- বইয়ের নামঃ যে তুমি হরণ করো
- লেখকের নামঃ আবুল হাসান
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
যে তুমি হরণ করো (কাব্যগ্রন্থ)
কালো কৃষকের গান
দুঃখের এক ইঞ্চি জমিও আমি অনাবাদী রাখবো না আর আমার ভেতর!
সেখানে বুনবো আমি তিন সারি শুভ্র হাসি, ধৃতিপঞ্চইন্দ্রিয়ের
সাক্ষাৎ আনন্দময়ী একগুচ্ছ নারী তারা কুয়াশার মতো ফের একপলক
তাকাবে এবং বোলবে, তুমি না হোমার? অন্ধ কবি ছিলে? তবে কেন হলে
চক্ষুষ্মান এমন কৃষক আজ? বলি কী সংবাদ হে মর্মাহত রাজা?
এখানে আঁধার পাওয়া যায়? এখানে কি শিশু নারী কোলাহল আছে?
রূপশালী ধানের ধারণা আছে। এখানে কি মানুষেরা সমিতিতে মালা
পেয়ে খুশী?
গ্রীসের নারীরা খুব সুন্দরের সর্বনাশ ছিল। তারা কত যে উল্লুক!
উরুভুরুশরীর দেখিয়ে এক অস্থির কুমারী কত সুপুরুষ যোদ্ধাকে
তো খেলো!
আমার বুকের কাছে তাদেরও দুঃখ আছে, পূর্বজন্ম পরাজয় আছে
কিন্তু কবি তোমার কিসের দুঃখ? কিসের এ হিরন্ময় কৃষকতা আছে?
মাটির ভিতরে তুমি সুগোপন একটি স্বদেশ রেখে কেন কাঁদো
বৃক্ষ রেখে কেন কাঁদো? বীজ রেখে কেন কাঁদো? কেন তুমি কাঁদো?
নাকি এক অদেখা শিকড় যার শিকড়ত্ব নেই তাকে দেখে তুমি ভীত আজ?
ভীত আজ তোমার মানুষ বৃক্ষশিশু প্রেম নারী আর নগরের নাগরিক ভূমা?
বুঝি তাই দুঃখের এক ইঞ্চি জমিও তুমি অনাবাদী রাখবে না আর
এসিইথয়েটার থেকে ফিরে এসে উষ্ণ চাষে হারাবে নিজেকে, বলবে
ও জল, ও বৃক্ষ, ও রক্তপাত, রাজনীতি ও নিভৃতি, হরিৎ নিভৃতি
পুনর্বার আমাকে হোমার করো, সুনীতিমূলক এক থরোথরো দুঃখের
জমিন আমি চাষ করি এ দেশের অকর্ষিত অমা!
*
উদিত দুঃখের দেশ
উদিত দুঃখের দেশ, হে কবিতা হে দুধভাত তুমি ফিরে এসো!
মানুষের লোকালয়ে ললিতলোভনকান্তি কবিদের মতো।
তুমি বেঁচে থাকো
তুমি ফের ঘুরে ঘুরে ডাকো সুসময়!
রমণীর বুকের স্তনে আজ শিশুদের দুধ নেই প্রেমিক পুরুষ তাই
দুধ আনতে গেছে দূর বনে!
শিমুল ফুলের কাছে শিশির আনতে গেছে সমস্ত সকাল!
সূর্যের ভিতরে আজ সকালের আলো নেই সব্যসাচীর তাই
চলে গেছে, এখন আকাল
কাঠুরের মতো শুধু কাঠ কাটে ফল পাড়ে আর শুধু খায়!
উদিত দুঃখের দেশ তাই বলে হে কবিতা, দুধভাত তুমি ফিরে এসো,
সূর্য হোক শিশিরের ভোর, মাতৃস্তন হোক লির শহর!
পিতৃপুরুষের কাছে আমাদের ঋণ আমরা শোধ করে যেতে চাই!
এইভাবে নতজানু হতে চাই ফলভারানত বৃক্ষে শস্যের শোভার দিনভর
তোমার ভিতর ফের বালকের মতো ঢের অতীতের হাওয়া
খেয়ে বাড়ি ফিরে যেতে চাই!
হে কবিতা তুমি কি দ্যাখোনি আমাদের ঘরে ঘরে তাঁতকল?
সাইকেলে পথিক?
সবুজ দীঘির ঘন শিহরণ? হলুদ শটির বন? রমণীর রোদে
দেয়া শাড়ি? তুমি কি দ্যাখোনি আমাদের
আত্মহুতি দানের যোগ্য কাল! তুমি কি পাওনি টের
আমাদের ক্ষয়ে যাওয়া চোখের কোণায় তুমি কি বোঝে নি আমাদের
হারানোর, সব হারানোর দুঃখ- শোক? তুমি কি শোনোনি ভালোবাসা
আজও দুঃখ পেয়ে বলে, ভালো আছো হে দূরাশা, হে নীল আশা?
*
ক্ষমাপ্রদর্শন
তুমি কি সত্যি ক্ষমার মানুষ? করছি ক্ষমা পরিত্রাণের
গন্ধ ভরা জল ছিটিয়ে তুলছি ঘরে, কৃতজ্ঞতা
তোমায় আমি বদলে দিয়ে কৃতজ্ঞতা তুলছি ঘরে
আকাল পোশাক বদলে দিয়ে রাখালে পোশাক তুলছি ঘরে!
তুমি কি সত্যি ক্ষমার মানুষ? করছি ক্ষমা পরিত্রাণের
একজনমে এত ক্ষমা তুমি কি তাই পাওয়ার যোগ্য হে মন আমার
করছি ক্ষমা করছি ক্ষমা;
এখন তুমি সংসারে যাও, তোমার শিশু সমস্যাদি
সংগঠন আর ন্দ্রিা এবং লবণ মাংস মহোৎসবের
রৌদ্রমেঘের পাশে দাঁড়াও, কৃতজ্ঞতা এখন তুমি
কৃতজ্ঞ হও কৃতজ্ঞ হও!
একজনমে পাপ করেছে, পাপের ছায়া পরিত্রাণের গন্ধ হলো একজনমে
খিড়কী দুয়ার এখন তোমার খিড়কী দুয়ার, ঝাপসা স্মৃতি রহস্য তার
জালা থেকে জানলা দেখায় অতীত থেকে অতীত দেখা।
একটু একটু তাঁদের ছায়ায় বেড়ে ওঠো এখন তুমি একটু একটু
তাদের বুকে তাদের চোখে তাদের ছায়ায় বেড়ে ওঠো,
হে মন তুমি অধঃপতন
থেকে এবার বেড়ে ওঠো!
*
অপেক্ষায় থেকো
আমরা আসবো ঠিকই আসবো, অপেক্ষায় থেকো!
নপুংশক ঘাতক বাউল সন্তু যাইই হই, বিবর্ণ বুলবুল
আমরা যাইই হই
আমরা আসবো ঠিকই ফিরে আসবো, অপেক্ষায় থেকো!
শিকড়ে শুকনো ঘাস, যুথীফুল একটি কি দুটি
ঘূর্ণিত পাখির চিহ্ন, কুমারীর কেঁপে ওঠা করাঙ্গুল একটি কি দুটি
আমরা যাইই হই
আমরা আসবো ঠিকই ফিরে আসবো, অপেক্ষায় থেকো!
উৎসবের মধ্যে আমরা যাইই হই পিষ্ট মোমবাতি!
শাদা জ্বলন্ত লোবাণ আমরা যাইই হই
আমরা আসবো ঠিকই ফিরে আসবো, অপেক্ষায় থেকো।
নৃত্য শেষে নর্তকীর নিহত মুদ্রায় শান্ত স্তব্ধ আঙ্গুল
যেই ভাবে ফিরে আসে,
অন্দ্রিায় চোখের পাতার শান্ত সমুদ্র বাতাস যেই ভাবে ফিরে আসে
সমুদ্রচারীর নিশ্বাসে!
আমরা আসবো ঠিকই ফিরে আসবো, অপেক্ষায় থেকো!
*
ভ্রমণ যাত্রা
এইভাবে ভ্রমণে যাওয়া ঠিক হয়নি, আমি ভুল করেছিলাম!
করাতকলের কাছে কাঠচেরাইয়ের শব্দে জেগেছিল সম্ভোগের পিপাসা!
ইস্টিশানে গাড়ীর বদলে ফরেস্ট সাহেবের বনবালাকে দেখে
বাড়িয়েছিলাম বুকের বনভূমি!
আমি কাঠ কাটতে গিয়ে কেটে ফেলেছিলাম আমার জন্মের আঙ্গুল!
ঝর্ণার জলের কাছে গিয়ে মনে পড়েছিল শহরে পানির কষ্ট!
স্রোতস্বিনী শব্দটি এত চঞ্চল কেন গবেষণায় মেতেছিলাম সারাদিন
ক্ষুধাতৃষ্ণা ভুলে!
আমি উপজাতি কুমারীর করুণ নশ্বর নম্র স্তনের অপার আঘ্রাণে
প্রাচীন অনাধুনিক হয়ে গিয়েছিলাম শিশুর মতো!
আমি ভুলে গিয়েছিলাম পৃথিবীতে তিন চতুর্থাংশ লোক এখনো
ক্ষুধার্ত!