। জ্ঞাতিগুষ্ঠিদের তোয়াক্কা করলাম না। একবার মসজিদে আর একবার পুরুত ডাকিয়ে–মুসলমানি মতে আর হিন্দুমতে তাকে বিয়ে করলাম। সেই থেকে রাবেয়া হল রেবা।
এইবার আসি আসল গল্পে। রেবার বোঁচকা দিয়েই এই বিচিত্র কাহিনির শুরু। বোঁচকার মধ্যে যেন সাত রাজার ধন আছে, এমনিভাবেই সবসময়ে তা আগলে রাখত রেবা। একদিন দেখলাম সেই সাত রাজার ধন।
বললে পেত্যয় হবে না আপনার। তবুও বলি। জিনিসটা একটা ঘড়ি। সেকেলে পেন্ডুলাম ঘড়ি। কিন্তু বাইরের গড়নটা মামুলি ঘড়ির মতো নয়। একটা মেয়েছেলের মুর্তি। ঘোমটা ফাঁক করে যেন সে উঁকি দিচ্ছে বাইরে। কিন্তু মুখের বদলে একটা ঘড়ি।
আমি এমন আজব ঘড়ি মশাই জীবনে দেখিনি। সাতগেঁইয়াদের সাতমহলা বাড়িতে হাজার রকমের দিশিবিলিতি ঘড়ি দেখেছি এতটুকু বয়স থেকে। কিন্তু মেয়েমানুষের চেহারাওয়ালা এমন অদ্ভুত ঘড়ি লাইফে দেখিনি। মেয়েটার মুখ নেই–অথচ তাকে বেশ সুন্দরীই মনে হয়। মনে হয় ঘোমটা সরিয়ে মুখটা দেখি। তার হাঁটু বেঁকিয়ে দাঁড়ানোর ভঙ্গিমার মধ্যেও এমন একটা আকর্ষণ যে একবার তাকালে আবার তাকাতে ইচ্ছে যায়–একদৃষ্টে চেয়ে থাকতে ইচ্ছে যায়।
আমিও চেয়েছিলাম। ঘাড়ের ওপর ফোঁস করে নিঃশ্বেস পড়তেই বুঝলাম রেবা এসে দাঁড়িয়েছে। ঘাড় না ফিরিয়েই বললাম–চমৎকার ঘড়ি তো!
রেবা জবাব দিল না। আমারও চোখ ফেরাতে ইচ্ছে হচ্ছিল না ঘড়ি-সুন্দরীর ওপর থেকে।
ঘাড় না ফিরিয়েই বললাম–এমন ঘড়িকে বোঁচকায় রেখেছ কেন? ঝুলিয়ে দাও দেওয়ালে। দু-চোখ ভরে রোজ দেখি।
রেবা তখনও জবাব দিল না।
আমিও একদৃষ্টে ঘড়ি-সুন্দরীকে দেখতে দেখতে বললাম–সত্যিই সুন্দরী। তোমার মতোই।
তাই বুঝি? খুব আস্তে কানের কাছে কথাটা বলল রেবা। গলার স্বর আর বলার ভঙ্গিটা এমন যে শুনেই খটনা লাগল। ঘাড় ফিরিয়ে দেখলাম। রেবা অনিমেষে তাকিয়ে আছে সেই ঘড়ির দিকে।
কার ঘড়ি, রেবা?
রেবা জবাব দিল না। কোনওদিনই দেয়নি। জিগ্যেস করে করে মুখ ব্যথা হয়ে যাওয়ায় আমিও আর জিগ্যেস করিনি। শুধু বুঝেছি, ঘড়িটা তার প্রাণ। এবং ঘড়ি নিয়ে কাউকে কোনও কথা বলতেই সে রাজি নয়।
ঘড়িটা কিন্তু জোর করেই আমি আমার শোওয়ার ঘরে টাঙিয়ে দিয়েছিলাম। দিন-কতক ঠিকমতো চলেছিল, সময়ও দিয়েছিল। তারপর একদিন রাত্রে দেখলাম ঘড়ি বন্ধ হয়ে গেছে।
মাঝ রাতে উঠেছিলাম পেট ব্যথা করছিল বলে। আফিং খেলে পেটে বড় বায়ু হয়। পেট ফাঁফে। আমারও ঘুম ভেঙে গেছে। এমনিতে বায়ুর রোগ। তার ওপর আফিং। রেবা ঘুমোচ্ছে দেখে আমি নেমে এলাম খাট থেকে। চোখ পড়ল ঘড়ির ওপর।
.
দেখলাম, পেন্ডুলাম দুলছে না। তার মানে ঘড়ি থেমে আছে। দম দেওয়া হয়নি বোধহয়। ও ঘড়িতে দম দেওয়ার ভার অবশ্য আমার নয়–রেবার। দম দেওয়া, তেল দেওয়া–সব ওর কাজ। তাই ঘড়ি বন্ধ দেখে আমি আর ঘড়িতে হাত না দিয়ে খাটের পাশ দিয়ে বাথরুমের দিকে এগোচ্ছি, এমন সময়ে টিক-টক টিক-টক আওয়াজ কানে ভেসে এল।
ঘড়ি তো বন্ধ। অথচ স্পষ্ট পেন্ডুলাম দোলার আওয়াজ হচ্ছে। ফিরে দেখলাম পেন্ডুলাম দুলছে না। ঘড়ি বন্ধ। টিক-টক টিক-টক আওয়াজটা বেশ শোনা যাচ্ছে। ঘর নিস্তব্ধ বলেই স্পষ্ট কানে বাজছে।
ধুত্তোর। আফিংয়ের মৌতাত তো। বাথরুম থেকে ঘুরে শুয়ে পড়লাম। টিক-টক আওয়াজ শুনতে-শুনতে ঘুমিয়ে পড়লাম।
সকালে উঠে চা খেতে খেতে রেবাকে ঘটনাটা বলতেই ওর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। ও মাথায় ঘোমটা দিয়ে দাঁড়িয়েছিল আমার পাশে। এক হাঁটু বেঁকিয়ে দাঁড়ানোর ভঙ্গিমাটা অনেকটা ওই ঘড়ি-সুন্দরীর মতোই। ঘাড় বেঁকিয়ে মুখের দিকে তাই চেয়েছিলাম। ঘড়ির বদলে অনিন্দ্যসুন্দর মুখখানা দেখলাম। যেন সমস্ত রক্ত নেমে গেছে সেই মুখ থেকে।
কী হল?
ত্রস্তে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল রেবা। এ সম্পর্কে আর কোনও কথাও হল না পরে।
এরপরেও একদিন রাত্রে দেখলাম, আর শুনলাম সেই একই কাণ্ড। ঘড়ি তো বন্ধ কিন্তু টিক-টক আওয়াজ শোনা যাচ্ছে রেবা।
সকালবেলা কথাটা বললাম রেবাকে। আবার সেইভাবে মুখখানা ছাইয়ের মতো ফ্যাকাশে করে ঘর থেকে ছুটে পালাল রেবা।
তারপর থেকেই দেখতাম, রাত্রে আর রেবা ঘুমোয় না। একদৃষ্টে চেয়ে থাকে দেওয়ালের ঘড়ির দিকে। ভোর হলেই ঘুমিয়ে পড়ে অকাতরে। যতক্ষণ জেগে থাকে, ঘড়িও চলে বেশ টিক-টক করে।
জোর করে ওকে নিয়ে এলাম পুরীতে। ঘড়িটা আনতে চেয়েছিল সঙ্গে। আমি রাজি হইনি। আমার মন বলছে, ওই ঘড়িই যত নষ্টের গোড়া। ওকে দূরে রাখা দরকার।
পুরীতে রাত্রে ঘুম ভেঙে গেল ঢেউয়ের গর্জনে। শুধু ঢেউয়ের গর্জনে নয়–আরও একটা আওয়াজে। টিক-টক শব্দটা যেন কানের কাছেই বাজছে।
উঠে বসলাম। ঘরে কোথাও ঘড়ি নেই। আমার হাতে ইলেকট্রনিক রিস্টওয়াচ। শব্দের বালাই নেই।
টর্চ জ্বেলে দেখছিলাম আশপাশ। হঠাৎ টর্চের আলো রেবার চুলের ওপর পড়তেই চমকে উঠলাম। ওর মাথা ভর্তি ঘন কালো চুলের মধ্যে সেই প্রথম সাদার ঝিলিক চোখে পড়ল। এর আগে ওর মাথায় পাকা চুল কখনো দেখিনি। এই বয়েসে চুল পাকার কথা ভাবাও যায় না। উদ্বেগে অবশ্য পাকে। ঠিক করলাম, কলকাতায় ফিরেই ডাক্তার দেখাতে হবে।
সকাল হল। আমার আগে অনেক ভোরে উঠে পড়েছিল রেবা। মুখ-চোখ বড্ড ক্লান্ত দেখলাম। যেন রাতারাতি বুড়িয়ে গেছে। মাথার পাকা চুলের সংখ্যা আরও বেড়েছে।
ক্লান্ত চোখে ক্লান্ত কণ্ঠে ও বললে–বাড়ি চলো এখুনি।
সে স্বর, সে চাউনি উপেক্ষা করতে পারলাম না। ফিরে এলাম কলকাতায়। বাড়িতে ঢোকার মুখেই দেখলাম দরজা খোলা। ভেতরে ঢুকে দেখলাম, চোর পড়েছিল, যা পেয়েছে, নিয়ে গেছে। শোবার ঘরে মেঝের ওপর আছড়ে ফেলে গেছে ঘড়ি সুন্দরীকে।
ধপ করে একটা শব্দ হল পেছনে। রেবা দু-হাতে বুক খামচে ধরে বসে পড়েছে মেঝেতে। মুখ নিরক্ত।
টেলিফোন তুললাম ডাক্তারকে ফোন করব বলে। লাইন খারাপ। বেরোতে যাচ্ছি–বাধা দিল রেবা। কোনও কথা না শুনে ছুটে গিয়ে ডেকে আনলাম ডাক্তার।
শোবার ঘরে ঢুকে কিন্তু রেবাকে দেখলাম না–ঘড়ি সুন্দরীকেও দেখলাম না। এক বস্ত্রে বাড়ি ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে রেবা–সঙ্গে নিয়ে গেছে ওর প্রাণ সেই ঘড়িটাকে।
রেবাকে আজ পর্যন্ত আর দেখিনি। আপনার চোখে পড়লে কাইন্ডলি খবর দেবেন। আমার মন বলছে ওকে কাছে পেলে সেই অদ্ভুত রহস্যের ব্যাখ্যা ঠিক পেয়ে যাব। নিস্তব্ধ রাতে ঘড়ি বন্ধ থাকলেও ঘড়ি চলার আওয়াজ কোত্থেকে হয়। ঠিক জানতে পারব–কানটা শুধু পাততে হবে–ওর বুকে!
* ক্রাইম পত্রিকায় প্রকাশিত, ১৯৬৩
ছিদ্রান্বেষী ইন্দ্রনাথ
গোয়েন্দা আমরা প্রত্যেকেই, দাঁতে কামড়ানো চুরুটের ফাঁক দিয়ে জড়িয়ে মড়িয়ে বলল ইন্দ্রনাথ। প্রাত্যহিক জীবনে কে গোয়েন্দা নয় বলতে পারো?
চাইনিজ শ্রিম্প বল খাওয়ার নেমন্তন্ন করেছিল কবিতা। সাদা বাংলায়, চিংড়ি, পকৌড়া। পাকস্থলী পরিপূর্ণ হওয়ার পর শুরু হয়েছে নির্ভেজাল আচ্ছা।
মেয়ে-গোয়েন্দা অবশ্য ঘরে ঘরে, সোয়ামীদের ওপর নজর রাখার সময়ে, মুচকি হেসে চুটকি ছাড়ল কবিতা : যেমন আমার ঘরে আমি গোয়েন্দা।
ইন্দ্রনাথ রসিকতার মুডে ছিল না। তাই একতাল ধোঁয়া ছেড়ে বললে, যেমন ধরো উকিল, ডাক্তার, অফিসার, ব্যবসাদার, রিপোর্টার। হোয়াইট হাউসের ভিত কাঁপিয়ে ছাড়ল দুজন রিপোর্টার। গিয়েছিল চুরির ঘটনার খোঁজে–পেলো সাপের সন্ধান। শুরু হল গোয়েন্দাগিরি। টেলিফোনে খবর নিতে হবে? প্রশ্ন করে চুপ করে থাকো দশ সেকেন্ড। জবাব না এলে বুঝতে হবে প্রশ্নের জবাব হল হ্যাঁ। টেলিফোনও যখন বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াল, তখন হোয়াইট হাউসের কেউকেটাটির সঙ্গে দেখা করার সঙ্কেত জানানো হত ঝুল বারান্দার কোণে ফুলদানি বসিয়ে দেখাসাক্ষাতের সময় জানানো হত পরের দিনের নিউইয়র্ক টাইমস-এর ২০ নম্বর পৃষ্ঠায়। সেই পৃষ্ঠায় ঘড়ির কাঁটা এঁকে গোপন সংবাদদাতা জানিয়ে দিতেন কোথায় কখন দেখা পাওয়া যাবে তার। আশ্চর্য, তাই না? গোয়েন্দা সাংবাদিকদের দৌলতেই সিংহাসনচ্যুত হলেন বহু কু-কর্মের নায়ক প্রেসিডেন্ট নিকসন।
আমি বললাম, নতুন কথা কিছু শুনছি না।
ভুরু তুলে ইন্দ্রনাথ বললে, নিকসনের ছিদ্র অন্বেষণ দূর করে শুধু একখানা বই লিখেই বব আর কার্ল আজ পর্যন্ত পিটেছেন এক কোটি চোদ্দো লক্ষ টাকা। বই লেখার আগেই প্রকাশকের কাছে পেয়েছেন পঁয়তাল্লিশ হাজার ডলার। প্লেরা পত্রিকা লেখাটা ছেপেছে ত্রিশ হাজার ডলার দিয়ে। ফিল্ম প্রোডিউসার সিনেমা করবেন বলে দিয়েছেন সাড়ে চার লক্ষ ডলার। পেপার ব্যাক বার করার জন্যে নিলাম করে বইটার দাম তুলে দিয়েছেন দশ লক্ষ ডলার পর্যন্ত। পুলিজার পুরস্কার পর্যন্ত পকেটে পুরেছেন ওঁরা। মৃগাঙ্ক, ইচ্ছে যায় আমার কেসগুলো বব আর কার্লের হাতে তুলে দিই। কলমের জোর থাকলে কি না হয়!
মাথা গরম হয়ে গেল আমার : নিজেকে বিরাট মনে করছিস মনে হচ্ছে? আমার না হয় কলমের জোর নেই, তোরও গোয়েন্দাগিরির জোর এমন কিছু নেই যে রাতারাতি পৃথিবী বিখ্যাত হবি। এত অহঙ্কার ভালো নয়। পতনের পূর্ব লক্ষণ।
যেন শুনতেই পায়নি। এমন ভাবে জানলা দিয়ে আকাশ দেখতে দেখতে ইন্দ্রনাথ আত্মগত ভাবে বলে চলল, যত ভাবি ততই অবাক হই। গোয়েন্দা কে নয়? সব মানুষই নিজের নিজের পেশায় অল্পবিস্তর গোয়েন্দা। চিন্তাকে যে ডিসিপ্লিনে আনতে পেরেছে, বুদ্ধিকে যে একাগ্র করতে পেরেছে, পর্যবেক্ষণকে যে প্রয়োগ করতে পেরেছে–গোয়েন্দা হবার যোগ্যতা তার মধ্যে আছে। ভালো ডাক্তারকেও ফাঁদ পেতে রোগকে সন্ধান করতে হয়। এইরকম একটি চরিত্র শার্লক হোমস এবং সুবিখ্যাত ডিটেকটিভ মেথডের সৃষ্টি করেন কোনান ডয়াল। অফিসার যদি অন্ধ হয়, কারবারি যদি ভোঁতা-বুদ্ধি হয়, তাহলে লুঠেরা জোচ্চোরেরা দুদিনেই রাজা হয়ে বসত। বুদ্ধির লড়াই চলছে। সর্বক্ষেত্রে। এরকম টুকটাক অনেক ঘটনা আমার জানা আছে। অফিসার নিজেই গোয়েন্দা হয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা বাঁচিয়ে দিয়েছে কোম্পানির।
তা ঠিক, সায় দিল কবিতা : প্রবঞ্চকরা দুষ্ট জীবাণুর মতোই কিলবিল করছে আশেপাশে। যে যত ভালো গোয়েন্দা, সে তত নিরাপদ। কথাগুলো দামি কথা সন্দেহ নেই। কিন্তু আমার নিরীহ সোয়ামীকে ঠেস দিয়ে কথা বলার কি দরকার বলতে পারো?
কেন বলব না বলতে পারো? চুরুট নামিয়ে বলল ইন্দ্রনাথ, স্ট্যানলি গার্ডনার, সিরিল হেয়ার–এঁরা প্রত্যেকেই পেশায় উকিল। তাই তাদের গোয়েন্দা গল্পে অত ধার। কোনান ডয়াল, নীহার গুপ্ত পেশায় ডাক্তার–তাই লেখাও ক্ষুরধার। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, জি-কে চেস্টারটন সাহিত্যের সম্রাট–গোয়েন্দা গল্পেও তার আভাস। কিন্তু আমাদের মৃগাঙ্ক রায়ের কি গুণ আছে বলতে পারো। না, না, চটলে চলবে না। গুণীর কাছে প্রশস্তির চেয়ে সমালোচনার কদর বেশি।
কিন্তু এর নাম ছিদ্রান্বেষণ–সমালোচনা নয়। মুখ টিপে হেসে বলল কবিতা।
ছিদ্র অন্বেষণ করাই তো আমার কাজ। চুরুট ফের কামড়ে ধরে বলল ইন্দ্রনাথ, নিচ্ছিদ্র চক্রান্তে ছিদ্র খুঁজে বার করার সাধু নাম হল গোয়েন্দাগিরি। সত্য আর ছিদ্র এক্ষেত্রে একই টাকার এপিঠ-ওপিঠ।
মুখ লাল করে বললাম, এর শোধ আমি তুলব, ইন্দ্র। এখন থেকে তোকে ছিদ্রান্বেষী ইন্দ্রনাথ বলেই চালাব–সত্যান্বেষী নয়।
অট্টহেসে বললে ইন্দ্রনাথ, ভালোই তো, তাতে এক ঢিলে দু-পাখি মরবে। তোর ভাষায় গ্ল্যামারের অভাব প্রকাশ পাবে। আর, এতদিন বাদে আমার কপালে একটা খেতাব অন্তত জুটবে।
এমন সময়ে কবিতা বললে সবিস্ময়ে, ওকি অবনীবাবু, নাক টিপে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?
রাগ জল হয়ে গেল দরজার দিকে তাকাতেই। অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার অবনী চাটুয্যে দাঁড়িয়ে সেখানে। তর্জনী আর বুড়ো আঙুল দিয়ে টিপে আছেন বাঁ-নাকের বাম ছিদ্র। বললেন অনুনাসিক কণ্ঠে, দেখছি উঁন ফুটোয় নিসে পড়ছে কিনা।
তাজ্জব হয়ে বললাম, সে আবার কী?
নাক ছেড়ে দিয়ে বাঁ-পা আগে বাড়িয়ে ঘরে পদার্পণ করলেন অবনীবাবু। বললেন, শাস্ত্র তো মানেন না। মানলে এত দুর্ঘটনা দেশে ঘটত না।
সকৌতুকে বলল ইন্দ্রনাথ, ইড়া আর পিঙ্গলার ব্যাপার মনে হচ্ছে?
ভীষণ খুশি হলেন অবনীবাবু ও যাক, জানেন তাহলে। শুভকর্মে চন্দ্রনাড়ী প্রশস্ত। মানে, বাঁ-নাকে নিসে পড়লেই শুভকর্ম করা উচিত।
এখন কোন নাকে পড়ছে দেখলেন?
বাঁ-নাকে। সেই জন্যেই তো বাঁ-পা ফেলে ঢুকলাম মশায়।
অশুভ ঝাটে পড়েছেন মনে হচ্ছে?
টাক চুলকে বললেন অবনীবাবু, আর বলেন কেন, একেবারে নিচ্ছিদ্র প্লট মশাই– স্কাউড্রেলটাকে ধরেও ধরতে পারছি না।
অপাঙ্গে আমার পানে চাইল ইন্দ্রনাথ। বলল, ছিদ্র খুঁজতে হবে তো? বলুন, বলুন, ছিদ্রান্বেষী হাজির।
.
বলব কি মশায়, রাত দুটোর সময়ে সে কি উৎপাত! ঝনঝনঝন। বুঝছেন তো কীসের উৎপাত? টেলিফোন! টেলিফোন! যতক্ষণ মরে থাকে, ততক্ষণ ঘুমিয়ে খেয়ে জিরিয়ে বাঁচি মশায়, জ্যান্ত হলেই প্রাণান্ত!
যাক, যা বলছিলাম, রাত দুটোর সময়ে আরম্ভ হল টেলিফোনের বাঁদরামি। ঠিক যেন ঘুংড়ি কাসি। ইচ্ছে হল দিই ব্যাটাকে এক ডোজ স্পঞ্জি খাইয়ে। হোমিওপ্যাথি বিদেশ থেকে এসেছে বলে এত হেনস্থা করবেন না। গরু হারালে শুধু গরু খুঁজে পাওয়া যায় না। বাদবাকি সব হয়। মহাত্মা হানিম্যান বলেছেন…
যাচ্চলে! যা বলতে যাচ্ছিলাম ভুলে গেলাম…। ও হ্যাঁ, নিচ্ছিদ্র প্লট। রাত দুটো। টেলিফোন। ঘুম ভাঙতেই তেড়েমেড়ে রিসিভার খামচে ধরে চেঁচিয়ে উঠলাম, কে? কে? এত রাত্রে কীসের দরকার?
অমনি মিষ্টি গলায় তোতলা স্বরে ককিয়ে উঠছিল একটা মেয়েছেলে : অবনীবাবু? বাঁ-বাঁচান! ওরা আ-আ-আমাকে কিডন্যাপ করতে আসছে!
সে এক জ্বালা মশায়! ভগবান তোতলাদের মেরেছেন। আমার কিছু বলার নেই। কিন্তু কথা বলতে গেলে বলুন দিকি মাথা গরম হয় না?
যাই হোক, হড়বড় করে তোতলাতে তোতলাতে মেয়েটা বললে পার্ক টেরেসের দশতলার ফ্ল্যাট থেকে তাকে গায়েব করতে আসছে ডাকাতরা। এক্ষুনি না এলেই নয়।
কথার শেষ পর্যন্ত শোনা গেল না, কড়-ড়-ড় করে গেল লাইনটা কেটে। এদিকে অ্যাটম বোমা ফাটিয়ে মরছি; অথচ টেলিফোনটা পর্যন্ত নিখুঁত বানাতে পারি না। মাইক্রোস্কোপ আনাই বিলেত থেকে। ঘেন্না ধরে গেল মশাই দেখে শুনে।
ওইরকম টেলিফোন পেলে চুপচাপ থাকা যায় না। দূরভাষিণীর মুণ্ডপাত করতে করতে ধড়াচূড়া এঁটে নিলাম। পার্ক স্ট্রিটেই যখন বদলি হয়েছি, তখন পার্ক টেরেসে না গিয়েও তো থাকা যায় না। বেরোতে যাচ্ছি, এমন সময়ে আবার উৎপাত। ফের টেলিফোন!
এবার অবিকল সেই রকম মেয়েলি গলা। সেই রকমই মিষ্টি, কিন্তু যেন সর্দিৰ্বসা–মানে আপনাদের ছেলেছোকরাদের ভাষায় সেক্সি। শুধু যা তোতলা নয়।
ও হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছি। প্রথম মেয়েটার নাম হিমি, দু-নম্বর মেয়েটার নাম হিমা। হিমি নাকি হিমার ছোটবোন। হিমা কান্না কান্না গলায় বললে, এক্ষুনি নাকি হিমিকে জোর করে নিয়ে যাবে মেয়েচোরেরা। ঠিকানাও বলে দিল। একই ঠিকানা। পার্ক টেরেসের দশতলা।
দুজন সেপাই আর একজন অফিসারকে নিয়ে ছুটলাম তক্ষুনি। নির্জন রাস্তা। পার্ক স্ট্রিটে অবশ্য রাত বলে কিছু নেই। দশতলা পার্ক টেরেসের সামনে আসতে না আসতে দেখলাম, সত্যি সত্যিই একটা মেয়েকে কাঁধের ওপর ফেলে বেরিয়ে আসছে একজন লোয়ার ক্লাসের লোক। পেছনে আরও দুজন। ওরা এসে দাঁড়াল একটা উইলিজ জিপের সামনে।
কিন্তু ঠিক সেই সময়ে মোড় ঘুরল আমার জিপ। ফুলস্পিডে গাড়ি চালাচ্ছিলাম। টহলদারি পুলিশকার হলে অত জোরে ছুটত না। ধড়িবাজ মেয়েচোরেরা তা বুঝেই বোধহয় মেয়েটাকে ফুটপাতে ফেলেই ফের ঢুকে পড়ল পার্ক টেরেসে।
মহা পড়ে পড়লাম তাই দেখে। মেয়েটাকে সামলাব, না স্কাউনড্রেলগুলোর পেছনে দৌড়াব। বুড়ো বয়েসে আমি তো আর ছুটতে পারি না। পার্ক টেরেসের বাড়িখানাও চাট্টিখানি কথা নয়। ফ্ল্যাটের সংখ্যাই তো আড়াইশ। শয়তান তিনটে কোথায় লুকিয়েছে দেখতে হলে আরও সেপাই চাই। আমি তাই মেয়েটাকে জিপে চাপিয়ে একজন সেপাই নিয়ে ফিরে এলাম থানায়। পরে ভ্যানভর্তি সেপাই পাঠালাম বটে কিন্তু ওদের আর টিকি দেখতে পেলাম না। উইলিজ জিপটাও নাকি চোরাই জিপ।
চুলোয় যাক সেকথা। ফ্যাসাদের শুরু হল থানায় ঢুকতেই। দেখি কি আমার অফিস ঘরে বসে অবিকল, ওই রকম চেহারার একটা মেয়ে। বলব কি মশায়, ঠিক যেন সন্দেশের ছাঁচে তৈরি মুখ চোখ। যমজ। বুঝেছেন? বউমা, অমন চোখ বড় বড় করে অকিও না মা। আরও আছে। শেষকালে চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসতেও পারে।
অজ্ঞান মেয়েটার জ্ঞান ফেরানোর ব্যবস্থা করলাম। যমজ বোনের পরিচয়ও পেলাম। হিমি আর হিমা। বড়লোকের মেয়ে মশাই। আদুরে আদুরে চেহারা। আইবুড়ো। অথচ বাপ এখনই দশতলা বারোতলা বাড়িতে একটি করে ফ্ল্যাট কিনে দিয়েছেন। ব্ল্যাকমানির খেলা তো, বলবার কিছুই নেই। মেয়েগুলিও হয়েছে তেমনি।
মরুকগে! ওদের কথা শুনব বলে বসতে না বসতেই রাতবিরেতে আর এক আপদ। বলুন দিকি কি আপদ? কল্পনাও করতে পারবেন না মশাই। মৃগাঙ্কবাবু অবশ্য আমাকে নিয়ে ঠেসে ক্যারিকেচার লিখছেন, কিন্তু বললে রাগ করবেন জানি–ওঁর কল্পনা শক্তিও তো তেমন নয়।
বউমার মুখ ভার হল কেন? আসল কথা না বলে, বাজে কথা বলছি বলে? বুড়ো হয়েছি তো। রিটায়ারের সময় হয়ে এল। এখন একটু ফালতু কথা বলে ফেলি। কিছু মনে কোরো না। কী বলছিলাম? ও হ্যাঁ। আর একটা আপদ। ধরতে পারেননি তো কি আপদ? মেয়েছেলে মশায়, আর একটা মেয়েছেলে। ভোর চারটের সময়ে হন্তদন্ত হয়ে থানায় ঢুকল আর একটা মেয়েছেলে। অবিকল অন্য দুজনের মতো দেখতে।
বললে না পেত্যয় যাবেন মশায়, থানাশুদ্ধ লোক ব্যোমকে গেল তিন তিনটে একই ছাঁচের সন্দেশ দেখে। সরেশ সন্দেশ। কিন্তু এরকম কাণ্ড কখনও দেখিনি হোল লাইফে। যমজ পর্যন্ত দেখেছি, কিন্তু…কিন্তু…তিনটে মেয়ে একই ডিম ফুটে বেরোলে কী বলা উচিত মৃগাঙ্কবাবু?…এমজ? ঠিক, ঠিক! এমজ! এমজ বোনই বটে। নামও শুনলাম তিন নম্বরের। হিমু। মানে, হিমি, হিমা আর হিমু হল
অনেক রাত্রে গ্র্যান্ড হোটেলের বিউটি কনটেস্ট থেকে। তিনজনেই ড্রেসিং টেবিলে একটা করে চিঠি পেয়েছে। তিনজনের চিঠিতেই লেখা আছে–বাপের পকেট থেকে লাখখানেক টাকা খসিয়ে না আনলে, খাঁচায় পোরা হবে সেই রাতেই। রাজি থাকলে জানলায় টর্চের আলো জ্বেলে রাখতে হবে একটানা এক মিনিট রাত ঠিক দুটোর সময়ে।
রূপকথা শোনাচ্ছি, ভাববেন না যেন। খাস কলকাতায় এমন অনেক ঘটনা ঘটে, যা মোহন সিরিজকেও টেক্কা মারতে পারে মশাই। সাঙ্কোপাঞ্জা শুধু রোমাঞ্চের পাতায় কেন, এই শহরেই আকচার ব্যাচেলার কিনা ভগবান জানেন–একা একা ফ্ল্যাটে থাকে–বাপ-মা অন্যবাড়িতে ফুর্তি করে নাগর নাগরী নিয়ে–এ ভাবা যায় না!
এই দেখুন, আবার আলতু-ফালতু বকতে আরম্ভ করেছি। দেখছি, আমার নিজেরই ব্যারাকার্ব খাওয়া উচিত। হোমিওপ্যাথি ওষুধ মশাই, বাঁচালতার দাওয়াই।
যাচ্চলে, আবার সব গুলিয়ে গেল। ও হ্যাঁ…হিমা আর হিমু চালাক মেয়ে। চিঠি পেয়েই টর্চ জ্বালিয়ে সঙ্কেত করেছে জানলায়। হিমি করেনি। ভয়ের চোটে সটান ফোন করেছে আমাকে। তারপর টেলিফোনে খবর দিয়েছে দুই বোনকে। টেলিফোন পেয়েই ওরা দুজনেই ছুটে এসেছে থানায়। এবার শুনুন, আসল কারবারটা!
তার আগে মা লক্ষ্মী, একটু চা-টা হবে? কফি-টফি না হলে গলাটা ইদানীং বড় শুকিয়ে যায়। আসছে? বেশ! বেশ! মা লক্ষ্মী আমাদের সাক্ষাৎ শচী দেবী–মৃগাঙ্কবাবু ভাগ্যবান ব্যক্তি। আমার গিন্নিটি হয়েছে বেয়াড়া টাইপের। কেউ চা চাইলেই এমন মুখখানা করবে, যেন ঘরে চিনি নেই।
গেল যা। আবার অন্য লাইনে চলে এসেছি। সেদিন একটা আমেরিকান নাটক দেখলাম মশাই। আমার হয়েছে ঠিক সেই অবস্থা। এক বুড়ো আর এক বুড়ি। দুজনেরই দ্বিতীয় বিয়ে। দুজনেই খালি খুলে যায়। দুজনেই এক পার্টনারের স্মৃতি, আরেক পার্টনারের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলছে। আমার হয়েছে…।
ধুত্তোর! কী বলছিলাম? ও হ্যাঁ…আসল কারবারটা। আসল কারবারটাই বলা হয়নি এতক্ষণ। হিমি, হিমা আর হিমুর মাটি হলেন আর এক শচী দেবী। এই…এই…এই দ্যাখো মা! কী বলতে কী বলে ফেললাম। ইন্দ্রজায়া শচী দেবীর একটা মস্ত দুর্নাম আছে, জানো তো? যখন যার, তখন তার। পুরোনো ইন্দ্রকে হটিয়ে স্বর্গটা যে দখল করবে, শচী দেবী হাসি হাসি মুখে অমনি তার হেঁসেল ঠেলতে আরম্ভ করে দেবেন। হিমি, হিমা আর হিমুর জননীটি অনেকটা তাই। মানে, সোসাইটি গার্ল। গার্ল এককালে ছিল–এখন পাক্কা লেডি। ফাংশন, মিটিং, পার্টি নিয়েই ব্যস্ত। স্বামীর নাম? এখনও বলিনি? হ্যাঃ হ্যাঃ! এই জন্যেই বোধ হয় ডি-সি পোস্টে প্রোমোশনটা আটকে গেল আমার। ভদ্রমহিলার স্বামী মস্ত কারবারি। কোচিন থেকে নারকেল এনে কলের ঘানিতে পিষে তেল বার করে সাপ্লাই দেন নানা কোম্পানিতে। বি-এম-পি তেলের নাম শোনেননি? খাঁটি নারকেল তেল বলতে আর কিছু নেই এদেশে।
কোটি কোটি টাকার মালিক হওয়ার পর ভদ্রলোকের মতিভ্রম হয়েছে বোধ হয়। বিশেষ করে প্যারালিসিসে কোমর থেকে নীচ পর্যন্ত অবশ হয়ে যাওয়ার পর থেকেই মাথায় নাকি ভূত চেপেছে। অদ্ভুত অদ্ভুত ব্যবসার পরিকল্পনা কাঁদছেন। মানে, শেষ পর্যন্ত কারবারটাকে তুলে দেওয়ার মতলব আর কি।
একটা প্ল্যান শুনবেন? কোচিন আর সিলোন থেকে জাহাজ-ভর্তি নারকেল এনে নাকি পোষাচ্ছে না। ঠিক করেছেন, চাষ করবেন নিজের দেশেই। সুন্দরবনে নারকেল ফলিয়ে দেশের চেহারা পাল্টে দেবেন। হাসবেন না! হাসবেন না। প্ল্যানটা একেবারে অবাস্তব নয়। কিন্তু বেড়ালের গলায় ঘণ্টাটা বাঁধবে কে? পশ্চিম বাংলার দক্ষিণ প্রান্তে বঙ্গোপসাগরের গায়ে যে রিজার্ভ ফরেস্ট আছে, সেখানকার নোনা মাটি আর আবহাওয়া নাকি নারকেল চাষের উপযুক্ত। উনি ঠিক করেছেন সেখানে এক লাখ নারকেল চারা লাগাবেন। মোটামুটি আট থেকে দশ বছরের মধ্যে ফল দেবে এক-একটা নারকেল গাছ। গাছ যতদিন বাঁচবে, ফলও তদ্দিন মিলবে। এক লাখ চারার মধ্যে পঁচাত্তর হাজার চারাও যদি বেঁচে থাকে, মন্দ কি? গাছ পিছু বছরে মাত্র একশো টাকার নারকেল ধরলেও, বছরে পঁচাত্তর লক্ষ টাকা নীট লাভ।
শুধু কি পঁচাত্তর লক্ষ টাকা? নারকেল তেল, নারকেল দড়ি ইত্যাদির জন্যেও কলকারখানা গড়ে তোলা যাবে ওখানে। ফলে, সুন্দরবন অঞ্চলের সম্পদ বৃদ্ধি পাবে। সুন্দরবনে হঠাৎ ক্রাইম বেড়ে যাওয়ায় কর্তাদের গরম মাথা ঠান্ডা হয়ে যাবে। হাতে পয়সা এলে চুরি-ডাকাতির সাধ কার থাকে বলুন?
গভর্নমেন্ট প্রকল্পটি লুফে নিয়েছেন। রিজার্ভ ফরেস্ট থেকে জমিও দিয়েছেন। তাইতেই লেগেছে গৃহবিবাদে। মানে বি-এম-পি অয়েল মিলের মালিক সনাতনপ্রসাদের সঙ্গে তার বিদুষী বিবি অহল্যার।
নামখানা শুনেছেন? অহল্যা। মেয়েদের মুখে শুনলাম, মা নাকি সত্যিই অহল্যা রূপের দিক দিয়ে। বাবা এই রূপ দেখেই টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছিলেন ভদ্রমহিলাকে। মেয়েদের জুলুষ দেখলেই অবশ্য খানিকটা আঁচ করা যায়। কিন্তু মায়ের ছিটেফোঁটাও নাকি ওদের বরাতে জোটেনি।
কী বলছিলাম মা লক্ষ্মী? কর্তা-গিন্নির ঝগড়ার কথা, তাই না? সুন্দরবনে নারকেল চাষ নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই খিটিমিটি লেগেছে, বাপ-মায়ের মধ্যে, বলল এমজ মেয়েরা। সনাতনপ্রসাদ নাকি নিজে তো মরতে বসেছেন, মরার আগে কারবার পর্যন্ত মেরে যাবেন।
যাকগে সেসব ঘরোয়া কেচ্ছা। মেয়ে তিনটের ওপর এই সময়ে নেকনজর পড়ল কোন হারামজাদাদের, জানবার জন্যে শুরু করলাম তদন্ত। সেরকম তদন্ত, কিছু মনে করবেন না ইন্দ্রনাথবাবু, আপনিও পারবেন না। অত ঝক্কি সইবার ক্ষমতা আপনাদের নেই। মৃগাঙ্কবাবু অবিশ্যি রুটিন তদন্ত বলে যথেষ্ট বিদ্রূপ করেন আমাদের পদ্ধতিকে। কিন্তু রুটিন তদন্তে একবার করতে আসুন না। কাছা খুলে যাবে।
তদন্তর ফিরিস্তি দেব না। তবে কি জানেন, তদন্তই সার হল। বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরোর মতো আর কি। মেয়ে তিনটেকে কিছুতেই ফ্ল্যাট থেকে সরানো গেল না। সনাতনপ্রসাদের স্পেশাল রিকোয়েস্টে কনস্টেবল বসিয়ে রাখলাম ফ্ল্যাটের গোড়ায় দিন কয়েকের জন্যে। কিন্তু সাতটা দিনও গেল না।
এবার আসছি আসলের আসল ব্যাপারে। রিয়াল মিস্ট্রি এইখানেই। কান খাড়া করে শুনুন মৃগাঙ্কবাবু। দয়া করে, নেক্সট গল্পে আমাকে একটু ক্রেডিট দেবেন।
সনাতনপ্রসাদের ফ্যাক্টরিতে কিছুদিন আগে বিশ্রী লেবার মুভমেন্ট হয়ে গিয়েছিল। জানেন তো, আজকালকার শ্রমিক-কর্মচারীরা কোম্পানির ভবিষ্যৎ নিয়েও ভাবে। ম্যানেজমেন্টকে যা খুশি তাই করতে দেয় না। ইউনিয়নের সঙ্গে মিটিং করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
সনাতনপ্রসাদ তার ধার ধারেননি। সুন্দরবনে নারকেল চাষ প্রসঙ্গে সরাসরি সরকারের সঙ্গে চুক্তিতে নেমেছেন। ফলে, আতঙ্ক দেখা দিয়েছে কারখানায়। লিডাররাও কিছু একটা না পেলে লেবার তাতাতে পারে না। এই ইস্যু নিয়ে ওরা এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করল কারখানায় যে, সনাতনপ্রসাদের প্রাইভেট কোয়ার্টারের সামনে সি-আর-পি বসাতে হল চৌপর দিনরাত।
আরও খবর পেয়েছি মশাই। অহল্যা দেবী নিজেও নাকি কারখানার লোককে খেপিয়ে তুলেছেন। লিডারদের ডেকে উস্কে দিয়েছেন। উদ্দেশ্য, কাটা দিয়ে কাঁটা তোলা। শ্রমিকদের চাপে যেন স্বামীরত্ন ভড়কে যান এবং নারকেল চাষ শিকেয় তুলে রাখেন। বড় ঘরের বড় ব্যাপার। দেখে দেখে চোখ পচে গেল।
হঠাৎ হিমি-হিমা-হিমুর কেস টেকআপ করার সাতদিন পরে, একটা অদ্ভুত কাণ্ড ঘটল সেদিন রাত্রে একটা বিয়ে বাড়িতে নেমন্তন্ন গিয়েছিলেন অহল্যাদেবী। আত্মীয় বাড়ির নেমন্তন্ন। মাঝরাতে লগ্ন। তাই ঠিক করেছিলেন, ভোররাতে ফিরবেন। রাত নটার সময়ে সেজেগুজে নীচে নেমেছিলেন। কারখানার পাশেই ওদের কোয়ার্টার। সি-আর-পি-দের বলেছিলেন, কর্তা একলা রইল। যেন একটু নজর রাখা হয়। আঙুল তুলে দেখিয়েছিলেন, আলো জ্বলছে তিনতলায়। বলেছিলেন, একটু বরং দাঁড়িয়ে যাই। আলো নিভিয়ে উনি শুয়ে পড়লে যাব। ড্রাইভারও দেখেছে আলো জ্বলছে। তারপর সবার সামনেই আলো নিভে গেল। অর্থাৎ সনাতনপ্রসাদ মাথার কাছে বেডসুইচ টিপে আলো নিভিয়ে দিয়ে ঘুমের আয়োজন করছেন। তিনতলায় আর কেউ থাকে না–অ্যালসেশিয়ান কুকুরটা ছাড়া। সনাতনপ্রসাদ কাউকে বিশ্বাস করেন না রাত্রে–কুকুর ছাড়া।
অহল্যা দেবী তিনতলার দরজায় নিজে চাবি লাগিয়েছিলেন। একটা চাবি ছিল ভেতরে– সনাতনপ্রসাদের বালিশের তলায়। দরজায় ইয়েল লক লাগানো ছিল। একবার চাবি লাগালে নিশ্চিন্ত। বিয়েবাড়ি যাচ্ছেন বলে হ্যান্ডব্যাগ রাখেননি। তাই চাবির গোছা রাখতে দিয়েছিলেন ড্রাইভারকে। বিদূষী বিবি তো–আপটুডেট লেডি। আঁচলে চাবি বাঁধলে ইজ্জত চলে যায়।
পরের দিন সকালবেলা কুকুরের হাঁক-ডাকে চমকে উঠল কারখানার দারোয়ান থেকে আরম্ভ করে সি-আর-পি পর্যন্ত। চাকরবাকররা দোতলা থেকে ছুটে গেল তিনতলায়। সবাই শুনলে, অ্যালসেশিয়ান কুকুরটা ভেতর থেকে দরজা আঁচড়াচ্ছে আর ভীষণ চেঁচাচ্ছে। কোনওদিন কিন্তু এভাবে চেঁচায় না।
আচ্ছা জ্বালা তো! দরজা খোলারও উপায় নেই। চাবি মেমসাহেবের কাছে। ঘরে আলোও জ্বলছে। কিন্তু সাহেব তো কুকুরটাকে ধমক দিচ্ছেন না?
ভোর ছটায় এসে পৌঁছোলেন অহল্যা দেবী। কুকুরে হাঁক-ডাক শুনে আর দরজার সামনে চাকর-বাকরের জটলা দেখে ড্রাইভারের কাছ থেকে চাবি নিয়ে দরজা খুললেন। কুকুরটাকে ডেকে নিয়ে চলে গেলেন করিডরের দিকে। তারপর ফিরে এসে গেলেন বেডরুমে।
চাকরবাকররা ছুটে গেল চিৎকার শুনে। দেখল, সনাতনপ্রসাদ মরে কাঠ হয়ে পড়ে আছেন বিছানায়। চোখ খোলা। মুখের ওপর মাছি উড়ছে।
জানেন তো, মরা হাতির দাম লাখ টাকা। ডাক পড়ল এই ঘাটের মড়া অবনী চাটুয্যের। চুলেচেরা রুটিন তদন্ত করে তো মশাই বিলকুল ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেলাম। ঘর বন্ধ। চাবি ড্রাইভারের কাছে। আর একটা চাবি সনাতনপ্রসাদের বালিশের তলায়। বিয়েবাড়ির সবাই সাক্ষী–অহল্যা দেবী আর ড্রাইভার দুজনেই বাড়ি ছেড়ে নড়েননি। সনাতনপ্রসাদেরও বিছানা ছেড়ে ওঠার ক্ষমতা নেই। বেড সুইচ টিপে না হয় আলো নিভিয়েছিলেন রাত নটায়। কিন্তু আলোটা জ্বালল কে? সারারাত আলো জ্বলেনি–সি-আর-পিরা সাক্ষী। ভোরবেলা বন্ধ ঘরে আলো জ্বালল কে? সনাতনপ্রসাদ? কি যে বলেন। তিনি তো তখন মরে ভূত। ময়নাতদন্তে দেখা গেল, তিনি হার্টফেল করেছেন রাত নটা থেকে দশটার মধ্যে। মানে আলো নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়ার পর ঘুমের মধ্যেই স্থূল শরীর ত্যাগ করেছেন। আলোটা তাহলে জ্বালল কে? ভূত? অ্যালসেশিয়ানের পক্ষেও সম্ভব নয় দাঁতে কামড়ে আলো জ্বালানো। সেক্ষেত্রে সুইচে দাঁতের দাগ থাকত। মনিব মারা গেছে বুঝেই সে দরজা খুলতে চেষ্টা করেছে, চেঁচিয়েছে–সুইচ টিপে আলো নিশ্চয় জ্বালায়নি। কে টিপল বেড সুইচ? তবে কি সি-আর-পি-রা মিথ্যে বলছে? আলো সারারাত জ্বলে ছিল, কিন্তু ব্যাটারা ঘুমোচ্ছিল বলে দেখেনি? এখন মানতে চাইছে না?
একটা স্ট্রোকের ফলেই শুয়ে পড়েছিলেন সনাতনপ্রসাদ। চিন্তাভাবনাও ইদানিং খুব বেড়েছিল। হার্ট আর অত ধকল সইতে পারেনি। ফাইনাল স্ট্রোকেই শেষ হয়ে গেছেন। বিধাতার কি লীলা। এত টাকার মালিক! মৃত্যুকালে মুখে জলটুকুও পেল না। কারও দেখা পেল না। তা না হয় হল, কিন্তু আলোটা জ্বালল কে?
না, না, যা ভাবছেন তা নয়। আলো যে জ্বেলেছে, তার নাম জানতে আমি আসিনি। শোনাতে এসেছি। বুঝলেন না? কে আলো জ্বেলেছে, সবই মোটামুটি আঁচ করে ফেলেছি। না, না, আমাকে বলতে দিন..পুলিশ গোয়েন্দারা ঘাসে মুখ দিয়ে চলে না। আমাদেরও ব্রেন আছে। আমি খবর নিয়ে জেনেছি, কারখানার ওয়ার্কস ম্যানেজারের সঙ্গে অহল্যা দেবীর একটু গুপ্ত প্রণয় ছিল। ভদ্রলোক খুবসুরৎ। বিলেত-ফেরত। ব্যাচেলর। আর কী চাই বলুন? আরও খবর পেয়েছি–পতিদেবতাকে রোজ স্বহস্তে ওষুধ খাওয়াতেন অহল্যা দেবী। এ ব্যাপারে কাউকে বিশ্বাস করতেন না সনাতনপ্রসাদ। শুনবেন আরও? সনাতনপ্রসাদের হার্ট হোঁচট খেয়ে খেয়ে চলছিল বলে একটা ওষুধ দেওয়া হত যার পাঁচ ফোঁটা মানে অমৃত, দশ ফোঁটা মানে বিষ-হার্টের রুগির পক্ষে। দোহাই মৃগাঙ্কবাবু, ওষুধটার নাম জিগ্যেস করবেন না। আপনারা–লেখকরা বড় অবিবেচক হন। যা শুনবেন তাই লিখবেন, তারপর আরও একশোটা খুনের কেস নিয়ে নাকের জলে চোখের জলে হতে হবে আমার মতো অনেক বান্দাকে। একটু বুঝেসুঝে লিখবেন মশাই। জানেন তো, শতং বদ মা লিখ।
আচ্ছা মুশকিল তো, আবার বেরুটে চলে গেলাম। আসল কথাটাই তো এখনো বলিনি। বিয়েবাড়িতে যাওয়ার আগে কর্তা-গিন্নিতে বেশ খানিকটা বচসা হয়েছিল। চাকরবাকররা শুনেছিল। চড়া গলায় ধমক দিয়েছিলেন সনাতনপ্রসাদ। অহল্যাও দু-কথা শুনিয়ে দিয়েছিলেন। তারপরই সেজেগুজে হোল নাইট বাইরে থাকবেন বলে বেরিয়ে গিয়েছিলেন অহল্যা। যাবার আগে সেই বিশেষ ওষুধটা খাইয়ে গিয়েছিলেন কর্তাকে রোজকার মতো রাত নটায়।
এখন কথা হচ্ছে কটো খাইয়েছিলেন? আমি বলব দশ ফোঁটা–মানে সঙ্গে সঙ্গে মারা গিয়েছিলেন সনাতনপ্রসাদ। প্রমাণ এখনও পাইনি; কিন্তু বিষয় মানেই বিষ–বিষয়ের লোভে সবই সম্ভব। আর এখানে তো নাগর জুটেছে। ঘরে পঙ্গু স্বামী কঁহাতক আর সহ্য করা যায়? সুতরাং পতিদেবতাকে তিনিই সরিয়ে দিয়েছেন ধরে নিলাম। কিন্তু আলোটা কীভাবে জ্বলল সেইটাই তো বুঝতে পারছি না।
দাঁড়ান, দাঁড়ান, এখনো শেষ হয়নি। আরও একটা জবর খবর শুনিয়ে দিই। শোনবার পর কিন্তু চোখ দুটো কোটর থেকে ঠেলে বেরিয়ে আসতে পারে মা লক্ষ্মী। সাবধান! সাবধান!
হিমা-হিমি-হিমু, এই মজকে ফ্ল্যাট থেকে লোপাট করার ষড়যন্ত্রটি কে এঁটেছিল জানেন? কল্পনা করুন তো। পারলেন না তো? দুয়ো! দুয়ো! স্বয়ং গর্ভধারিণী মশাই। অহল্যা দেবী নিজে লোক লাগিয়ে মেয়েদের লোপাট করতে চেয়েছিলেন। কেন? কেন আবার–মেয়েরা কোনও গতিকে জেনে ফেলেছিল মায়ের হাতে বাবার জীবন বিপন্ন হলেও হতে পারে। অথচ সেকথা সবাইকে বলা যায় না। তাই ওরা ঠিক করল আমার দোর ধরবে। অহল্যা দেবী চলেন শিরায় শিরায়। মেয়েদের মতলব টের পেয়ে পুলিশের নজর অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেবার জন্যে ইচ্ছে করেই মেয়েদেরকে গায়েব করতে আরম্ভ করলেন। আসলে পুরো ব্যাপারটাই সাজানো। অর্থাৎ সেই রাতে আমাকে স্রেফ বোকা বানিয়ে ছেড়েছেন অহল্যা দেবী তাঁর ভাড়াটে গুন্ডা দিয়ে। মেয়েরাও বিহ্বল হয়ে পড়ল হঠাৎ এই উৎপাতে। বাপের কথা খেয়াল রইল না।
তার সাতদিন পরেই কাজ হাসিল করে ফেললেন অহল্যা দেবী। তিনি জানেন, মেয়েরা বাপকে বাঁচাতে চেয়েছে ঠিকই, কিন্তু মাকে ফাঁসাতে চায়নি। পুলিশের কাছে এলেও তারা মায়ের নাম করত না। বাবা মারা যাওয়ার পর তো আরও বোবা হয়ে যাবে। সনাতনপ্রসাদ মারা যেতেনই–না হয় দুদিন আগেই তার কষ্ট ঘুচিয়ে দেওয়া হল। মাকে ফাঁসিয়ে ঘরোয়া কেলেঙ্কারি ফাঁস করে আর লাভ আছে কী?
বলব কি মশায়, গোটা ফ্যামিলিটাই যেন কেমনতর। সব ছাড়া ছাড়া। অথচ তালে হুঁশিয়ার। মা থেকে মেয়েরা পর্যন্ত কেউ একটি কথাও ফাস করেনি। কিন্তু আমার নাম অবনী চাটুয্যে। ঠেঙিয়ে নকশাল তাড়িয়েছি। কি বললেন? খুব বাহাদুরি করেছি? চাকরি মশাই, চাকরি! চাকরি করতে গেলে নিজের ছেলেকেও ফাটকে পুরতে হয়, নকশাল তো ছার!
এখন বলুন, প্লটটা নিচ্ছিদ্র কিনা। বেশ বুঝতে পারছি, সনাতনপ্রসাদ এমনি এমনি মরেননি। কিন্তু শালা কিছুতেই তা প্রমাণ করতে পারছি না। নিচ্ছিদ্র প্লটে একটা ছিদ্রও আবিষ্কার করতে পারছি না। একি গেরোয় পড়লাম বলুন তো? আলোটা কে জ্বেলেছে, তা তো জানি। কিন্তু জ্বালল কী করে তাইতো বুঝছি না। বেশ বুঝছি, ছিদ্রটা ওইখানেই। ওই ছিদ্রটা আবিষ্কার করতে পারলেই ফাঁসিয়ে দেব অহল্যা দেবীকে।
ম্যারাথন বক্তৃতা থামতেই কবিতা বললে, আপনার কফি জুড়িয়ে গেল। চাইনিজ শ্রিম্প বলগুলো পর্যন্ত ইটের গুলি হয়ে গেল।
আঁ! কখন এল এসব? বলোনি তো? আঁতকে উঠে প্লেটভর্তি চিংড়ি পকৌড়া আক্রমণ করলেন অবনী চাটুয্যে।
বলতে দিলেন কই? যতবার মুখ খুলতে গেলাম, ততবারই তো দাবড়ানি দিয়ে থামিয়ে দিলেন।
মুখভর্তি পকোড়া নিয়ে অঁ-অঁ-অঁ-অঁ করে কি যেন বললেন অবনী চাটুয্যে, বোঝা গেল না।
হাসি চেপে ইন্দ্রনাথ বলল, আস্তে আস্তে খান, বিষম লেগে যাবে। খেয়ে নিয়ে চলুন ঘরটা দেখে আসি।
কোঁৎ করে গিলে নিয়ে বললেন, অবনীবাবু, কার ঘর?
সনাতনপ্রসাদের।
হা পোড়া কপাল! সপ্তকাণ্ড রামায়ণ শুনে সীতা কার বাবা! আরে মশায়, এখনো বুঝলেন রুটিন-তদন্তে আমরা কিছুই বাদ দিই না?
রুটি আর লুচির মধ্যে যা তফাত, আপনার রুটিন-তদন্ত আর আমার লুচিন তদন্তেও সেই তফাত অবনীবাবু।
মানে? মানে? মানে? এত অবিশ্বাস আমার ওপর কেন? বলেই খপাৎ করে আরও দুটো পকৌড়া মুখগহ্বরে ঠেসে দিলেন অবনীবাবু।
দেখবেন শ্বাসনালীতে যেন আটকে না যায়। বলল ইন্দ্রনাথ, আপনি এত সুন্দরভাবে সব কথা বললেন যে, অবিশ্বাস করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। জ্বলন্ত বর্ণনা যাকে বলে–আপনার বর্ণনাও তাই। বায়োস্কোপের ছবির মতো সব চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি বলেই একটা খটমট জায়গা ভেরিফাই করতে চাই।
মুখভর্তি পকৌড়া চিবোনো বন্ধ করে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন অবনীবাবু। ভাবখানা-খটমট জায়গাটা আবার কোথায় দেখলেন মশায়?
ইন্দ্রনাথ বুঝিয়ে দিলে, অহল্যা দেবী বিয়েবাড়ি থেকে এসে দরজা খুলেই কিন্তু বেডরুমে যাননি–যা সবাই যায়। উনি কুকুরটাকে নিয়ে করিডরে গেলেন। কেন?
চোখদুটো আস্তে আস্তে ছানাবড়ার মতো করে ফেললেন অবনীবাবু।
ইন্দ্রনাথ আরও বললে, উনি কি তাহলে জ্ঞানপাপী? উনি কি জানতেন, শোবার ঘরে স্বামীর মৃতদেহ পড়ে রয়েছে? কুকুরের অস্বাভাবিক চেঁচামেচির পর দরজা খুলেই ওঁর উচিত ছিল অসুস্থ স্বামীর কাছে ছুটে যাওয়া। কিন্তু কেন উনি করিডরে গেলেন, আমি গিয়ে দেখতে চাই।
কণ্ঠনালী দিয়ে মস্ত ডেলাটাকে পাকস্থলীতে চালান করে দিয়ে বললেন অবনীবাবু, একটু দাঁড়ান। আর মোট চারটে আছে।
.
ইন্দ্রনাথ আগে থাকতেই শিখিয়ে পড়িয়ে রেখেছিল অবনীবাবুকে।
সনাতনপ্রসাদের ঘরে ঢুকে তাই অবনী চাটুয্যে সোজা চলে গেলেন বেডরুমে। অহল্যা দেবীকে আবোল তাবোল কথায় আটকে রেখে দিলেন সেখানে।
ইন্দ্রনাথ এল করিডরে। ঢুকেই বাঁদিকে। শেষপ্রান্তে একটা কাঠের বাক্স। অ্যালসেশিয়ানের শোবার জায়গা। বাক্সটা তখন খালি। কুকুর বেরিয়েছে চাকরের সঙ্গে হাওয়া খেতে।
ইন্দ্রনাথ আগে থেকেই ভেবে রেখেছিল, কী করতে হবে। তাই হেঁট হয়ে কাঠের বাক্সটা সরিয়ে রাখল পাশে।
বাক্সর তলায় একটা ময়লা লিনোনিয়াম পাতা। লিনোনিয়ামটাও তুলে ফেলল ইন্দ্রনাথ।
তলায় একটা কাঠের পাটাতন। লম্বায় একফুট, চওড়ায় একফুট। দেওয়ালের গা ঘেঁষে কাঠের ঢাকনির গায়ে পেনসিল ঢোকানোর মতো একটা ফুটো।
ছিদ্রপথে কড়ে আঙুল ঢুকিয়ে পাটাতনটা উঠিয়ে ফেলল ইন্দ্রনাথ। মেঝের চৌকোণা গর্তে একটা বাক্স বসানো। ইলেকট্রিক মিটার আর মেন সুইচের জঙ্গল সেখানে। হালফ্যাসানের বাড়ি তো–দেওয়ালের গায়ে কিছু নেই।
পকেট থেকে টর্চ বের করে খুঁটিয়ে দেখল ইন্দ্রনাথ। কাঠের ঢাকনির যেখানে ফুটো, ঠিক তার তলায় কাঠের গায়ে দুটো ছোট ছোট ছিদ্র। যেন স্কু লাগানো ছিল। মেন সুইচের মাথা থেকে দুটো তার বেরিয়েছে। একটা তারে কিন্তু ব্ল্যাকটেপ জড়ানো।
সন্তর্পণে ব্ল্যাক টেপ খুলে ফেলল ইন্দ্রনাথ তার না ছুঁয়েই। তারটা সত্যিই কাটা। দুটো প্রান্ত জুড়ে ব্ল্যাক টেপ দিয়ে মুড়ে রাখা হয়েছে।
বাক্সের তলায় ছোট্ট একটা টুকরো। সোলার ছিপির টুকরো।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল ইন্দ্রনাথ।
ফিরে এল শোবার ঘরে। অহল্যা দেবী গালে হাত দিয়ে নিশ্চুপ হয়ে শুনছেন অবনীবাবুর ফালতু বক্তিমে।
ভদ্রমহিলা নিঃসন্দেহে অপূর্ব সুন্দরী। খুঁত কোথাও নেই। বয়স হয়তো তিরিশ, মনে হচ্ছে আরও কম।
ইন্দ্রনাথকে দেখেই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন অবনীবাবু। চোখের মধ্যে প্রশ্ন ফুটিয়ে জানতে চাইলেন–হল কিছু?
গম্ভীর মুখে পলকহীন চোখে অহল্যা দেবীর পানে চেয়ে বলল ইন্দ্রনাথ, নমস্কার, আমার নাম ইন্দ্রনাথ রুদ্র। প্রাইভেট ডিটেকটিভ। আপনার কাছে শুধু দুটি জিনিস চাইতে এলাম।
প্রতি নমস্কার করলেন অহল্যা, বলুন।
একটা কলিংবেলের টেপা সুইচ। আর একটা ছোট্ট সোলার ছিপি।
নিমেষ মধ্যে নিরক্ত হয়ে গেলেন অহল্যা।
অবনীবাবুর পানে ফিরে বলল ইন্দ্রনাথ, এখন গ্রেপ্তার করতে পারেন। প্রমাণ পাওয়া গেছে।
.
আবার চিংড়ি পকৌড়া। আবার কফি। আবার সরগরম বৈঠক।
ইন্দ্রনাথ বললে, ছিদ্রান্বেষী ছিদ্র খুঁজতে গিয়ে সত্যি সত্যিই ছিদ্র বের করে ফেলল।
সেটা কিন্তু এখনও আমার কাছে পরিষ্কার হয়নি। উৎকট গম্ভীর হয়ে বললাম আমি।
ইহজন্মে হবে না। অবনীবাবু নিচ্ছিদ্র প্লটের ছিদ্রটা তার অজান্তেই শুনিয়ে দিয়েছিলেন। তোরা প্রত্যেকে শুনেছিস। আমিও শুনেছি কিন্তু ওই যে বললাম, যার চিন্তার ডিসিপ্লিন, বুদ্ধির একাগ্রতা আর পর্যবেক্ষণ প্রয়োগশক্তি আছে–সে ছাড়া গোয়েন্দা হওয়া কাউকে সাজে না। তাই নিচ্ছিদ্র প্লটের ছিদ্র আমার মাথায় এসে গেল, তোদের মাথায় এল না।
কবিতা একদম না ঘাঁটিয়ে ভালো মানুষের মতো মুখ করে বলল, হার মানছি ঠাকুরপো। কিন্তু আর সাসপেন্সে রেখো না। প্রেশার উঠে যাচ্ছে।
প্রসন্ন হয়ে ইন্দ্রনাথ বললে, আমি এইখানে বসেই আঁচ করেছিলাম, আলোর তারে এমন কিছু কারচুপি করা হয়েছিল যা অহল্যা দেবীর অনুপস্থিতিতে আপনা থেকেই আলো নেভাবে বা জ্বালাবে। ঘরের মধ্যে প্রাণী ছিলেন দুজন। সনাতনপ্রসাদ আর কুকুর। সনাতনপ্রসাদ চলৎশক্তিহীন এবং আলো যখন জ্বলেছে বা নিভেছে–তখন তিনি মৃত। জীবিত প্রাণী বলতে রইল শুধু কুকুরটা। কুকুরটার সঙ্গে আলো জ্বলা নেভার কোনও সম্পর্ক নেই তো? অহল্যা দরজা খুলে ঢুকেই কুকুরটাকে নিয়ে করিডরে গেছিলেন কেন? করিডরেই কারচুপিটা নেই তো? হতে পারে কুকুরটা না জেনেই পুশ বাটনে চাপ দিয়ে ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়েছে অথবা জ্বালিয়েছে। কিন্তু নিভেছে রাত্রে– কুকুরের শোবার সময়। জ্বলেছে ভোরে কুকুরের ওঠার সময়। তবে কি শোবার জায়গাটাতেই টেপা সুইচটা আছে?
তাই তিনতলায় গিয়ে আমি আগে গেলাম করিডরে। দেখলাম, সত্যিই কুকুরের শোবার বাক্স রয়েছে সেখানে। সুসংবদ্ধ চিন্তা আর শৃঙ্খলাবদ্ধ যুক্তির প্রথমটি যদি সঠিক হয়, পরেরগুলোও সঠিক হতে বাধ্য। তাই বাক্স সরাতেই কী-কী পেলাম তা আগেই বলেছি।
মেন সুইচের একটা তার কেটে, সেই তারে বাড়তি তার জুড়ে এনে লাগানো হয়েছিল একটা টেপা সুইচে। সুইচটা ভ্রু দিয়ে লাগানো হয়েছিল কাঠের ডালার ছোট্ট ফুটোর ঠিক তলায়। সুইচের ভেতরে কনট্যাক্ট প্লেট দুটোকে ইচ্ছে করে বেঁকিয়ে এমন জায়গায় রাখা হয়েছিল, যাতে বাক্সের মধ্যে কুকুর শুলেই ঢাকনি চেপে বসবে সুইচের ওপর। ফলে কনট্যাক্ট কেটে যাবে। মানে আলো নিভে যাবে। কুকুরটা বাক্স থেকে নেমে এলেই ডালাটা সুইচের ওপরে উঠে যাবে–আলো জ্বলে উঠবে। অর্থাৎ পুশ বাটন টিপে ধরলে আলো জ্বলে, ছেড়ে নিলে নেভে। এই সুইচে ঠিক তার উল্টো ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। টিপলে নিভবে, ছাড়লে জ্বলবে।
কিন্তু ছিপিটার ভূমিকা কী? শুধোলাম আমি।
কাঠের ঢাকনিটা সুইচের মাথায় ঠেকছিল না বলেই ফুটো দিয়ে সোলার ছিপি এঁটে দিয়েছিলেন অহল্যা দেবী। ছিপির তলাটাই সুইচের ওপর চেপে বসে আলো নিভিয়েছে কুকুরের শোবার সময়ে। ঘরে ঢুকেই ওই ছিপিটা সরিয়ে নেবেন বলে অহল্যা দেবী আগে করিডরে গিয়েছিলেন। পুশ বাটন সরিয়েছেন পরে ধীরে সুস্থে।
বিমূঢ় কণ্ঠে কবিতা বললে, দরজা বন্ধ করে অহল্যা দেবী নীচে নামার আগেই তো কুকুরটা বাক্সে গিয়ে শুড়ে পড়তে পারত! তাহলে তো আলো নেভার ব্যাপারে সি-আর-পি-দের সাক্ষী রাখা যেত না?
হাল ছেড়ে দিয়ে ইন্দ্রনাথ বললে, জন্মে এমন দেখিনি! আরে বাবা, খানকয়েক বিস্কুট শোবার ঘরে ছড়িয়ে এলেই তো হল! কুকুর বিস্কুট না খেয়ে শুতে আসবে না। ততক্ষণে অহল্যা দেবী নীচে পৌঁছে যাবেন। সি-আর-পি-দের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবেন–ঘরে আলো জ্বলছে। হয়েছেও তাই। সব কবুল করেছেন অহল্যা দেবী।
ত্রমজ মেয়ে তিনটে? বোকার মতো জিগ্যেস করে ফেলেছিলাম আমি।
সঙ্গে সঙ্গে তেড়ে উঠেছিল : মরণ আর কি! সে-খোঁজে তোমার দরকার কী?
* রোমাঞ্চ পত্রিকায় প্রকাশিত।
জিরো জিরো গজানন
ত্রিশূল এর আমন্ত্রণ
জিরো জিরো গজানন পরপর দুটো ট্যাবলেট মুখে ফেলে দিয়ে বললে পুঁতিবালাকে, লাশটা কোথায়?
পুঁতিবালা তখন হাঁফাচ্ছে। অনেকটা পথ ছুটে আসতে হয়েছে খবরটা দিতে। একে তো এই পাহাড়ি রাস্তা। ওঠো আর নামো, ওঠো আর নামো। ধুস! দম বেরিয়ে যায়!
বললে জোরে-জোরে নিঃশ্বাস নেওয়ার ফাঁকে-ফাঁকে–এখন ও রাস্তায়…মানে, বস্তির দিকে যে সিঁড়িটা নেমে গেছে, তার ওপর।
ট্যাবলেট দুটো ততক্ষণে জিভের তলায় মিলিয়ে গেছে। বেশ চাঙ্গা লাগছে গজাননের। আমেরিকান বড়ি। ব্রেনটাকে আঁকুনি মেরে সজাগ করে দেয় চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে।
মোষের শিংয়ের নস্যাধার খুলে এক টিপ নস্যি নিয়ে নাসিকা গহ্বরে সশব্দে চালান করে দিয়ে ভারিক্তি গলায় বললে গজানন, মানে জিরো জিরো গজানন, ওরফে সুপার স্পাই ট্রিপলজি– পুঁতিবালা, যে অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে এসেছি, মনে হচ্ছে, এবার তার ভেতরে প্রবেশ করব। এ সময়ে তোমার এই ভয়ংকর হাঁপানিটা সব বানচাল করে দিতে পারে।
পুঁতিবালা নামটা গেঁইয়া হতে পারে, কিন্তু মেয়েটি খাসা। সুপার মডার্ন গার্ল বললেই চলে। গজানন একে আবিষ্কার করেছিল হিন্দ সিনেমার সামনে থেকে। কলগার্ল পুঁতিবালা ষোড়শী বালিকার মতোই ডাগর চোখে উৎসুক পথচারীদের প্রাণে পুলক জাগিয়ে চলেছিল। গোধূলির লাল আভা গণেশ এভিনিউ বেয়ে তার মুখে পড়েছে। চৌমাথায় ট্রাফিক পুলিশ যথারীতি কথাকলি নৃত্য করে যানবাহন জট রুখে দিচ্ছে। পুঁতিবালাকে সে রোজই দেখে। ছেলেছোকরা থেকে আরম্ভ করে প্রৌঢ়রা পর্যন্ত হেসে-হেসে তার সঙ্গে কথা বলে স্কুটার অথবা গাড়িতে চাপিয়ে হু-উ-উ-স করে উধাও হয়। কনস্টেবল পুঙ্গব তা দেখেও দেখে না। আহা, মেয়েটা রোজগার করছে, করুক।
কিন্তু জিরো জিরো গজাননের চোখের কোয়ালিটিই আলাদা। মেন্টাল হোমে থাকতে থাকতেই তার চোখের আর মনের ধার বেড়েছে। ম্যাচুইরিটি এসেছে। ইনটেলেকচুয়াল ম্যাচুইরিটি।
তারপরেই বেপারিটোলা লেনে ভোলা হাউসের ঠিক পেছনের লাল বাড়িটায় পেয়ে গেল একটা ঘর। আশেপাশে কালোয়ারদের আড্ডা। পুরোনো মাল নীলামে কিনে এনে খুলে রকমারি পার্টস চড়া দামে বেচেই এরাই এখন লাখোপতি কোটিপতি। শুধু নীলামে নয়, চোরাই মালও আসছে এই তল্লাটে। সুতরাং এসপায়োনেজ অ্যাকটিভিটির পক্ষে জায়গাটা উপযুক্ত।
মেন্টাল হোম থেকে বেরোনোর আগেই গজানন ঠিক করেছিল সে স্পাই হবে। নিক কার্টার পড়েছে বিস্তর। জেমস বন্ড তার প্রিয় হিরো। ব্রুস লীর পরম ভক্ত। এই সবগুলো মাথার মধ্যে তালগোল পাকিয়ে যাওয়ার ফলেই যেতে হয়েছিল মেনটাল হোমে। কঁকড়া চুল নেড়ে একদিন লরির ওপর লাফিয়ে উঠে লাথি মেরে উইন্ডস্ক্রিন ভেঙে দিতেই পা কেটে গেছিলজুক্ষেপ করেনি। কিন্তু লরির ভেতর স্মাগলার তিনজন যখন ছুরি হাতে বেরিয়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল গজাননের ওপর–টনক নড়েছিল তখনই।
একটা বাচ্চা মেয়েকে ঠিকরে ফেলে দিয়ে উধাও হওয়ার ফিকিরে ছিল বলেই অসম সাহসিকতাটা দেখিয়ে ফেলেছিল গজানন। নিমেষের মধ্যে আত্মবিস্মৃত হয়েছিল। বেঞ্চিতে বসা ইয়ারবন্ধুদের সঙ্গে গল্প করা মাথায় উঠেছিল। হুঙ্কার ছেড়ে লাফিয়ে উঠেই নক্ষত্রবেগে ধেয়ে গিয়ে ঠিকরে গেছিল লরির ওপর।
তারপরেই প্রচণ্ড লাথি। ঝনঝন করে ভেঙেছে কাঁচ। থেমেছে লরি। পরমুহূর্তেই ভাঙা কাঁচে রক্তরক্তি ড্রাইভারের পাশে বসা তিন মস্তান বেরিয়ে এসে খোলা ছুরি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল গজাননের ওপর।
বেলেঘাটা মেন রোডের ওপর বোমা নিয়ে দু-দলে মারামারি নতুন দৃশ্য নয়। কিন্তু সে দিনের সেই দৃশ্য ছিল একেবারে অন্যরকম। তিন-তিনটে ঝকঝকে ছুরি তিনদিকে ঝলসে উঠতেই গজাননের মাথার মধ্যে কী যেন ঘটে গেল। মনে হল পটাং করে একটা টান করে বাঁধা তার ছিঁড়ে গেল। সেতারের তার ছেঁড়ার মতো আওয়াজটা মাথার মধ্যে মিলিয়ে যেতে না যেতেই গজানন হয়ে গেল আর এক মানুষ।
তিন-তিনটে ছুরিধারী মস্তানকে কীভাবে রুখেছিল গজানন, তা তার কিছু মনে নেই। পটাং করে তার ছিঁড়ে যাওয়ার পর থেকেই কী-কী ঘটেছিল, কিসসু মনে নেই।
রাস্তার লোকে দেখেছিল যেন স্বয়ং জেমস বন্ড, ব্রুস লী আর অমিতাভ বচ্চন একইসঙ্গে মিলেমিশে গেছে গজাননের বিদ্যুৎ গতি ক্ষিপ্রতার মধ্যে। ক্যারাটে, মার, লাথি, ঘুসি চলছে এত দ্রুত পরম্পরায় যে ভালো করে দেখা যাচ্ছে না কী ঘটে চলেছে। সেকেন্ড কয়েকের মধ্যে তিন তিনটে হাত-পা-মাথা ভাঙা জোয়ান ঠিকরে পড়ল বেলেঘাটা মেন রোডের খোলা ড্রেনে পাঁকের মধ্যে।
আর রক্তাক্ত দেহে দাঁড়িয়ে সুন্দরবনের আহত বাঘের মতো সমানে গর্জে চলল গজানন। তিনটে ছুরির একটা তার পেটের চামড়া এদিক থেকে ওদিক পর্যন্ত কেটে দিয়েছে, আর একটা গোটা পিঠটাকে কোণাকুণিভাবে চিরে দিয়েছে, তৃতীয়টায় কেটেছে ডান গাল।
বীভৎস মূর্তি নিয়ে তাই হুঙ্কারের পর হুঙ্কার ছেড়ে চলেছে গজানন। চোখ ঘুরছে বনবন করে। দাঁত খিঁচিয়ে রয়েছে হিংস্র হায়নার মতো।
বন্ধুরাই ওকে জাপটে ধরে এবং দশ-দশটা বন্ধু নাকানিচোবানি খেয়ে যায় তাকে মেনটাল হোমে নিয়ে যেতে। স্ট্রেটজ্যাকেট পরিয়ে সেল-এ রাখতে হয়েছিল কিছুদিন। মাথায় শক দিতে হয়নি– স্রেফ শক থেরাপিতেই কাজ হয়েছিল। মাস কয়েক পরে ডাঃ রাঘব বক্সীর চেম্বার থেকে যখন বেরিয়ে এল, তখন আর গজাননকে চেনা যায় না। বাবরি প্যাটার্নের অসুর মার্কা চুল ওর বরাবরই। কিন্তু শরীর আরও মজবুত হয়েছে। গায়ের রং আগে ছিল ফরসা, এবং লালচে। চোখ-মুখ-নাকের ধার আরও বেড়েছে। সব মিলিয়ে ঝকঝক করছে চেহারাটা।
ডাঃ বক্সী তাকে পিটিয়ে শক্ত করে দিয়েছেন। লোহা থেকে ইস্পাত। আসবার সময়ে চোখে চোখ রেখে কঠোর কাটা কাটা স্বরে শুধু বলেছিলেন, গজানন, আর যাই করো, কুপথে যেও না, তোমার মধ্যে যে সম্পদ আছে, তা দেশের কাজে লাগিও।
তাই স্পাই কোম্পানি খুলে বসেছিল গজানন ওরফে ট্রিপল-জি ওরফে জিরো জিরো গজানন।
উদ্দেশ্য একটাই, দুর্নীতির অবসান। কালোবাজারি হটাও, দেশকে বাঁচাও–এই হচ্ছে জিরো জিরো গজানন কোম্পানির পলিসি।
বেপারিটোলা লেনের অফিস থেকে বেরিয়ে একদিন হিন্দ সিনেমার সামনে ট্যাক্সির জন্যে দাঁড়িয়ে থাকার সময়ে দেখেছিল কলগার্ল পুঁতিবালাকে। দেখেই বুঝেছিল, এমন মেয়েকেই তার দরকার সাগরেদ হিসেবে। ন্যাতাজোবরা মেয়েদের দিয়ে এ লাইনে কিছু হবে না। চাই শার্প, ডেয়ারিং, বডি অ্যাফেয়ার্স নিয়ে সনাতনী ধারণাহীন বলগা ছাড়া মেয়ে। যার তেরচা চাহনি, বুকের ইশারা আর নিতম্বের দুলুনি দেখে পার্টি মজবে, পথ পরিষ্কার হবে দরকার হলে বডিলাভেও পার্টিকে ঘায়েল করবে–মনে কিন্তু দাগ পড়বে না। ইমোশন-টিমোশন নিয়ে এ কারবার চলে না। টিট ফর ট্যাট।
পুঁতিবালাকে অফিসে নিয়ে এসেছিল গজানন। তিনকুলে কেউ নেই শুনে, বউবাজারের হাড়কাটা গলির ডেরা তুলে দিয়ে ঠাই দিয়েছিল অফিস ঘরেরই পাশের ঘরে। পুঁতিবালার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল শার্দুল-চরিত্র ট্রিপল-জি।
ট্রেনিং? বেলেঘাটার রাস্তার ধারে বসে আর পাড়ায়-পাড়ায় মস্তানি করে যে ট্রেনিং পেয়েছে গজানন, তা কম কী? যে-কোনও টেররিস্ট বর্তে যাবে এই জাতীয় কলকাত্তাই ট্রেনিং পেলে। কথায় বলে যা নেই কলকাতায় তা নেই…..
যাক সে কথা। গজানন কোম্পানি দু-বছরেই গাড়ি কিনে ফেলেছে। অফিস চেম্বারটিকেও মডার্ন করে ফেলেছে। এই কলকাতারই বেশ কয়েকটা বড় কোম্পানি তাকে দিয়ে অনেক কালো কারবার ধরে ফেলেছে। লোকসান কমতেই কোম্পানির লাভের অঙ্ক বেড়েছে। গজাননের কোনও নির্দিষ্ট দক্ষিণা নেই। যত লোকসান বাঁচিয়ে দেবে তার ফাইভ পারসেন্ট দিতে হবে।
তাতেই এই অবস্থা। যার জীবনের ভয় নেই, রাতদুপুরেও যে খিদিরপুর ডকে গিয়ে বিদেশি মাল চুরি হচ্ছে দেখে, লুকিয়ে থেকে, বিদেশি জাহাজ থেকে নৌকোয় আউটরাম ঘাটে প্যাকেটে দামি বস্তু হস্তান্তরের সময়ে সাহেব পার্টিকেও খপাত করে চেপে ধরতে দ্বিধা করে না–এমন ডাকাবুকো মূর্তিমান যমকেই তো চায় বড়-বড় কোম্পানিরা।
বর্তমান কাহিনির শুরু বেশ কিছুদিন আগে। এয়ারকন্ডিশনড ঘরে বসে নস্যিও নিচ্ছে, পাইপও খাচ্ছে গ্রেট গজানন। পুঁতিবালা বেরিয়েছে একটা ধুরন্ধর অ-বাঙালি স্মাগলারের পেট থেকে কথা বার করতে। তৈরি হয়েই বেরিয়েছে। হয়তো রাত্রে নাও ফিরতে পারে। বেশ আছে চুড়ি। মজাও লুটছে, কাজও করছে। গজানন অবশ্য এই সময়গুলোয় বেশ উদ্বেগের মধ্যেই থাকে পুঁতিবালার জন্যে। হাজার হোক মেয়েছেলে তো। গজানন ওকে দেখে নিজের বোনের মতো। তাই….
এমন সময়ে বাজল টেলিফোন। লাল টকটকে রিসিভার তুলে নিল গজানন। তারের মধ্যে দিয়ে ভেসে এল সুমিষ্ট নারীকণ্ঠ জিরো জিরো গজানন?
বলছি।
একটু ধরুন।
সেকেন্ড কয়েক পরেই ভারি গলা ভেসে এল তারের মধ্যে দিয়ে।
মিঃ ট্রিপল জি, আমি ত্রিশূল বলছি। একটু থেমে–চিনতে পারছেন?
আন্তর্জাতিক দুর্নীতি প্রতিরোধ সঙ্ঘ?
রাইট, মিঃ ট্রিপল-জি আপনার সাহায্য দরকার।
আমি তো পিঁপড়ে আপনাদের কাছে। টিপে মেরে ফেললেই পারেন।
আরে ছিঃ ছিঃ। উদ্দেশ্য আমাদের একই। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। যাক, টেলিফোন ট্যাপিং হতে পারে।
হয়ে গেল বোধ হয় এতক্ষণে।
পাবলিক টেলিফোন থেকে কথা বলছি ওই কারণেই। আমাদের প্রেজেন্ট অ্যাড্রেস জানেন?
অতবার ঠিকানা পালটালে জানব কী করে?
নোট ডাউন। থ্রি লেটার্স–সিক্স–-টোটাল লাইন। মাইনাস থ্রি। ফাইন্যাল সিক্স। সুপ্রভাত।
লাইন কেটে গেল।
সুপ্রভাত দৈনিকটা সামনেই পড়ে। সুপ্রভাত বলে শুভেচ্ছা জানানো হল না গজাননকে, সেটুকু বোঝবার বুদ্ধি ওর ব্রেনে আছে। কোড মেসেজে বলা হল সুপ্রভাত কাগজটা দেখতে দেখতে হবে সম্পাদকীয় পাতা। এইটাই নিয়ম। সম্পাদকীয় বার করে প্রথম প্যারাগ্রাফের প্রতি ষষ্ঠ শব্দ বেছে নিয়ে কাগজে লিখল গজানন। লেখাটা দাঁড়াল এই :।
দিলদার ভবন। অরুণাভ। পঁয়ত্রিশ।
পাইপ নিভে গেছে। নস্যির ডিবে পেঁচিয়ে খুলতে খুলতে হাতঘড়ি দেখে নিল গজানন। ঠিক পনেরো মিনিটেই পৌঁছে যাবে দিলদার ভবনের পঁয়ত্রিশ নম্বর ফ্ল্যাটে অরুণাভর কাছে।
.
যন্ত্রদানবের সামনে
অরুণাভ লোকটা যে এত কালো আর বেঁটে, এত মোটা আর কদাকার হবে, গজানন ভাবতেই পারেনি।
কালো জুনোয় কালো পালিশ লাগিয়ে বুরুশ দিয়ে ঘষলে যা দাঁড়ায়, শ্রী অরুণাভর মুখের কান্তি সেই রকম। তার ওপর মাথাজোড়া টাক। গদিমোড়া কালো রিভলভিং চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই চেয়ার বেচারি যেন স্বস্তির নিশ্বেস ফেলে পিঠঠাকে একটু সিধে করল। মোটা বটে। কী খায়? এত চর্বি আসে কোত্থেকে?
বলুন গজাননবাবু, কালো মুখে সাদা দাঁত বার করে ভারি অমায়িক হাসি হাসল অরুণাভ। ওই হাসি আর কথাগুলোর মধ্যে দিয়েই প্রকট হল লোকটার ভেতরে সচল রয়েছে বুঝি একটা ডায়নামো। শক্তির ডায়নামো। ঝকঝকে কিন্তু ছোট-ছোট দুই চোখে যেন তারই স্পার্ক।
সতর্ক হল গজানন। বেলেঘাটার রাস্তা থেকে আজ সে উঠেছে যেখানে, এই ত্রিশূল সঙঘ কিন্তু সেখান থেকে অনেক উঁচুতে। পৃথিবী জুড়ে জাল পেতে খপাখপ ধরছে রাঘববোয়ালদের। তার মতো চুনোপুটিকে কী দরকারে তলব পড়ল, ঠিক ভেবে ওঠা যাচ্ছে না। খতম-টতম করে দেবে না তো? সিক্রেট এজেন্টদের পক্ষে সবই সম্ভব। এই লাইনে প্রতিদ্বন্দ্বী কেউ রাখতে চায় না।
বসল গজানন। একটু ঝুঁকেই বসল। যাতে বাঁ-দিকের কোমরে হোলস্টারটা টেবিলে ঠেকে যায়। বুশ শার্টের তলায় থেকেও খাপে গোঁজা নাইন এম এম লুগারটা অনেকটা ধাতস্থ করে তোলে ট্রিপল জিকে। শক্তির আধার তারও হাতের কাছে। এক থেকে তিন গুনতে যেটুকু সময় লাগে, তার মধ্যেই লুগার চলে আসবে হাতে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেবে চক্ষের নিমেষে।
চোখে-চোখে চেয়ে মিটিমিটি হাসছিল অরুণাভ। যেন গজাননের মনের কথা টের পেয়েছিল। ড্রয়ার টেনে একটা চকচকে উইলহেলমিনা বার করে রাখল সাড়ে পাঁচ মিলিমিটার পুরু কাঁচ দিয়ে ঢাকা টেবিলের ওপর।
বলল, আপনারটাও এখানে রাখতে পারেন।
বিনা বাক্যব্যয়ে নাইন এম এম লুগার বের করে উইলহেলমিনা-র পাশে রেখেছিল গজানন। দুটো আগ্নেয়াস্ত্রই প্রায় একই রকম দেখতে। দুটোই প্রাণ-প্রদীপ নিভিয়ে দিতে মোক্ষম।
এবার কাজের কথায় আসা যাক, বলেছিল অরুণাভ আপনি রিসেন্ট সুইসাইড কেসগুলো নিয়ে ভেবেছেন?
কাজের লোক বটে এই অরুণাভ। এক্কেবারে আসল পয়েন্টে চলে এসেছে। মাস দুয়েকের মধ্যে তিনটে সুইসাইডের রহস্য গজাননের মগজেও আলোড়ন তুলেছে। এদের মধ্যে একজন ছিল তারই পার্টি। হরেন জোয়ারদার। কোটিপতি। উলটোডাঙায় গেঞ্জির কল আছে। মিজোরামে নিজের জমিতে ঔষধি গাছের চাষবাসও করত। মিজোরামের হার্বস এক্সপোর্ট করে যখন কোটিপতি, ঠিক তখন ভদ্রলোক দ্বারস্থ হয়েছিল গজাননের। কারা যেন তাকে সমানে হুমকি দিয়ে চলেছে টেলিফোনে আর চিঠিতে। ওখানে অত টাকা রাখো, এখানে এত টাকা রাখোনইলে বোমা মেরে দেব খুলি উড়িয়ে।
গজানন নেমে পড়েছিল মাঠে। নেমে, কাজটা টেক-আপ করেই ধড়াধড় এগিয়ে গেছিল বেশ খানিকটা। হাতেনাতে ধরেও ফেলেছিল হুমকি দেনেওলাকে। হ্যাঁ, একজনই। জোয়ারদারের গেঞ্জির কলের ইউনিয়ন লিডার।
সে কেস মেটবার মাসখানেক পরেই একটা টেলিফোন এল গজাননের কাছে। ফোন করছে জোয়ারদার স্বয়ং।
গজাননবাবু? ভারী বিমর্ষ স্বর–এসব কী হচ্ছে?
কী হচ্ছে মানে? ঘাবড়ে গেছিল গজানন। অন্যায়-টন্যায় করে ফেলল না কি? ডাঃ বক্সীর কাটা-কাটা কথা এখনও কানে লেগে রয়েছে–অন্যায় পথে যেও না। জ্ঞাতসারে তো যায়নি গজানন। তবে?
জোয়ারদারের বিষণ্ণ কণ্ঠস্বর হঠাৎ বিষম উত্তেজিত হয়ে ওঠে–ওই…ওই শুনুন আবার ওরা শাসাচ্ছে …।
কারা? কারা? কারা? চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে ওঠে গজানন–কোন শয়তানের বাচ্চারা?
ওই তো–ওই তো দলে-দলে দরজা দিয়ে ঢুকছে আর জানলা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। আমাকে ডাকছে, গজাননবাবু, আমাকে ডাকছে, বলছে–শান্তি, শান্তি, এই পথেই শান্তি উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তার শান্তি এইখানে, এই জানলার বাইরে। গজাননবাবু, ও গজাননবাবু বেরিয়ে যাব জানলা দিয়ে?
না, না, না, এমন জোরে সেদিন গজানন চেঁচিয়েছিল যে তিনদিন ভোকাল কর্ড ভালো কাজ দেয়নি–ভাঙা গলায় কথা বলতে হয়েছে–চোদ্দোতলার জানলা দিয়ে বেরিয়ে যাবেন কী? আপনার মাথা কি খারাপ হয়েছে?
আমার মাথা খারাপ? হাঃ হাঃ হাঃ! হাঃ হাঃ হাঃ! হাঃ হাঃ হাঃ! আমার মাথা খারাপ বলার আগে গজাননবাবু আপনার মাথাটা মনের ডাক্তার দিয়ে দেখিয়ে নিন। ওই ওই ওই কটমট করে আবার তাকাচ্ছে, শাসাচ্ছে–বলছে, চলে আয় চলে আয় চলে আয়–ওরে আয়, ওরে আয়, ওরে আয়! যাই গজাননবাবু, এত করে ডাকছে।
দড়াম করে টেলিফোন আছড়ে পড়ার শব্দ ভেসে এসেছিল। মনশ্চক্ষে গজানন দেখতে পেয়েছিল, টেলিফোন ক্রেডল-এ রিসিভার বসানো হয়নি। ঝুলছে। তাই শোনা যাচ্ছে জোয়ারদারের জোরাল গলায় অট্টহাসি দূর হতে দূরে সরে যাচ্ছে। তারপরেই–নৈঃশব্দ্য!
মনের চোখে বাকি দৃশ্যটুকুও কল্পনা করে শিউরে উঠেছিল গজানন। ধাঁই করে রিসিভার নামিয়ে রেখে ধড়মড় করে বেরিয়ে এসেছিল বাইরে। উল্কাবেগে বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের চোদ্দোতলা বাড়িটার সামনে পৌঁছেই দেখেছিল কাতারে কাতারে লোক জমে রয়েছে রাস্তা পর্যন্ত।
জোয়ারদার তার কথা রেখেছিল। এই বহুতল অট্টালিকার কোনও ঘরেই জানলায় গরাদ নেই। জানলায় বাইরে তাই পাটাতন পেতে ফুলের টব রাখা হয়। এই রকমই জানলা গলে হাসতে হাসতে শূন্যে লাফ দিয়ে–আছড়ে পড়েছে একতলায়।
থ হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েছিল গজানন। আচমকা শক খেয়েই স্থাণু হয়ে গেছিল। মস্তিষ্ক একদম কাজ করেনি।
তারপরেই বিদ্যুৎ খেলে গেছিল কোষে-কোষে। জোয়ারদারকে কি ভূতে পেয়েছিল? নাকি পাগল হয়ে গেছিল? মনের ডাক্তারকে দিয়ে গজাননের মাথাটা দেখাতে বলছিল। ভদ্রলোকের জানা ছিল না, ও কাজটি সেরেই এ লাইনে এসেছে গজানন। তাহলে, তাহলে
দি আইডিয়া। মনের ডাক্তারের কাছেই ছোটা যাক।
বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড থেকে বাঁই-বাই করে গাড়ি চালিয়ে একেবারে ইন্দ্র দত্ত রোড এক কোণে ডাঃ বক্সীর কেয়ার ক্লিনিক। লোহার গেটের ভেতরে চাবি হাতে বসেছিল নেপালি দারোয়ান। গজাননকে দেখেই একগাল হেসে উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিল?
–কী খবর?
ডাক্তারবাবু–ডাক্তারবাবু আছেন?
গজাননের মুখের চেহারা আর কথার ধরন দেখে হাসি মিলিয়ে গেছিল দারোয়ানের মুখ থেকে। কেস গড়বড় মনে হচ্ছে? অনেকেই এরকম ফিরে আসে বটে। কিন্তু এভাবে নিজে থেকে–
তাড়াতাড়ি তালা খুলে গজাননকে ভেতরে ঢুকিয়ে নিয়েছিল দারোয়ান।
–বসুন, খবর দিই।
একটু পরেই ডাক এসেছিল ওপর থেকে। বাইরের ঘরে গদিমোড়া চেয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে পাইপ টানছিলেন দীর্ঘদেহী অতীব সুপুরষ ডাঃ বক্সী। ফরসা দুই চোখে যেন ঈগলের চাহনি।
কী ব্যাপার, গজানন?
ব্যাপার কী তা ব্যক্ত করেছিল গজানন। শুনেটুনে হা-হা করে হেসে ডাঃ বক্সী বলেছিলেন– না, না ভূত নয়, প্রেত নয়, দত্যি নয়, দানো নয়, পিশাচ নয়–কিসসু নয়। গজানন, ব্যাপারটা তোমার বোঝা উচিত ছিল।
কী, স্যার?
অডিটরি হ্যাঁলিউসিনেশন। অপটিক্যাল হ্যাঁলিউসেনশন। কর্ণ বিভ্রম আর দৃষ্টি বিভ্রম। এরকম কেস তো এখানেই ছিল–তুমি যখন ছিলে। এখনও আছে। মনে হয় যেন দেবব্রত বিশ্বাসের রবীন্দ্রসঙ্গীত অবিরাম শুনে যাচ্ছে। অথবা চোখের সামনে সায়রা বানুকে দেখতে পাচ্ছে। ইডিয়ট!
অরুণাভ চেয়েছিল গজাননের দিকে। দুই চোখে সেই স্পার্ক। এখন বললে–বুঝতে পারছেন কেন আপনাকে ডাকা হয়েছে? আপনারই একজন ক্লায়েন্ট পাগল হয়ে গিয়ে আত্মহত্যা করেছে। ঠিক একইভাবে পাগল হয়ে গিয়ে একজন চলন্ত লরির সামনে লাফিয়ে পড়েছে হাসতে-হাসতে।
আর একজন হাওড়ার পোল থেকে। গজাননবাবু, এই দুজনেই ছিল আমাদের ক্লায়েন্ট।
অ্যাঁ।
আজ্ঞে হ্যাঁ। কুচক্রীদের হাত থেকে বাঁচতে এই তিনজনেই শরণ নিয়েছিল আমাদের। এই ঘটনা পরপর ঘটে যেতে থাকলে কেউ আর আমাদের কাছে আসবে না। কুচক্রীদের কারবার ফলাও চলবে। আপনি কি তাই চান?
কক্ষনও না।
তাহলে শুনুন এখনও যা জানেন না। জোয়ারদার আপনার মক্কেল ছিল–কারেক্ট?
সব খবরই তো রাখেন।
একটু বেশিই রাখি। জোয়ারদার কিছুদিন নিউইয়র্কে ছিল জানেন?
জানি। বেড়াতে গেছিল।
আজ্ঞে না। কারবার করতে গেছিল। কুল ড্রিঙ্কস-এর নাম শুনেছেন?
নিশ্চয়।
দীর্ঘ কুড়ি বছর পরে পৃথিবী বিখ্যাত এই কোম্পানি আবার ইন্ডিয়ায় ব্যবসা করার জন্যে লাইসেন্স চেয়েছে। এখন ইন্ডিয়ায় সফট ড্রিঙ্কস এর যা টোটাল মার্কেটতার সবটুকু মিটোনোর মতো প্ল্যান্ট ক্যাপাসিটি চেয়ে দরখাস্ত করেছে। অথচ ইন্ডিয়ায় এই টোটাল মার্কেটটা ধরে রেখেছে। তিনটে কোম্পানি। তাদের নাম বলার দরকার আছে কি?
না। বলে যান।
বলে গেল অরুণাভ, এই তিনটে কোম্পানির তিন ম্যানেজিং ডিরেক্টর অ্যাপ্রোচ করেছে গভর্নমেন্টকে, লাইসেন্স যেন ইস্যু করা না হয়। পেল্লায় আমেরিকান কোম্পানির দাপটে ধুলোয় মিশে যাবে তিন-তিনটে ইন্ডিয়ান কোম্পানি। ক্লিয়ার?
ও ইয়েস, তারপর? নস্যি নিল গজানন।
নস্যির ডিবের দিকে তৃষ্ণার্ত চোখে চেয়ে অরুণাভ বললে, আমাকেও দিন।
খুশি হল গজানন। নস্যি কালচার সিক্রেট এজেন্ট মহলেও তাহলে ঢুকে পড়েছে! গুড! বাড়িয়ে দিল ডিবেটা-তারপর?
তারপর-এর কথাটা নস্যি নেওয়ার পরে বলল অরুণাভ। এই তিন জনের দুজন সুইসাইড করেছে। কাগজে ছবিও বেরিয়েছে।
কিন্তু জোয়ারদার তো এসবের মধ্যে ছিল না।
মশায় গজানন, আই মীন, মাই ডিয়ার গজাননবাবু, হার্বস বেচতে জোয়ারদার নিউইয়র্কে গেছিল ঠিকই, কিন্তু তাকে মোটা রকমের শেয়ার অফার করা হয়েছিল কুল ড্রিঙ্কস-এর তরফ থেকে যাতে ইন্ডিয়ায় জবর ঘাঁটি গড়ে তোলা যায়। জোয়ারদারের আসল জোর কোথায় ছিল জানেন তো?
সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টে।
রাইট। জোয়ারদার অফার অ্যাকসেপ্ট করেনি। তিন-তিনটে ইন্ডিয়ান কোম্পানির সর্বনাশ করতে চায়নি, এই তার অপরাধ।
কিন্তু জোয়ারদার তো পাগল হয়ে গেছিল।
বেঁটে মোটা কালো শরীরখানা দুলিয়ে-দুলিয়ে কিছুক্ষণ ধরে অট্টহাসি হাসল অরুণাভ। হাসির মধ্যেও যেন ব্যাটারির চার্জ।
বললে, ইন্ডিয়ায় পয়লা সারির বিজনেস ম্যাগনেটগুলো হঠাৎ পাগল হয়ে গিয়ে আত্মহত্যা করছে, মনে একটুও ধন্দ লাগছে না?
তা ইয়ে…খটকা একটু লাগছে বইকী।
সফট ড